কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সমাজে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার যে কাজটি হচ্ছে এটা নীতি বহির্ভূত। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া সংবিধান ও সাম্যের পরিপন্থী। গতকাল নাগরিক প্লাটফর্মের ভার্চুয়াল সংলাপে এমন মন্তব্য করেছেন বক্তারা। নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের উপস্থাপনায় সংলাপে ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, যে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার অবস্থান নেয়াকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচনা হচ্ছে। রাস্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’ এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। জনাব মো. ফরিদ উদ্দিন, সাবেক সদস্য (শুল্কনীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংলাপে বলেন যে, কালো টাকা আয়ের মূল কারণ হলো সুশাসনের অভাব। তিনি মন্তব্য করেন যে কালো টাকা রোধে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।

রাজনৈতিক অঙ্গীকার, গণতান্ত্রিক চর্চা, তথ্যের অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত করে প্রত্যেককে সৎ কর ব্যবস্থার অধীনে আনার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আলোচনায় জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ ১০ হাজার ২২০ কোটি কালো টাকা সাদা হয়েছে। করদাতারা তাদের আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত আয়ের নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য যেকোন সম্পদের ওপর ১০ শতাংশ কর দেয়ার মাধ্যমে বৈধ করতে পারবেন বলে নতুন বিধানে বলা হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে প্রদর্শিত আয়ের ওপর সর্বোচ্চ প্রদেয় কর ২৫ শতাংশ। কিন্তু সেখানে অপ্রদর্শিত আয়ের ওপর এই হার মাত্র ১০ শতাংশ।

আলোচনায় ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক এই সুযোগ দ্রুতই বন্ধ করা উচিত। আমরা আশা করব, সাম্য ও উন্নয়নবিরোধী এই সুযোগ আগামী অর্থবছর থেকে বাতিল হবে।

সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, স্বাধীনতার আগে থেকেই ক্ষমার নামে নামমাত্র কর প্রদানের সুযোগ ছিল। এতে করে অর্থনীতি কোনকালেই লাভবান হয়নি। ক্ষমার নামে নামমাত্র কর দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধ না করার সুযোগ বন্ধের পরামর্শ দেন তিনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, হুন্ডি ও ট্রেডের মাধ্যমে কালোটাকা বিদেশে পাচার হয়। কিন্তু ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং ঠেকাতে দুদক, রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। কালো টাকা লালনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না চাইলে সমস্ত ট্রানজেকশনকে তদারকির আওতায় আনতে হবে।

ব্যবসায়ী তাবিথ আওয়াল মনে করেন, প্রতিবছর কালো টাকা সাদা করার দুষ্টচক্র বন্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যত কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বলেন, রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন দরকার। কেননা এখনও কর ফাঁকি দিতে পারাটাকে অনেকেই গর্বের বিষয় মনে করেন।

জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, রাজস্ব ও কর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বাবসায়ীদের প্রতিনিধি এবং অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন এই ভার্চুয়াল সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ এনজিও প্রতিনিধি, সমাজকর্মী, পেশাজীবী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।

বুধবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২০ মাঘ ১৪২৭, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সিপিডি সংলাপ

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক |

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সমাজে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার যে কাজটি হচ্ছে এটা নীতি বহির্ভূত। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া সংবিধান ও সাম্যের পরিপন্থী। গতকাল নাগরিক প্লাটফর্মের ভার্চুয়াল সংলাপে এমন মন্তব্য করেছেন বক্তারা। নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের উপস্থাপনায় সংলাপে ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, যে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার অবস্থান নেয়াকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচনা হচ্ছে। রাস্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’ এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। জনাব মো. ফরিদ উদ্দিন, সাবেক সদস্য (শুল্কনীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংলাপে বলেন যে, কালো টাকা আয়ের মূল কারণ হলো সুশাসনের অভাব। তিনি মন্তব্য করেন যে কালো টাকা রোধে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।

রাজনৈতিক অঙ্গীকার, গণতান্ত্রিক চর্চা, তথ্যের অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত করে প্রত্যেককে সৎ কর ব্যবস্থার অধীনে আনার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আলোচনায় জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ ১০ হাজার ২২০ কোটি কালো টাকা সাদা হয়েছে। করদাতারা তাদের আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত আয়ের নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য যেকোন সম্পদের ওপর ১০ শতাংশ কর দেয়ার মাধ্যমে বৈধ করতে পারবেন বলে নতুন বিধানে বলা হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে প্রদর্শিত আয়ের ওপর সর্বোচ্চ প্রদেয় কর ২৫ শতাংশ। কিন্তু সেখানে অপ্রদর্শিত আয়ের ওপর এই হার মাত্র ১০ শতাংশ।

আলোচনায় ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক এই সুযোগ দ্রুতই বন্ধ করা উচিত। আমরা আশা করব, সাম্য ও উন্নয়নবিরোধী এই সুযোগ আগামী অর্থবছর থেকে বাতিল হবে।

সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, স্বাধীনতার আগে থেকেই ক্ষমার নামে নামমাত্র কর প্রদানের সুযোগ ছিল। এতে করে অর্থনীতি কোনকালেই লাভবান হয়নি। ক্ষমার নামে নামমাত্র কর দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধ না করার সুযোগ বন্ধের পরামর্শ দেন তিনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, হুন্ডি ও ট্রেডের মাধ্যমে কালোটাকা বিদেশে পাচার হয়। কিন্তু ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং ঠেকাতে দুদক, রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। কালো টাকা লালনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না চাইলে সমস্ত ট্রানজেকশনকে তদারকির আওতায় আনতে হবে।

ব্যবসায়ী তাবিথ আওয়াল মনে করেন, প্রতিবছর কালো টাকা সাদা করার দুষ্টচক্র বন্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যত কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বলেন, রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন দরকার। কেননা এখনও কর ফাঁকি দিতে পারাটাকে অনেকেই গর্বের বিষয় মনে করেন।

জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, রাজস্ব ও কর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বাবসায়ীদের প্রতিনিধি এবং অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন এই ভার্চুয়াল সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ এনজিও প্রতিনিধি, সমাজকর্মী, পেশাজীবী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।