ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নিষিদ্ধ করার দাবি!

মিথুশিলাক মুরমু

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিগত কয়েক বছর পূর্বে উদ্যাপন করেছে রজতজয়ন্তী। ১৯ জানুয়ারি পদার্পণ করেছে ২৯ বছরে, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি জন্ম হয়েছিল স্বপ্ন, দর্শন ও আদর্শকে নতুনীকরণে। মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্বাসিত আদর্শকে নবায়নে নির্মূল কমিটির সাদৃশ্য কমিটির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। সংগঠনটি বন্ধুর পথ পরিভ্রমণ করতে গিয়ে অনেক দুঃখ-বেদনা, সংকট-নিঃসঙ্গতা এবং সফলতা রয়েছে। সত্যিই পেছনের দিকে ফিরে তাকালে পুলকিত হতে হয়। এই স্বনামধন্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ; মৃত্যু পর্যন্ত সংগঠনকে আগলে রেখে মুক্তচিন্তার মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন এবং এখনও রেখে চলেছে। ২৫ বছর পূর্তিতে প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব না কষেই নিরলসভাবেই দেশ, জাতি, মানবাধিকার, মাইনোরিটি, পরিবেশ উন্নয়নেও মেগা মেগা উদ্যোগ গ্রহণ করে সর্বস্তরের জনসাধারণকে সামিল করার অসাধারণ দক্ষতা ইতোমধ্যেই সচেতন নাগরিক প্রত্যক্ষ করেছেন। কৈশর পেরিয়ে পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ হতেই আমার দেশের একজন এমপি ফিরোজ রশীদ চৌধুরী, যিনি জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, এরূপ দায়িত্ববান ব্যক্তি সংগঠনটি সম্পর্কে অত্যন্ত অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন।

মহান জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘আমাদের কিছু সংগঠন আছে। একটি সংগঠন আছে নাস্তিক নির্মূল কমিটি। আরেকটি সংগঠন হচ্ছে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। এই নির্মূল করার ক্ষমতা এদের কে দিয়েছে? আমি জানতে চাই। তুমি কে নির্মূল করার। ... আমার দেশে কোর্ট-কাচারি আছে না? অনেক বিচার করেছে এই সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হচ্ছে, রাজাকারদের বিচার হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তুমি কেন? ... আমি মনে করি যে এদের প্রতিরোধ করা দরকার। ... তোমরা নিজেরা পুলিশ প্রোটেকশনে থেকে এই ধান্দাবাজি করছ, এইটা জনগণ বিশ^াস করে না। আমি মনে করি যে এদেরই প্রতিরোধ করার দরকার।’ (বিডিনিউজ২৪.কম ২৬.০১.২০২১)। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিকে প্রতিরোধ ও নিষিদ্ধ করার দাবি অযোক্তিক কারণ-

প্রথমত- মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেতনাকে ধারণ ও লালন করার প্রত্যয়ে উজ্জীবিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমে ক্রীত স্বাধীনতার মশালকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর যে রেওয়াজ শুরু করেছে, এটি নিঃসন্দেহে সংগঠনটির অন্যতম অর্জন। আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভ্রান্তি ও ভুলতে বসেছিল, যুব সমাজ সংগঠনটির বদৌলতে বাংলাদেশের প্রসব বেদনার অতীতকে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়াস চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক, অহিংস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নির্মূল কমিটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মশাল প্রজ্বলন অনুষ্ঠানে আদর্শের ধারাবাহিকতায় আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ ও মশাল জ্বালিয়ে সম্মানিত করেছে। মিত্র দেশ ভারতের আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান তুলে ধরেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বহু জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্মের সম্মীলন শক্তি আমাদের মুক্ত করেছে; সেটিকে বরং বার দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরেছে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায়ে এই সংগঠনটিই সোচ্চার এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। নির্মূল কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ পুস্তিকার সম্পাদকীয়তে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে-‘৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসররা পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে স্বাধীনতাকামী ৩০ লাখ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছিল, সরকারি হিসেবে ২ লাখ- বেসরকারি হিসেবে ৫ লক্ষাধিক নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, ১ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধর্মের নামে এত নৃশংস গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে অতীতে কখনও ঘটেনি।’ পাকিস্তান সম্পর্কে আপদমস্তক স্বচ্ছ ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং বোধকরি, এটির প্রেক্ষাপটেই আমাদের সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানকে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত- বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করতে যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে। দুঃসাহস দেখিয়েছে, সংবিধান থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত পবিত্র সংবিধানের স্তম্ভ ও মৌলিকত্ব- ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিলের প্রতিবাদ করে। একটি সংগঠন যে জাতির বিবেককে জাগ্রত করতে সক্ষম এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে নির্ভিকচিত্তে অগ্রসর হওয়ার যে দক্ষতা, সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের পক্ষেই এটি সম্ভবপর। আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে; যে চেতনা ধারণ করেই ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ছিল- সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

