মূল : সা’দাত হাসান মান্টো ভাষান্তর : হাইকেল হাশমী
নাইম হাঁটতে হাঁটতে একটি বাগানে চলে এলো। জায়গাটার পরিবেশ তার অনেক পছন্দ হলো। ঘাসের উপর শুয়ে নিজের সাথে কথা বলতে লাগলো।
“কতো মনোরম পরিবেশ- কীভাবে এতো দিন আমার চোখের আড়ালে রইলো, চোখের আড়ালে।” এইটুকু বলে সে মুচকি হাসলো।
“দৃষ্টি থাকলেও অনেক কিছু দেখা যায় না- আহ, দৃষ্টির অগোচর!” সে অনেকক্ষণ ঘাসের উপর শুয়ে মাটির ঠাণ্ডা অনুভব করতে থাকলো আর নিজের সাথে কথোপকথন চালিয়ে গেল।
“এই নরম ঘাস কতো আরামদায়ক!” চোখ মনে হয় পায়ের পাতায় চলে এসেছে- আর এই ফুল মোটেও সুন্দর না কিন্তু তার গন্ধটা প্রতারক। প্রত্যেকটি প্রতারক জিনিসই সুন্দর হয়। প্রতারক মেয়ে, প্রতারক পুরুষ- বুঝতে পারি না এই সুন্দর জিনিসগুলোর আগে জন্ম হয়েছিল না কি সুন্দর কল্পনার- প্রত্যেকটি কল্পনা সুন্দর; কিন্তু বিপদ হচ্ছে যে প্রত্যেকটি ফুল সুন্দর হয় না, যেমন এই ফুল।” সে উঠে একটি ফুলের দিকে তাকালো আর নিজের সাথে কথা চালিয়ে যেতে লাগলো।
“এই ফুল এই ডালের উপর কাত হয়ে বসে আছে দেখতে কেমন বাজে লাগছে। যা হোক এই জায়গাটা খুবই মনরোম। মনে হয় যেন অনেক বড় মস্তিষ্ক- আলো আছে, ছায়া আছে- এখন মনে হচ্ছে আমি না, এই জায়গাটাই কল্পনা করছি।”
এতো সুন্দর জায়গা কীভাবে আমার চোখের আড়ালে রইলো। তার পর সে খুশি মনে একটি গান ধরলো। তখনই হঠাৎ একটি গাড়ির কর্কশ হর্ন তার মন বীণার সকল তার ছিঁড়ে দিলো।
সে চমকে উঠে দাঁড়ালো- দেখলো পাশের সরু পথে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আর একজন লম্বা গোঁফওয়ালা লোক তার দিকে রাগাম্বিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ওই গোঁফওয়ালা লোক চিৎকার দিয়ে তাকে বলল, “আবে তুই কে?”
নাইম, যে নিজের নেশায় মশগুল ছিল, বিস্ময়ের সাথে বলল, “এই গাড়িটি বাগানে কীভাবে ঢুকলো?”
গোঁফওয়ালা লোক যে এই বাগানের মালিক সে বিড়বিড় করে বলল, “দেখতে তো ভদ্রই মনে হচ্ছে কিন্তু এই বাগানে কীভাবে ঢুকলো? কতো আরামে শুয়ে আছে যেন তার বাবার বাগান।” তার পর উঁচু গলায় নাইমকে বলল, “আমি কি বলি কিছু শুনছো?”
নাইম উত্তর দিল, “হ্যাঁ শুনছি, এখানে চলে আসেন। খুব সুন্দর পরিবেশ।”
বাগানের মালিক রেগে গিয়ে বলল, “আবে এই দিকে আয়।”
নাইম আবার শুয়ে পড়লো আর বলল, “না আমি আসতে পারবো না, তুমি চলে আসো। অনেক সুন্দর জায়গা সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।”
বাগানের মালিক গাড়ি থেকে বের হয়ে তার কাছে এসে রেগে বলল, “এখান থেকে ওঠো।”
তার তীক্ষè কণ্ঠ নাইমের মোটেও ভালো লাগেনি- “এতো জোরে কথা বলার দরকার নেই- এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ো- একদম চুপচাপ যেমন আমি শুয়ে আছি- চোখ বন্ধ করে নাও- নিজের শরীরকে ঢিলা করে ছেড়ে দাও- মগজের সব বাতি নিভিয়ে দাও- তখন তুমি আঁধারে হাঁটবে আর তোমার আঙ্গুল অনেকগুলো বাল্বের সুইচ জ্বালিয়ে দিবে যেটা তোমার জন্য এখন পর্যন্ত অজানা ছিল। আসো আমার পাশে শুয়ে পড়ো।”
বাগানের মালিক একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “তুমি কি পাগল?”
নাইম মুচকি হেসে বলল, “না- তুমি কোনো দিন বোধহয় পাগল দেখোনি- আমার জায়গায় যদি কোনো পাগল হতো তা হলে এই ঝোপঝাড়ে, এই গাছের ডালে, শিশুর গালের মতো ঝুলতে থাকা ফুল থেকে কোনো দিন সন্তুষ্ট হতো না। পাগলামি শান্তির নাম নয় হে আমার বন্ধু। কিন্তু আসো তোমার সাথে পাগলামির কথা বলি।”
“বাজে কথা বন্ধ করো আর এখান থেকে এখনই বের হয়ে যাও”। বাগানের মালিক অনেক রেগে গেল এবং তার ড্রাইভারকে ডেকে বলল, “এই লোককে ধাক্কা মেরে বের করে দাও।”
“আরে তুমি কে? তুমি তো অনেক বেয়াদব মানুষ।”
নাইম যখন বাগান থেকে বের হচ্ছিল তখন গেটে লাগানো বোর্ড দেখলো। লেখা- “বিনা অনুমতিতে
প্রবেশ নিষেধ”। সে মুচকি হাসলো।
আশ্চর্য এটাও আমি দেখি নাই! দৃষ্টি থাকলেও অনেক কিছু দেখা যায় না, আহা দৃষ্টির এই দৃষ্টিহীনতা।
এখান থেকে বের হয়ে সে একটি আর্ট এক্সিবিশানে চলে গেল মনকে কিছু খোরাক দেয়ার জন্য। হলে ঢুকেই তার নজরে পড়লো কিছু পুরুষ আর মহিলার জটলা- যারা দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি দেখছিল। একজন লোক একটি পারসি মহিলাকে বলছে, “মিসেস ফৌজদার, এই পেন্টিংটি দেখেছেন আপনি?” মিসেস ফৌজদার ছবি একনজর দেখে পুরুষটিকে বলল, “তুমি দেখেছো, শিরিন কতো সেজেগুঁজে এসেছে?” শিরিন হলো সেই মহিলা যার সাথে ওই পুরুষের বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে।
একটি যুবতী মহিলা একজন অল্পবয়সী মেয়েকে বলছে, “সুরাইয়া এখানে এসে পেন্টিং দেখো। ওখানে একা দাঁড়িয়ে কী করছো?” পেন্টিংয়ে সুরাইয়ার কোনো আগ্রহ নেই, সে তো একটি “বয় ফ্রেন্ডের” খোঁজে আছে।
একজন মধ্যবয়সী পুরুষ যার পেন্টিংয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই সে তার মধ্যবয়সী বন্ধুকে বলছে, “তার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে তা না হলে সে অবশ্যই আসতো। আপনি তো জানেন সে পেন্টিং কতো ভালবাসে। এখন তো সে অনেক ভালো ছবি আঁকে। গতকাল দেখলাম সে পেন্সিল দিয়ে তার ভাই-এর সাইকেলের ছবি হুবহু স্কেচ করে ফেলেছে, আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেলাম।”
নাইম পাশে দাঁড়ানো, সে ব্যঙ্গপূর্ণ স্বরে বলল, “বেশ তো, হুবহু সাইকেল মনে হচ্ছিলো, তাই না?” দুইজন বন্ধু চমকে উঠলো যে এ কোন বেয়াদব লোক। একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কে?”
