তামান্না শারমিন তিথি
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের জন্য গত বছর মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কয়েক মাস ধরে পুরো পৃথিবী স্থবির হয়ে থাকলেও এখন প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তবে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। আর তার মাঝে সর্বোচ্চ ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের উচ্চশিক্ষা। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৪১ লাখ। এর মধ্যে ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে প্রায় ৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। আবার ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার লাখের মতো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২ হাজার ২৫৮টি কলেজে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৮ লাখ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ লাখ। আর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে আরও প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনলাইন ক্লাস। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান সংরক্ষণ, জ্ঞান বিতরণে এই অনলাইন ক্লাসের সুফল আসলে কতদূর তাই আজকে ভাবার বিষয়। শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আর অনলাইন শিখনের মাঝে আছে বিরাট পার্থক্য। তাছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণে প্রয়োজনীয় ডাটা বা ডিভাইস কেনার সামর্থ্য না থাকা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্বল নেটওয়ার্ক কাঠামোর জন্য নিয়মিত ক্লাসে যুক্ত হতে না পারা, সুযোগ-সুবিধার অভাবে শহরের শিক্ষার্থীদের চেয়ে গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়া, একীভূত শিক্ষার অভাব, মনোযোগের অভাব, পড়াশোনার যথোপযুক্ত পরিবেশের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ অনলাইন ক্লাস। যার কারণে তা আসলে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যই ছুঁতে পারছে না। কয়েকটি বিভাগ বা ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের আর্থিক বা ইন্টারনেট সাহায্য দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই পুরোপুরি পড়াশোনার বাইরে। ফলে আমাদের সারা দেশে উচ্চশিক্ষার হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতি।
গত এক দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট প্রশংসনীয়ভাবে কমে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা এ সমস্যাটিকে ভুলতে শুরু করলেও কোভিড-১৯ এর ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন ভর্তি, ক্লাস নেয়া, পাঠ্যক্রম শেষ করা, পরীক্ষা গ্রহণে সামগ্রিক জটের মধ্যে পড়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব বিভাগ বা ইনস্টিটিউটে সেমিস্টার সিস্টেম বিদ্যমান, তাদের জন্য সমস্যাটি বেশি প্রকট। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আজ রয়েছে সেশনজটের আশঙ্কায়। আবার অনলাইনে নামমাত্র কোর্স শেষ করে পরীক্ষা নিয়ে দায়সারা হয়ে গেলেও সেখানে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যটা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি আরও একটি উদ্বেগপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর থেকে বেশ কয়েকটি এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মাঝে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছে ১১ জন। বিষয়টি সত্যিই খুব দুঃখজনক। আরও একটি বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা টিউশন করে নিজের ও পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আর প্রায় দীর্ঘ ১ বছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার জন্য এখন সেই সুযোগটাও আর পাচ্ছে না তারা। ফলে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙে পড়েছে খুব করুণভাবে।
ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা সচল হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো আছে পূর্বাবস্থায়ই। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠা গেলেও দেশের শিক্ষার এই নির্মম ক্ষতি কাটিয়ে উঠা যাবে না। শিক্ষার্থী তার জীবনের এই মূল্যবান সময় কখনো ফিরে পাবে না। আর উচ্চশিক্ষায় অটোপাস নামক শব্দটাও প্রয়োগযোগ্য না যে এই অভাবনীয় ক্ষতি অটোপ্রমোশনের মাধ্যমে সেরে উঠা যাবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সেশন জটসহ সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের জীবনের এ অপূরণীয় ক্ষতির কথা বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া জরুরি।
[ লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ]
বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২১ মাঘ ১৪২৭, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪২
তামান্না শারমিন তিথি
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের জন্য গত বছর মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কয়েক মাস ধরে পুরো পৃথিবী স্থবির হয়ে থাকলেও এখন প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তবে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। আর তার মাঝে সর্বোচ্চ ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের উচ্চশিক্ষা। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৪১ লাখ। এর মধ্যে ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে প্রায় ৮ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। আবার ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার লাখের মতো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২ হাজার ২৫৮টি কলেজে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৮ লাখ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ লাখ। আর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে আরও প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনলাইন ক্লাস। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান সংরক্ষণ, জ্ঞান বিতরণে এই অনলাইন ক্লাসের সুফল আসলে কতদূর তাই আজকে ভাবার বিষয়। শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আর অনলাইন শিখনের মাঝে আছে বিরাট পার্থক্য। তাছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণে প্রয়োজনীয় ডাটা বা ডিভাইস কেনার সামর্থ্য না থাকা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্বল নেটওয়ার্ক কাঠামোর জন্য নিয়মিত ক্লাসে যুক্ত হতে না পারা, সুযোগ-সুবিধার অভাবে শহরের শিক্ষার্থীদের চেয়ে গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়া, একীভূত শিক্ষার অভাব, মনোযোগের অভাব, পড়াশোনার যথোপযুক্ত পরিবেশের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ অনলাইন ক্লাস। যার কারণে তা আসলে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যই ছুঁতে পারছে না। কয়েকটি বিভাগ বা ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের আর্থিক বা ইন্টারনেট সাহায্য দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই পুরোপুরি পড়াশোনার বাইরে। ফলে আমাদের সারা দেশে উচ্চশিক্ষার হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতি।
গত এক দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট প্রশংসনীয়ভাবে কমে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা এ সমস্যাটিকে ভুলতে শুরু করলেও কোভিড-১৯ এর ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন ভর্তি, ক্লাস নেয়া, পাঠ্যক্রম শেষ করা, পরীক্ষা গ্রহণে সামগ্রিক জটের মধ্যে পড়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব বিভাগ বা ইনস্টিটিউটে সেমিস্টার সিস্টেম বিদ্যমান, তাদের জন্য সমস্যাটি বেশি প্রকট। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আজ রয়েছে সেশনজটের আশঙ্কায়। আবার অনলাইনে নামমাত্র কোর্স শেষ করে পরীক্ষা নিয়ে দায়সারা হয়ে গেলেও সেখানে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যটা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি আরও একটি উদ্বেগপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর থেকে বেশ কয়েকটি এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মাঝে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছে ১১ জন। বিষয়টি সত্যিই খুব দুঃখজনক। আরও একটি বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা টিউশন করে নিজের ও পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আর প্রায় দীর্ঘ ১ বছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার জন্য এখন সেই সুযোগটাও আর পাচ্ছে না তারা। ফলে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙে পড়েছে খুব করুণভাবে।
ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা সচল হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো আছে পূর্বাবস্থায়ই। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠা গেলেও দেশের শিক্ষার এই নির্মম ক্ষতি কাটিয়ে উঠা যাবে না। শিক্ষার্থী তার জীবনের এই মূল্যবান সময় কখনো ফিরে পাবে না। আর উচ্চশিক্ষায় অটোপাস নামক শব্দটাও প্রয়োগযোগ্য না যে এই অভাবনীয় ক্ষতি অটোপ্রমোশনের মাধ্যমে সেরে উঠা যাবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সেশন জটসহ সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের জীবনের এ অপূরণীয় ক্ষতির কথা বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া জরুরি।
[ লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ]