মমতার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের রাজনৈতিক তাৎপর্য

গৌতম রায়

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় ছিলেন, ততদিন আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির রাজনীতি আর ধর্মান্ধতার মিশেল স্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’ সম্পর্কে কোনো আপত্তির কথা কেউ কখনো শোনেননি। গুজরাট গণহত্যায় বহুল ব্যবহৃত এই স্লোগান ঘিরে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্যা মমতা কখনো এতটুকু আপত্তি জানাননি। বরং সেই স্লোগান দিতে দিতে মুসলমানের রক্তে হাত রাঙিয়ে নরেন্দ্র মোদি আবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুল পাঠাতেও মমতার কোনো অসুবিধা হয়নি। মমতা যখন বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবার লক্ষ্যে সিঙ্গুর ঘিরে ধর্মতলায় অনশনের অভিনয় করেছিলেন, তখন বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং আসার পর, সেখানে জমে থাকা বিজেপি সমর্থকেরা যখন সেই স্লোগান দেয়, সেদিনের বিরোধী নেত্রীর কাছে চরম সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতবাহী সেই স্লোগান ঘিরে কোনো আপত্তি উঠেনি।

২০১৯ সালের লোকসভার ভোটে এই রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসন পাওয়ার পর, বিজেপিকে জেতাতে মমতা বা তার দল কীভাবে- কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে সাহায্য করেছে, সেই বিষয়টি যখন সর্বস্তরের মানুষের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন বিজেপির সঙ্গে ছদ্ম দূরত্বটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতেই প্রকাশ্য জনপথে ওই স্লোগানটিকে ঘিরে মমতা এমন আচরণ করলেন, যে আচরণ কে কোনো অবস্থাতেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পরিচয়ের সঙ্গে খাপ খায় না। বিজেপির সঙ্গে নিজের ছদ্ম দূরত্ব বোঝাতে ভাটপাড়া তে প্রকাশ্য রাস্তায় বিজেপির স্লোগানের মোকাবিলার নাম করে তিনি চূড়ান্ত ভাষা এবং জাতি বিদ্বেষ ছড়ালেন। তারপর থেকেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ জীবনপণ লড়াই করে যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিজয় বৈজয়ন্তী উড়িয়ে ছিলেন, সেই স্লোগানের অনুকরণে মমতা জাতি এবং ভাষা বিদ্বেষ ছড়িয়ে, আরএসএস-বিজেপির ধর্মান্ধতার প্রতিকল্প হিসেবে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার আমদানি ঘটালেন।

মমতা আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে তার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সাথে বিজেপির পক্ষে মেরুকরণের রাজনীতিকে আরো স্পষ্ট করতে সংযুক্ত করেছেন ভাষা-জাতপাতভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে। এ উদ্দেশেই তিনি গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর থেকে যে বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন, সেটিকে যেমন সময়ের নিরিখে উচ্চানাদে নিয়ে গিয়েছেন, তেমনিই ‘বহিরাগত’ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তত্ত্বের ভিতর দিয়ে মমতা ঠিক শিবসেনার মারাঠি অস্মিতা বা আনন্দমার্গের রাজনৈতিক সংগঠন ‘আমরা বাঙালির’ উগ্রতার আমদানি ঘটাতে চাইছেন। এই উগ্রতার ভিতর দিয়ে আরএসএস-বিজেপির ধর্মান্ধতা আর মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এমন একটা জায়গাতে গিয়ে পৌঁছতে শুরু করেছে, যার জেরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অবাঙালি ভারতীয় নাগরিকেরা, যারা রুটি-রুজির তাগিদে এই রাজ্যে কত পুরুষ আগে এসেছেন, তার সালতামামি তাদের নিজেদেরই মনে নেই, সেসব মানুষদের ভিতরে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছেন। আর এর পাল্টা হিসেবে অন্য রাজ্যগুলোতে রুটি-রুজির জন্যে যেসব বাঙালিরা আছেন, তাদের সেসব রাজ্যের মানুষদের বিদ্বেষের শিকার করে তুলছেন। আরএসএস-বিজেপির যে বিদ্বেষের রাজনীতি, বিভাজনের কৌশল- তাকে এভাবে উস্কে দিচ্ছেন মমতা। এভাবেই তিনি সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে সাহায্য করে চলেছেন।

