‘দুঃখের মন্থন বেগে উঠিবে অমৃত’

পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথনে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

সুশীল সাহা

“সর্বখর্ব তারে দহে তব ক্রোধদাহ-

হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্তপানে চাহো ॥

দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র

মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ ॥

এই প্রতিবাদী গানটি রবীন্দ্রনাথের রচনা। বিপ্লবী যতীন দাসের অনশনে মৃত্যুসংবাদ পাবার পর সমাজনিষ্ঠ সচেতন কবির এই গানটি দেশবাসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল নিঃসন্দেহে। ১৯২৯ সালের ১৪ জুন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী হিসেবে যতীন দাসকে গ্রেপ্তার করে লাহোর জেলে পাঠানো হয়। রাজবন্দিদের ওপর পীড়ন অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তাঁর এই ঐতিহাসিক অনশন শুরু করেন। এই সময় তাঁকে বহুবার জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা হয়। খাদ্য ভুলপথে শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করায় তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। ২৫ বছরের এই যুবকের এমন অকালমৃত্যুকে (১৩. ৯. ১৯২৯) হত্যা বলেই মনে করেছিলেন তখনকার মানুষেরা। তাঁর মরদেহ কলকাতায় আনা হলে স্মরণকালের মধ্যে এক বৃহত্তম শোকযাত্রা হয় ১৭ সেপ্টেম্বর।

রবীন্দ্রনাথের মত বজ্রনির্ঘোষে নিজের কণ্ঠস্বরকে আগুনঝরা লেখায় রূপান্তরিত করেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরোজ দত্তের মৃত্যুতে। ১৯৭১-এর সেই দুঃসময়ের সাক্ষী হয়ে আছে এই কবিতা। সময়ের চাকা ঘোরে তার নিজস্ব নিয়মে, কিন্তু কবির অমোঘ বাণী অমর হয়ে থাকে।

“যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে

সেই সব কালের জল্লাদ

তোমাকে পশুর মত বধ করে আহ্লাদিত?

নাকি স্বদেশের নিরাপত্তা চায় কবির হৃৎপিণ্ড?

তবে শান্তি! কার শান্তি? হাজার কুকুর ঘোরে

দুর্ভিক্ষের নবাবী বাংলায়

গান গায় দরবারী কানাড়া, লেখে পোশাকি কবিতা।

তুমি মৃত! কতদিন কবিতা লেখনি! বহুদিন

পরিচ্ছন্ন পোশাক পরনি, ঘুরেছ উন্মাদ হয়ে

উলঙ্গের, নিরন্নের দেশে- তাই মৃত- তুমি পোশাক ছেড়েছ তার

অপরাধ...”

(১০ ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

ঠিক এইভাবেই পাবলো নেরুদার মত মহান কবি ব্যক্ত করেন তাঁর মর্মবেদনা, ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে লোরকার হত্যাকাণ্ডে।

“যদি পারতাম কোনো একা বাড়িতে ভয়ে কেঁদে উঠতে,

যদি পারতাম আমার চোখ দুটোকে উপড়ে ফেলে গিলে ফেলতে,

আমি তাহলে তা-ই করতাম, আর্ত কমলাগাছের মতো

তোমার কণ্ঠস্বরের জন্যে

আর তোমার কবিতার জন্যে যা উঠে আসে তা শুধু চিৎকারেরই উচ্চারণ।”

(ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার উদ্দেশে ওড, দীর্ঘ কবিতার প্রথমাংশ, অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই হত্যাকাণ্ড নেরুদাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, একসময় তিনি রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। অথচ তাঁর মানবিক মূল্যবোধ বন্ধু লোরকার এই নৃশংসভাবে নিহত হবার প্রেক্ষিতে তাঁকে ফ্যাসিস্টবিরোধী করে তোলে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনগুলোতে তিনি এইভাবেই ফ্যাসিবাদের ঘোষিত শত্রু হয়ে ওঠেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই ফ্যাসিবিরোধী মনোভাবের সূত্রেই তিনি একজন কমিউনিস্ট হন। তাই লোরকার হত্যাকাণ্ড পাবলো নেরুদার জীবনে একটি চূড়ান্ত বাঁকবদলের ভূমিকা নিয়েছিল।

নেরুদার অকৃত্রিম বন্ধু লোরকা ছিলেন একজন প্রকৃত কবি ও নাট্যকার। তিনি তাঁর আবেগের গহীন থেকে চয়ন করতেন অনুভব ও উপলব্ধির মণিমাণিক্য, এবং তা তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে ছড়িয়ে দিতেন দেশ ও মানুষের উন্মুখর ডালিতে। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে এক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন,

“সব সময় আমার মধ্যে জ্বলছে ভালবাসার আগুন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করার আশা আমি মনে পুষে রাখি আর আমার মাথার ওপর যত নিন্দা, ভয়, ঘৃণার ভার চাপানো হয় তত আমার চোখের সামনে এক কৃষকের হাসি ভেসে ওঠে, বৃষ্টির ধারার মত সুন্দর যে হাসি, এ একেবারেই আমার জন্যই।”

