শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও একটি অশনি সংকেত

মাছুম বিল্লাহ

মাউশি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে পাঁচটি শর্ত দিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনা দিয়েছিল। এক্ষেত্রে আবেদন ফি ধরা হয়েছিল ১৫০ টাকা। লটারি প্রক্রিয়া ফেসবুক লাইভে অথবা অন্য যে কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করার কথা বলেছিল। লটারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারের ভর্তি তদারকি ও পরিবীক্ষণ কমিটি, বিদ্যালয়ের ভর্তি পরিচালনা কমিটি, অভিভাবক প্রতিনিধি, ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিনিধি ও শিক্ষক প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছিল। লটারির তারিখ নির্ধারণ করে ভর্তি তদারকি ও পরিবীক্ষণ কমিটিকে অবহিত করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লটারি কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং সর্বোপরি লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যাতে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। ঢাকাসহ দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন নেয়া শুরু হয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত। অনলাইনে আবেদনের কথা বলা হয়েছিল। ৩০ ডিসেম্বর অনলাইনে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করার কথা। ঢাকা মহানগরীরর বিদ্যালয়গুলোতে অর্ধেক শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় বসবাসরত (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। এসব ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছিল।

এতদিন সারা দেশের স্কুলগুলোর প্রথম শ্রেণীতে রটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। আর নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হতো জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। করোনার কারণে অন্তত শিশু শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার চাপ থেকে বেঁচে গিয়েছিল। ঢাকা মহানগরে ৩৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে জাতীয়করণ হওয়া আরও দুটি বিদ্যালয় যুক্ত হয়েছে। এগুলোতে মাউশির অধীন কেন্দ্রেীয় ব্যবস্থাপনায় ভর্তির কাজটি হয়। এবারও বিদ্যালয়গুলোকে তিনটি গুচ্ছ বা গ্রুপ (এ, বি ও সি) করে ভর্তির কাজটি করা হয়েছে। আবেদনের সময় একজন শিক্ষার্থী একটি গুচ্ছের পাঁচটি বিদ্যালয়ে ভর্তির পছন্দক্রম দিতে পেরেছে। প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত আসন ছিল সাড়ে ১১ হাজারের মতো। এসব কিছু ছাড়িয়ে এবার ভর্তি প্রক্রিযার মাধ্যমে এমন একটি তথ্য বেরিয়ে এসেছে যা শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে।

করোনারভাইরাসের অভিঘাতে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে অনেক পরিবার। এর প্রতিফলন দেখা গেছে রাজধানীর সাধারণ মানের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নতুন বছরে সেগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে খুবই কম। গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা এসব বেসরকারি স্কুলের জন্য এটি আরেকটি বড় ধাক্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়রা যাতে ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। রাজধানীর সূত্রাপুরে বেসরকারি একটি নি¤œ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘লিটল স্টার স্কুল’। গত বছর ২০২০ সালে এ প্রতিষ্ঠানে চারশ’র বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এবার মাত্র ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে এখানে।

ওই স্কুলের একজন শিক্ষক এ ব্যাপারে বলেন, অনেক অভিভাবক এলাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। পুরনো শিক্ষার্থীরা তো আসেই না। নতুন শিক্ষার্থীও কমে গেছে। এভাবে করোনায় তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন ভাড়া শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ে প্রায় এক কোটি টাকা ঋণ হয়েছে স্কুলটির। এখন যদি কাক্সিক্ষত সংখ্যক শিক্ষার্থী না পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

জুরাইন রেলগেট এলাকার মাস্টারমাইন্ড কেজি স্কুলের উদ্যোক্তা বলেন, মাত্র পাঁচ বছরেই তার স্কুলটি এলাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। প্রতি বছর এখানে শিশুদের ভর্তির জন্য অনেক ভিড় জমে। এবার ভিড় দূরের কথা, খোঁজ করেও শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এ স্কুলটি বেশ জনপ্রিয়।

