প্রেরণায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

জোবায়ের মিলন

‘ভগবানের গুপ্তচর মৃতু এসে বাঁধুক ঘর

ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না’

(উৎসর্গপত্র, শ্রেষ্ঠ কবিতা)

কৈশোরেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের এমন উস্কানির জালে পড়েছিলোম কবিতা ভালোবেসে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে চিনেছিলাম কবিতার এই জহুরীকে। জেনেছিলাম কবিতার বাঁকে অভিনব, আধুনিক, উত্তরাধুনিক পথে তার বহুবাঁকের বহু কথা। তারপর কত সময় চলে গেছে সময়ের হাত ধরে তা আর হিসাবে টুকে রাখিনি। কাব্যপ্রেমে মাতাল হয়ে উঠেছি। ঘর থেকে বাহিরে হয়েছি। তার কবিতার মোহ মোড়িয়ে করেছে ছন্নছাড়া। ডান-বাঁম-সম্মুখ-পেছন ঘুরে ফিরে ফের ফিরে ফিরে এসেছি তার ঝোলার কাছে। করজোর করে চেয়েছি ভাবের, ভাষার বিশদ ব্যাখ্যা। রাতে আলো নিভিয়ে টেবিল-আলো জ্বেলে বইয়ের ভাঁজে পৃষ্ঠা রেখে পড়েছি তাকে, পাছে গৃহকর্তা বিছানা ছেড়ে পিঠে বসিয়ে দেয় কয়েক কিল! ভয় ধরেছে মনে, কেঁপেছে আঙুল, চোখ নড়েছে এদিক ওদিক। যদি ধরা খাই! সকালের খাবার বন্ধ। তবু সাহস উঠেছে উজানি কই হয়ে, মাথার ভেতর প্রবল ঘুরেছে, ‘ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর/ ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না’। পাঠ্যবই চুলায় গেছে, পরিচিত খাতা হারিয়েছে, কখন কোন্ মলাট গেছে ছিঁড়ে রাখিনি খোঁজ। এক কবিতার পর আরেক কবিতা; ঘোর লাগা সেইসব রাত-দিন।

‘জীবনানন্দ সভাঘরে

তোমায় ডেকেছি সমাদরে

তারপর ভিড় হতেই

দুজন বসেছি বারান্দায়

শুভেন্দু শোনো, এছাড়া আর আমাদের তীর্থ নেই।

(শুভেন্দু শোনো)

তীর্থ আর আসলে পাইনি। বয়স বেড়েছে, হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখ সময়ে সময়ে একূল ছেড়ে ওকূলে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে, ওকূল ছেড়ে একূলে এনে আছড়ে ফেলেছে; নানান ইশারা চেয়েছে আকৃষ্ট করতে, পুরোহিতের মতো ডেকেছে কাছে, যাওয়া হয়নি কোনো একটি কোলে। ‘কবিতা’ তীর্থস্থানে নত হয়ে নমচিত্তে অবলোকন করেছি সৌন্দর্য আর সুন্দরের বীজপত্র। তার দেখানো ভাবে, বর্ণে, কল্পনার অমিত রঙে নতুনের সন্ধানে হাঁটছি তো হাঁটছি, যদি আরেকটি নতুন বাঁক দেখা যায়। বহুযুগের ধারা পাল্টে যদি আরও একটি ধারা দাঁড় করা যায় সত্যের মতো সাবলীল পন্থায়। এ চেষ্টা তার শেখানো। পঞ্চদশকে শুরু করে আমৃত্যু সে পথের সন্ধানে তার আয়ু ব্যয়।

‘খুব সম্ভব মৃত্যুর মুখ থেকে

ফিরে এসে তাঁর খিদে পেয়েছিল খুব,

বললেন: ‘এসো, সেরে নিই প্রাতরাশ’,

সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যেরা জাল ফেলে

ধরল একশো তেপ্পান্নটা মাছ।

হ্রদের কিনারে কাঠকয়লার আঁচে

মাছ ভাজা হলো ভয়ানক পরিপাটি,

চেটেপুটে খেল নির্বাচিতেরা, আর

যারা ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না

এই রকমের হাজার পাঁচেক আরো।

সেন্ট জনের বিখ্যাত গসপেলে

শুনেছি এসব, বৃত্তিতে ছিল সেই

শিষ্যেরা জেলে, আর বিধাতার ছেলে,

তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়

মৃত্যু আমার নাকের ডগায় এলে।

(তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়)

তিনি চেয়েছেন খোলস পাল্টাতে। কবিতার যে খোলসের ভেতর আটকে গিয়েছিলো কাল, কবিতাকে খোলস বন্দি করে বয়ে নিয়ে চলছিলো পথিকেরা। ভেবেছিলো, বোতলের মুখে ছিপি আটকে রাখা যে কবিতা সেই কবিতা। তার বাহিরে ভিন্ন অন্য নেই। পথিকের ভাবনার এমন দৈন্যকে ভাঙ্গার প্রত্যয়ে পথে নেমেছিলেন তিনি একদল যুয়ানের সাথে, বসেছিলেন সাহসের নায়ে চড়ে। যা হবার তাই হবে। সাহস দুঃসহস হয়নি। পাল ছিঁড়ে পড়েনি স্রোতের ধারায়। যে বিপরীত থেকে যাত্রা সে বিপরীত- রীতি হয়ে ধরা দিলো কাব্য ধারায়। উন্মোচন হলো নবধারার। সে ধারার কোণ ধরে আবার কোণঠাসা হয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুরে নিজেই বদ হয়ে যাননি আত্ম-অহমে। খুঁজেছেন আরও নতুন পথ। আর সে অনুসন্ধিৎসু নাবিকের সন্ধান আর সৃষ্টির পয়ারে আমি যেন পাগলপ্রায়। পান করি তার এক একটি প্রসব। অমৃত মনে হয় তার ফলানো ফল, ফসলের মধুরস।

‘যেন এ অবুঝ তারুণ্য কারো চোখে না পড়ে

সারা চোখ মুখ ঢেকে রাখি শুধু কালো কাপড়ে

কেউ কেউ ভাবে আতঙ্কবাদী, শেষে যেই দ্যাখে

কোনো কিছু আর বদলে দিই না, ক্ষমা চেয়ে যায়;

এমন সময় যখনই বৃষ্টি আঙিনা ভেজায়

তোমার কাছেই আশ্রয় নিতে করেছি কামনা;

পৌঁছুতে গিয়ে আবার আরেক সতর্কপনা

যদি তুমি ভাবো তোমাকে চাইতে এসেছি আবার

সারাটা শরীর আবজিয়ে রাখি নীল ধুতুরায়। (নীল ধুতুরা)

নিভৃতব্রতী। শক্তি-শঙ্খ-সুনীল-বিনয়-আলোকের সহযাত্রী হয়েও সহপথ ধরে যাত্রা রাখেননি সমগতিতে। রিয়েলিটির পকেটে মূল্যের মুদ্রা রাখতে গিয়ে অ্যাবাসট্রাক্টকে কিছুটা ম্লান যে করেনি তা অস্বীকার করি কী করে। অধ্যাপনা তো সময় দখল করেনি কম! কেড়ে নেয়নি কবিতার মানসপুত্রের কম কয়েন। কম টেনে ধরেনি কাক্সিক্ষত আকাক্সক্ষার রাশ। সে রাশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে বের যে হননি তাও না। ভারত মাটির সাথে যোগ করেছেন জার্মান মাটি। জার্মান মাটির সাথে গেঁথেছেন ভারত মাটি। বাংলা কবিতা তার মুঠোতে পা রেখে হয়ে উঠেছে আবহমান বাংলার মহাকালীন চিত্রাঙ্ক। বিশ্বসাহিত্য ঘরে বিস্তুৃত হয়ে জানান দিয়েছেন কবিতার একক ভাষা নেই, কবিতা ভাষার পোশাক গায়ে দিয়ে কেবল ঘুরে বেড়ায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কাব্যচোখ যাদের, তারা কবিতাকে ধরতে পারে যে কোনো ভাষা থেকেই। কবিতা তো তার নিজের স্বর নিয়ে বিচরণ করে ইহজাগতিক অঙ্গনে; কেউ কেউ তা ধরতে পারে, কেউ কেউ তা ধরতে পারে না। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কবিতাকে ধরা এক কবি। তার কবিতা সে কথা বলে। স্বীকার করে, রবীন্দ্র পরবর্তী উত্তররৈবিক কালের তিনি উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। তার কবিতা আমার মাতৃভাষার আকম্প্র সীমারেখাকে সম্প্রসারিত করে দেয় এক ধাক্কায়। তাকে পাঠ করে তৃষ্ণা মিটে না। না পাঠ করা কী এক তৃষ্ণা আকণ্ঠ পোড়ায়। আমি পড়ে থাকি তার ভেতর। তার বাহির। তাকে দেখি, আরও দেখার ইচ্ছায়:

‘কারা যেন কালরাত্রে এসে

আমার এ প্রদীপের সলতে গেছে কেটে...

কী-করে জানাই তবে আমন্ত্রণ আলো উদ্দেশ্যে?’

(নিরাময়হীন এক ক্ষত)

আবার

‘সব-কিছু তার নিজের জায়গায় রইবে অটুক;

চিত্রদারুধেণু চরিয়ে গোঠে সুরদাসের আঁকা

বালককৃষ্ণ দাঁড়িয়ে থাকবেন;

আবহমান কৃষ্ণচূড়ার নিচে

বোষ্টমী তার গান গাইতে গিয়ে

কণ্ঠিবদল করবে থির বিজুরী

আগের মতো তোমার সঙ্গে!

তুমি নিজেই কি এক, ফিরে-আসার পরেও?’ (ফেরা)

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের উচ্ছ্বাস প্রকৃত বাউলের। তার খোঁজ প্রাজ্ঞ নির্জনতার। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী পাড় হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কূল আর প্রেসিডেন্সি কলেজ বারান্দার গ্রিল ছুঁয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠান মারিয়ে জার্মান হাইডেলবার্গের পরেও ¯পষ্ট এক আলোর হাতছানি তাকে পথে নামিয়েছে। হাঁটার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আর তিনি এখানে সংশয়াচ্ছন্ন নন, দক্ষ পথিক। এই পথটিকে তিনি সত্য জীবন মনে করেছেন। সমন্বয়ও করেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। দুটো আলাদা দেশ, মহাসময়ের বিরাট একটা প্রান্তর, ঈশ্বরচেতনা এবং মানবচেনতার দুই ভিন্ন অভিমুখ অন্য এক বোধের ধারা মিশে গেছে তার মধ্যে। ব্রেশট এবং চণ্ডীদাস এক সঙ্গে কথা বলেন তার বিশ্বে। কখনো কখনো হয়ত খ্রিস্টপূর্বাব্দের রচনার সঙ্গেই সঙ্গম করে তার অক্ষর, কথা।

‘সুগত, এ জন্মে আমি কেউ না তোমার।

আজ তবু সন্ধ্যায় যখন

জাতিস্মর জ্যোৎস্নার ঝালরে

তোমার হাসির মন্ত্র নীরব ঝর্ণায় ঝরে পড়ে,

আমারও নির্বেদ ঘিরে পূর্ণিমার তিলপর্ণিকার

অগুরু গন্ধের বৃষ্টি- মনে হল এখানে আবার

তোমার সময় থেকে বহুদূর শতাব্দীর তীরে

জয়শ্রীজীবন পাব ফিরে,

ফিরে পাব পরশরতন।’

(বুদ্ধপূর্ণিমার রাত্রে)