এই লোরকা ছিলেন স্পেনের জেগে ওঠার মন্ত্রদাতা। জীবৎকালে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন তিনি যে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে উৎসাহী জনতা তাঁকে অভিনন্দিত করত। এমন মান্যতা কিন্তু খুব কম কবিরই ভাগ্যে জোটে। লোরকা তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, তরবারি যেমন হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করতে পারে তেমন কবিতা এখনও লেখা হয়নি। অর্থাৎ তিনি কবিতাকে অস্ত্রের মত আরও শাণিত করতে চেয়েছিলেন। এই মনোভঙ্গি নেরুদাকে ভাবিয়েছিল, তাঁর চিত্তে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে লোরকার

ভূমিকা তাই অপরিসীম। তাই তো তাঁর স্মৃতিকথনে লোরকা জীবন্ত হয়ে ওঠেন,

“১৯শে জুলাই। ১৯৩৬। সমস্ত ঘটনার সূচনাবিন্দু ছিল এটি আমার জন্য।... সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু লোরকার দেখা নেই। সে যে মৃত্যুর পথে এ কথা জানতে পরিনি তখন। এরপর ওঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার। স্পেনের সেই যুদ্ধ এইভাবে আমাদের একজন কবির নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধই আমার কবিতাকে পুড়িয়ে ঝলসিয়ে পাল্টে দেয়। লোরকার তুলনা লোরকা নিজেই। কী প্রচণ্ড এক লেখক! প্রাণশক্তি ও প্রতিভা তাঁর মধ্যে একসঙ্গে মিশ খেয়েছে। আকাশের রোদ ছুঁয়ে-আসা ডানার মত সহজ তার বেগ, আর পাহাড়ী জলের স্ফটিক স্বচ্ছতা- এই দুইদিক এমন ঘনিষ্ঠভাবে জোট বাঁধতে আর কোথাও দেখিনি। আনন্দ ছিল তাঁর ভেতরে, চুম্বকের মত। একদিকে হাতখোলা, রসিক, বাস্তবতাবোধ সম্পন্ন, এক অদ্ভুত শিল্পীসত্তা। অন্যদিকে, কুসংস্কার, নিরাপত্তাহীনতা, এগুলিও তাঁর মধ্যে ছিল। মূকাভিনয় ব্যাপারটিও সে ভালো পারত। অত্যন্ত উঁচু মাপের মানুষ ছিল সে। তার কথা মনে রেখেই মানুষ স্পেনকে শ্রদ্ধা করেছে। ঐতিহ্যের কদর করেছে। ওর নিজের শেকড়ের সন্ধান করলে হয়ত দেখা যাবে সে আরব-আন্দালুসীয় এলাকার লোক। অসাধারণ একটি প্রতিভার বিকাশের সঙ্গে একটি ফুলের ফুটে ওঠার সাদৃশ্য আছে। সেই ফুলটির সমস্ত সুঘ্রাণ আর আলো সে স্পেনকে দিয়ে যায়। কিন্তু স্পেন তা রাখতে পারেনি।” নেরুদা আরো লিখেছেন, “ভিড়ের মধ্যে, শব্দহীন পরিবেশে, ছোটবড় সব ধরনের পরিবেশে তার অস্তিত্ব ঝিলিক মেরে উঠত। তাঁর দুই হাতে যে অসাধারণ ক্ষমতা, তেমন আর দেখিনি। এখনো তাঁর মত এক ভাইকে আমি পাইনি যার কাছে প্রাণখোলা হাসি এত প্রিয় ছিল। সে হাসত। গাইত। পিয়ানো বাজাত, নেচে, আবিষ্কার করে বেড়াত। কবিতার ভাঁড়ারে সে একা যে রসদ জুগিয়েছে, তার তুলনা চলে না। শব্দের সোনাকে আকর থেকে ছেনে, কঠিন শ্রমে কবিতার প্রতিমাকে তৈরি করেছে সে। অথচ তার অসামান্য প্রতিভা কখনো যে সে বরবাদও করেনি, তা নয়।” (অনুবাদ : আনন্দময়ী মজুমদার)

তাই তো নেরুদার সেই দীর্ঘ কবিতার শেষ হয় লোরকার প্রতি অসীম শ্রদ্ধায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে নুতন প্রাণ দাও হে’, তেমনি নেরুদা লেখেন- “ফেদেরিকো,/ দ্যাখো তাকিয়ে জগৎকে, রাস্তাঘাটগুলো।/ আঙুরলতা/ স্টেশনে- স্টেশনে বিদায়/ যখন ধোঁয়া তুলে দেয় তার সিদ্ধান্তের সব চাকা/ সেইখানটার উদ্দেশে যেখানে শুধু আছে/ পাথর, রেললাইন, বিচ্ছেদ/ সবখানে শুধোয়/ এত লোক/ রক্তাক্ত অন্ধ মানুষ আর রাগি মানুষ আর হতাশ মানুষ,/ আর হাভাতে ও হাঘরেরা, কাঁটাওয়ালা গাছ,/ পিঠে হিংসে নিয়ে যত বান্দোলেরা।/ জীবন এইরকমই, ফেদারিকো-/ এইই সব/ যা বিষণœ কোনো পুরুষমানুষ তোমায় দিতে পারে।/ এর মধ্যেই তুমি নিজে- নিজেই শিখে ফেলেছো কতকিছু,/ আর বাকি সবকিছুও তুমি শিখে ফেলবে আস্তে আস্তে/ যত দিন যাবে।” (প্রাগুক্ত কবিতার শেষাংশ, অনুবাদ- মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই দীর্ঘ কবিতাটির মধ্য দিয়েই পাবলো নেরুদা লোরকার প্রতি তাঁর সমস্ত শ্রদ্ধা এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন তা শুধু একটি শোকগাথা হয়েই থাকেনি, হয়েছে একজন আপোসহীন সংগ্রামী মানুষের প্রতি অকুতোভয় অপর একজনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ছত্রে ছত্রে যে বীরগাথা ব্যক্ত হয়েছে তা শুধু লোরকাকেই মহিমান্বিত করেনি, নেরুদাকেও বসিয়েছে এক পরম আদরণীয় জায়গায়। তাই তো নেরুদার স্মৃতিকথনের স্বল্প পরিসরে লোরকা আমাদের কাছে চিরভাস্বর হয়ে উঠেছেন। নেরুদা লিখছেন,

“লোরকার মৃত্যুর বহু বছর পর তাঁর ওপর একটি সভা হয়। এক শ্রোতা সেখানে আমাকে প্রশ্ন করেন ‘ওজে এ গার্সিয়া লোরকা’-এ আপনি লিখেছেন তাঁর জন্য হাসপাতালগুলি পর্যন্ত নীল রঙ করা হয়। এর অর্থ একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

প্রশ্নের জবাবে আমি বলি, ‘এ ধরনের প্রশ্ন কবিদের করা অনেকটা মেয়েদের বয়েস জিজ্ঞেস করার মত। আমি মনে করি কবিতা বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত। তাকে হাতের মুঠোয় ধরতে যাওয়াই অর্থহীন। এমনকি কবির নিজের আঙুল গলেও সে রুপোর জলের মত বেরিয়ে যায়। কবিতার গাঁথনির ভেতর কিছু শক্ত মাটি আছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে রঙধনুর মত অছোঁয়া কিছুও আছে। যাকে বাস্তবে চিহ্নিত করা দুরূহ। তবুও যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। রং হিশেবে নীলকে আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। নীল বলতে আমি আনন্দের পেখমমেলা এল অবারিত আকাশ বুঝি। ফেদেরিকোর জ্বলজ্বলে উপস্থিতি এমনই এক বাঁধনভাঙা আনন্দের কথা মনে করিয়ে দিত। হয়ত ওই কথার মধ্যে আমি বোঝাতে চেয়েছি হাসপাতালের সমগ্র অসুস্থতাকেও তার উপস্থিতি এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারত।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লোরকা সে-সম্পর্কে এক পূর্ব-ইঙ্গিত পেয়েছিল। একবার এক নাটকের দলের সঙ্গে ঘুরে এসে সে আমাকে ফোন করে এক অদ্ভুত ঘটনার কথা জানায়। তাদের সঙ্গে সে কান্টিলের এক পাড়াগাঁয়ে গিয়ে পৌঁছয়। ভোরে সে একা ঘুরে বেড়ানোর জন্যে বের হয়। কান্টিলের শীত মারাত্মক। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে সব কিছু ধোঁয়াটে ও অবাস্তব দেখায়।

একটি নোনাধরা লোহার আগড়। ছাঁদলা-পড়া পাতার মধ্যে ভেঙ্গে ক্ষয়ে যাওয়া মূর্তি আর স্তম্ভ। এক জমিদারী বর্গার ফটকের কাছে উপস্থিত হয় সে। হাহাকার ছাড়ে নৈঃশব্দ্য। একটি শিরশিরে ভাব হয় তার। মনে হতে থাকে এই মুহূর্তে যেন কিছু ঘটবে। একটি ভাঙা থাম পেয়ে লোরকা সেখানে বসে পড়ে। সেই অন্ধকারের কোটর থেকে এক ঝলক রোদের মতন একটি ছোট ভেড়ার বাচ্চা এসে ধ্বংসস্তূপের আগাছার দিকে এগিয়ে আসে। একটু পরে চার বা পাঁচটি আধা উন্মাদ বুনো শুয়োর সেই একই জায়গায় ছুটে আসে। তাদের দাঁত দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। পায়ের খুর পাথরের মত শক্ত। তারা ভেড়ার বাচ্চাটির ওপর হামলে পড়ে এবং দেখতে-না-দেখতে তাকে রক্ত-জল-করা বন্যতায় টুকরো টুকরো করে ফেলে।

এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পর লোরকা তার দল নিয়ে সেই জায়গা থেকে সরে পড়ে। গৃহযুদ্ধ বাধার তিন মাস আগে সে আমাকে এই ঘটনাটা জানায়। পরে মনে হয়েছে ঘটনাটি তাঁর নিজেরই পাশবিক হত্যাকাে র একটি পূর্ব ইঙ্গিত মাত্র।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে শুধুমাত্র গুলি করেই শেষ করা হয়নি, দস্তুরমত কষাই-এর হাতে খুন করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যু বলতে একটি জঘন্য হত্যাকা বোঝাবে, এ কথা বোধহয় কেউ ভাবেনি পর্যন্ত। তাঁর মতন ক’জন কবি মানুষের কাছ থেকে এমন শ্রদ্ধা আর ভালবাসা পেয়েছেন, আমি জানি না। তাঁর রক্তেই আনন্দ বহমান ছিল। অসাধারণ এক কিশোর বাস করত এই বিশাল মানুষটির মধ্যে। কেউ জানত কি, তাঁর স্বদেশ গ্রানাদায় এমন নরঘাতক আছে, যারা তাঁকে দেশের মাটিতেই শেষ করে দিতে পারে?

