এনজিও ঋণের ফাঁদে এক বছরের শিশুসহ মা কারাবন্দী অবশেষে জামিন

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের আবদুস সালাম তার স্ত্রী নিলুফা খাতুনের নামে বেসরকারি ঋণদান সংস্থা ‘বীজ’ এনজিও থেকে গতবছর এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন কাজ না পায়ে আবদুস সালামের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়।

এ কারণে কিস্তির টাকা বকেয়া পড়ে যায় এনজিওর কাছে। সরকারের তরফ থেকে করোনাকালে কিস্তির টাকা আদায়ে বিরত থাকার জন্য এনজিওগুলোকে নির্দেশ দিলেও সরকারের সেই নির্দেশনা মোটেও আমলে নেয়নি এনজিও বীজ।

খেলাপি দেখিয়ে আবদুস সালামের স্ত্রীর নামে মামলা দায়ের করে এনজিও বীজ। ওই মামলায় আদালত আবদুস সালামের স্ত্রীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত রোববার রাতে দুর্গাপুর থানা পুলিশ আবদুস সালামের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। সঙ্গে এক বছর বয়সী শিশু কন্যাও বাদ যায়নি।

বাধ্য হয়ে পুলিশ শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়েই থানায় নিয়ে যায়। মাত্র এক বছর বয়সের অবুঝ একটি শিশুকে কারাগারে যেতে হবে তা হয়তো কখনওই ভাবেননি শিশুটির মা-বাবা। এ নিয়ে সোমবার দিনভর দুর্গাপুর সদরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এনজিওর মানবিকতা নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝেও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত নিলুফা বেগমের স্বামী আবদুস সালাম জানান, সাংসারিক নানা দায় দেনার কারণে প্রায় দুই বছর আগে দুর্গাপুর উপজেলা থেকে পরিচালিত ‘বীজ’ নামক এনজিও থেকে নিজ স্ত্রী নিলুফা বেগমের নামের জনতা ব্যাংক দুর্গাপুর শাখার চেক এনজিওতে জমা দিয়ে মাসিক কিস্তিতে একলাখ টাকা ঋণ নেন। ঋণ নেয়ার পর থেকে নিয়মিতভাবে এনজিওর মাস্টারের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে থাকেন।

সহায়সম্বলহীন হতদরিদ্র আবদুস সালাম দিনমজুরি করে একদিকে পরিবার পরিজনদের দিনে দু’মুঠো ডাল-ভাত, পরিধেয় বস্ত্র এবং চিকিৎসার খরচ অন্যদিকে এনজিওর কিস্তির টাকার জোগাড় করতে অতিরিক্ত পরিশ্রম ও মানসিক টেনশনের ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ভর্তি হন।

হাসপাতালে প্রায় দেড়মাস চিকিৎসাধীন থাকেন আবদুস সালাম। জমানো কিছু টাকা সেই সঙ্গে ধারকর্য ও এলাকার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা খরচের ব্যবস্থা করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে ফেরা মাত্রই এনজিওকর্মী ও ম্যানেজার মহিরুল ইসলাম এসে কিস্তির টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং বলে দ্রুত টাকা পরিশোধ না করলে মামলা করে জেলের ভাত খাওয়াবে।

আবদুস সালাম আরও বলেন, এনজিওর চাপের মুখে মামলার ভয়ে এলাকার সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে এনজিও ম্যানেজারকে আরেকটি কিস্তি দেন। পরের মাসে সুদখোর মহাজনের চাপে সুদের টাকা দেয়ায় এনজিওর কিস্তি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে আবদুস সালাম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ‘বীজ’ এনজিওর দুর্গাপুর শাখা ব্যবস্থাপক মহিরুল ইসলাম আবদুস সালামের স্ত্রী নিলুফার বেগমের জমা রাখা জনতা ব্যাংকের চেক ডিজঅনার করে নিলুফা বেগমকে আসামি করে রাজশাহী চিফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলা করে।

এরপর দেশে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাব আসলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আবদুস সালাম দিশেহারা হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে শহরে গিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে না পারায় বিজ্ঞ আদালত হতদরিদ্র দিনমজুর আবদুস সালামের স্ত্রী নিলুফা বেগমের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

এতে গত ২৪ জানুয়ারি আনুমানিক রাত ১২টার দিকে দুর্গাপুর থানা পুলিশ মাড়িয়া গ্রামের নিজবাড়ি থেকে আবদুস সালামের স্ত্রী নিলুফাকে গ্রেপ্তার করে। এক বছরের দুধের বাচ্চা সানিয়াকে নিয়ে অসহায় মা নিলুফা বেগম থানায় রাতভর আটক থাকার পর ২৫ জানুয়ারি সকালে এক বছরের শিশুকন্যা সানিয়াকসহ আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করে দুর্গাপুর থানা পুলিশ।

গত সোমবার দুপুরে রাজশাহী জেলা বিজ্ঞ যুগ্ম তৃতীয় আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে বিচারক তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। সংবাদের প্রতিনিধিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ‘বীজ’ এনজিওর দুর্গাপুর শাখার ব্যবস্থাপক মহিরুল ইসলাম।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