রাজ্য বিধানসভার ভোট যত এগিয়ে আসছে, মমতা ততোই তার বিজেপিকে সাহায্য করবার নতুন কৌশল, ‘ভাষা-জাতপাতভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা’কে আরো উগ্র করে তুলতে বিজেপির রাজনৈতিক স্লোগানের অনুকরণে নিজের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’কে তুলে ধরতে শুরু করেছেন। এই স্লোগান টিকে মমতা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে কিন্তু তুলে ধরছেন না। এই স্লোগান মমতা তুলে ধরছেন ভাষা-জাতপাতকেন্দ্রিক অস্মিতাকে চাগিয়ে দিয়ে বিজেপিকে ভোট রাজনীতিতে সুবিধে করে দিতে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে সামনে রেখে হানাদার পাক বাহিনীকে মিত্রশক্তির সহায়তার পর্যুদস্ত করেছিল, সেই স্লোগানের মূলভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। মমতা কিন্তু কোনো অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে তার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে তুলে ধরছেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার দ্বারা নিজের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে মানুষের সামনে মেলে ধরছেন না।

ধর্মান্ধ চেতনাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতেই মমতা এই রাজ্যের বাঙালি অধিবাসীদের সঙ্গে অবাঙালি অধিবাসীদের একটা ভয়াবহ দ্বন্দ্ব তৈরি করতে, সংঘাত সৃষ্টি করতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে তুলে ধরছেন। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে উঠে এসে মুসলিম জাতীয়তার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, তার অন্তস্থলে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার চেতনাই ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের মতো বহুভাষী দেশে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংগ্রামঋদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার মূল স্লোগান ‘জয় বাংলার’ দর্শনজনিত সাদৃশ্য নেই। মমতা যে ‘জয় বাংলার’ স্লোগান দিচ্ছেন, সেই স্লোগান কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ ‘জয় বাংলার’ সঙ্গে কখনোই সম্পৃক্ত নয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির আন্তর্জাতিক মাত্রা পাওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো- স্লোগানটির অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার বিশ্বস্ত দোসর হিসেবে পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা।

মমতা এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে যে দ্যোতনায় তুলে ধরছেন, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার কোনো জায়গা নেই। বরং রয়েছে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলার নাম করে ভাষাভিত্তিক, জাতপাতভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ডিমে তা দেওয়ার একটা জঘন্য ষড়যন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক স্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির ভিতর দিয়ে পরীক্ষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভিত্তি স্থাপন করেছিল, মমতা সেই স্লোগানটিকে আঞ্চলিক ভেদবুদ্ধির নিরিখে তুলে ধরে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে একদম খুন করতেই, বিভাজনের উদ্দেশে, বাঙালি-অবাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বনাম ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের ভিতরে একটা সংঘাত তৈরি করে বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই এই স্লোগানটিকে তুলে ধরছেন।