নির্মূল কমিটিকেই প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে শোনা গেছে- ‘১৯৭৫ এ স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ’৭২-এর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর এই অসামান্য দলিলের পাকিস্তানিকরণ করেছেন তার আন্তর্জাতিক প্রভুদের সন্তুষ্ট করার জন্য। আমাদের মূল সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস...’ তিনি সংযোজন করেছিলেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতলবে, যার সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা.) প্রথম মুসলিম নগর রাষ্ট্র মদিনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন সেখানে ‘বিসমিল্লাহ...’ ছিল না, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ও ছিল না।” একজন বঙ্গবন্ধু সৈনিকের পক্ষেই উপরিউক্ত কথাগুলো বলা ও সংগঠনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা প্রত্যাশিত। রাজনৈতিক পালা বদলে সুবিধাবাদীরা সব সময়ই গাছের ও তলারটিও কুড়িয়েছে।

তৃতীয়ত- দেশের অবহেলিত, নির্যাতিত, পিছিয়ে পড়া, অধিকারহারা এবং সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার জনগোষ্ঠীর পক্ষে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছে নির্মূল কমিটি। গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় উচ্ছেদে পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর আক্রান্তের রহস্য উন্মোচন করেছেন। ঘটনার পেছনের ঘটনা, রহস্যের মায়াজালকে ছিন্ন করতে দিন-রাত কাজ করেছে। নির্মূল কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিযাত্রা’ শীর্ষক বইয়ের সম্পাদকীয়তে পাওয়া যায়, ‘আমরা বাঙালি জাতি, যে জাতির কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা কেউ ইসলাম ধর্মের অনুসারী, কেউ হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। আবার এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা কোন ধর্মীয় আচরণই পালন করেন না। এছাড়া প্রায় অর্ধশত আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। কিন্তু যে পরিচয় আমাদের এক সূত্রে গ্রথিত করেছে, একই প্রকৃতির রূপরসগন্ধ অনুভব করতে শিখিয়েছে- সে পরিচয় হচ্ছে আমরা মানুষ। এই পরিচয় দেশ, কাল ও সমাজের গণ্ডি অতিক্রম করে আমাদের মহত্তর জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের চেতনাকে এভাবেই গড়ে তুলতে হবে।’

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্ণধার শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গি মৌলবাদের পূর্ণ গ্রহণ গ্রাস করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূর্যকে। অন্ধকার কখনও স্থায়ী হয় না, সত্যের জয় অনিবার্য, আমরা লড়ছি সত্য ও ন্যায়ের জন্য, আমরা অবশ্যই জয়ী হব...। নির্মূল কমিটির অগ্রযাত্রা পর্বত সমান সমস্যাকেই চিহ্নিত করেছে নিজেদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে। দেশের সর্বস্তরের নাগরিকের প্রতি তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেই পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচিত হয়েছে। সুবিধা ভোগের চেয়ে সুবিধা বঞ্চিতদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে উদীপ্ত করেছে।

চতুর্থত- মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরিবেশের সমন্বয় সাধন করেছে। ৩০ লাখ শহীদের স্মরণে দেশব্যাপী ৩০ লক্ষাধিক ফলজ-বনজ-ঔষধি বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখেছে। এছাড়াও রয়েছে বহুমুখী কার্যসূচি। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল পর্যায়ের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্রই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ব্যতিক্রম উদ্যোগ সত্যিই অনন্দিনীয়।

