পিকে হালদারের লুটপাটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ

পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। তাদের একজন এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। এই নির্বাহী পরিচালককে পিকে হালদার মাসে ২ লাখ টাকা মাসোহারা দিতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্বাহী পরিচালকের নাম শাহ আলম। তার সঙ্গে আরও ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক এমএ শহীদ রেজাও। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৩শ কোটি টাকা অবৈধভাবে ঋণ দেয়া এবং তা আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি রাশেদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে এখন বিদেশে পালিয়ে আছেন প্রশান্ত কুমার হালদার।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সংবাদ থেকে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘আদালতে কে কি বলেছে সে বিষয়ে আমি কথা বলবো না। আর এসব বিষয় নিয়ে টেলিফোনে কথা বলতে চাই না।’

আদালতের কোর্ট ইন্সপেক্টর জুলফিকার আলী সংবাদকে জানান, ইন্টারন্যাল লিজিং থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক যে ৫টি মামলা করেছেন সেই মামলায় গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানটির এমডি রাশেদুল হক। রাশেদুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড হেফাজতে নেয় দুদক। রিমান্ড শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান তাকে গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট বাকী বিল্লাহর আদালতে হাজির করেন। আদালতে তিনি স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে পিকে হালদারের ক্ষমতার উৎস আর্থিক অনিয়মের নেপথ্যে বাংলাদেশ বাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর, বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদ রেজাসহ অনেক প্রভাবশালীদের কথা বলেছেন। তারা কিভাবে পিকে হালদারকে সহযোগিতা করেছেন, কিভাবে পিকে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ন্ত্রণে রেখে ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তার আন্দোপান্ত বর্ণনা দিয়েছেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে আদালত তাকে মঙ্গলবারই কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

আদালত সূত্রে জানায়, জবানবন্দিতে আদালতের কাছে মো. রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিআইএফএম (ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড মার্কেটিং) এর তৎকালীন জিএম (বর্তমানে নিবার্হী পরিচালক) শাহ আলমকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেও প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে দেয়া হতো। এটা ক্যাস হিসেবে উত্তোলন দেখিয়ে সান্ড্রি হিসাবে বিবিধ খরচ হিসাবে দেখানো হতো যাতে ঘুষের টাকার কোন প্রমাণ থাকতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেকশন বিভাগ থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এ বছরে দুবার অডিট হতো এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দুই সদস্যবিশিষ্ট অডিট টিমকে প্রতিবারই ১০ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। যে কারণে তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছিল। পিকে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বড় উপহার দেয়ার কথা বলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন এবং এভাবে এসকে সুর ও শাহ আলমকে ম্যানেজ করতেন। এছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদ রেজাও পিকে হালদারকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।

আদালতকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুল বলেছেন, তিনি (রাশেদুল হক) মালেশিয়া থেকে বিবিএ পাস করে এসে ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এ প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৬-০৭ সালে আইআইডিএফসিতে এভিপি হিসাবে প্রশান্ত কুমার হালদারের অধীনে চাকরি করেন। তিনি ২০১১-১২ সনে রিলায়েন্স ফিন্যান্সে এসভিপি হিসাবে যোগদান করেন্ ও প্রশান্ত কুমার হালদারের অধীনে চাকরি করেন। পিকে হালদার তখন রিলায়েন্স-এর এমডি ছিলেন। পিকে হালদারের অপকর্মের শুরু রিলায়েন্স ফ্যাইন্যান্স থেকে। তিনি নিজের ইচ্ছামতো গ্রাহকদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে একদিনের মধ্যে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করতেন। অনেক সময় গ্রাহক জানতো না যে, তার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে। এভাবে শত শত কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে আত্মসাত করেন। একাজে তাকে সহায়তা করতো রিলায়েন্সের কর্মকর্তা রুনাই আহমেদ, আল মামুন সোহাগ ও রাফসান আহমেদ চৌধুরী। আদালতে এসব কথা রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন।

আদালত সূত্র জানায়, আদালতে রাশেদুল হক বলেছেন, পিকে হালদারের কথামতো তিনি (রাশেদুল হক) ২০১৫ সালের জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি হলেও প্রতিষ্ঠান চালাতেন মূলত পিকে হালদারই। তিনি নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে রিলায়েন্স লিজিং-এর তার অনুসারী রুনাই আহমেদ, আল মামুন সোহাগ, রাফসান, অভীক সাহাকে ইন্টান্যাশনাল লিজিং-এ নিয়ে আসেন। তারা মূলত পিকে হালদারের সঙ্গে সরাসরি ডিলিং করতেন। বেশিরভাগ পার্টিই ছিল পিকে হালদারের আত্মীয় স্বজন। তারা পিকে হালদারের কাছে ঋণের প্রস্তাব দিলে পিকে হালদার সে প্রস্তাব সোহাগ, রাফসানদের মাধ্যমে রাশেদুল হকের কাছে পাঠাত। রাশেদ মার্ক করে তা রুনাই আহমেদকে দিলে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই, কোন মর্টগেজ না নিয়ে পিকে হালদারের নির্দেশ মতো ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে তাতে রুনাই, সোহাগ, রাফসান স্বাক্ষর করতো এবং এমডি হিসেবে রাশেদুল হক অনুমোদন দিত। প্রতিটি বোর্ড মিটিং পিকে হালদার উপস্থিত থাকত এবং ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে বাধ্য করতো।

আদালত সূত্রে আরও জানা যায় যে, আদালতের কাছে মো. রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন যে, বোর্ড সদস্যরা সবাই ছিল পিকে হালদারের লোক। তাই তারা ভুয়া/অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান জেনে ঋণ অনুমোদন করে দিতো। মো. নওশের উল ইসলাম, মমতাজ বেগম, পাপিয়া ব্যানার্জী, বাসুদেব ব্যানার্জী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর পরিচালক হওয়ার সত্ত্বেও অনিয়ম করে বেআইনিভাবে তাদের ভুয়া প্রতিষ্ঠান এমএসটি মেরিন, এমএসটি ফার্মা, নিউট্রিক্যাল, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নিয়ে তা জমা না দিয়ে পিকে হালদারসহ নিজের অন্য প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর করে তা উত্তোলন করেন এবং পরে তা বিদেশে পাচার করেন। এমডি রাশেদুল হক তাদের সহকর্মীদের সহায়তায় আনাম কেমিক্যাল, রহমান কেমিক্যাল, নর্দান জুটসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব, কাঠামো ও ঋণ নেয়ার উদ্দেশ্য যাচাই ছাড়া এবং কোন মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন, যা পরে পিকে হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর হয়েছে।

আদালত সূত্রে আরও জানা যায় যে, আদালতের কাছে মো. রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন যে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান শহিদ রেজা মূলত ছিলেন পিকে হালদারের প্রধান সহযোগী। পিকে হালদারের নির্র্দেশে তার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ২০০ কোটি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, সিমটেক্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদ, পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, রাজীম সোম, কাজী মোমরেজ মাহমুদ, স্বপন কুমার বিশ্বাস, অভিজিত, অমিতাভ অধিকারী, শংখ ব্যাপারি, সুস্মিতা সাহা, গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, অতশী মৃধা, অমল চন্দ্র দাস, রতন কুমার বিশ্বাস ছিল পিকে হালদারের সহযোগী এবং পিকে হালদার মূলত এদের এনআইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে তা দিয়ে শত শত কোটি টাকা লিজিং থেকে লুট করেছে। অমিতাভ অধিকারী হলেন পিকে হালদারের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জ্বল কুমার নন্দী হলেন পিকে হালদারের পুরনো অফিসের সহকর্মী।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিং পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ বেনামী প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তীতে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন। জেনিথ ও লিপরো ইন্টারন্যাশনাল নামে এক কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে পিকে হালদারের নির্দেশে কোন মর্টগেজ, যাচাই এবং বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই এমডি রাশেদুল হক একক কর্তৃত্বে ১২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দেন। রিলায়েন্স লিজিংকে তিনটি চেকের মাধ্যমে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ভাউচারের মাধ্যমে ৮০ কোটি টাকা দিয়েছেন রুনাই, সোহাগ, অভীক, রাফসান ও রাশেদ। ট্রেজারি বিভাগ থেকে কোন ঋণ অনুমোদন ছাড়াই শর্টটাম ঋণের নামে এমডি রাশেদুল হক পিপলস লিজিংকে ২০০ কোটি টাকা দিয়েছেন। ওই সময় পিপলস লিজিং-এর এমডি ছিলেন উজ্জ্বল কুমার নন্দী। পরে তা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে উত্তোলন দেখিয়ে আত্মসাত করেছেন। পিকে হালদারের বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিঃ-এর পরিচালক একেএম শহীদ রেজার স্বার্থসংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে ১০৪ কোটি টাকা এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ৭টি ঋণ হিসাব হতে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংক লিঃ-এর স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ খান-এর জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল-এর নামে পরিচালিত একটি হিসাব ৭৪ কোটি সরিয়ে নিয়ে আত্মসাত করা হয়।

পিকে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাব হলেও হিসাবটিতে সর্বমোট ১৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ও সমপরিমাণ উত্তোলন করা হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে এমডি রাশেদুল হক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ দিয়েছেন। এসব বিষয়ে দুদকের হেফাজতে থাকাকালীন স্বীকার করেছে রাশেদুল হক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৩শ’ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের ঘটনায় ৫টি মামলা করেন দুদক। এসব মামলায় ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি রাশেদুল হকসহ ৬ জন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। ৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাত ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদক ৬২ ব্যক্তির ১ হাজার কোটি টাকার বেশি জব্দ করেছেন। এছাড়া ৮৩ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে এবং বিনিয়োগ থাকা ৩ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছেন। বিদেশ যাত্রায় নিষেজ্ঞাধা রয়েছে পিকে হালদারের মা লিলাবতীসহ অনেকের।

বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২১ মাঘ ১৪২৭, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পিকে হালদারের লুটপাটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ

সাইফ বাবলু

পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। তাদের একজন এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। এই নির্বাহী পরিচালককে পিকে হালদার মাসে ২ লাখ টাকা মাসোহারা দিতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্বাহী পরিচালকের নাম শাহ আলম। তার সঙ্গে আরও ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক এমএ শহীদ রেজাও। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৩শ কোটি টাকা অবৈধভাবে ঋণ দেয়া এবং তা আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি রাশেদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে এখন বিদেশে পালিয়ে আছেন প্রশান্ত কুমার হালদার।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সংবাদ থেকে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘আদালতে কে কি বলেছে সে বিষয়ে আমি কথা বলবো না। আর এসব বিষয় নিয়ে টেলিফোনে কথা বলতে চাই না।’

আদালতের কোর্ট ইন্সপেক্টর জুলফিকার আলী সংবাদকে জানান, ইন্টারন্যাল লিজিং থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক যে ৫টি মামলা করেছেন সেই মামলায় গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানটির এমডি রাশেদুল হক। রাশেদুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড হেফাজতে নেয় দুদক। রিমান্ড শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান তাকে গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট বাকী বিল্লাহর আদালতে হাজির করেন। আদালতে তিনি স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে পিকে হালদারের ক্ষমতার উৎস আর্থিক অনিয়মের নেপথ্যে বাংলাদেশ বাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর, বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদ রেজাসহ অনেক প্রভাবশালীদের কথা বলেছেন। তারা কিভাবে পিকে হালদারকে সহযোগিতা করেছেন, কিভাবে পিকে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ন্ত্রণে রেখে ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তার আন্দোপান্ত বর্ণনা দিয়েছেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে আদালত তাকে মঙ্গলবারই কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