মমতা যখন এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের ধর্ম-রাজনীতির মিশেল দেওয়া স্লোগান ‘জয় শ্রীরামের’ তৃণমূলীয় পরিপূরক হিসেবে তুলে ধরছেন, ঠিক তখনই মমতার এই স্লোগানযুদ্ধের লোক দেখানো খেলাকে বিজেপির দিলীপ ঘোষ বর্ণনা করছেন, মমতার ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ তৈরির উদ্যোগ হিসেবে। আরএসএস-বিজেপি বঙ্গবন্ধু উত্তর বাংলাদেশের সংবিধানে স্বৈরাচারী এরশাদ কর্তৃক রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অন্তর্ভুক্তিকে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এভাবে তুলে ধরতে চায় যে, বাংলাদেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান যে অর্থে ইসলামিক রাষ্ট্র, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যে সেই চেতনার অনুসারী আদৌ নয়, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি সেটা কিছুতেই স্বীকার করে না। এই প্রকৃত সত্যটা যে ভারতের সাধারণ মানুষ জানুক, সেটাও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি চায় না। তাই মমতা যে অর্থে বাংলাদেশে তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মবলিদানের ভিতর দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে বুকে ধারণ করে, যে স্লোগান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শাহাদাত বরণের পর জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ, খালেদা জিয়া কার্যত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশে, তাকে পশ্চিমবঙ্গে তুলে ধরছেন বিভাজনের রাজনীতিকেই উস্কে দিতে, বিজেপির প্রতি সাহায্যকারী মমতার এই ভূমিকাকেই ব্যবহার করছে আরএসএস-বিজেপি। মমতা যেভাবে বিজেপির সঙ্গে একটা ছদ্ম সংঘাতের পথে হেঁটে বিজেপিকে সবরকম ভাবে সাহায্য করছেন, বিজেপিও এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ঘিরে মমতার ভূমিকাকে কেন্দ্র করে, মমতার বিরুদ্ধে একটা ছদ্ম লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছে।

মমতা তার দশ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছেন। ফলে বাংলাদেশে প্রবহমান গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার, সেদেশের ইসলামীয় মৌলবাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। মমতার এ বাংলাদেশকে পানিতে মারার ষড়যন্ত্রের ভিতর দিয়ে একদিকে লাভবান হয়েছে বাংলাদেশের ইসলামীয় মৌলবাদীরা। তারা খুব সহজেই মমতার ব্যক্তিগত অভিসন্ধিকে ভারতের অভিসন্ধি হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। এ বিভ্রান্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেখানে যেমন সুযোগ পেয়েছে, বিক্ষিপ্তভাবে অত্যাচার চালিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার সেসব অত্যাচারের খবর পাওয়া মাত্রই চূড়ান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলেও, সেখানকার ইসলামীয় মৌলবাদীদের আচরণকে সম্বল করে ভারতের হিন্দু মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানেদের ওপর যেখানে যেভাবে পেরেছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অত্যাচার চালিয়েছে। মমতা আন্তর্জাতিকভাবে অভিনন্দিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কেনিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করে দিলীপ ঘোষের মতো বিজেপি নেতাদের ‘মমতা গ্রেটার বাংলাদেশ তৈরির ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত অভিযোগ তোলবার যে সুযোগ করে দিয়েছেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন ভোটে সীমান্তবর্তী এলাকাসহ রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় বিভাজনের পরিবেশ তৈরির একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল।

বাঙালি জাতিসত্তার সম্যক বিকাশের যে ঐতিহাসিক পরম্পরা আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে ধারণ করছে, তার সঙ্গে ভারতের মতো একটি বহু ভাষাভাষী, সংস্কৃতির বৈচিত্রপূর্ণ দেশের একটি অঙ্গ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানা চরম বিভ্রান্তিকর। অথচ মমতা তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে অন্য রাজ্য থেকে বিজেপির যেসব নেতারা এই রাজ্যে তাদের দলের রাজনৈতিক প্রয়োজনে আসছেন, তাদের ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে দিচ্ছেন। এ ধরনের তকমাতে ভারতের একটি রাজ্য থেকে যে কোনো প্রয়োজনেই অপর একটি রাজ্যে আসা মানুষকে দেগে দেওয়ার অর্থ হলো- জাতি এবং ভাষা বিদ্বেষকে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া। মমতা বিজেপির যেসব নেতারা ভিন প্রদেশ থেকে আসছেন এই রাজ্যে, তাদের উদ্দেশ্যে কিন্তু একটিবারের জন্যও কোনো রাজনৈতিক আক্রমণ করছেন না। ভারতের মানুষকে এক রাজ্য থেকে রাজনৈতিক তাগিদে বা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে আসাটার পেছনে ‘বহিরাগত’ তত্ত্বের অবতারণা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব যে মমতার দলের ভিন রাজ্যের অধিবাসী সাংসদ দ্বিনেশ ত্রিবেদির উদ্দেশে খাটে কিনা বলে বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, সেই বিষয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি।

মমতা কর্তৃক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিষয়টিকে যেমন প্রতিবেশি বাংলাদেশের রক্তার্জিত স্বাধীনতার প্রতি বিজেপির চরম কদর্য মানসিকতায় পর্যবসিত করবার অভিপ্রায় আমরা দেখেছি, তেমনই এ ‘বহিরাগত তত্ত্ব’ ঘিরে তৃণমূলের লোকসভাতে পরাজয়ের পর রাজ্যসভার সাংসদ দ্বিনেশ ত্রিবেদিকে ঘিরে বিজেপির বিতর্র্কের অবতারণা, তা কেবল বাংলার রাজনীতিকেই আগামী দিনে প্রভাবিত করবে না। ধর্মান্ধতার পাশাপাশি ভাষা এবং জাতপাত ঘিরে বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতার’ গোটা দেশব্যাপী প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের রাস্তাটিকে নগ্নভাবে খুলে দেবে।

রাস্তাকে এভাবে নগ্ন করে তুলতেই মমতা চাইছিলেন। তিনি বিজেপির পশ্চিবঙ্গে পা রাখবার সিঁড়ি হিসেবে এতকাল ব্যবহৃত হয়েছেন। এখন মমতা চাইছেন, নিজের পিঠের ওপর বিজেপির ভার বহন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, গান্ধী হত্যাকারী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই উদ্দেশেই রাজ্য বিধানসভার সদ্য সমাপ্ত সংক্ষিপ্ততম অধিবেশনে বিজেপির স্লোগানের মোকাবিলায় নিজের স্লোগান ঘিরে শীবাকীর্তন গাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সিপিআই (এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বিধানসভার ভিতরে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে, স্লোগানটির মূল ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কীভাবে গঙ্গাযাত্রা ঘটাচ্ছেন, তা বোঝাতে চাইলেও আনন্দবাজার পত্রিকা সুজন বাবুর বক্তব্যকে ঘিরে একটা বিকৃত মানসিকতা তৈরিতে প্রবৃত্ত হলো। এই পত্রিকা এমনভাবে বিধানসভার ভিতরে স্লোগান বিতর্ককে উপস্থাপিত করলো, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয়- সিপিআই (এম) নেতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্লোগানটির বিরোধিতা করছেন।

মমতা যেহারে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন প্রতিদিন নিজের পেটোয়া খবরের কাগজগুলোতে দিচ্ছেন, তাতে সুজন বাবুকে বিকৃত করে মমতার প্রিয়পাত্র হওয়া ছাড়া আনন্দবাজারের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ অবশ্য ছিল না। বাবু যত বলে, পারিষদগণ বলে তার শতগুণ, দুই বিঘা জমিতে রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত আপ্তবাক্যের প্রতি মর্যাদা দিয়েই ওই কাগজের এক সাংবাদিক সামাজিক গণমাধ্যমে নিজের কাগজের অপব্যাখ্যার সমর্থনে সুজন চক্রবর্তীকে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিরোধী বলে মন্তব্য করতেও ছাড়েননি। এ বাংলাতেই কাঙাল হরিনাথ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মুজিবুর রহমান (দি মুসলমান), বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়রা সাংবাদিকতা করেছিলেন- এটা ভাবতেও এখন লজ্জা হয়।

শনিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৩ মাঘ ১৪২৭, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মমতার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের রাজনৈতিক তাৎপর্য