গৃহযুদ্ধের সময়টা আমাদের কেটেছে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে। শুধুমাত্র লড়াই নয়, আমরা যা করেছি তাকে সংগ্রাম বলাই সঙ্গত হবে। এর মধ্যে ফেদারিকোর মৃত্যুই আমাকে ঘা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। স্পেনে বহুদিন গ্ল্যাডিয়েটর ছিল। এ মাটি অনেক রক্ত খেয়েছে। স্পেন বারবার রক্তের বীভৎসতাকে উত্তেজক পানীয়র মত মানুষকে খাইয়েছে। তার প্রমাণ স্পেনের প্রাচীন ষাঁড়ের লড়াই।”

(অনুবাদ- আনন্দময়ী মজুমদার)

স্পেনের গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৯৩৯) ছিল প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র আর সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র, সমরবাদ ও স্বৈরাচারী শক্তির যুদ্ধ, যাতে শেষপর্যন্ত হিটলারের মদদপুষ্ট জেনারেল ফ্র্যাংকো জয়লাভ করে স্পেনে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র স্থাপন করেন। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে ‘সভ্যতার সংকট’। এরমাত্র কয়েক বছর আগে অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে স্পেনে কবিতার এক মনোরম উদ্যান রচিত হয়েছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের ভহাবহ উত্তাপে অকালে ঝরে গেল অর্ধমুকুলিত বহু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর প্রাণ। সমগ্র স্পেন সহসা হয়ে উঠেছিল এক ভয়ঙ্কর বধ্যভূমি। কোথায় আলো? কোথায় মুক্ত বাতাস? শুধু শাসকের রক্তচক্ষু আর সেন্সর। অন্ধকারে বুলেটের শব্দ, উদ্যত বেয়নেট আর রক্তাক্ত বিষণœ স্বদেশ। এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন মধ্য বিংশ শতকের স্পেনীয় সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। আর তাঁরই স্মৃতিচারণে স্বদেশের আর এক বিশ্ববিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা নিবেদন করেছেন এক চিরন্তন শোকাঞ্জলি।

“প্রতিভা আর মাধুর্যের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি। ডানাখোলা মুক্ত হৃদয় আর স্বচ্ছ স্ফটিক জলপ্রপাতের এমন যোগাযোগও দেখিনি। তাঁর আনন্দোচ্ছল লেখনী ছিল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, যা অন্যকেও আকর্ষণ করত। দিলখোলা আনন্দমুখর মানুষ ছিলেন তিনি। সততাই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আরব আর আন্দালুসিয়ান শিকড় থেকে জেগে ওঠা জুঁই ফুলের গন্ধে সারা স্পেনকে মাতিয়ে দিয়ে তিনি চিরতরে চলে গেলেন। তাঁর সমস্ত কবিতাই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। মাঝে মাঝে আমার সাম্প্রতিক কবিতা পরে শোনাবার সময় তিনি চিৎকার করে উঠতেন, ‘থামো, থামো, দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ছি আমি।’

হায় হতভাগ্য বন্ধু আমার। এই পৃথিবীর জন্যে তুমি গান গাইলে, লাফালে, নাচলে, পিয়ানো বাজালে- জীবনের উজ্জ্বলতা দিয়ে স্বপ্ন গড়ে তুললে- কৃতি শিল্পীর মত মণিমুক্তার কারুকার্যে ঝলমলে হীরকসদৃশ তোমার কবিতাসমূহ রেখে গেলে।”

(অনুবাদ- গৌরীশংকর দে)

এই স্মৃতিকথনের রেশ ধরে আমরা যেমন লোরকার এক স্বচ্ছ পরিচয়ে ঋদ্ধ হই, তেমনি তাঁর প্রকৃত এক উত্তরাধিকারের সন্ধান পেয়ে আলোকিত হই। বুদ্ধদেব কথিত- “আত্মদীপো ভব” মুহূর্তে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে যায়। সেই সব দীপ যা এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরতে থাকে। আলোকিত করে তোলে আমাদের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, প্রাণিত করে তোলে মৃতপ্রায় জীবনকে।

পাবলো নেরুদার স্মৃতিসরণি ধরে আমাদের লোরকা স্মরণ কিন্তু মৃত্যুত্তীর্ণ এক জীবনগাথা ছাড়া আর কিছু নয়। শুরুতে রবীন্দ্রনাথের গানের যে অনুষঙ্গ, তারই রেশ ধরে ওই গানের বাকি চারটি চরণ উদ্ধৃত করছি।

“দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত

শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।

তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে

প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ।”