আমার কেবল মতে হতে থাকে, তার কবিতা অনেক অনেক ভিড়ের মধ্যে নিশ্চুপ কথা বলে বউলের উদাসীন মতো; কিন্তু আসক্ত, মায়াবী। তিনি পাওয়ার কথা বলেন অথচ না পাওয়াটাও প্রবল তার কাছে। না পাওয়ার মধ্য হতে আবার পাওয়ার ইচ্ছা প্রগাঢ়। যেন সমস্ত দৃশ্য রঙ, রূপ নিয়ে দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গের সাথে বসবাস তার। দারজা খোলে, দরজা পেছনে পড়ে, দরজা দেখা যায় অদূরে। এক খোলের পর আরেক খোল, আরেক খোলের পর আরেক খোল। কøান্ত হই না। শেষ সার দেখার ইচ্ছায় ছাড়ি না তাকে। অলোকের প্রেমে যে প্রেমিক সেজেছি, পরিণয়হীনে আর ছাড় নাই। আলিঙ্গন পরে আলিঙ্গন। তার পরমের সাথে মিশার নেশায় বুঁদ হয়ে গিলি তারে। তার কবিতা। বোধের কোরকে টোকা দিয়ে যেন কে তাড়িয়ে বেড়ায়। আরও আরও কী যেন অপেক্ষায় আছে! এক প্রহরী ঠেলে দেয় সামনের দিকে। পেয়েও যায় না-পাওয়া বোধধ্বনি। পিপাসা মেটে। কণ্ঠনালী হয়ে ভেতর, অভ্যন্তর চৈত্রতাপ জ্বালার থেকে পায় রেহাই। আমি তারে পাশে রাখি না। সাথে সাথে রাখি পরশমণির মতন।

‘দেখেছি সে-এক অন্ধ ধানক্ষেতে সারারাত্রি ঘুরে

সূর্যকে জাগাবে বলে বিষর্ণ্ণ বাঁশির সুরে সুরে

একা একা জ্বলে ওঠে, আর বিদীর্ণ আলে-আলে

বিধাতার মতো বুঝি স্বরচিত সে-আগুন জ্বালে!

তার দিব্য দ্ইু হাতে আমাকে ছুঁয়েছে কালরাতে,

স্পর্শের অনলে কেঁপে পুণ্য হল আমার শরীর;

অগ্নিবেদ শুধালেন; হাত রাখ আমার দুহাতে,

এানুষের নামে বল এই গাঢ় শীতশর্বরীর।

আড়ালে যে-প্রাণজ্যোতি, তুমি তাঁর বিতন্ত্রিত বীণা

তোমার জীবনে নিয়ে এ বিশ্বে বিকীর্ণ হবে কিনা?

রাগিনীর বৃষ্টি হয়ে খরশব জ্যৈষ্ঠের জ্বালায়

প্রান্তরে ছড়াবে নাকি প্রাণভরা পুবালিদখিনা,

রূপান্তর দেবে তাকে হেমন্তের হিরণ্যথালায়...’

সেই যে উস্কানি, সেই যে ভালোলাগা। ভালোবেসে প্রথম কোন্ দিন, তারিখে জড়িয়েছিলাম তার ছন্দে, বাক্যে মনে নেই। মনের বিস্তীর্ণ মাঠে তার আসা-যাওয়া। বাদ দিই না তারে, পারি না বাদ দিতে, আস্তে করে বালিশের কিনারে রাখতে সাধে, বিষাদে কাঁপে হাত। ভোরে, বিকালে আমি তার কবিতার কাছে ভিড়ি তার কবিতার যোগ্যতায়, বেদনা ও জিজ্ঞাসা ভুলবার মোহমায়ায়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নয়, তার অনন্য কাব্যবাউলিয়ানা, তার সৃষ্ট কাব্যলাবণ্যে বিমুগ্ধ আমি চলতি পথের বাকি পথটুকুও একই মুগ্ধতায় বলে যেতে চাই, ‘ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর/ ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না।’

