মায়ানমারে আবারও দন্ডমুন্ডের কর্তা সেনাবাহিনী

মোহাম্মদ আবু নোমান

মায়ানমারে সেনা শাসন নতুন নয় এবং নতুন করে সামরিক অভ্যুত্থানের নাটকীয়তায় আমাদের বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। বিশ্বজুড়ে মায়ানমারের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি ছিল সামরিক শাসনের। মায়ানমারে সেনাবাহিনীই যে দন্ডমুন্ডের গুরু, এখন তা আবারও প্রমাণিত হলো। মজা ও কৌতুকের দিক হলো, সেনাবাহিনী জানিয়েছে তারা সংবিধানের বিধান অনুযায়ীই ক্ষমতা নিয়েছে। যেভাবে শান্তির মুখোশে নোভেল জয়ী, ভয়ঙ্কর ক্ষমতা লোভী, অহিংস নেত্রীখ্যাত, মানবাধিকারের প্রতীক তকমাধারী, অং সান সু চি একদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, অন্যদিকে হত্যা, ধর্ষণ, আগুন জ্বালিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়াসহ রোহিঙ্গাদের জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। হিটলারের নাৎসি সরকার যেমন ইহুদি জনগোষ্ঠীকে গ্যাস চেম্বারে পুরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সু চির সরকারও হত্যার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সব রকমভাবে সন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে, মানুষের রাজনৈতিক ও আবাসিক অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে মায়ানমারের আচরণ সবসময়ই শুধু শঠতা, অমানবিকতাই নয়, ছিল শতভাগ ন্যায়নীতির বিরোধীও। রাখাইনে তাদের ভিটেমাটি বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের বসতভিটা এখন অচেনা জনপদে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোন একসময় রোহিঙ্গা জনবসতি ছিল এমনটা অনুমান করাও এখন দুঃসাধ্য।

১৯৬২ সাল থেকে টানা ৫০ বছরের সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রায় ২০১৫ সালে দেশটিতে প্রথম নির্বাচন হলেও তা সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত ছিল না। অর্থাৎ দেশটি মাঝখানে মাত্র ১০ বছর ‘কথিত’ গণতন্ত্রের পথে বলা হলেও এ সময়েও সামরিক হস্তক্ষেপ যখন তখনই ছিল।

ইতিপূর্বে গৃহবন্ধী থাকাবস্থায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রাম ও অবস্থান নেয়ার ঘোষণা এবং অঙ্গীকার করেছিলেন। তখন রোহিঙ্গা মুসলমানরা তার মুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল। অথচ ক্ষমতায় আসার পর সু চি রোহিঙ্গা নিপীড়নে মদত দেন। সু চির মুক্তির জন্য আন্দোলনকারীরা জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্বে অং সান সু চির যে জনপ্রিয়তা ও ভালো অবস্থান রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার পরই সেটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি সমালোচিত হন; বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সু চিকে দেয়া সম্মানসূচক ডিগ্রি ও পদক প্রত্যাহার করে নেয়।

গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকারে দীর্ঘ বন্দিত্ব শেষে ২০১০ সালে মুক্তি দেয়া হয়েছিল অং সান সু চিকে। বিশ্ববাসী দেখেছে, সেই সু চি আন্তর্জাতিক আদালতে মায়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের জবাব দিলেও, অপরাধ করা সত্ত্বেও তার দেশের সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে জনপ্রিয়তা অর্জন ও সেনাবাহিনীকে রক্ষার চেষ্টা করলেও এখন সু চিরই রক্ষা হলো না। এখন বুঝতেছেন মজা...। স্বাভাবিকভাবেই এখন সু চি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি, আন্তর্জাতিক সুনাম ও মিত্র তথা দুকূলই হারিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন।

শুধু ক্ষমতাকে আঁকরে থাকার জন্য নীতি ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক মুসলিম অধ্যুষিত রোহিঙ্গাদের বর্বর নির্যাতন ও বাধ্যতামূলক দেশত্যাগের ঘটনাকে সমর্থন দানের কারণে বিশ্বব্যাপী সু চির জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে। তাই সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ হলেও সু চির গ্রেপ্তারে অধিকাংশ বিশ্ব জনমত তার পক্ষে নেই বলে আমরা বিশ্বাস করি।

মায়ানমারে সেনা নিয়ন্ত্রণের ঘটনা অং সান সু চির জন্য একটি বড় শিক্ষা। দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাকে দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এ কারণে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ ক্ষমতার প্রলোভনে তিনি সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর চালানো জাতিগত নিধন ও তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে গেছেন। এ কারণে বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যে ক্ষমতার জন্য তিনি জেনে-বুঝে এ ক্ষতি মেনে নিয়েছিলেন, এবার সেই ক্ষমতা তাকে হারাতে হলো, নিয়তির এ এক পরিহাসই বটে!