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

‘দুঃখের মন্থন বেগে উঠিবে অমৃত’

পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথনে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

সুশীল সাহা

image

“সর্বখর্ব তারে দহে তব ক্রোধদাহ-

হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্তপানে চাহো ॥

দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র

মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ ॥

এই প্রতিবাদী গানটি রবীন্দ্রনাথের রচনা। বিপ্লবী যতীন দাসের অনশনে মৃত্যুসংবাদ পাবার পর সমাজনিষ্ঠ সচেতন কবির এই গানটি দেশবাসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল নিঃসন্দেহে। ১৯২৯ সালের ১৪ জুন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী হিসেবে যতীন দাসকে গ্রেপ্তার করে লাহোর জেলে পাঠানো হয়। রাজবন্দিদের ওপর পীড়ন অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তাঁর এই ঐতিহাসিক অনশন শুরু করেন। এই সময় তাঁকে বহুবার জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা হয়। খাদ্য ভুলপথে শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করায় তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। ২৫ বছরের এই যুবকের এমন অকালমৃত্যুকে (১৩. ৯. ১৯২৯) হত্যা বলেই মনে করেছিলেন তখনকার মানুষেরা। তাঁর মরদেহ কলকাতায় আনা হলে স্মরণকালের মধ্যে এক বৃহত্তম শোকযাত্রা হয় ১৭ সেপ্টেম্বর।

রবীন্দ্রনাথের মত বজ্রনির্ঘোষে নিজের কণ্ঠস্বরকে আগুনঝরা লেখায় রূপান্তরিত করেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরোজ দত্তের মৃত্যুতে। ১৯৭১-এর সেই দুঃসময়ের সাক্ষী হয়ে আছে এই কবিতা। সময়ের চাকা ঘোরে তার নিজস্ব নিয়মে, কিন্তু কবির অমোঘ বাণী অমর হয়ে থাকে।

“যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে

সেই সব কালের জল্লাদ

তোমাকে পশুর মত বধ করে আহ্লাদিত?

নাকি স্বদেশের নিরাপত্তা চায় কবির হৃৎপিণ্ড?

তবে শান্তি! কার শান্তি? হাজার কুকুর ঘোরে

দুর্ভিক্ষের নবাবী বাংলায়

গান গায় দরবারী কানাড়া, লেখে পোশাকি কবিতা।

তুমি মৃত! কতদিন কবিতা লেখনি! বহুদিন

পরিচ্ছন্ন পোশাক পরনি, ঘুরেছ উন্মাদ হয়ে

উলঙ্গের, নিরন্নের দেশে- তাই মৃত- তুমি পোশাক ছেড়েছ তার

অপরাধ...”

(১০ ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

ঠিক এইভাবেই পাবলো নেরুদার মত মহান কবি ব্যক্ত করেন তাঁর মর্মবেদনা, ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে লোরকার হত্যাকাণ্ডে।

“যদি পারতাম কোনো একা বাড়িতে ভয়ে কেঁদে উঠতে,

যদি পারতাম আমার চোখ দুটোকে উপড়ে ফেলে গিলে ফেলতে,

আমি তাহলে তা-ই করতাম, আর্ত কমলাগাছের মতো

তোমার কণ্ঠস্বরের জন্যে

আর তোমার কবিতার জন্যে যা উঠে আসে তা শুধু চিৎকারেরই উচ্চারণ।”

(ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার উদ্দেশে ওড, দীর্ঘ কবিতার প্রথমাংশ, অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই হত্যাকাণ্ড নেরুদাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, একসময় তিনি রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। অথচ তাঁর মানবিক মূল্যবোধ বন্ধু লোরকার এই নৃশংসভাবে নিহত হবার প্রেক্ষিতে তাঁকে ফ্যাসিস্টবিরোধী করে তোলে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনগুলোতে তিনি এইভাবেই ফ্যাসিবাদের ঘোষিত শত্রু হয়ে ওঠেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই ফ্যাসিবিরোধী মনোভাবের সূত্রেই তিনি একজন কমিউনিস্ট হন। তাই লোরকার হত্যাকাণ্ড পাবলো নেরুদার জীবনে একটি চূড়ান্ত বাঁকবদলের ভূমিকা নিয়েছিল।

নেরুদার অকৃত্রিম বন্ধু লোরকা ছিলেন একজন প্রকৃত কবি ও নাট্যকার। তিনি তাঁর আবেগের গহীন থেকে চয়ন করতেন অনুভব ও উপলব্ধির মণিমাণিক্য, এবং তা তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে ছড়িয়ে দিতেন দেশ ও মানুষের উন্মুখর ডালিতে। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে এক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন,

“সব সময় আমার মধ্যে জ্বলছে ভালবাসার আগুন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করার আশা আমি মনে পুষে রাখি আর আমার মাথার ওপর যত নিন্দা, ভয়, ঘৃণার ভার চাপানো হয় তত আমার চোখের সামনে এক কৃষকের হাসি ভেসে ওঠে, বৃষ্টির ধারার মত সুন্দর যে হাসি, এ একেবারেই আমার জন্যই।”

