ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার

চার

ছয় দফাকেন্দ্রিক নির্যাতন চলতেই থাকে : বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করে বস্তুত পুরো পাকিস্তানের রাজনীতির ছক পাল্টে দিলেন। এর আগে পাকিস্তানের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পেছনে ভাষা আন্দোলন একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এর পাশাপাশি বঞ্চিত অবহেলিত পূর্ববাংলার বিষয়গুলোও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাতচল্লিশ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন যখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে যায় তখন মহাশক্তিধর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাজনীতি করার তেমন জোরালো কোন ইস্যু বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই ছিল না। তার চাইতেও বড় কথা ছিল যে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাড়া বাকি রাজনীতিকরা ছিলেন দ্বিধান্বিত। পাকিস্তানভিত্তিক মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে একদল রাজনীতিক প্রগতিশীলতা বা বাম রাজনীতির কথা বললেও তাদের কোন স্থিরতা ছিল না। কোন কোন রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠীর দালালিতেও লিপ্ত হয়। অন্যদিকে আইয়ুব খান মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়া গ্রহণ করেন। সেজন্য পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে সবার ওপরে রাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ফলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটক রাখা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। ’৬৬ সালের মে মাসে তাকে গ্রেফতার করার আগে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

ঢাকার ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে প্রস্তুতকৃত পত্রে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অভিযোগ আনা হয়-

... is reported to have acted and likely to act is a manner prejudicial to the public safety and the maintenance of public order, the maintenance of peaceful conditions is the country, the maintenance of essential supplies and services… Now, therefore, in exercise of the power conferred by clause (b) of sub rule (I) in rule 32 of the defense of Pakistan rules, 1965.. the Government of East Pakistan notification No. 115-Pol. (II), dated 13-9-65. অনুযায়ী

that the said Mr. Sk. Mujibur Rahman, Shall be detained for a period of three months from the date of service of this order,

… the said person shall be deterred in the Dacca Central Jail. (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থার নথি, F/N 606-48 PF-Part-25) তাকে তিন মাসের আটকাদেশ প্রদান করে ৯ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। ৯ মে গ্রেফতারকৃত অপর নেতাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এমএ আজিজ (চট্টগ্রাম) জহুর আহমদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম), মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) এমএস হক এবং আবদুর রহমান সিদ্দিকী।

ডিএসপিএলআর ৯-৫-৬৬ তারিখের চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের u/r 47(5) DPR/65 & 7(3) EPPSO/58 পাবনায় ৮-৫-৬৬ (পাবনা PS মামলা নং 5 তারিখ 8-5-66-u/r47(5) DPR/65 7(3) EPPSO/58 শুরু করা হয়েছে। ৭-৪-৬৬ তারিখে পাবনায় অনুষ্ঠিত জনসভায় আইন বিরোধী বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে। নতুন নতুন অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার ছয় দফার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অনবরত নাজেহাল করার চেষ্টা করতেই থাকে।

পাকিস্তান সরকার ধারণা করেছিল এর ফলে ছয় দফার আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া আরো বিস্তৃত হয়ে পূর্ববাংলাব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি নুরুল আমিন, শাহ আজিজ, নেজামে ইসলাম নেতা ফরিদ আহমেদও এভাবে দমন নির্যাতন হয়রানি ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করেন। মানিক মিয়া তার জনপ্রিয় রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে এ ধরনের গ্রেপ্তারের তীব্র বিরোধিতা করে ১০ মে সাহসী লেখা লিখেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১০-৫-১৯৬৬) প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩ মে তারিখে ধর্মঘট পালিত হয় এবং বিকেলে পল্টন ময়দানে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে ধানমন্ডির (৫৪৩) জি রোড নং ১৩) বাসিন্দা রেজাউল মালিক পিতা আবদুল মালেক খান, ২৯ বছর বয়সের একজন ব্যবসায়ী ১২-৫-১৯৬৬ তারিখ, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ মোর্শেদ বরাবরে একটি আর্জি পেশ করেন। বিচারপতি বিএ সিদ্দিকি, সৈয়দ এবি মাহমুদ হোসেন ১৩ মে তারিখে সরকার পক্ষে স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিসি, ঢাকা এবং ডিআইজি (প্রিজন) এবং ঢাকা জেল সুপারকে এবং আবেদনকারীর পক্ষে এ সালাম খান, মির্জা গোলাম হাফিজ, এমএ রব হুমায়ুন কবীর চৌধুরী এবং আমিনুল হককে নিম্নোক্ত আদেশ জারি করেন।

let a rule nisi be issued calling upon the respondents to show cause why sk. Mujibur Rahman, who is alleged to be illegally and improperly detained in Dacca Central Jail, should not be produced before this court and be dealt with in accordance with the law,… (F/N 606-48 PF-Part-25)