নাইম বিচলিত হয়ে বলল, “আমি- আমি”।
“আমি আমি কী করছো, বলো তুমি কে?”
নাইম নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, “আপনারা একটু ভদ্রভাবে কথা বলেন, আমি বলছি আমি কে?”
“তুমি এখানে কীভাবে এলে?”
নাইম ছোট করে বলল, “জি হেঁটে।”
পুরুষ আর মহিলারা যারা ছবি দেখছিলো আর বিবিধ আলাপ করছিলো, তার কথা শুনে হেসে দিলো। তখনই ওই পরিদর্শনের আয়োজনকারী চলে এলো। তাকে নাইমের বেয়াদবি সম্বন্ধে জানানো হলো, সে খুব কড়া স্বরে নাইমকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমার কাছে কি কার্ড আছে?”
নাইম সরলভাবে বলল, “কার্ড- কেমন কার্ড, পোস্টকার্ড?”
“অনুমতি ছাড়া তুমি এখানে ঢুকেছো, এখনই বের হও এখান থেকে।”
নাইম ছবি দেখতে চাচ্ছিল কিন্তু কি আর করা ওকে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। সে সোজা নিজের বাসায় এসে দরজার কড়া নাড়ার সাথে সাথে তার কাজের লোক ফজলু দরজা খুললো। নাইম তাকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলো, “আমি কি ভিতরে আসতে পারি?”
ফজলু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী বলছেন হুজুর, এটা তো আপনার বাসা, অনুমতির কী দরকার?”
নাইম তাকে বলল, “না ফজলু এটা আমার বাসা না, যে বাসা আমাকে আরাম দেয় ওটা আমার কীভাবে হতে পারে? ফজলু আজ আমি একটি নতুন কথা জানলাম।”
ফজলু সম্মানের সাথে জিজ্ঞাসা করল, “কী হুজুর?”
নাইম বলল, “এই বাসা আমার না, কিন্তু এটার ধুলা আর ময়লা আমার, ওইসব জিনিসই আমার যেটা আমার বিরক্তির কারণ হয়; কিন্তু যেগুলো আমাকে আরাম দেয় ওগুলো অন্য কারোর, জানি না কার। এখন আমি ভয় পাই কোনো ভালো জিনিসকে আমার বলতে। এই পানি আমার না, এই বাতাস আমার না, এই আকাশ আমার না, এবং ওই লেপ যেটা আমি শীতে গায়ে দেই আমার না- কারণ হচ্ছে আমি ওটা থেকে আরাম পাই।”
“ফজলু যাও তুমিও আমার না”, নাইম ফজলুকে কোনো কথা বলতে দিল না এবং ফজলু চলে গেল।
হিরামন্ডির একটি বাঈজির কোঠা থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে, “পিয়া বিন নাহি আওয়াত চ্যান”। নাইম ওই কোঠায় গেল। ভিতরে কয়েকজন লোক মুজরা শোনার জন্য বসে আছে। সে বাঈজিকে বলল, “ইনাদের কোনো আপত্তি নেই তো, আমি ভিতরে আসি?”
বাঈজি হেসে বলল, “উনাদের কেন আপত্তি হবে, আপনি ওই কার্পেটে বসে যান আর কোল বালিশটি নিয়ে নেন।” নাইম বসে চারিদিকে দেখলো এবং ওই বাঈজিকে বলল, “এটা কতো ভালো জায়গা।”
বাঈজি গম্ভীরভাবে বলল, “আপনি কি এখানে আমার সাথে কৌতুক করতে এসেছেন, এটা ভালো জায়গা? যেটাকে ভদ্রলোকেরা সবচেয়ে নোংরা জায়গা বলে তাকে আপনি ভালো জায়গা বলছেন?”
এটি ভালো জায়গা এই কারণে যে, এখানে “বিনা অনুমতিতে ভিতরে আসা নিষেধ”-এর বোর্ড লাগানো নেই। তার কথা শুনে বাঈজি এবং অন্য দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লো। নাইমের মনে হলো যেন এই দুনিয়াটা একটা বাঈজি আর তার মুজরা শোনার জন্য এমন নির্বোধ লোকেরা আসে।
লেখক পরিচিতি : সাদত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ মে পাঞ্জাব লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামের ব্যারিস্টার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মান্টোর পূর্বপুরুষ কাশ্মিরী বংশোদ্ভূত ছিলেন। মান্টোর পিতা ছিলেন একজন আদালতের বিচারক। কঠোর শাসনেও মান্টো ছোটবেলা থেকে বোহেমিয়ান হয়ে ওঠেন। কিন্তু স্কুলের গণ্ডিতে তার মনপ্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো। পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে স্বভাবতই দু’বার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। ঝুঁকে পড়েন সংস্কৃতি চর্চা ও সাহিত্য সাধনায়। বিখ্যাত ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চিন্তার এই উর্দু লেখককে তার মুক্তচিন্তার কারণে অপমানিত, লাঞ্ছিত হতে হয় ভারত পাকিস্তান দুই দেশেই। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে তিনি লাহোর চলে যান। পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসির কাজমি, আহমেফ রহি প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাহিত্যচর্চায় তার বিশেষ খ্যাতি হয়। তিনি একজন বেতার লিপি লেখক ও সাংবাদিকও ছিলেন। তার ছোটগল্পের সংকলন Kingdom’s end and other stories, একটি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত স্কেচের দুটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। বোম্বাই চলচ্চিত্র জগত অর্থাৎ বলিউডে মান্টোর অজস্র কাজ রয়েছে। বহু সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির চিত্রাভিনেতা ও পরিচালকদের কাছে মান্টোর কদর ছিল। আট দিন, চল চলরে নওজোয়ান, মির্জা গালিব ইত্যাদি সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটিং তার কৃতিত্ব।
বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২
মূল : সা’দাত হাসান মান্টো ভাষান্তর : হাইকেল হাশমী
নাইম হাঁটতে হাঁটতে একটি বাগানে চলে এলো। জায়গাটার পরিবেশ তার অনেক পছন্দ হলো। ঘাসের উপর শুয়ে নিজের সাথে কথা বলতে লাগলো।
“কতো মনোরম পরিবেশ- কীভাবে এতো দিন আমার চোখের আড়ালে রইলো, চোখের আড়ালে।” এইটুকু বলে সে মুচকি হাসলো।
“দৃষ্টি থাকলেও অনেক কিছু দেখা যায় না- আহ, দৃষ্টির অগোচর!” সে অনেকক্ষণ ঘাসের উপর শুয়ে মাটির ঠাণ্ডা অনুভব করতে থাকলো আর নিজের সাথে কথোপকথন চালিয়ে গেল।
“এই নরম ঘাস কতো আরামদায়ক!” চোখ মনে হয় পায়ের পাতায় চলে এসেছে- আর এই ফুল মোটেও সুন্দর না কিন্তু তার গন্ধটা প্রতারক। প্রত্যেকটি প্রতারক জিনিসই সুন্দর হয়। প্রতারক মেয়ে, প্রতারক পুরুষ- বুঝতে পারি না এই সুন্দর জিনিসগুলোর আগে জন্ম হয়েছিল না কি সুন্দর কল্পনার- প্রত্যেকটি কল্পনা সুন্দর; কিন্তু বিপদ হচ্ছে যে প্রত্যেকটি ফুল সুন্দর হয় না, যেমন এই ফুল।” সে উঠে একটি ফুলের দিকে তাকালো আর নিজের সাথে কথা চালিয়ে যেতে লাগলো।
“এই ফুল এই ডালের উপর কাত হয়ে বসে আছে দেখতে কেমন বাজে লাগছে। যা হোক এই জায়গাটা খুবই মনরোম। মনে হয় যেন অনেক বড় মস্তিষ্ক- আলো আছে, ছায়া আছে- এখন মনে হচ্ছে আমি না, এই জায়গাটাই কল্পনা করছি।”
এতো সুন্দর জায়গা কীভাবে আমার চোখের আড়ালে রইলো। তার পর সে খুশি মনে একটি গান ধরলো। তখনই হঠাৎ একটি গাড়ির কর্কশ হর্ন তার মন বীণার সকল তার ছিঁড়ে দিলো।
সে চমকে উঠে দাঁড়ালো- দেখলো পাশের সরু পথে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আর একজন লম্বা গোঁফওয়ালা লোক তার দিকে রাগাম্বিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ওই গোঁফওয়ালা লোক চিৎকার দিয়ে তাকে বলল, “আবে তুই কে?”
নাইম, যে নিজের নেশায় মশগুল ছিল, বিস্ময়ের সাথে বলল, “এই গাড়িটি বাগানে কীভাবে ঢুকলো?”
গোঁফওয়ালা লোক যে এই বাগানের মালিক সে বিড়বিড় করে বলল, “দেখতে তো ভদ্রই মনে হচ্ছে কিন্তু এই বাগানে কীভাবে ঢুকলো? কতো আরামে শুয়ে আছে যেন তার বাবার বাগান।” তার পর উঁচু গলায় নাইমকে বলল, “আমি কি বলি কিছু শুনছো?”
নাইম উত্তর দিল, “হ্যাঁ শুনছি, এখানে চলে আসেন। খুব সুন্দর পরিবেশ।”
বাগানের মালিক রেগে গিয়ে বলল, “আবে এই দিকে আয়।”
নাইম আবার শুয়ে পড়লো আর বলল, “না আমি আসতে পারবো না, তুমি চলে আসো। অনেক সুন্দর জায়গা সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।”
বাগানের মালিক গাড়ি থেকে বের হয়ে তার কাছে এসে রেগে বলল, “এখান থেকে ওঠো।”
তার তীক্ষè কণ্ঠ নাইমের মোটেও ভালো লাগেনি- “এতো জোরে কথা বলার দরকার নেই- এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ো- একদম চুপচাপ যেমন আমি শুয়ে আছি- চোখ বন্ধ করে নাও- নিজের শরীরকে ঢিলা করে ছেড়ে দাও- মগজের সব বাতি নিভিয়ে দাও- তখন তুমি আঁধারে হাঁটবে আর তোমার আঙ্গুল অনেকগুলো বাল্বের সুইচ জ্বালিয়ে দিবে যেটা তোমার জন্য এখন পর্যন্ত অজানা ছিল। আসো আমার পাশে শুয়ে পড়ো।”
বাগানের মালিক একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “তুমি কি পাগল?”
নাইম মুচকি হেসে বলল, “না- তুমি কোনো দিন বোধহয় পাগল দেখোনি- আমার জায়গায় যদি কোনো পাগল হতো তা হলে এই ঝোপঝাড়ে, এই গাছের ডালে, শিশুর গালের মতো ঝুলতে থাকা ফুল থেকে কোনো দিন সন্তুষ্ট হতো না। পাগলামি শান্তির নাম নয় হে আমার বন্ধু। কিন্তু আসো তোমার সাথে পাগলামির কথা বলি।”
“বাজে কথা বন্ধ করো আর এখান থেকে এখনই বের হয়ে যাও”। বাগানের মালিক অনেক রেগে গেল এবং তার ড্রাইভারকে ডেকে বলল, “এই লোককে ধাক্কা মেরে বের করে দাও।”
“আরে তুমি কে? তুমি তো অনেক বেয়াদব মানুষ।”
নাইম যখন বাগান থেকে বের হচ্ছিল তখন গেটে লাগানো বোর্ড দেখলো। লেখা- “বিনা অনুমতিতে
প্রবেশ নিষেধ”। সে মুচকি হাসলো।
আশ্চর্য এটাও আমি দেখি নাই! দৃষ্টি থাকলেও অনেক কিছু দেখা যায় না, আহা দৃষ্টির এই দৃষ্টিহীনতা।
এখান থেকে বের হয়ে সে একটি আর্ট এক্সিবিশানে চলে গেল মনকে কিছু খোরাক দেয়ার জন্য। হলে ঢুকেই তার নজরে পড়লো কিছু পুরুষ আর মহিলার জটলা- যারা দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি দেখছিল। একজন লোক একটি পারসি মহিলাকে বলছে, “মিসেস ফৌজদার, এই পেন্টিংটি দেখেছেন আপনি?” মিসেস ফৌজদার ছবি একনজর দেখে পুরুষটিকে বলল, “তুমি দেখেছো, শিরিন কতো সেজেগুঁজে এসেছে?” শিরিন হলো সেই মহিলা যার সাথে ওই পুরুষের বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে।
একটি যুবতী মহিলা একজন অল্পবয়সী মেয়েকে বলছে, “সুরাইয়া এখানে এসে পেন্টিং দেখো। ওখানে একা দাঁড়িয়ে কী করছো?” পেন্টিংয়ে সুরাইয়ার কোনো আগ্রহ নেই, সে তো একটি “বয় ফ্রেন্ডের” খোঁজে আছে।
একজন মধ্যবয়সী পুরুষ যার পেন্টিংয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই সে তার মধ্যবয়সী বন্ধুকে বলছে, “তার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে তা না হলে সে অবশ্যই আসতো। আপনি তো জানেন সে পেন্টিং কতো ভালবাসে। এখন তো সে অনেক ভালো ছবি আঁকে। গতকাল দেখলাম সে পেন্সিল দিয়ে তার ভাই-এর সাইকেলের ছবি হুবহু স্কেচ করে ফেলেছে, আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেলাম।”
নাইম পাশে দাঁড়ানো, সে ব্যঙ্গপূর্ণ স্বরে বলল, “বেশ তো, হুবহু সাইকেল মনে হচ্ছিলো, তাই না?” দুইজন বন্ধু চমকে উঠলো যে এ কোন বেয়াদব লোক। একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কে?”
নাইম বিচলিত হয়ে বলল, “আমি- আমি”।
“আমি আমি কী করছো, বলো তুমি কে?”
নাইম নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, “আপনারা একটু ভদ্রভাবে কথা বলেন, আমি বলছি আমি কে?”
“তুমি এখানে কীভাবে এলে?”
নাইম ছোট করে বলল, “জি হেঁটে।”
পুরুষ আর মহিলারা যারা ছবি দেখছিলো আর বিবিধ আলাপ করছিলো, তার কথা শুনে হেসে দিলো। তখনই ওই পরিদর্শনের আয়োজনকারী চলে এলো। তাকে নাইমের বেয়াদবি সম্বন্ধে জানানো হলো, সে খুব কড়া স্বরে নাইমকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমার কাছে কি কার্ড আছে?”
নাইম সরলভাবে বলল, “কার্ড- কেমন কার্ড, পোস্টকার্ড?”
“অনুমতি ছাড়া তুমি এখানে ঢুকেছো, এখনই বের হও এখান থেকে।”
নাইম ছবি দেখতে চাচ্ছিল কিন্তু কি আর করা ওকে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। সে সোজা নিজের বাসায় এসে দরজার কড়া নাড়ার সাথে সাথে তার কাজের লোক ফজলু দরজা খুললো। নাইম তাকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলো, “আমি কি ভিতরে আসতে পারি?”
ফজলু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী বলছেন হুজুর, এটা তো আপনার বাসা, অনুমতির কী দরকার?”
নাইম তাকে বলল, “না ফজলু এটা আমার বাসা না, যে বাসা আমাকে আরাম দেয় ওটা আমার কীভাবে হতে পারে? ফজলু আজ আমি একটি নতুন কথা জানলাম।”
ফজলু সম্মানের সাথে জিজ্ঞাসা করল, “কী হুজুর?”