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে থাকেন, সেখানে কীভাবে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটে? কীভাবে সেদেশের রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে? আজকের এই সভ্যযুগে নারী ও শিশুদের কীভাবে ধর্ষণ করতে পারে? কীভাবে লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে তাদের নিজেদের ভিটেমাটি থেকে?

সু চিকে গ্রেপ্তারের কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইড়েনের হুঁশিয়ারি ও জাতিসংঘের মহাসচিব নিন্দা জানিয়েছেন। অথচ ইতিপূর্বে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন গাফিলতি ও স্বার্থের হিসাব-নিকাশের কারণে মায়ানমার এমন দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন করে ভিটেমাটি থেকে মুছে দেয়ার বিভীষিকা দীর্ঘ দিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের সামনে ঘটেছে। এখন দেখার বিষয় হলো, মায়ানমারে গণতন্ত্র রক্ষায় আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো কী পদক্ষেপ নেয়? ইরাক, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, আফগানিস্তান, তিউনিসিয়াতে যেমন ‘গণতন্ত্র উদ্ধারে’ সেনা ও ন্যাটো সৈন্য পাঠিয়েছিল; মায়ানমারে গণতন্ত্র উদ্ধারেও কী সৈন্য পাঠাবে? নাকি কেবল কঠোর ‘নিন্দা’ আর বিবৃতি জানিয়ে দায় সারবে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, মায়ানমারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার যেকোন ধরনের চেষ্টার বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। মায়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টারও বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটলে মায়ানমারের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অ্যাকশন নেয়াসহ গ্রেপ্তারদের ছেড়ে না দিলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন সু চিকে ছেড়ে না দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অথচ যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করা হয়েছিল তখন কোথায় ছিল মানবতা, কোথায় ছিল পশ্চিমারা? রোহিঙ্গা মুসলমানদের বেলায় এমন হুংকার কোথায় ছিল?

প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে হুমকি-ধমকি দেয়ার আগে চীনের কথাও মনে রাখতে হবে। কোন দেশের সেনাবাহিনী এত অপরিপক্ব নয় যে, কোন শক্তির ব্যাপআপ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করবে! পেছনে শক্তিধর কোন দেশের মদত ও সাপোর্ট ছাড়া সেনা ক্যু হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী যে কারণে সু চির হাত থেকে ক্ষমতা ছিনতাই করেছে, চীনও একই কারণে তাতে সমর্থন দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মায়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনের শিকড় বিস্তার দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রভাব বাড়াতে পারে বলে চীনের বিশেষ ভাবনা রয়েছে। চীনের কাছে মায়ানমারের ভূকৗশলগত গুরুত্ব উত্তর কোরিয়ার মতো। সীমান্ত লাগোয়া এই দেশগুলোতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রভাবই দেখতে চায় না এবং সেটা যেকোন মূল্যে। শুধু সামরিক অভ্যুত্থান নয়, মায়ানমারজুড়ে খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন এবং জাতিগত নিপীড়নেও চীন স্থানীয় জেনারেলদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হয়ে ছিল দশকের পর দশক ধরে। ফলে ধারণা করা যায়, জনগণের মতামতের বিরুদ্ধে চলতি সেনা আগ্রাসনেও চীনের নীরব সম্মতি রয়েছে।

মায়ানমারে মানবাধিকার, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ফিরে আসুক। সহিংসতা থেকে সব পক্ষকে বিরত থাকতে হবে। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। জনগণের ভোটে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার মানসিকতাসম্পন্ন সরকার ক্ষমতায় আসুক এটাই আমাদের কামনা।

abunoman1972@gmail.com

শুক্রবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২২ মাঘ ১৪২৭, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মায়ানমারে আবারও দন্ডমুন্ডের কর্তা সেনাবাহিনী