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

প্রেরণায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

জোবায়ের মিলন

image

‘ভগবানের গুপ্তচর মৃতু এসে বাঁধুক ঘর

ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না’

(উৎসর্গপত্র, শ্রেষ্ঠ কবিতা)

কৈশোরেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের এমন উস্কানির জালে পড়েছিলোম কবিতা ভালোবেসে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে চিনেছিলাম কবিতার এই জহুরীকে। জেনেছিলাম কবিতার বাঁকে অভিনব, আধুনিক, উত্তরাধুনিক পথে তার বহুবাঁকের বহু কথা। তারপর কত সময় চলে গেছে সময়ের হাত ধরে তা আর হিসাবে টুকে রাখিনি। কাব্যপ্রেমে মাতাল হয়ে উঠেছি। ঘর থেকে বাহিরে হয়েছি। তার কবিতার মোহ মোড়িয়ে করেছে ছন্নছাড়া। ডান-বাঁম-সম্মুখ-পেছন ঘুরে ফিরে ফের ফিরে ফিরে এসেছি তার ঝোলার কাছে। করজোর করে চেয়েছি ভাবের, ভাষার বিশদ ব্যাখ্যা। রাতে আলো নিভিয়ে টেবিল-আলো জ্বেলে বইয়ের ভাঁজে পৃষ্ঠা রেখে পড়েছি তাকে, পাছে গৃহকর্তা বিছানা ছেড়ে পিঠে বসিয়ে দেয় কয়েক কিল! ভয় ধরেছে মনে, কেঁপেছে আঙুল, চোখ নড়েছে এদিক ওদিক। যদি ধরা খাই! সকালের খাবার বন্ধ। তবু সাহস উঠেছে উজানি কই হয়ে, মাথার ভেতর প্রবল ঘুরেছে, ‘ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর/ ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না’। পাঠ্যবই চুলায় গেছে, পরিচিত খাতা হারিয়েছে, কখন কোন্ মলাট গেছে ছিঁড়ে রাখিনি খোঁজ। এক কবিতার পর আরেক কবিতা; ঘোর লাগা সেইসব রাত-দিন।

‘জীবনানন্দ সভাঘরে

তোমায় ডেকেছি সমাদরে

তারপর ভিড় হতেই

দুজন বসেছি বারান্দায়

শুভেন্দু শোনো, এছাড়া আর আমাদের তীর্থ নেই।

(শুভেন্দু শোনো)

তীর্থ আর আসলে পাইনি। বয়স বেড়েছে, হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখ সময়ে সময়ে একূল ছেড়ে ওকূলে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে, ওকূল ছেড়ে একূলে এনে আছড়ে ফেলেছে; নানান ইশারা চেয়েছে আকৃষ্ট করতে, পুরোহিতের মতো ডেকেছে কাছে, যাওয়া হয়নি কোনো একটি কোলে। ‘কবিতা’ তীর্থস্থানে নত হয়ে নমচিত্তে অবলোকন করেছি সৌন্দর্য আর সুন্দরের বীজপত্র। তার দেখানো ভাবে, বর্ণে, কল্পনার অমিত রঙে নতুনের সন্ধানে হাঁটছি তো হাঁটছি, যদি আরেকটি নতুন বাঁক দেখা যায়। বহুযুগের ধারা পাল্টে যদি আরও একটি ধারা দাঁড় করা যায় সত্যের মতো সাবলীল পন্থায়। এ চেষ্টা তার শেখানো। পঞ্চদশকে শুরু করে আমৃত্যু সে পথের সন্ধানে তার আয়ু ব্যয়।

