আ-মরি বাংলা ভাষা

প্রায় সাত দশকেও তৈরি হয়নি ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা

সাদেকুর রহমান

স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির পঞ্চম দিন আজ। নিরন্তর আগ্রহোদ্দীপক এ মাসটি এলেই ‘অমর একুশে’, ‘ভাষা-শহীদ, ‘ভাষা-সন্তান’, ‘ভাষা-পুত্র’, ‘রক্তাক্ত অ আ ক খ’ ইত্যাকার শব্দমালা প্রতিটি বাংলাদেশি বাঙালির শিরা-উপশিরায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবেগে উচ্ছ্বাসিত হয় প্রাণ। কিন্তু নতুন প্রজন্ম কি জানে, ভাষা আন্দোলন শুধু বায়ান্নতেই সীমাবদ্ধ নয়। সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর এ জাতি পেয়েছে বাংলা ভাষা আপন করে। শাশ্বত ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠা করে সংকট লড়াইয়ের অগ্রজ সেনানিরা আমাদের ঋণের দায়ে আবদ্ধ করে গেছেন। আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় তারা হয়ে আছে আপন মহিমায় ভাস্বর, জ্যোতির্ময়। ইতিহাস বিকৃত করতে একটি কূটচক্র সবসময়ই তৎপর থাকে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এ ধরনের মতলববাজদের দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। যারা কিনা এখনও বিশিষ্ট জনদের বাংলা ভাষার দাবি আন্দোলনকে কৌশলে অস্বীকার করতে চায়।

ভাষা সৈনিক, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক এমআর মাহবুব তার ‘বাঙালা কী করে রাষ্ট্রভাষা হলো’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ‘অধ্যাপক (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল) আবুল কাসেম বহু চেষ্টা করেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসকমন্ডলিকে এ ব্যাপারে কোনরূপ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে সক্ষম হননি। ফলে সর্বস্তরে বাংলা চালু ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার একটি বাকসর্বস্ব বক্তব্যে পরিণত হয়। এমনকি যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনোত্তর ক্ষমতাসীন হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অধ্যাপক আবুল কাসেম পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে সর্বস্তরে বাংলা চালুর জন্য বাংলা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৬২ সালে (রাজধানীর মিরপুরে) বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু ও ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও বহুমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।’

এদিকে, প্রায় সাত দশকেও তৈরি হয়নি ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা। এ নিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দেয়ার এগারো বছরেও তেমন অগ্রগতি নেই। বাংলা ভাষার গৌরবের আন্দোলনে সম্পৃক্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশনাও দেয়া হয়। পরে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করে। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে কিছু নামে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক।

এমন পরিস্থিতিতে তালিকা প্রণয়ের কাজটি স্থগিত করা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। শুরুতেই জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়। কমিটি জানায়, মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। একটি হচ্ছে, যারা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রাখার কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, অর্থাৎ যারা ভাষা সংগঠক। অন্যটি হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের কারণে যারা কারাবরণ করেছেন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল শুধু ঢাকায়। কমিটির কার্যক্রমও থমকে আছে নানা কারণে।

যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আজ নেই। হাতে গোনা যেসব ভাষাসংগ্রামী বেঁচে আছেন তারা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, স্মৃতিবিভ্রমে ভুগছেন। তবুও যদি অবিলম্বে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে জীবিত ভাষা সৈনিকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ভাষাশহীদ ও ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়, সরকার ও রাষ্ট্রের দায় কিছুটা হলেও মিটবে বৈকি!

শুক্রবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২২ মাঘ ১৪২৭, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

প্রায় সাত দশকেও তৈরি হয়নি ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা

সাদেকুর রহমান

image

স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির পঞ্চম দিন আজ। নিরন্তর আগ্রহোদ্দীপক এ মাসটি এলেই ‘অমর একুশে’, ‘ভাষা-শহীদ, ‘ভাষা-সন্তান’, ‘ভাষা-পুত্র’, ‘রক্তাক্ত অ আ ক খ’ ইত্যাকার শব্দমালা প্রতিটি বাংলাদেশি বাঙালির শিরা-উপশিরায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবেগে উচ্ছ্বাসিত হয় প্রাণ। কিন্তু নতুন প্রজন্ম কি জানে, ভাষা আন্দোলন শুধু বায়ান্নতেই সীমাবদ্ধ নয়। সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর এ জাতি পেয়েছে বাংলা ভাষা আপন করে। শাশ্বত ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠা করে সংকট লড়াইয়ের অগ্রজ সেনানিরা আমাদের ঋণের দায়ে আবদ্ধ করে গেছেন। আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় তারা হয়ে আছে আপন মহিমায় ভাস্বর, জ্যোতির্ময়। ইতিহাস বিকৃত করতে একটি কূটচক্র সবসময়ই তৎপর থাকে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এ ধরনের মতলববাজদের দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। যারা কিনা এখনও বিশিষ্ট জনদের বাংলা ভাষার দাবি আন্দোলনকে কৌশলে অস্বীকার করতে চায়।

ভাষা সৈনিক, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক এমআর মাহবুব তার ‘বাঙালা কী করে রাষ্ট্রভাষা হলো’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ‘অধ্যাপক (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল) আবুল কাসেম বহু চেষ্টা করেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসকমন্ডলিকে এ ব্যাপারে কোনরূপ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে সক্ষম হননি। ফলে সর্বস্তরে বাংলা চালু ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার একটি বাকসর্বস্ব বক্তব্যে পরিণত হয়। এমনকি যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনোত্তর ক্ষমতাসীন হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অধ্যাপক আবুল কাসেম পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে সর্বস্তরে বাংলা চালুর জন্য বাংলা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৬২ সালে (রাজধানীর মিরপুরে) বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু ও ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও বহুমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।’

এদিকে, প্রায় সাত দশকেও তৈরি হয়নি ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা। এ নিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দেয়ার এগারো বছরেও তেমন অগ্রগতি নেই। বাংলা ভাষার গৌরবের আন্দোলনে সম্পৃক্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশনাও দেয়া হয়। পরে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করে। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে কিছু নামে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক।

এমন পরিস্থিতিতে তালিকা প্রণয়ের কাজটি স্থগিত করা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। শুরুতেই জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়। কমিটি জানায়, মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। একটি হচ্ছে, যারা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত রাখার কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, অর্থাৎ যারা ভাষা সংগঠক। অন্যটি হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের কারণে যারা কারাবরণ করেছেন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল শুধু ঢাকায়। কমিটির কার্যক্রমও থমকে আছে নানা কারণে।

যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আজ নেই। হাতে গোনা যেসব ভাষাসংগ্রামী বেঁচে আছেন তারা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, স্মৃতিবিভ্রমে ভুগছেন। তবুও যদি অবিলম্বে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে জীবিত ভাষা সৈনিকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ভাষাশহীদ ও ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়, সরকার ও রাষ্ট্রের দায় কিছুটা হলেও মিটবে বৈকি!