মোহাম্মদ আবু নোমান

image

মায়ানমারে সেনা শাসন নতুন নয় এবং নতুন করে সামরিক অভ্যুত্থানের নাটকীয়তায় আমাদের বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। বিশ্বজুড়ে মায়ানমারের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি ছিল সামরিক শাসনের। মায়ানমারে সেনাবাহিনীই যে দন্ডমুন্ডের গুরু, এখন তা আবারও প্রমাণিত হলো। মজা ও কৌতুকের দিক হলো, সেনাবাহিনী জানিয়েছে তারা সংবিধানের বিধান অনুযায়ীই ক্ষমতা নিয়েছে। যেভাবে শান্তির মুখোশে নোভেল জয়ী, ভয়ঙ্কর ক্ষমতা লোভী, অহিংস নেত্রীখ্যাত, মানবাধিকারের প্রতীক তকমাধারী, অং সান সু চি একদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, অন্যদিকে হত্যা, ধর্ষণ, আগুন জ্বালিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়াসহ রোহিঙ্গাদের জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। হিটলারের নাৎসি সরকার যেমন ইহুদি জনগোষ্ঠীকে গ্যাস চেম্বারে পুরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সু চির সরকারও হত্যার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সব রকমভাবে সন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে, মানুষের রাজনৈতিক ও আবাসিক অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে মায়ানমারের আচরণ সবসময়ই শুধু শঠতা, অমানবিকতাই নয়, ছিল শতভাগ ন্যায়নীতির বিরোধীও। রাখাইনে তাদের ভিটেমাটি বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের বসতভিটা এখন অচেনা জনপদে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোন একসময় রোহিঙ্গা জনবসতি ছিল এমনটা অনুমান করাও এখন দুঃসাধ্য।

১৯৬২ সাল থেকে টানা ৫০ বছরের সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রায় ২০১৫ সালে দেশটিতে প্রথম নির্বাচন হলেও তা সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত ছিল না। অর্থাৎ দেশটি মাঝখানে মাত্র ১০ বছর ‘কথিত’ গণতন্ত্রের পথে বলা হলেও এ সময়েও সামরিক হস্তক্ষেপ যখন তখনই ছিল।

ইতিপূর্বে গৃহবন্ধী থাকাবস্থায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রাম ও অবস্থান নেয়ার ঘোষণা এবং অঙ্গীকার করেছিলেন। তখন রোহিঙ্গা মুসলমানরা তার মুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল। অথচ ক্ষমতায় আসার পর সু চি রোহিঙ্গা নিপীড়নে মদত দেন। সু চির মুক্তির জন্য আন্দোলনকারীরা জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্বে অং সান সু চির যে জনপ্রিয়তা ও ভালো অবস্থান রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার পরই সেটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি সমালোচিত হন; বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সু চিকে দেয়া সম্মানসূচক ডিগ্রি ও পদক প্রত্যাহার করে নেয়।

গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকারে দীর্ঘ বন্দিত্ব শেষে ২০১০ সালে মুক্তি দেয়া হয়েছিল অং সান সু চিকে। বিশ্ববাসী দেখেছে, সেই সু চি আন্তর্জাতিক আদালতে মায়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের জবাব দিলেও, অপরাধ করা সত্ত্বেও তার দেশের সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে জনপ্রিয়তা অর্জন ও সেনাবাহিনীকে রক্ষার চেষ্টা করলেও এখন সু চিরই রক্ষা হলো না। এখন বুঝতেছেন মজা...। স্বাভাবিকভাবেই এখন সু চি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি, আন্তর্জাতিক সুনাম ও মিত্র তথা দুকূলই হারিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন।

শুধু ক্ষমতাকে আঁকরে থাকার জন্য নীতি ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক মুসলিম অধ্যুষিত রোহিঙ্গাদের বর্বর নির্যাতন ও বাধ্যতামূলক দেশত্যাগের ঘটনাকে সমর্থন দানের কারণে বিশ্বব্যাপী সু চির জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে। তাই সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ হলেও সু চির গ্রেপ্তারে অধিকাংশ বিশ্ব জনমত তার পক্ষে নেই বলে আমরা বিশ্বাস করি।

মায়ানমারে সেনা নিয়ন্ত্রণের ঘটনা অং সান সু চির জন্য একটি বড় শিক্ষা। দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাকে দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এ কারণে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ ক্ষমতার প্রলোভনে তিনি সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর চালানো জাতিগত নিধন ও তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে গেছেন। এ কারণে বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। যে ক্ষমতার জন্য তিনি জেনে-বুঝে এ ক্ষতি মেনে নিয়েছিলেন, এবার সেই ক্ষমতা তাকে হারাতে হলো, নিয়তির এ এক পরিহাসই বটে!