সরকারের ওপর কারণ দর্শানোর এ নির্দেশ জারিকে অনেকেই দেশের বিচার-বিভাগের এক বলিষ্ঠ এবং নজিরবিহীন সাহসী ভূমিকা বলে অভিহিত করেছেন। প্রকাশ থাকে যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ভাগ্নে এবং ন্যায়নীতির প্রতি এক অবিচল পুরুষ। জেলের অভ্যন্তরে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতারা জেল কর্তৃপক্ষকে ১১-৫-৬৬ তারিখে এ বলে হুমকি দেন যে, যদি তাদের একসঙ্গে থাকতে দেয়া না হয় তাহলে তারা ‘অনশন ধর্মঘট’ শুরু করবেন। (গোয়েন্দা সংস্থার নথি থেকে Extract from Daily Report No. 125 dat-11-5-66 from SBEPDB.No.8258/12-5-66.F/N 606-48 PF-Part-25) জেল কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলখানার মধ্যেও একত্রে থাকতে বা চলাফেরা করাকে সুনজরে দেখেননি, আইবি হুকুম দিয়েই চলেছে জেলে আওয়ামী লীগারদের আলাদা আলাদা রাখতে হবে। তাদের কষ্ট দিতে হবে। তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে হবে। সেজন্যই শেখ মুজিবসহ নেতাদের অনশন করার হুমকি। এরপর তাদের একত্রে থাকতে দেয়া হয়েছিল কিনা-তা কোন সূত্র থেকেই উদ্ধার করা যায়নি। পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে বন্দী করে রেখেও স্বস্তিতে ছিল না। বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি নানা অজুহাতে নিপীড়ন চালাতে থাকে সরকার। জেলের আইন ভঙ্গ করে তাকে একা রাখা হতো যাতে কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ না পান। অন্যান্য রাজবন্দীরা বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে যেতে পারলেও সরকারের হুকুমে বঙ্গবন্ধুকে কারও কাছে দেয়া হতো না।

তাকে নিয়ে বরাবরই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল সরকার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ তাদের ২১-৫-৬৬ তারিখের ৪৫২/ কন সংখ্যক স্মারকে ২৪-৫-৬৬ তারিখে শেখ মুজিবের মামলার হাজিরার অনুমতি প্রসঙ্গে লিখেছিল-

…As courts order shall have to be complied with, it is for consideration whether it would be advisable to send Mr Sheikh Mujibur Rahman to mymensingh now. if not, we may request D/C, mymensingh to instruct P.P to move court for fixing a later date for the Prisoner.

এর উত্তরে ঢাকায় ডিআইবি/এসবি. ২৩-৫-৬৬ তারিখে লিখেছেন যে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ময়মনসিংহ পাঠানো সমীচীন নয়।

it will not be advisable to send Sk Mujibur Rahman to mymensingh at this stage due to the political activities of Awami League. (গোয়েন্দা নথি, F/N 606-48 PF-Part-25)

দলীয় প্রধান নেতা জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৩০ মে তারিখ দলের ছয় দফা বাস্তবায়নের নীতি অব্যাহত রাখা, ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই সময় সরকার আওয়ামী লীগের প্রচারকার্যে বাধা হিসেবে পোস্টার ছাপানোয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, কর্মীদের বেআইনিভাবে আটক রাখার কৌশল অবলম্বন করে। মিজানুর রহমান চৌধুরী পত্র-পত্রিকায় সরকারের এ ধরনের বাধার তীব্র সমালোচনা করে একটি বিবৃতি প্রদান করলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পাল্টা বিবৃতির মাধ্যমে ছয় দফার আন্দোলন ‘কঠোরহস্তে’ দমনের হুমকি প্রদান করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার আইনজীবী আমিনুল হক এবং এমএ রব হাইকোর্টে ৬ জুন তারিখের রিট পিটিশনের শুনানিতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকবেন কিনা এসব প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য ৩০ মে তারিখ বিকেল সাড়ে ৪টায় জেলখানায় যান। ওই দিনই আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার আসমতউল্লাহও বিকেল সোয়া ৫টায় জেলে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা সম্পর্কে আলোচনা করেন। (গোয়েন্দা নথি F/N 606-48 PF-Part-1)