করোনায় আর্থিক সংকটের কারণে স্কুল ছাড়ছে অনেক শিশু। অনেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, ‘এ বছরের মতো এত কমসংখ্যক শিক্ষার্থী তাদের কখনোই ছিল না। সর্বনিম্ন ছিল ২০১৪ সালে কারণ আগের বছর একটা রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল। তাতেও শিক্ষার্থী ভর্তিতে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। অন্য একজন প্রধান শিক্ষক বলেছেন, গত নভেম্বর থেকে ভর্তির প্রচার করে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ২৮ শিশু ভর্তি হয়েছে। পূর্বে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল সাড়ে তিনশত। এখন পুরনো শিক্ষার্থী এসেছে ৫০ থেক ৬০ জন। দুই শিফটে স্কুল পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে দশজন শিক্ষক ও দু’জন কর্মকর্তা এবং চারজন অফিস সহকারী আছেন। করোনার সময় স্কুলের আয় না থাকলেও নিয়মিত ভবন ভাড়া দিতে হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন প্রথম কয়েক মাস দিয়েছি। এরপর অনেক বকেয়া আছে। তিনজন চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।’

এ ধরনের চিত্র রাজধানীর সাধারণ বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন, নি¤œমাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। এর বাইরে স্বনামধন্য কিছু বেসরকারি স্কুলেও পুরনো শিক্ষার্থী কমেছে। এ ধরনের চিত্র শিক্ষাক্ষেত্রে এক অশনি সংকেত। এ অবস্থা সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অতএব বিষয়টি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।

কম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, করোনা সংক্রমণে বিশে^র সব খাতে বড় ধরনের একটা নাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে বা কমেছে। কর্ম হারিয়েছেন অনেক মানুষ। এ কারণে শহর থেকে পরিবারগুলো গ্রামে চলে গেছে। এটি এক ধরনের বাস্তুচ্যুতি। এ বাস্তুচ্যুত সাধারণ প্রাকৃতিক ঝড়, বন্যা, নদী ভাঙনের কারণেই বেশি হয়। সেটি ভিন্ন রূপে ঘটেছে আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ মহামারীতে। এ কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারের শিশুরা আগের স্কুলে ফিরছে না। তবে শিশুরা শহরে থাকুক আর গ্রামে থাকুক, তারা এ দেশেই আছে। সুতরাং তাদের ঝরে পড়ার একটা আশঙ্কা আমরা আগেই করেছি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনায় যেসব পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের শিশুদের নিজ এলাকায় সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার নির্দেশনা আগেই দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর আগের শ্রেণীর যে কোন ডকুমেন্ট দেখালেই চলবে। আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনতে আমরা বৃত্তি, উপবৃত্তি এবং জামাকাপড় কেনার জন্য সহায়তা দিচ্ছি। পাশাপাশি স্কুলে যে মিড ডে বিস্কুট দেয়া হতো, সেটি এখন বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর তারা স্কুলেই একবেলা খেতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি নেয়া অনেক পদক্ষেপই প্রশসংনীয়। তবে, এগুলোর প্রভাব খুব একটা লক্ষণীয় নয় বিশেষ করে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে। সেটিও বিশেষ দৃষ্টি পাওয়ার যোগ্য।

এসেছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটির একঘেয়েমিতে ক্লান্ত শিক্ষার্থীরা স্কুলের দিকে ছোটার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্লাস ও স্কুলের নিশ্চয়তা কাটেনি। কম্পিউটার আর মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে থাকতে তারা এখন মহা বিরক্ত। মুখিয়ে আছে মুক্তির প্রত্যাশায়। কবে আসবে সেই মুক্তির দিন? বিদ্যালয় খোলার দু’মাসের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং ৮৪ দিনের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষা নেয়া যাবে না। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পিছিয়ে জুন মাসে এবং এইচএসসি পরীক্ষা জুলাই-আগস্টে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।

অভিভাবকদেরও দাবি, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা হোকÑকারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়াশোনা ও বইয়ের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে যা কমানো উচিত এ মুহূর্তে। একটি জরিপে দেখা যায় যে, ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে চাচ্ছে। এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন ২০২১-এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকে ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বেড়ে যাবে।

শিক্ষার্থীদের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে এ দীর্ঘকালীন বন্ধে। বইয়ের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া মানে তাদের দৃষ্টি, চেতনা, মন অন্যদিকে ফেরানো যেটি সমাজের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য সুখকর নয়। একটি বিদ্যালয় সামাজিকতা, নীতি-নৈতিকতা শেখার উত্তম জায়গা। সেই জায়গার সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে তাদের যোগাযোগ নেই, সংশ্রব নেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে শিক্ষা কমিউনিটিকে। এজন্য সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ এ খাতের অস্থিরতা গোটা সমাজকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

[ লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত ]

masumbillah65@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২১ মাঘ ১৪২৭, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও একটি অশনি সংকেত

মাছুম বিল্লাহ

মাউশি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে পাঁচটি শর্ত দিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনা দিয়েছিল। এক্ষেত্রে আবেদন ফি ধরা হয়েছিল ১৫০ টাকা। লটারি প্রক্রিয়া ফেসবুক লাইভে অথবা অন্য যে কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করার কথা বলেছিল। লটারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারের ভর্তি তদারকি ও পরিবীক্ষণ কমিটি, বিদ্যালয়ের ভর্তি পরিচালনা কমিটি, অভিভাবক প্রতিনিধি, ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিনিধি ও শিক্ষক প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছিল। লটারির তারিখ নির্ধারণ করে ভর্তি তদারকি ও পরিবীক্ষণ কমিটিকে অবহিত করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লটারি কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং সর্বোপরি লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যাতে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। ঢাকাসহ দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন নেয়া শুরু হয়েছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত। অনলাইনে আবেদনের কথা বলা হয়েছিল। ৩০ ডিসেম্বর অনলাইনে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করার কথা। ঢাকা মহানগরীরর বিদ্যালয়গুলোতে অর্ধেক শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় বসবাসরত (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। এসব ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছিল।

এতদিন সারা দেশের স্কুলগুলোর প্রথম শ্রেণীতে রটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। আর নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হতো জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। করোনার কারণে অন্তত শিশু শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার চাপ থেকে বেঁচে গিয়েছিল। ঢাকা মহানগরে ৩৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে জাতীয়করণ হওয়া আরও দুটি বিদ্যালয় যুক্ত হয়েছে। এগুলোতে মাউশির অধীন কেন্দ্রেীয় ব্যবস্থাপনায় ভর্তির কাজটি হয়। এবারও বিদ্যালয়গুলোকে তিনটি গুচ্ছ বা গ্রুপ (এ, বি ও সি) করে ভর্তির কাজটি করা হয়েছে। আবেদনের সময় একজন শিক্ষার্থী একটি গুচ্ছের পাঁচটি বিদ্যালয়ে ভর্তির পছন্দক্রম দিতে পেরেছে। প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত আসন ছিল সাড়ে ১১ হাজারের মতো। এসব কিছু ছাড়িয়ে এবার ভর্তি প্রক্রিযার মাধ্যমে এমন একটি তথ্য বেরিয়ে এসেছে যা শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে।

করোনারভাইরাসের অভিঘাতে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে অনেক পরিবার। এর প্রতিফলন দেখা গেছে রাজধানীর সাধারণ মানের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নতুন বছরে সেগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে খুবই কম। গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা এসব বেসরকারি স্কুলের জন্য এটি আরেকটি বড় ধাক্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়রা যাতে ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। রাজধানীর সূত্রাপুরে বেসরকারি একটি নি¤œ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘লিটল স্টার স্কুল’। গত বছর ২০২০ সালে এ প্রতিষ্ঠানে চারশ’র বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এবার মাত্র ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে এখানে।

ওই স্কুলের একজন শিক্ষক এ ব্যাপারে বলেন, অনেক অভিভাবক এলাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। পুরনো শিক্ষার্থীরা তো আসেই না। নতুন শিক্ষার্থীও কমে গেছে। এভাবে করোনায় তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন ভাড়া শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ে প্রায় এক কোটি টাকা ঋণ হয়েছে স্কুলটির। এখন যদি কাক্সিক্ষত সংখ্যক শিক্ষার্থী না পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

জুরাইন রেলগেট এলাকার মাস্টারমাইন্ড কেজি স্কুলের উদ্যোক্তা বলেন, মাত্র পাঁচ বছরেই তার স্কুলটি এলাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। প্রতি বছর এখানে শিশুদের ভর্তির জন্য অনেক ভিড় জমে। এবার ভিড় দূরের কথা, খোঁজ করেও শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এ স্কুলটি বেশ জনপ্রিয়।