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে থাকেন, সেখানে কীভাবে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটে? কীভাবে সেদেশের রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে? আজকের এই সভ্যযুগে নারী ও শিশুদের কীভাবে ধর্ষণ করতে পারে? কীভাবে লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে তাদের নিজেদের ভিটেমাটি থেকে?

সু চিকে গ্রেপ্তারের কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইড়েনের হুঁশিয়ারি ও জাতিসংঘের মহাসচিব নিন্দা জানিয়েছেন। অথচ ইতিপূর্বে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন গাফিলতি ও স্বার্থের হিসাব-নিকাশের কারণে মায়ানমার এমন দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন করে ভিটেমাটি থেকে মুছে দেয়ার বিভীষিকা দীর্ঘ দিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের সামনে ঘটেছে। এখন দেখার বিষয় হলো, মায়ানমারে গণতন্ত্র রক্ষায় আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো কী পদক্ষেপ নেয়? ইরাক, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, আফগানিস্তান, তিউনিসিয়াতে যেমন ‘গণতন্ত্র উদ্ধারে’ সেনা ও ন্যাটো সৈন্য পাঠিয়েছিল; মায়ানমারে গণতন্ত্র উদ্ধারেও কী সৈন্য পাঠাবে? নাকি কেবল কঠোর ‘নিন্দা’ আর বিবৃতি জানিয়ে দায় সারবে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, মায়ানমারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার যেকোন ধরনের চেষ্টার বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। মায়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টারও বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটলে মায়ানমারের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অ্যাকশন নেয়াসহ গ্রেপ্তারদের ছেড়ে না দিলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন সু চিকে ছেড়ে না দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অথচ যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করা হয়েছিল তখন কোথায় ছিল মানবতা, কোথায় ছিল পশ্চিমারা? রোহিঙ্গা মুসলমানদের বেলায় এমন হুংকার কোথায় ছিল?

প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে হুমকি-ধমকি দেয়ার আগে চীনের কথাও মনে রাখতে হবে। কোন দেশের সেনাবাহিনী এত অপরিপক্ব নয় যে, কোন শক্তির ব্যাপআপ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করবে! পেছনে শক্তিধর কোন দেশের মদত ও সাপোর্ট ছাড়া সেনা ক্যু হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী যে কারণে সু চির হাত থেকে ক্ষমতা ছিনতাই করেছে, চীনও একই কারণে তাতে সমর্থন দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মায়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনের শিকড় বিস্তার দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রভাব বাড়াতে পারে বলে চীনের বিশেষ ভাবনা রয়েছে। চীনের কাছে মায়ানমারের ভূকৗশলগত গুরুত্ব উত্তর কোরিয়ার মতো। সীমান্ত লাগোয়া এই দেশগুলোতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রভাবই দেখতে চায় না এবং সেটা যেকোন মূল্যে। শুধু সামরিক অভ্যুত্থান নয়, মায়ানমারজুড়ে খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন এবং জাতিগত নিপীড়নেও চীন স্থানীয় জেনারেলদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হয়ে ছিল দশকের পর দশক ধরে। ফলে ধারণা করা যায়, জনগণের মতামতের বিরুদ্ধে চলতি সেনা আগ্রাসনেও চীনের নীরব সম্মতি রয়েছে।

মায়ানমারে মানবাধিকার, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ফিরে আসুক। সহিংসতা থেকে সব পক্ষকে বিরত থাকতে হবে। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। জনগণের ভোটে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার মানসিকতাসম্পন্ন সরকার ক্ষমতায় আসুক এটাই আমাদের কামনা।

abunoman1972@gmail.com