এই লোরকা ছিলেন স্পেনের জেগে ওঠার মন্ত্রদাতা। জীবৎকালে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন তিনি যে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে উৎসাহী জনতা তাঁকে অভিনন্দিত করত। এমন মান্যতা কিন্তু খুব কম কবিরই ভাগ্যে জোটে। লোরকা তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, তরবারি যেমন হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করতে পারে তেমন কবিতা এখনও লেখা হয়নি। অর্থাৎ তিনি কবিতাকে অস্ত্রের মত আরও শাণিত করতে চেয়েছিলেন। এই মনোভঙ্গি নেরুদাকে ভাবিয়েছিল, তাঁর চিত্তে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে লোরকার

ভূমিকা তাই অপরিসীম। তাই তো তাঁর স্মৃতিকথনে লোরকা জীবন্ত হয়ে ওঠেন,

“১৯শে জুলাই। ১৯৩৬। সমস্ত ঘটনার সূচনাবিন্দু ছিল এটি আমার জন্য।... সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু লোরকার দেখা নেই। সে যে মৃত্যুর পথে এ কথা জানতে পরিনি তখন। এরপর ওঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার। স্পেনের সেই যুদ্ধ এইভাবে আমাদের একজন কবির নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধই আমার কবিতাকে পুড়িয়ে ঝলসিয়ে পাল্টে দেয়। লোরকার তুলনা লোরকা নিজেই। কী প্রচণ্ড এক লেখক! প্রাণশক্তি ও প্রতিভা তাঁর মধ্যে একসঙ্গে মিশ খেয়েছে। আকাশের রোদ ছুঁয়ে-আসা ডানার মত সহজ তার বেগ, আর পাহাড়ী জলের স্ফটিক স্বচ্ছতা- এই দুইদিক এমন ঘনিষ্ঠভাবে জোট বাঁধতে আর কোথাও দেখিনি। আনন্দ ছিল তাঁর ভেতরে, চুম্বকের মত। একদিকে হাতখোলা, রসিক, বাস্তবতাবোধ সম্পন্ন, এক অদ্ভুত শিল্পীসত্তা। অন্যদিকে, কুসংস্কার, নিরাপত্তাহীনতা, এগুলিও তাঁর মধ্যে ছিল। মূকাভিনয় ব্যাপারটিও সে ভালো পারত। অত্যন্ত উঁচু মাপের মানুষ ছিল সে। তার কথা মনে রেখেই মানুষ স্পেনকে শ্রদ্ধা করেছে। ঐতিহ্যের কদর করেছে। ওর নিজের শেকড়ের সন্ধান করলে হয়ত দেখা যাবে সে আরব-আন্দালুসীয় এলাকার লোক। অসাধারণ একটি প্রতিভার বিকাশের সঙ্গে একটি ফুলের ফুটে ওঠার সাদৃশ্য আছে। সেই ফুলটির সমস্ত সুঘ্রাণ আর আলো সে স্পেনকে দিয়ে যায়। কিন্তু স্পেন তা রাখতে পারেনি।” নেরুদা আরো লিখেছেন, “ভিড়ের মধ্যে, শব্দহীন পরিবেশে, ছোটবড় সব ধরনের পরিবেশে তার অস্তিত্ব ঝিলিক মেরে উঠত। তাঁর দুই হাতে যে অসাধারণ ক্ষমতা, তেমন আর দেখিনি। এখনো তাঁর মত এক ভাইকে আমি পাইনি যার কাছে প্রাণখোলা হাসি এত প্রিয় ছিল। সে হাসত। গাইত। পিয়ানো বাজাত, নেচে, আবিষ্কার করে বেড়াত। কবিতার ভাঁড়ারে সে একা যে রসদ জুগিয়েছে, তার তুলনা চলে না। শব্দের সোনাকে আকর থেকে ছেনে, কঠিন শ্রমে কবিতার প্রতিমাকে তৈরি করেছে সে। অথচ তার অসামান্য প্রতিভা কখনো যে সে বরবাদও করেনি, তা নয়।” (অনুবাদ : আনন্দময়ী মজুমদার)

তাই তো নেরুদার সেই দীর্ঘ কবিতার শেষ হয় লোরকার প্রতি অসীম শ্রদ্ধায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে নুতন প্রাণ দাও হে’, তেমনি নেরুদা লেখেন- “ফেদেরিকো,/ দ্যাখো তাকিয়ে জগৎকে, রাস্তাঘাটগুলো।/ আঙুরলতা/ স্টেশনে- স্টেশনে বিদায়/ যখন ধোঁয়া তুলে দেয় তার সিদ্ধান্তের সব চাকা/ সেইখানটার উদ্দেশে যেখানে শুধু আছে/ পাথর, রেললাইন, বিচ্ছেদ/ সবখানে শুধোয়/ এত লোক/ রক্তাক্ত অন্ধ মানুষ আর রাগি মানুষ আর হতাশ মানুষ,/ আর হাভাতে ও হাঘরেরা, কাঁটাওয়ালা গাছ,/ পিঠে হিংসে নিয়ে যত বান্দোলেরা।/ জীবন এইরকমই, ফেদারিকো-/ এইই সব/ যা বিষণœ কোনো পুরুষমানুষ তোমায় দিতে পারে।/ এর মধ্যেই তুমি নিজে- নিজেই শিখে ফেলেছো কতকিছু,/ আর বাকি সবকিছুও তুমি শিখে ফেলবে আস্তে আস্তে/ যত দিন যাবে।” (প্রাগুক্ত কবিতার শেষাংশ, অনুবাদ- মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)