‘খুব সম্ভব মৃত্যুর মুখ থেকে

ফিরে এসে তাঁর খিদে পেয়েছিল খুব,

বললেন: ‘এসো, সেরে নিই প্রাতরাশ’,

সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যেরা জাল ফেলে

ধরল একশো তেপ্পান্নটা মাছ।

হ্রদের কিনারে কাঠকয়লার আঁচে

মাছ ভাজা হলো ভয়ানক পরিপাটি,

চেটেপুটে খেল নির্বাচিতেরা, আর

যারা ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না

এই রকমের হাজার পাঁচেক আরো।

সেন্ট জনের বিখ্যাত গসপেলে

শুনেছি এসব, বৃত্তিতে ছিল সেই

শিষ্যেরা জেলে, আর বিধাতার ছেলে,

তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়

মৃত্যু আমার নাকের ডগায় এলে।

(তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়)

তিনি চেয়েছেন খোলস পাল্টাতে। কবিতার যে খোলসের ভেতর আটকে গিয়েছিলো কাল, কবিতাকে খোলস বন্দি করে বয়ে নিয়ে চলছিলো পথিকেরা। ভেবেছিলো, বোতলের মুখে ছিপি আটকে রাখা যে কবিতা সেই কবিতা। তার বাহিরে ভিন্ন অন্য নেই। পথিকের ভাবনার এমন দৈন্যকে ভাঙ্গার প্রত্যয়ে পথে নেমেছিলেন তিনি একদল যুয়ানের সাথে, বসেছিলেন সাহসের নায়ে চড়ে। যা হবার তাই হবে। সাহস দুঃসহস হয়নি। পাল ছিঁড়ে পড়েনি স্রোতের ধারায়। যে বিপরীত থেকে যাত্রা সে বিপরীত- রীতি হয়ে ধরা দিলো কাব্য ধারায়। উন্মোচন হলো নবধারার। সে ধারার কোণ ধরে আবার কোণঠাসা হয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুরে নিজেই বদ হয়ে যাননি আত্ম-অহমে। খুঁজেছেন আরও নতুন পথ। আর সে অনুসন্ধিৎসু নাবিকের সন্ধান আর সৃষ্টির পয়ারে আমি যেন পাগলপ্রায়। পান করি তার এক একটি প্রসব। অমৃত মনে হয় তার ফলানো ফল, ফসলের মধুরস।

‘যেন এ অবুঝ তারুণ্য কারো চোখে না পড়ে

সারা চোখ মুখ ঢেকে রাখি শুধু কালো কাপড়ে

কেউ কেউ ভাবে আতঙ্কবাদী, শেষে যেই দ্যাখে

কোনো কিছু আর বদলে দিই না, ক্ষমা চেয়ে যায়;

এমন সময় যখনই বৃষ্টি আঙিনা ভেজায়

তোমার কাছেই আশ্রয় নিতে করেছি কামনা;

পৌঁছুতে গিয়ে আবার আরেক সতর্কপনা

যদি তুমি ভাবো তোমাকে চাইতে এসেছি আবার

সারাটা শরীর আবজিয়ে রাখি নীল ধুতুরায়। (নীল ধুতুরা)

নিভৃতব্রতী। শক্তি-শঙ্খ-সুনীল-বিনয়-আলোকের সহযাত্রী হয়েও সহপথ ধরে যাত্রা রাখেননি সমগতিতে। রিয়েলিটির পকেটে মূল্যের মুদ্রা রাখতে গিয়ে অ্যাবাসট্রাক্টকে কিছুটা ম্লান যে করেনি তা অস্বীকার করি কী করে। অধ্যাপনা তো সময় দখল করেনি কম! কেড়ে নেয়নি কবিতার মানসপুত্রের কম কয়েন। কম টেনে ধরেনি কাক্সিক্ষত আকাক্সক্ষার রাশ। সে রাশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে বের যে হননি তাও না। ভারত মাটির সাথে যোগ করেছেন জার্মান মাটি। জার্মান মাটির সাথে গেঁথেছেন ভারত মাটি। বাংলা কবিতা তার মুঠোতে পা রেখে হয়ে উঠেছে আবহমান বাংলার মহাকালীন চিত্রাঙ্ক। বিশ্বসাহিত্য ঘরে বিস্তুৃত হয়ে জানান দিয়েছেন কবিতার একক ভাষা নেই, কবিতা ভাষার পোশাক গায়ে দিয়ে কেবল ঘুরে বেড়ায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কাব্যচোখ যাদের, তারা কবিতাকে ধরতে পারে যে কোনো ভাষা থেকেই। কবিতা তো তার নিজের স্বর নিয়ে বিচরণ করে ইহজাগতিক অঙ্গনে; কেউ কেউ তা ধরতে পারে, কেউ কেউ তা ধরতে পারে না। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কবিতাকে ধরা এক কবি। তার কবিতা সে কথা বলে। স্বীকার করে, রবীন্দ্র পরবর্তী উত্তররৈবিক কালের তিনি উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। তার কবিতা আমার মাতৃভাষার আকম্প্র সীমারেখাকে সম্প্রসারিত করে দেয় এক ধাক্কায়। তাকে পাঠ করে তৃষ্ণা মিটে না। না পাঠ করা কী এক তৃষ্ণা আকণ্ঠ পোড়ায়। আমি পড়ে থাকি তার ভেতর। তার বাহির। তাকে দেখি, আরও দেখার ইচ্ছায়:

‘কারা যেন কালরাত্রে এসে

আমার এ প্রদীপের সলতে গেছে কেটে...

কী-করে জানাই তবে আমন্ত্রণ আলো উদ্দেশ্যে?’

(নিরাময়হীন এক ক্ষত)

আবার

‘সব-কিছু তার নিজের জায়গায় রইবে অটুক;

চিত্রদারুধেণু চরিয়ে গোঠে সুরদাসের আঁকা

বালককৃষ্ণ দাঁড়িয়ে থাকবেন;

আবহমান কৃষ্ণচূড়ার নিচে

বোষ্টমী তার গান গাইতে গিয়ে

কণ্ঠিবদল করবে থির বিজুরী

আগের মতো তোমার সঙ্গে!

তুমি নিজেই কি এক, ফিরে-আসার পরেও?’ (ফেরা)

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের উচ্ছ্বাস প্রকৃত বাউলের। তার খোঁজ প্রাজ্ঞ নির্জনতার। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী পাড় হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কূল আর প্রেসিডেন্সি কলেজ বারান্দার গ্রিল ছুঁয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠান মারিয়ে জার্মান হাইডেলবার্গের পরেও ¯পষ্ট এক আলোর হাতছানি তাকে পথে নামিয়েছে। হাঁটার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আর তিনি এখানে সংশয়াচ্ছন্ন নন, দক্ষ পথিক। এই পথটিকে তিনি সত্য জীবন মনে করেছেন। সমন্বয়ও করেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। দুটো আলাদা দেশ, মহাসময়ের বিরাট একটা প্রান্তর, ঈশ্বরচেতনা এবং মানবচেনতার দুই ভিন্ন অভিমুখ অন্য এক বোধের ধারা মিশে গেছে তার মধ্যে। ব্রেশট এবং চণ্ডীদাস এক সঙ্গে কথা বলেন তার বিশ্বে। কখনো কখনো হয়ত খ্রিস্টপূর্বাব্দের রচনার সঙ্গেই সঙ্গম করে তার অক্ষর, কথা।

‘সুগত, এ জন্মে আমি কেউ না তোমার।

আজ তবু সন্ধ্যায় যখন

জাতিস্মর জ্যোৎস্নার ঝালরে

তোমার হাসির মন্ত্র নীরব ঝর্ণায় ঝরে পড়ে,

আমারও নির্বেদ ঘিরে পূর্ণিমার তিলপর্ণিকার

অগুরু গন্ধের বৃষ্টি- মনে হল এখানে আবার

তোমার সময় থেকে বহুদূর শতাব্দীর তীরে

জয়শ্রীজীবন পাব ফিরে,

ফিরে পাব পরশরতন।’

(বুদ্ধপূর্ণিমার রাত্রে)