নাইম বলল, “এই বাসা আমার না, কিন্তু এটার ধুলা আর ময়লা আমার, ওইসব জিনিসই আমার যেটা আমার বিরক্তির কারণ হয়; কিন্তু যেগুলো আমাকে আরাম দেয় ওগুলো অন্য কারোর, জানি না কার। এখন আমি ভয় পাই কোনো ভালো জিনিসকে আমার বলতে। এই পানি আমার না, এই বাতাস আমার না, এই আকাশ আমার না, এবং ওই লেপ যেটা আমি শীতে গায়ে দেই আমার না- কারণ হচ্ছে আমি ওটা থেকে আরাম পাই।”
“ফজলু যাও তুমিও আমার না”, নাইম ফজলুকে কোনো কথা বলতে দিল না এবং ফজলু চলে গেল।
হিরামন্ডির একটি বাঈজির কোঠা থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে, “পিয়া বিন নাহি আওয়াত চ্যান”। নাইম ওই কোঠায় গেল। ভিতরে কয়েকজন লোক মুজরা শোনার জন্য বসে আছে। সে বাঈজিকে বলল, “ইনাদের কোনো আপত্তি নেই তো, আমি ভিতরে আসি?”
বাঈজি হেসে বলল, “উনাদের কেন আপত্তি হবে, আপনি ওই কার্পেটে বসে যান আর কোল বালিশটি নিয়ে নেন।” নাইম বসে চারিদিকে দেখলো এবং ওই বাঈজিকে বলল, “এটা কতো ভালো জায়গা।”
বাঈজি গম্ভীরভাবে বলল, “আপনি কি এখানে আমার সাথে কৌতুক করতে এসেছেন, এটা ভালো জায়গা? যেটাকে ভদ্রলোকেরা সবচেয়ে নোংরা জায়গা বলে তাকে আপনি ভালো জায়গা বলছেন?”
এটি ভালো জায়গা এই কারণে যে, এখানে “বিনা অনুমতিতে ভিতরে আসা নিষেধ”-এর বোর্ড লাগানো নেই। তার কথা শুনে বাঈজি এবং অন্য দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লো। নাইমের মনে হলো যেন এই দুনিয়াটা একটা বাঈজি আর তার মুজরা শোনার জন্য এমন নির্বোধ লোকেরা আসে।
লেখক পরিচিতি : সাদত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ মে পাঞ্জাব লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামের ব্যারিস্টার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মান্টোর পূর্বপুরুষ কাশ্মিরী বংশোদ্ভূত ছিলেন। মান্টোর পিতা ছিলেন একজন আদালতের বিচারক। কঠোর শাসনেও মান্টো ছোটবেলা থেকে বোহেমিয়ান হয়ে ওঠেন। কিন্তু স্কুলের গণ্ডিতে তার মনপ্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো। পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে স্বভাবতই দু’বার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। ঝুঁকে পড়েন সংস্কৃতি চর্চা ও সাহিত্য সাধনায়। বিখ্যাত ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চিন্তার এই উর্দু লেখককে তার মুক্তচিন্তার কারণে অপমানিত, লাঞ্ছিত হতে হয় ভারত পাকিস্তান দুই দেশেই। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে তিনি লাহোর চলে যান। পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসির কাজমি, আহমেফ রহি প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাহিত্যচর্চায় তার বিশেষ খ্যাতি হয়। তিনি একজন বেতার লিপি লেখক ও সাংবাদিকও ছিলেন। তার ছোটগল্পের সংকলন Kingdom’s end and other stories, একটি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত স্কেচের দুটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। বোম্বাই চলচ্চিত্র জগত অর্থাৎ বলিউডে মান্টোর অজস্র কাজ রয়েছে। বহু সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির চিত্রাভিনেতা ও পরিচালকদের কাছে মান্টোর কদর ছিল। আট দিন, চল চলরে নওজোয়ান, মির্জা গালিব ইত্যাদি সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটিং তার কৃতিত্ব।