এই দীর্ঘ কবিতাটির মধ্য দিয়েই পাবলো নেরুদা লোরকার প্রতি তাঁর সমস্ত শ্রদ্ধা এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন তা শুধু একটি শোকগাথা হয়েই থাকেনি, হয়েছে একজন আপোসহীন সংগ্রামী মানুষের প্রতি অকুতোভয় অপর একজনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ছত্রে ছত্রে যে বীরগাথা ব্যক্ত হয়েছে তা শুধু লোরকাকেই মহিমান্বিত করেনি, নেরুদাকেও বসিয়েছে এক পরম আদরণীয় জায়গায়। তাই তো নেরুদার স্মৃতিকথনের স্বল্প পরিসরে লোরকা আমাদের কাছে চিরভাস্বর হয়ে উঠেছেন। নেরুদা লিখছেন,

“লোরকার মৃত্যুর বহু বছর পর তাঁর ওপর একটি সভা হয়। এক শ্রোতা সেখানে আমাকে প্রশ্ন করেন ‘ওজে এ গার্সিয়া লোরকা’-এ আপনি লিখেছেন তাঁর জন্য হাসপাতালগুলি পর্যন্ত নীল রঙ করা হয়। এর অর্থ একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

প্রশ্নের জবাবে আমি বলি, ‘এ ধরনের প্রশ্ন কবিদের করা অনেকটা মেয়েদের বয়েস জিজ্ঞেস করার মত। আমি মনে করি কবিতা বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত। তাকে হাতের মুঠোয় ধরতে যাওয়াই অর্থহীন। এমনকি কবির নিজের আঙুল গলেও সে রুপোর জলের মত বেরিয়ে যায়। কবিতার গাঁথনির ভেতর কিছু শক্ত মাটি আছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে রঙধনুর মত অছোঁয়া কিছুও আছে। যাকে বাস্তবে চিহ্নিত করা দুরূহ। তবুও যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। রং হিশেবে নীলকে আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। নীল বলতে আমি আনন্দের পেখমমেলা এল অবারিত আকাশ বুঝি। ফেদেরিকোর জ্বলজ্বলে উপস্থিতি এমনই এক বাঁধনভাঙা আনন্দের কথা মনে করিয়ে দিত। হয়ত ওই কথার মধ্যে আমি বোঝাতে চেয়েছি হাসপাতালের সমগ্র অসুস্থতাকেও তার উপস্থিতি এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারত।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লোরকা সে-সম্পর্কে এক পূর্ব-ইঙ্গিত পেয়েছিল। একবার এক নাটকের দলের সঙ্গে ঘুরে এসে সে আমাকে ফোন করে এক অদ্ভুত ঘটনার কথা জানায়। তাদের সঙ্গে সে কান্টিলের এক পাড়াগাঁয়ে গিয়ে পৌঁছয়। ভোরে সে একা ঘুরে বেড়ানোর জন্যে বের হয়। কান্টিলের শীত মারাত্মক। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে সব কিছু ধোঁয়াটে ও অবাস্তব দেখায়।

একটি নোনাধরা লোহার আগড়। ছাঁদলা-পড়া পাতার মধ্যে ভেঙ্গে ক্ষয়ে যাওয়া মূর্তি আর স্তম্ভ। এক জমিদারী বর্গার ফটকের কাছে উপস্থিত হয় সে। হাহাকার ছাড়ে নৈঃশব্দ্য। একটি শিরশিরে ভাব হয় তার। মনে হতে থাকে এই মুহূর্তে যেন কিছু ঘটবে। একটি ভাঙা থাম পেয়ে লোরকা সেখানে বসে পড়ে। সেই অন্ধকারের কোটর থেকে এক ঝলক রোদের মতন একটি ছোট ভেড়ার বাচ্চা এসে ধ্বংসস্তূপের আগাছার দিকে এগিয়ে আসে। একটু পরে চার বা পাঁচটি আধা উন্মাদ বুনো শুয়োর সেই একই জায়গায় ছুটে আসে। তাদের দাঁত দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। পায়ের খুর পাথরের মত শক্ত। তারা ভেড়ার বাচ্চাটির ওপর হামলে পড়ে এবং দেখতে-না-দেখতে তাকে রক্ত-জল-করা বন্যতায় টুকরো টুকরো করে ফেলে।

এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পর লোরকা তার দল নিয়ে সেই জায়গা থেকে সরে পড়ে। গৃহযুদ্ধ বাধার তিন মাস আগে সে আমাকে এই ঘটনাটা জানায়। পরে মনে হয়েছে ঘটনাটি তাঁর নিজেরই পাশবিক হত্যাকাে র একটি পূর্ব ইঙ্গিত মাত্র।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে শুধুমাত্র গুলি করেই শেষ করা হয়নি, দস্তুরমত কষাই-এর হাতে খুন করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যু বলতে একটি জঘন্য হত্যাকা বোঝাবে, এ কথা বোধহয় কেউ ভাবেনি পর্যন্ত। তাঁর মতন ক’জন কবি মানুষের কাছ থেকে এমন শ্রদ্ধা আর ভালবাসা পেয়েছেন, আমি জানি না। তাঁর রক্তেই আনন্দ বহমান ছিল। অসাধারণ এক কিশোর বাস করত এই বিশাল মানুষটির মধ্যে। কেউ জানত কি, তাঁর স্বদেশ গ্রানাদায় এমন নরঘাতক আছে, যারা তাঁকে দেশের মাটিতেই শেষ করে দিতে পারে?

গৃহযুদ্ধের সময়টা আমাদের কেটেছে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে। শুধুমাত্র লড়াই নয়, আমরা যা করেছি তাকে সংগ্রাম বলাই সঙ্গত হবে। এর মধ্যে ফেদারিকোর মৃত্যুই আমাকে ঘা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। স্পেনে বহুদিন গ্ল্যাডিয়েটর ছিল। এ মাটি অনেক রক্ত খেয়েছে। স্পেন বারবার রক্তের বীভৎসতাকে উত্তেজক পানীয়র মত মানুষকে খাইয়েছে। তার প্রমাণ স্পেনের প্রাচীন ষাঁড়ের লড়াই।”

(অনুবাদ- আনন্দময়ী মজুমদার)

স্পেনের গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৯৩৯) ছিল প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র আর সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র, সমরবাদ ও স্বৈরাচারী শক্তির যুদ্ধ, যাতে শেষপর্যন্ত হিটলারের মদদপুষ্ট জেনারেল ফ্র্যাংকো জয়লাভ করে স্পেনে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র স্থাপন করেন। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে ‘সভ্যতার সংকট’। এরমাত্র কয়েক বছর আগে অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে স্পেনে কবিতার এক মনোরম উদ্যান রচিত হয়েছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের ভহাবহ উত্তাপে অকালে ঝরে গেল অর্ধমুকুলিত বহু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর প্রাণ। সমগ্র স্পেন সহসা হয়ে উঠেছিল এক ভয়ঙ্কর বধ্যভূমি। কোথায় আলো? কোথায় মুক্ত বাতাস? শুধু শাসকের রক্তচক্ষু আর সেন্সর। অন্ধকারে বুলেটের শব্দ, উদ্যত বেয়নেট আর রক্তাক্ত বিষণœ স্বদেশ। এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন মধ্য বিংশ শতকের স্পেনীয় সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। আর তাঁরই স্মৃতিচারণে স্বদেশের আর এক বিশ্ববিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা নিবেদন করেছেন এক চিরন্তন শোকাঞ্জলি।

“প্রতিভা আর মাধুর্যের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি। ডানাখোলা মুক্ত হৃদয় আর স্বচ্ছ স্ফটিক জলপ্রপাতের এমন যোগাযোগও দেখিনি। তাঁর আনন্দোচ্ছল লেখনী ছিল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, যা অন্যকেও আকর্ষণ করত। দিলখোলা আনন্দমুখর মানুষ ছিলেন তিনি। সততাই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আরব আর আন্দালুসিয়ান শিকড় থেকে জেগে ওঠা জুঁই ফুলের গন্ধে সারা স্পেনকে মাতিয়ে দিয়ে তিনি চিরতরে চলে গেলেন। তাঁর সমস্ত কবিতাই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। মাঝে মাঝে আমার সাম্প্রতিক কবিতা পরে শোনাবার সময় তিনি চিৎকার করে উঠতেন, ‘থামো, থামো, দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ছি আমি।’

হায় হতভাগ্য বন্ধু আমার। এই পৃথিবীর জন্যে তুমি গান গাইলে, লাফালে, নাচলে, পিয়ানো বাজালে- জীবনের উজ্জ্বলতা দিয়ে স্বপ্ন গড়ে তুললে- কৃতি শিল্পীর মত মণিমুক্তার কারুকার্যে ঝলমলে হীরকসদৃশ তোমার কবিতাসমূহ রেখে গেলে।”

(অনুবাদ- গৌরীশংকর দে)

এই স্মৃতিকথনের রেশ ধরে আমরা যেমন লোরকার এক স্বচ্ছ পরিচয়ে ঋদ্ধ হই, তেমনি তাঁর প্রকৃত এক উত্তরাধিকারের সন্ধান পেয়ে আলোকিত হই। বুদ্ধদেব কথিত- “আত্মদীপো ভব” মুহূর্তে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে যায়। সেই সব দীপ যা এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরতে থাকে। আলোকিত করে তোলে আমাদের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, প্রাণিত করে তোলে মৃতপ্রায় জীবনকে।

পাবলো নেরুদার স্মৃতিসরণি ধরে আমাদের লোরকা স্মরণ কিন্তু মৃত্যুত্তীর্ণ এক জীবনগাথা ছাড়া আর কিছু নয়। শুরুতে রবীন্দ্রনাথের গানের যে অনুষঙ্গ, তারই রেশ ধরে ওই গানের বাকি চারটি চরণ উদ্ধৃত করছি।

“দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত

শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।

তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে

প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ।”