এনজিও ঋণের ফাঁদে এক বছরের শিশুসহ মা কারাবন্দী অবশেষে জামিন

জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

image

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের আবদুস সালাম তার স্ত্রী নিলুফা খাতুনের নামে বেসরকারি ঋণদান সংস্থা ‘বীজ’ এনজিও থেকে গতবছর এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন কাজ না পায়ে আবদুস সালামের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়।

এ কারণে কিস্তির টাকা বকেয়া পড়ে যায় এনজিওর কাছে। সরকারের তরফ থেকে করোনাকালে কিস্তির টাকা আদায়ে বিরত থাকার জন্য এনজিওগুলোকে নির্দেশ দিলেও সরকারের সেই নির্দেশনা মোটেও আমলে নেয়নি এনজিও বীজ।

খেলাপি দেখিয়ে আবদুস সালামের স্ত্রীর নামে মামলা দায়ের করে এনজিও বীজ। ওই মামলায় আদালত আবদুস সালামের স্ত্রীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত রোববার রাতে দুর্গাপুর থানা পুলিশ আবদুস সালামের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। সঙ্গে এক বছর বয়সী শিশু কন্যাও বাদ যায়নি।

বাধ্য হয়ে পুলিশ শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়েই থানায় নিয়ে যায়। মাত্র এক বছর বয়সের অবুঝ একটি শিশুকে কারাগারে যেতে হবে তা হয়তো কখনওই ভাবেননি শিশুটির মা-বাবা। এ নিয়ে সোমবার দিনভর দুর্গাপুর সদরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এনজিওর মানবিকতা নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝেও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত নিলুফা বেগমের স্বামী আবদুস সালাম জানান, সাংসারিক নানা দায় দেনার কারণে প্রায় দুই বছর আগে দুর্গাপুর উপজেলা থেকে পরিচালিত ‘বীজ’ নামক এনজিও থেকে নিজ স্ত্রী নিলুফা বেগমের নামের জনতা ব্যাংক দুর্গাপুর শাখার চেক এনজিওতে জমা দিয়ে মাসিক কিস্তিতে একলাখ টাকা ঋণ নেন। ঋণ নেয়ার পর থেকে নিয়মিতভাবে এনজিওর মাস্টারের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে থাকেন।

সহায়সম্বলহীন হতদরিদ্র আবদুস সালাম দিনমজুরি করে একদিকে পরিবার পরিজনদের দিনে দু’মুঠো ডাল-ভাত, পরিধেয় বস্ত্র এবং চিকিৎসার খরচ অন্যদিকে এনজিওর কিস্তির টাকার জোগাড় করতে অতিরিক্ত পরিশ্রম ও মানসিক টেনশনের ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ভর্তি হন।

হাসপাতালে প্রায় দেড়মাস চিকিৎসাধীন থাকেন আবদুস সালাম। জমানো কিছু টাকা সেই সঙ্গে ধারকর্য ও এলাকার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা খরচের ব্যবস্থা করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে ফেরা মাত্রই এনজিওকর্মী ও ম্যানেজার মহিরুল ইসলাম এসে কিস্তির টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং বলে দ্রুত টাকা পরিশোধ না করলে মামলা করে জেলের ভাত খাওয়াবে।

আবদুস সালাম আরও বলেন, এনজিওর চাপের মুখে মামলার ভয়ে এলাকার সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে এনজিও ম্যানেজারকে আরেকটি কিস্তি দেন। পরের মাসে সুদখোর মহাজনের চাপে সুদের টাকা দেয়ায় এনজিওর কিস্তি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে আবদুস সালাম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ‘বীজ’ এনজিওর দুর্গাপুর শাখা ব্যবস্থাপক মহিরুল ইসলাম আবদুস সালামের স্ত্রী নিলুফার বেগমের জমা রাখা জনতা ব্যাংকের চেক ডিজঅনার করে নিলুফা বেগমকে আসামি করে রাজশাহী চিফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলা করে।

এরপর দেশে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাব আসলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আবদুস সালাম দিশেহারা হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে শহরে গিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে না পারায় বিজ্ঞ আদালত হতদরিদ্র দিনমজুর আবদুস সালামের স্ত্রী নিলুফা বেগমের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

এতে গত ২৪ জানুয়ারি আনুমানিক রাত ১২টার দিকে দুর্গাপুর থানা পুলিশ মাড়িয়া গ্রামের নিজবাড়ি থেকে আবদুস সালামের স্ত্রী নিলুফাকে গ্রেপ্তার করে। এক বছরের দুধের বাচ্চা সানিয়াকে নিয়ে অসহায় মা নিলুফা বেগম থানায় রাতভর আটক থাকার পর ২৫ জানুয়ারি সকালে এক বছরের শিশুকন্যা সানিয়াকসহ আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করে দুর্গাপুর থানা পুলিশ।

গত সোমবার দুপুরে রাজশাহী জেলা বিজ্ঞ যুগ্ম তৃতীয় আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে বিচারক তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। সংবাদের প্রতিনিধিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ‘বীজ’ এনজিওর দুর্গাপুর শাখার ব্যবস্থাপক মহিরুল ইসলাম।