করোনায় আর্থিক সংকটের কারণে স্কুল ছাড়ছে অনেক শিশু। অনেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, ‘এ বছরের মতো এত কমসংখ্যক শিক্ষার্থী তাদের কখনোই ছিল না। সর্বনিম্ন ছিল ২০১৪ সালে কারণ আগের বছর একটা রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল। তাতেও শিক্ষার্থী ভর্তিতে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। অন্য একজন প্রধান শিক্ষক বলেছেন, গত নভেম্বর থেকে ভর্তির প্রচার করে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ২৮ শিশু ভর্তি হয়েছে। পূর্বে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল সাড়ে তিনশত। এখন পুরনো শিক্ষার্থী এসেছে ৫০ থেক ৬০ জন। দুই শিফটে স্কুল পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে দশজন শিক্ষক ও দু’জন কর্মকর্তা এবং চারজন অফিস সহকারী আছেন। করোনার সময় স্কুলের আয় না থাকলেও নিয়মিত ভবন ভাড়া দিতে হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন প্রথম কয়েক মাস দিয়েছি। এরপর অনেক বকেয়া আছে। তিনজন চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।’

এ ধরনের চিত্র রাজধানীর সাধারণ বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন, নি¤œমাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। এর বাইরে স্বনামধন্য কিছু বেসরকারি স্কুলেও পুরনো শিক্ষার্থী কমেছে। এ ধরনের চিত্র শিক্ষাক্ষেত্রে এক অশনি সংকেত। এ অবস্থা সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অতএব বিষয়টি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।

কম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, করোনা সংক্রমণে বিশে^র সব খাতে বড় ধরনের একটা নাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে বা কমেছে। কর্ম হারিয়েছেন অনেক মানুষ। এ কারণে শহর থেকে পরিবারগুলো গ্রামে চলে গেছে। এটি এক ধরনের বাস্তুচ্যুতি। এ বাস্তুচ্যুত সাধারণ প্রাকৃতিক ঝড়, বন্যা, নদী ভাঙনের কারণেই বেশি হয়। সেটি ভিন্ন রূপে ঘটেছে আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ মহামারীতে। এ কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারের শিশুরা আগের স্কুলে ফিরছে না। তবে শিশুরা শহরে থাকুক আর গ্রামে থাকুক, তারা এ দেশেই আছে। সুতরাং তাদের ঝরে পড়ার একটা আশঙ্কা আমরা আগেই করেছি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনায় যেসব পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের শিশুদের নিজ এলাকায় সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার নির্দেশনা আগেই দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর আগের শ্রেণীর যে কোন ডকুমেন্ট দেখালেই চলবে। আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনতে আমরা বৃত্তি, উপবৃত্তি এবং জামাকাপড় কেনার জন্য সহায়তা দিচ্ছি। পাশাপাশি স্কুলে যে মিড ডে বিস্কুট দেয়া হতো, সেটি এখন বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর তারা স্কুলেই একবেলা খেতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি নেয়া অনেক পদক্ষেপই প্রশসংনীয়। তবে, এগুলোর প্রভাব খুব একটা লক্ষণীয় নয় বিশেষ করে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে। সেটিও বিশেষ দৃষ্টি পাওয়ার যোগ্য।

এসেছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটির একঘেয়েমিতে ক্লান্ত শিক্ষার্থীরা স্কুলের দিকে ছোটার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্লাস ও স্কুলের নিশ্চয়তা কাটেনি। কম্পিউটার আর মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে থাকতে তারা এখন মহা বিরক্ত। মুখিয়ে আছে মুক্তির প্রত্যাশায়। কবে আসবে সেই মুক্তির দিন? বিদ্যালয় খোলার দু’মাসের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং ৮৪ দিনের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষা নেয়া যাবে না। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পিছিয়ে জুন মাসে এবং এইচএসসি পরীক্ষা জুলাই-আগস্টে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।

অভিভাবকদেরও দাবি, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা হোকÑকারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়াশোনা ও বইয়ের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে যা কমানো উচিত এ মুহূর্তে। একটি জরিপে দেখা যায় যে, ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে চাচ্ছে। এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন ২০২১-এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকে ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বেড়ে যাবে।

শিক্ষার্থীদের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে এ দীর্ঘকালীন বন্ধে। বইয়ের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া মানে তাদের দৃষ্টি, চেতনা, মন অন্যদিকে ফেরানো যেটি সমাজের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য সুখকর নয়। একটি বিদ্যালয় সামাজিকতা, নীতি-নৈতিকতা শেখার উত্তম জায়গা। সেই জায়গার সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে তাদের যোগাযোগ নেই, সংশ্রব নেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে শিক্ষা কমিউনিটিকে। এজন্য সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ এ খাতের অস্থিরতা গোটা সমাজকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

[ লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত ]

masumbillah65@gmail.com