আমার কেবল মতে হতে থাকে, তার কবিতা অনেক অনেক ভিড়ের মধ্যে নিশ্চুপ কথা বলে বউলের উদাসীন মতো; কিন্তু আসক্ত, মায়াবী। তিনি পাওয়ার কথা বলেন অথচ না পাওয়াটাও প্রবল তার কাছে। না পাওয়ার মধ্য হতে আবার পাওয়ার ইচ্ছা প্রগাঢ়। যেন সমস্ত দৃশ্য রঙ, রূপ নিয়ে দীর্ঘ এক সুড়ঙ্গের সাথে বসবাস তার। দারজা খোলে, দরজা পেছনে পড়ে, দরজা দেখা যায় অদূরে। এক খোলের পর আরেক খোল, আরেক খোলের পর আরেক খোল। কøান্ত হই না। শেষ সার দেখার ইচ্ছায় ছাড়ি না তাকে। অলোকের প্রেমে যে প্রেমিক সেজেছি, পরিণয়হীনে আর ছাড় নাই। আলিঙ্গন পরে আলিঙ্গন। তার পরমের সাথে মিশার নেশায় বুঁদ হয়ে গিলি তারে। তার কবিতা। বোধের কোরকে টোকা দিয়ে যেন কে তাড়িয়ে বেড়ায়। আরও আরও কী যেন অপেক্ষায় আছে! এক প্রহরী ঠেলে দেয় সামনের দিকে। পেয়েও যায় না-পাওয়া বোধধ্বনি। পিপাসা মেটে। কণ্ঠনালী হয়ে ভেতর, অভ্যন্তর চৈত্রতাপ জ্বালার থেকে পায় রেহাই। আমি তারে পাশে রাখি না। সাথে সাথে রাখি পরশমণির মতন।

‘দেখেছি সে-এক অন্ধ ধানক্ষেতে সারারাত্রি ঘুরে

সূর্যকে জাগাবে বলে বিষর্ণ্ণ বাঁশির সুরে সুরে

একা একা জ্বলে ওঠে, আর বিদীর্ণ আলে-আলে

বিধাতার মতো বুঝি স্বরচিত সে-আগুন জ্বালে!

তার দিব্য দ্ইু হাতে আমাকে ছুঁয়েছে কালরাতে,

স্পর্শের অনলে কেঁপে পুণ্য হল আমার শরীর;

অগ্নিবেদ শুধালেন; হাত রাখ আমার দুহাতে,

এানুষের নামে বল এই গাঢ় শীতশর্বরীর।

আড়ালে যে-প্রাণজ্যোতি, তুমি তাঁর বিতন্ত্রিত বীণা

তোমার জীবনে নিয়ে এ বিশ্বে বিকীর্ণ হবে কিনা?

রাগিনীর বৃষ্টি হয়ে খরশব জ্যৈষ্ঠের জ্বালায়

প্রান্তরে ছড়াবে নাকি প্রাণভরা পুবালিদখিনা,

রূপান্তর দেবে তাকে হেমন্তের হিরণ্যথালায়...’

সেই যে উস্কানি, সেই যে ভালোলাগা। ভালোবেসে প্রথম কোন্ দিন, তারিখে জড়িয়েছিলাম তার ছন্দে, বাক্যে মনে নেই। মনের বিস্তীর্ণ মাঠে তার আসা-যাওয়া। বাদ দিই না তারে, পারি না বাদ দিতে, আস্তে করে বালিশের কিনারে রাখতে সাধে, বিষাদে কাঁপে হাত। ভোরে, বিকালে আমি তার কবিতার কাছে ভিড়ি তার কবিতার যোগ্যতায়, বেদনা ও জিজ্ঞাসা ভুলবার মোহমায়ায়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নয়, তার অনন্য কাব্যবাউলিয়ানা, তার সৃষ্ট কাব্যলাবণ্যে বিমুগ্ধ আমি চলতি পথের বাকি পথটুকুও একই মুগ্ধতায় বলে যেতে চাই, ‘ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর/ ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না।’