মাননীয় সংসদ সদস্য ফিরোজ রশীদ চৌধুরীর ‘প্রতিরোধ’ থিওরি সত্যিই চমৎকার। শহীদের রক্তে ভেজা মাটির সঙ্গে কেউ সম্পর্কহীন হয়ে পড়লে তার চিন্তা-চেতনা মরুভূমিতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিতে আমাদের বিবেক সক্রিয় হলেও সুবিধাবাদীরা নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করে। প্রকৃত ইতিহাস ফিনিক্স পাখির মতোই উদ্ভাসিত হয়; তবে হ্যাঁ বিরোধিতা, সমালোচনা, মিথ্যাচার, বিকৃতি ও অপপ্রচার আদর্শিক সংগঠনের ভিত্তিকে মজবুত করে, সুদৃঢ় করে তোলে। নির্মূল কমিটির খানাখন্দ রাস্তাতে যুক্ত হলো একটি গভীর খাদ। মহান জাতীয় সংসদে দূরভিসন্ধিমূলক বক্তব্যে আমরা নির্বাক হলেও হতভম্ব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই প্রতিরোধ থিওরিকে ‘প্রতি আনুগত্যে’ পরিণত করতে আরও দুর্গম পথ পাড়ি দিতে সাহসী হবে।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম কর্ণধার প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নিজ এপিটাফ-এ স্বরচিত কবিতাতেও সংগঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে-

‘কখনও করেনি আপোস অশুভের সঙ্গে বীর না হলেও ভীরুতাকে কদাপি দেয়নি প্রশ্রয় রয়েছে সতত আঁকড়ে মহৎ আদর্শ মহানবতার। চৌদিকে যখন মৌলবাদী দানবের হিংস্র হুংকার ধুলায় আচ্ছন্ন যখন তাবৎ শুভ মূলবোধ রীতির কপটবন্ধন সে তখনও অনায়াসে করেছে চুরমার।’

মঙ্গলবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৯ মাঘ ১৪২৭, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নিষিদ্ধ করার দাবি!

মিথুশিলাক মুরমু

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিগত কয়েক বছর পূর্বে উদ্যাপন করেছে রজতজয়ন্তী। ১৯ জানুয়ারি পদার্পণ করেছে ২৯ বছরে, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি জন্ম হয়েছিল স্বপ্ন, দর্শন ও আদর্শকে নতুনীকরণে। মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্বাসিত আদর্শকে নবায়নে নির্মূল কমিটির সাদৃশ্য কমিটির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। সংগঠনটি বন্ধুর পথ পরিভ্রমণ করতে গিয়ে অনেক দুঃখ-বেদনা, সংকট-নিঃসঙ্গতা এবং সফলতা রয়েছে। সত্যিই পেছনের দিকে ফিরে তাকালে পুলকিত হতে হয়। এই স্বনামধন্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ; মৃত্যু পর্যন্ত সংগঠনকে আগলে রেখে মুক্তচিন্তার মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন এবং এখনও রেখে চলেছে। ২৫ বছর পূর্তিতে প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব না কষেই নিরলসভাবেই দেশ, জাতি, মানবাধিকার, মাইনোরিটি, পরিবেশ উন্নয়নেও মেগা মেগা উদ্যোগ গ্রহণ করে সর্বস্তরের জনসাধারণকে সামিল করার অসাধারণ দক্ষতা ইতোমধ্যেই সচেতন নাগরিক প্রত্যক্ষ করেছেন। কৈশর পেরিয়ে পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ হতেই আমার দেশের একজন এমপি ফিরোজ রশীদ চৌধুরী, যিনি জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, এরূপ দায়িত্ববান ব্যক্তি সংগঠনটি সম্পর্কে অত্যন্ত অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন।

মহান জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘আমাদের কিছু সংগঠন আছে। একটি সংগঠন আছে নাস্তিক নির্মূল কমিটি। আরেকটি সংগঠন হচ্ছে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। এই নির্মূল করার ক্ষমতা এদের কে দিয়েছে? আমি জানতে চাই। তুমি কে নির্মূল করার। ... আমার দেশে কোর্ট-কাচারি আছে না? অনেক বিচার করেছে এই সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হচ্ছে, রাজাকারদের বিচার হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তুমি কেন? ... আমি মনে করি যে এদের প্রতিরোধ করা দরকার। ... তোমরা নিজেরা পুলিশ প্রোটেকশনে থেকে এই ধান্দাবাজি করছ, এইটা জনগণ বিশ^াস করে না। আমি মনে করি যে এদেরই প্রতিরোধ করার দরকার।’ (বিডিনিউজ২৪.কম ২৬.০১.২০২১)। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিকে প্রতিরোধ ও নিষিদ্ধ করার দাবি অযোক্তিক কারণ-

প্রথমত- মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেতনাকে ধারণ ও লালন করার প্রত্যয়ে উজ্জীবিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমে ক্রীত স্বাধীনতার মশালকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর যে রেওয়াজ শুরু করেছে, এটি নিঃসন্দেহে সংগঠনটির অন্যতম অর্জন। আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভ্রান্তি ও ভুলতে বসেছিল, যুব সমাজ সংগঠনটির বদৌলতে বাংলাদেশের প্রসব বেদনার অতীতকে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়াস চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক, অহিংস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নির্মূল কমিটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মশাল প্রজ্বলন অনুষ্ঠানে আদর্শের ধারাবাহিকতায় আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ ও মশাল জ্বালিয়ে সম্মানিত করেছে। মিত্র দেশ ভারতের আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান তুলে ধরেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বহু জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্মের সম্মীলন শক্তি আমাদের মুক্ত করেছে; সেটিকে বরং বার দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরেছে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায়ে এই সংগঠনটিই সোচ্চার এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। নির্মূল কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ পুস্তিকার সম্পাদকীয়তে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে-‘৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসররা পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে স্বাধীনতাকামী ৩০ লাখ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছিল, সরকারি হিসেবে ২ লাখ- বেসরকারি হিসেবে ৫ লক্ষাধিক নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, ১ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধর্মের নামে এত নৃশংস গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে অতীতে কখনও ঘটেনি।’ পাকিস্তান সম্পর্কে আপদমস্তক স্বচ্ছ ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং বোধকরি, এটির প্রেক্ষাপটেই আমাদের সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানকে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত- বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করতে যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে। দুঃসাহস দেখিয়েছে, সংবিধান থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত পবিত্র সংবিধানের স্তম্ভ ও মৌলিকত্ব- ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিলের প্রতিবাদ করে। একটি সংগঠন যে জাতির বিবেককে জাগ্রত করতে সক্ষম এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে নির্ভিকচিত্তে অগ্রসর হওয়ার যে দক্ষতা, সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের পক্ষেই এটি সম্ভবপর। আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে; যে চেতনা ধারণ করেই ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ছিল- সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

নির্মূল কমিটিকেই প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে শোনা গেছে- ‘১৯৭৫ এ স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ’৭২-এর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর এই অসামান্য দলিলের পাকিস্তানিকরণ করেছেন তার আন্তর্জাতিক প্রভুদের সন্তুষ্ট করার জন্য। আমাদের মূল সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস...’ তিনি সংযোজন করেছিলেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতলবে, যার সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা.) প্রথম মুসলিম নগর রাষ্ট্র মদিনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন সেখানে ‘বিসমিল্লাহ...’ ছিল না, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ও ছিল না।” একজন বঙ্গবন্ধু সৈনিকের পক্ষেই উপরিউক্ত কথাগুলো বলা ও সংগঠনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা প্রত্যাশিত। রাজনৈতিক পালা বদলে সুবিধাবাদীরা সব সময়ই গাছের ও তলারটিও কুড়িয়েছে।