ইত্যবসরে ২ জুন তারিখে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, ঢাকা জেলা ও নগর কমিটির বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার ৭ জুন হরতাল উপলক্ষে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করে পত্রপত্রিকাগুলোর ওপর অঘোষিতভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করে। বিশেষ করে ইত্তেফাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর। কারণ এর পাঠকের সংখ্যা অসংখ্য। পূর্ব পাকিস্তানে ইত্তেফাক সব কাগজের থেকে বেশি ছাপা হয়। বাংলার গ্রামে গ্রামে ইত্তেফাক পরিচিত। দেশরক্ষা আইনের বলে অন্য কোন কাগজকে এত বড় আঘাত করা হয়নি যেটি ইত্তেফাককে করেছে। কিছুদিন আগেও হুকুম দিল ‘এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করছে এ খবর লিখতে পারবে না, ছাত্রদের কোন নিউজ ছাপাতে পারবে না, এমন কি তারা যে হুকুম দিল সেটিও ছাপাতে পারবে না, যে ইত্তেফাকের ওপর এ হুকুম দিয়েছে। তবুও ইত্তেফাক ব্যতীত কোন পত্রিকাতেই ওই সময় ৭ জুন হরতালের কোন খবর কোনভাবেই ছাপা হয়নি, তারপরও গোটা দেশেই ৭ জুনের হরতালের খবর জানাজানি হয়ে যায় এবং হরতাল পালিত হয়।

সরকারের পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। এর ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশে মনু মিয়া, মুজিবর হকসহ ১১ জন নিহত ও অনেকে আহত হন।

ঢাকা। প্রথম লেখা ১৬ অক্টোবর ২০২১। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৪ জানুয়ারি ২০২০

[মতামত লেখকের নিজস্ব]

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com, www.bijoyekushe.net.bd, www.bijoydigital.com

মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২১ , ১২ মাঘ ১৪২৭, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার

চার

ছয় দফাকেন্দ্রিক নির্যাতন চলতেই থাকে : বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করে বস্তুত পুরো পাকিস্তানের রাজনীতির ছক পাল্টে দিলেন। এর আগে পাকিস্তানের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পেছনে ভাষা আন্দোলন একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এর পাশাপাশি বঞ্চিত অবহেলিত পূর্ববাংলার বিষয়গুলোও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাতচল্লিশ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন যখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে যায় তখন মহাশক্তিধর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাজনীতি করার তেমন জোরালো কোন ইস্যু বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই ছিল না। তার চাইতেও বড় কথা ছিল যে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাড়া বাকি রাজনীতিকরা ছিলেন দ্বিধান্বিত। পাকিস্তানভিত্তিক মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে একদল রাজনীতিক প্রগতিশীলতা বা বাম রাজনীতির কথা বললেও তাদের কোন স্থিরতা ছিল না। কোন কোন রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠীর দালালিতেও লিপ্ত হয়। অন্যদিকে আইয়ুব খান মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়া গ্রহণ করেন। সেজন্য পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে সবার ওপরে রাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ফলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটক রাখা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। ’৬৬ সালের মে মাসে তাকে গ্রেফতার করার আগে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

ঢাকার ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে প্রস্তুতকৃত পত্রে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অভিযোগ আনা হয়-

... is reported to have acted and likely to act is a manner prejudicial to the public safety and the maintenance of public order, the maintenance of peaceful conditions is the country, the maintenance of essential supplies and services… Now, therefore, in exercise of the power conferred by clause (b) of sub rule (I) in rule 32 of the defense of Pakistan rules, 1965.. the Government of East Pakistan notification No. 115-Pol. (II), dated 13-9-65. অনুযায়ী

that the said Mr. Sk. Mujibur Rahman, Shall be detained for a period of three months from the date of service of this order,

… the said person shall be deterred in the Dacca Central Jail. (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থার নথি, F/N 606-48 PF-Part-25) তাকে তিন মাসের আটকাদেশ প্রদান করে ৯ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। ৯ মে গ্রেফতারকৃত অপর নেতাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এমএ আজিজ (চট্টগ্রাম) জহুর আহমদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম), মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) এমএস হক এবং আবদুর রহমান সিদ্দিকী।