আদালত সূত্রে জানায়, জবানবন্দিতে আদালতের কাছে মো. রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিআইএফএম (ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড মার্কেটিং) এর তৎকালীন জিএম (বর্তমানে নিবার্হী পরিচালক) শাহ আলমকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেও প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে দেয়া হতো। এটা ক্যাস হিসেবে উত্তোলন দেখিয়ে সান্ড্রি হিসাবে বিবিধ খরচ হিসাবে দেখানো হতো যাতে ঘুষের টাকার কোন প্রমাণ থাকতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেকশন বিভাগ থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এ বছরে দুবার অডিট হতো এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দুই সদস্যবিশিষ্ট অডিট টিমকে প্রতিবারই ১০ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। যে কারণে তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছিল। পিকে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বড় উপহার দেয়ার কথা বলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন এবং এভাবে এসকে সুর ও শাহ আলমকে ম্যানেজ করতেন। এছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদ রেজাও পিকে হালদারকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।

আদালতকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুল বলেছেন, তিনি (রাশেদুল হক) মালেশিয়া থেকে বিবিএ পাস করে এসে ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এ প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৬-০৭ সালে আইআইডিএফসিতে এভিপি হিসাবে প্রশান্ত কুমার হালদারের অধীনে চাকরি করেন। তিনি ২০১১-১২ সনে রিলায়েন্স ফিন্যান্সে এসভিপি হিসাবে যোগদান করেন্ ও প্রশান্ত কুমার হালদারের অধীনে চাকরি করেন। পিকে হালদার তখন রিলায়েন্স-এর এমডি ছিলেন। পিকে হালদারের অপকর্মের শুরু রিলায়েন্স ফ্যাইন্যান্স থেকে। তিনি নিজের ইচ্ছামতো গ্রাহকদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে একদিনের মধ্যে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করতেন। অনেক সময় গ্রাহক জানতো না যে, তার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে। এভাবে শত শত কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে আত্মসাত করেন। একাজে তাকে সহায়তা করতো রিলায়েন্সের কর্মকর্তা রুনাই আহমেদ, আল মামুন সোহাগ ও রাফসান আহমেদ চৌধুরী। আদালতে এসব কথা রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন।

আদালত সূত্র জানায়, আদালতে রাশেদুল হক বলেছেন, পিকে হালদারের কথামতো তিনি (রাশেদুল হক) ২০১৫ সালের জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি হলেও প্রতিষ্ঠান চালাতেন মূলত পিকে হালদারই। তিনি নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে রিলায়েন্স লিজিং-এর তার অনুসারী রুনাই আহমেদ, আল মামুন সোহাগ, রাফসান, অভীক সাহাকে ইন্টান্যাশনাল লিজিং-এ নিয়ে আসেন। তারা মূলত পিকে হালদারের সঙ্গে সরাসরি ডিলিং করতেন। বেশিরভাগ পার্টিই ছিল পিকে হালদারের আত্মীয় স্বজন। তারা পিকে হালদারের কাছে ঋণের প্রস্তাব দিলে পিকে হালদার সে প্রস্তাব সোহাগ, রাফসানদের মাধ্যমে রাশেদুল হকের কাছে পাঠাত। রাশেদ মার্ক করে তা রুনাই আহমেদকে দিলে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই, কোন মর্টগেজ না নিয়ে পিকে হালদারের নির্দেশ মতো ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে তাতে রুনাই, সোহাগ, রাফসান স্বাক্ষর করতো এবং এমডি হিসেবে রাশেদুল হক অনুমোদন দিত। প্রতিটি বোর্ড মিটিং পিকে হালদার উপস্থিত থাকত এবং ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে বাধ্য করতো।

আদালত সূত্রে আরও জানা যায় যে, আদালতের কাছে মো. রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন যে, বোর্ড সদস্যরা সবাই ছিল পিকে হালদারের লোক। তাই তারা ভুয়া/অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান জেনে ঋণ অনুমোদন করে দিতো। মো. নওশের উল ইসলাম, মমতাজ বেগম, পাপিয়া ব্যানার্জী, বাসুদেব ব্যানার্জী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর পরিচালক হওয়ার সত্ত্বেও অনিয়ম করে বেআইনিভাবে তাদের ভুয়া প্রতিষ্ঠান এমএসটি মেরিন, এমএসটি ফার্মা, নিউট্রিক্যাল, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নিয়ে তা জমা না দিয়ে পিকে হালদারসহ নিজের অন্য প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর করে তা উত্তোলন করেন এবং পরে তা বিদেশে পাচার করেন। এমডি রাশেদুল হক তাদের সহকর্মীদের সহায়তায় আনাম কেমিক্যাল, রহমান কেমিক্যাল, নর্দান জুটসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব, কাঠামো ও ঋণ নেয়ার উদ্দেশ্য যাচাই ছাড়া এবং কোন মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন, যা পরে পিকে হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর হয়েছে।

আদালত সূত্রে আরও জানা যায় যে, আদালতের কাছে মো. রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন যে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান শহিদ রেজা মূলত ছিলেন পিকে হালদারের প্রধান সহযোগী। পিকে হালদারের নির্র্দেশে তার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ২০০ কোটি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, সিমটেক্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদ, পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, রাজীম সোম, কাজী মোমরেজ মাহমুদ, স্বপন কুমার বিশ্বাস, অভিজিত, অমিতাভ অধিকারী, শংখ ব্যাপারি, সুস্মিতা সাহা, গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, অতশী মৃধা, অমল চন্দ্র দাস, রতন কুমার বিশ্বাস ছিল পিকে হালদারের সহযোগী এবং পিকে হালদার মূলত এদের এনআইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে তা দিয়ে শত শত কোটি টাকা লিজিং থেকে লুট করেছে। অমিতাভ অধিকারী হলেন পিকে হালদারের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জ্বল কুমার নন্দী হলেন পিকে হালদারের পুরনো অফিসের সহকর্মী।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিং পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ বেনামী প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তীতে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন। জেনিথ ও লিপরো ইন্টারন্যাশনাল নামে এক কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে পিকে হালদারের নির্দেশে কোন মর্টগেজ, যাচাই এবং বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই এমডি রাশেদুল হক একক কর্তৃত্বে ১২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দেন। রিলায়েন্স লিজিংকে তিনটি চেকের মাধ্যমে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ভাউচারের মাধ্যমে ৮০ কোটি টাকা দিয়েছেন রুনাই, সোহাগ, অভীক, রাফসান ও রাশেদ। ট্রেজারি বিভাগ থেকে কোন ঋণ অনুমোদন ছাড়াই শর্টটাম ঋণের নামে এমডি রাশেদুল হক পিপলস লিজিংকে ২০০ কোটি টাকা দিয়েছেন। ওই সময় পিপলস লিজিং-এর এমডি ছিলেন উজ্জ্বল কুমার নন্দী। পরে তা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে উত্তোলন দেখিয়ে আত্মসাত করেছেন। পিকে হালদারের বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিঃ-এর পরিচালক একেএম শহীদ রেজার স্বার্থসংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে ১০৪ কোটি টাকা এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ৭টি ঋণ হিসাব হতে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংক লিঃ-এর স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ খান-এর জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল-এর নামে পরিচালিত একটি হিসাব ৭৪ কোটি সরিয়ে নিয়ে আত্মসাত করা হয়।

পিকে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাব হলেও হিসাবটিতে সর্বমোট ১৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ও সমপরিমাণ উত্তোলন করা হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে এমডি রাশেদুল হক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ দিয়েছেন। এসব বিষয়ে দুদকের হেফাজতে থাকাকালীন স্বীকার করেছে রাশেদুল হক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৩শ’ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের ঘটনায় ৫টি মামলা করেন দুদক। এসব মামলায় ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি রাশেদুল হকসহ ৬ জন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। ৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাত ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদক ৬২ ব্যক্তির ১ হাজার কোটি টাকার বেশি জব্দ করেছেন। এছাড়া ৮৩ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে এবং বিনিয়োগ থাকা ৩ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছেন। বিদেশ যাত্রায় নিষেজ্ঞাধা রয়েছে পিকে হালদারের মা লিলাবতীসহ অনেকের।