তৃতীয়ত- দেশের অবহেলিত, নির্যাতিত, পিছিয়ে পড়া, অধিকারহারা এবং সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার জনগোষ্ঠীর পক্ষে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছে নির্মূল কমিটি। গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় উচ্ছেদে পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর আক্রান্তের রহস্য উন্মোচন করেছেন। ঘটনার পেছনের ঘটনা, রহস্যের মায়াজালকে ছিন্ন করতে দিন-রাত কাজ করেছে। নির্মূল কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিযাত্রা’ শীর্ষক বইয়ের সম্পাদকীয়তে পাওয়া যায়, ‘আমরা বাঙালি জাতি, যে জাতির কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা কেউ ইসলাম ধর্মের অনুসারী, কেউ হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। আবার এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা কোন ধর্মীয় আচরণই পালন করেন না। এছাড়া প্রায় অর্ধশত আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। কিন্তু যে পরিচয় আমাদের এক সূত্রে গ্রথিত করেছে, একই প্রকৃতির রূপরসগন্ধ অনুভব করতে শিখিয়েছে- সে পরিচয় হচ্ছে আমরা মানুষ। এই পরিচয় দেশ, কাল ও সমাজের গণ্ডি অতিক্রম করে আমাদের মহত্তর জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের চেতনাকে এভাবেই গড়ে তুলতে হবে।’

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্ণধার শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গি মৌলবাদের পূর্ণ গ্রহণ গ্রাস করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূর্যকে। অন্ধকার কখনও স্থায়ী হয় না, সত্যের জয় অনিবার্য, আমরা লড়ছি সত্য ও ন্যায়ের জন্য, আমরা অবশ্যই জয়ী হব...। নির্মূল কমিটির অগ্রযাত্রা পর্বত সমান সমস্যাকেই চিহ্নিত করেছে নিজেদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে। দেশের সর্বস্তরের নাগরিকের প্রতি তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেই পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচিত হয়েছে। সুবিধা ভোগের চেয়ে সুবিধা বঞ্চিতদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে উদীপ্ত করেছে।

চতুর্থত- মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরিবেশের সমন্বয় সাধন করেছে। ৩০ লাখ শহীদের স্মরণে দেশব্যাপী ৩০ লক্ষাধিক ফলজ-বনজ-ঔষধি বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখেছে। এছাড়াও রয়েছে বহুমুখী কার্যসূচি। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল পর্যায়ের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্রই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ব্যতিক্রম উদ্যোগ সত্যিই অনন্দিনীয়।

মাননীয় সংসদ সদস্য ফিরোজ রশীদ চৌধুরীর ‘প্রতিরোধ’ থিওরি সত্যিই চমৎকার। শহীদের রক্তে ভেজা মাটির সঙ্গে কেউ সম্পর্কহীন হয়ে পড়লে তার চিন্তা-চেতনা মরুভূমিতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিতে আমাদের বিবেক সক্রিয় হলেও সুবিধাবাদীরা নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করে। প্রকৃত ইতিহাস ফিনিক্স পাখির মতোই উদ্ভাসিত হয়; তবে হ্যাঁ বিরোধিতা, সমালোচনা, মিথ্যাচার, বিকৃতি ও অপপ্রচার আদর্শিক সংগঠনের ভিত্তিকে মজবুত করে, সুদৃঢ় করে তোলে। নির্মূল কমিটির খানাখন্দ রাস্তাতে যুক্ত হলো একটি গভীর খাদ। মহান জাতীয় সংসদে দূরভিসন্ধিমূলক বক্তব্যে আমরা নির্বাক হলেও হতভম্ব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই প্রতিরোধ থিওরিকে ‘প্রতি আনুগত্যে’ পরিণত করতে আরও দুর্গম পথ পাড়ি দিতে সাহসী হবে।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম কর্ণধার প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নিজ এপিটাফ-এ স্বরচিত কবিতাতেও সংগঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে-

‘কখনও করেনি আপোস অশুভের সঙ্গে বীর না হলেও ভীরুতাকে কদাপি দেয়নি প্রশ্রয় রয়েছে সতত আঁকড়ে মহৎ আদর্শ মহানবতার। চৌদিকে যখন মৌলবাদী দানবের হিংস্র হুংকার ধুলায় আচ্ছন্ন যখন তাবৎ শুভ মূলবোধ রীতির কপটবন্ধন সে তখনও অনায়াসে করেছে চুরমার।’