ডিএসপিএলআর ৯-৫-৬৬ তারিখের চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের u/r 47(5) DPR/65 & 7(3) EPPSO/58 পাবনায় ৮-৫-৬৬ (পাবনা PS মামলা নং 5 তারিখ 8-5-66-u/r47(5) DPR/65 7(3) EPPSO/58 শুরু করা হয়েছে। ৭-৪-৬৬ তারিখে পাবনায় অনুষ্ঠিত জনসভায় আইন বিরোধী বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে। নতুন নতুন অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার ছয় দফার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অনবরত নাজেহাল করার চেষ্টা করতেই থাকে।

পাকিস্তান সরকার ধারণা করেছিল এর ফলে ছয় দফার আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া আরো বিস্তৃত হয়ে পূর্ববাংলাব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি নুরুল আমিন, শাহ আজিজ, নেজামে ইসলাম নেতা ফরিদ আহমেদও এভাবে দমন নির্যাতন হয়রানি ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করেন। মানিক মিয়া তার জনপ্রিয় রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে এ ধরনের গ্রেপ্তারের তীব্র বিরোধিতা করে ১০ মে সাহসী লেখা লিখেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১০-৫-১৯৬৬) প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩ মে তারিখে ধর্মঘট পালিত হয় এবং বিকেলে পল্টন ময়দানে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে ধানমন্ডির (৫৪৩) জি রোড নং ১৩) বাসিন্দা রেজাউল মালিক পিতা আবদুল মালেক খান, ২৯ বছর বয়সের একজন ব্যবসায়ী ১২-৫-১৯৬৬ তারিখ, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ মোর্শেদ বরাবরে একটি আর্জি পেশ করেন। বিচারপতি বিএ সিদ্দিকি, সৈয়দ এবি মাহমুদ হোসেন ১৩ মে তারিখে সরকার পক্ষে স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিসি, ঢাকা এবং ডিআইজি (প্রিজন) এবং ঢাকা জেল সুপারকে এবং আবেদনকারীর পক্ষে এ সালাম খান, মির্জা গোলাম হাফিজ, এমএ রব হুমায়ুন কবীর চৌধুরী এবং আমিনুল হককে নিম্নোক্ত আদেশ জারি করেন।

let a rule nisi be issued calling upon the respondents to show cause why sk. Mujibur Rahman, who is alleged to be illegally and improperly detained in Dacca Central Jail, should not be produced before this court and be dealt with in accordance with the law,… (F/N 606-48 PF-Part-25)

সরকারের ওপর কারণ দর্শানোর এ নির্দেশ জারিকে অনেকেই দেশের বিচার-বিভাগের এক বলিষ্ঠ এবং নজিরবিহীন সাহসী ভূমিকা বলে অভিহিত করেছেন। প্রকাশ থাকে যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ভাগ্নে এবং ন্যায়নীতির প্রতি এক অবিচল পুরুষ। জেলের অভ্যন্তরে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতারা জেল কর্তৃপক্ষকে ১১-৫-৬৬ তারিখে এ বলে হুমকি দেন যে, যদি তাদের একসঙ্গে থাকতে দেয়া না হয় তাহলে তারা ‘অনশন ধর্মঘট’ শুরু করবেন। (গোয়েন্দা সংস্থার নথি থেকে Extract from Daily Report No. 125 dat-11-5-66 from SBEPDB.No.8258/12-5-66.F/N 606-48 PF-Part-25) জেল কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলখানার মধ্যেও একত্রে থাকতে বা চলাফেরা করাকে সুনজরে দেখেননি, আইবি হুকুম দিয়েই চলেছে জেলে আওয়ামী লীগারদের আলাদা আলাদা রাখতে হবে। তাদের কষ্ট দিতে হবে। তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে হবে। সেজন্যই শেখ মুজিবসহ নেতাদের অনশন করার হুমকি। এরপর তাদের একত্রে থাকতে দেয়া হয়েছিল কিনা-তা কোন সূত্র থেকেই উদ্ধার করা যায়নি। পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে বন্দী করে রেখেও স্বস্তিতে ছিল না। বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি নানা অজুহাতে নিপীড়ন চালাতে থাকে সরকার। জেলের আইন ভঙ্গ করে তাকে একা রাখা হতো যাতে কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ না পান। অন্যান্য রাজবন্দীরা বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে যেতে পারলেও সরকারের হুকুমে বঙ্গবন্ধুকে কারও কাছে দেয়া হতো না।

তাকে নিয়ে বরাবরই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল সরকার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ তাদের ২১-৫-৬৬ তারিখের ৪৫২/ কন সংখ্যক স্মারকে ২৪-৫-৬৬ তারিখে শেখ মুজিবের মামলার হাজিরার অনুমতি প্রসঙ্গে লিখেছিল-

…As courts order shall have to be complied with, it is for consideration whether it would be advisable to send Mr Sheikh Mujibur Rahman to mymensingh now. if not, we may request D/C, mymensingh to instruct P.P to move court for fixing a later date for the Prisoner.

এর উত্তরে ঢাকায় ডিআইবি/এসবি. ২৩-৫-৬৬ তারিখে লিখেছেন যে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ময়মনসিংহ পাঠানো সমীচীন নয়।

it will not be advisable to send Sk Mujibur Rahman to mymensingh at this stage due to the political activities of Awami League. (গোয়েন্দা নথি, F/N 606-48 PF-Part-25)

দলীয় প্রধান নেতা জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৩০ মে তারিখ দলের ছয় দফা বাস্তবায়নের নীতি অব্যাহত রাখা, ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই সময় সরকার আওয়ামী লীগের প্রচারকার্যে বাধা হিসেবে পোস্টার ছাপানোয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, কর্মীদের বেআইনিভাবে আটক রাখার কৌশল অবলম্বন করে। মিজানুর রহমান চৌধুরী পত্র-পত্রিকায় সরকারের এ ধরনের বাধার তীব্র সমালোচনা করে একটি বিবৃতি প্রদান করলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পাল্টা বিবৃতির মাধ্যমে ছয় দফার আন্দোলন ‘কঠোরহস্তে’ দমনের হুমকি প্রদান করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার আইনজীবী আমিনুল হক এবং এমএ রব হাইকোর্টে ৬ জুন তারিখের রিট পিটিশনের শুনানিতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকবেন কিনা এসব প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য ৩০ মে তারিখ বিকেল সাড়ে ৪টায় জেলখানায় যান। ওই দিনই আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার আসমতউল্লাহও বিকেল সোয়া ৫টায় জেলে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা সম্পর্কে আলোচনা করেন। (গোয়েন্দা নথি F/N 606-48 PF-Part-1)

ইত্যবসরে ২ জুন তারিখে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, ঢাকা জেলা ও নগর কমিটির বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার ৭ জুন হরতাল উপলক্ষে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করে পত্রপত্রিকাগুলোর ওপর অঘোষিতভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করে। বিশেষ করে ইত্তেফাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর। কারণ এর পাঠকের সংখ্যা অসংখ্য। পূর্ব পাকিস্তানে ইত্তেফাক সব কাগজের থেকে বেশি ছাপা হয়। বাংলার গ্রামে গ্রামে ইত্তেফাক পরিচিত। দেশরক্ষা আইনের বলে অন্য কোন কাগজকে এত বড় আঘাত করা হয়নি যেটি ইত্তেফাককে করেছে। কিছুদিন আগেও হুকুম দিল ‘এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করছে এ খবর লিখতে পারবে না, ছাত্রদের কোন নিউজ ছাপাতে পারবে না, এমন কি তারা যে হুকুম দিল সেটিও ছাপাতে পারবে না, যে ইত্তেফাকের ওপর এ হুকুম দিয়েছে। তবুও ইত্তেফাক ব্যতীত কোন পত্রিকাতেই ওই সময় ৭ জুন হরতালের কোন খবর কোনভাবেই ছাপা হয়নি, তারপরও গোটা দেশেই ৭ জুনের হরতালের খবর জানাজানি হয়ে যায় এবং হরতাল পালিত হয়।

সরকারের পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। এর ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশে মনু মিয়া, মুজিবর হকসহ ১১ জন নিহত ও অনেকে আহত হন।

ঢাকা। প্রথম লেখা ১৬ অক্টোবর ২০২১। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৪ জানুয়ারি ২০২০

[মতামত লেখকের নিজস্ব]

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com, www.bijoyekushe.net.bd, www.bijoydigital.com