গৌতম রায়

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় ছিলেন, ততদিন আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির রাজনীতি আর ধর্মান্ধতার মিশেল স্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’ সম্পর্কে কোনো আপত্তির কথা কেউ কখনো শোনেননি। গুজরাট গণহত্যায় বহুল ব্যবহৃত এই স্লোগান ঘিরে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্যা মমতা কখনো এতটুকু আপত্তি জানাননি। বরং সেই স্লোগান দিতে দিতে মুসলমানের রক্তে হাত রাঙিয়ে নরেন্দ্র মোদি আবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুল পাঠাতেও মমতার কোনো অসুবিধা হয়নি। মমতা যখন বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবার লক্ষ্যে সিঙ্গুর ঘিরে ধর্মতলায় অনশনের অভিনয় করেছিলেন, তখন বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং আসার পর, সেখানে জমে থাকা বিজেপি সমর্থকেরা যখন সেই স্লোগান দেয়, সেদিনের বিরোধী নেত্রীর কাছে চরম সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতবাহী সেই স্লোগান ঘিরে কোনো আপত্তি উঠেনি।

২০১৯ সালের লোকসভার ভোটে এই রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসন পাওয়ার পর, বিজেপিকে জেতাতে মমতা বা তার দল কীভাবে- কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে সাহায্য করেছে, সেই বিষয়টি যখন সর্বস্তরের মানুষের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন বিজেপির সঙ্গে ছদ্ম দূরত্বটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতেই প্রকাশ্য জনপথে ওই স্লোগানটিকে ঘিরে মমতা এমন আচরণ করলেন, যে আচরণ কে কোনো অবস্থাতেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পরিচয়ের সঙ্গে খাপ খায় না। বিজেপির সঙ্গে নিজের ছদ্ম দূরত্ব বোঝাতে ভাটপাড়া তে প্রকাশ্য রাস্তায় বিজেপির স্লোগানের মোকাবিলার নাম করে তিনি চূড়ান্ত ভাষা এবং জাতি বিদ্বেষ ছড়ালেন। তারপর থেকেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ জীবনপণ লড়াই করে যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিজয় বৈজয়ন্তী উড়িয়ে ছিলেন, সেই স্লোগানের অনুকরণে মমতা জাতি এবং ভাষা বিদ্বেষ ছড়িয়ে, আরএসএস-বিজেপির ধর্মান্ধতার প্রতিকল্প হিসেবে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার আমদানি ঘটালেন।

মমতা আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে তার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সাথে বিজেপির পক্ষে মেরুকরণের রাজনীতিকে আরো স্পষ্ট করতে সংযুক্ত করেছেন ভাষা-জাতপাতভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে। এ উদ্দেশেই তিনি গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর থেকে যে বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন, সেটিকে যেমন সময়ের নিরিখে উচ্চানাদে নিয়ে গিয়েছেন, তেমনিই ‘বহিরাগত’ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তত্ত্বের ভিতর দিয়ে মমতা ঠিক শিবসেনার মারাঠি অস্মিতা বা আনন্দমার্গের রাজনৈতিক সংগঠন ‘আমরা বাঙালির’ উগ্রতার আমদানি ঘটাতে চাইছেন। এই উগ্রতার ভিতর দিয়ে আরএসএস-বিজেপির ধর্মান্ধতা আর মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এমন একটা জায়গাতে গিয়ে পৌঁছতে শুরু করেছে, যার জেরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অবাঙালি ভারতীয় নাগরিকেরা, যারা রুটি-রুজির তাগিদে এই রাজ্যে কত পুরুষ আগে এসেছেন, তার সালতামামি তাদের নিজেদেরই মনে নেই, সেসব মানুষদের ভিতরে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছেন। আর এর পাল্টা হিসেবে অন্য রাজ্যগুলোতে রুটি-রুজির জন্যে যেসব বাঙালিরা আছেন, তাদের সেসব রাজ্যের মানুষদের বিদ্বেষের শিকার করে তুলছেন। আরএসএস-বিজেপির যে বিদ্বেষের রাজনীতি, বিভাজনের কৌশল- তাকে এভাবে উস্কে দিচ্ছেন মমতা। এভাবেই তিনি সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে সাহায্য করে চলেছেন।

রাজ্য বিধানসভার ভোট যত এগিয়ে আসছে, মমতা ততোই তার বিজেপিকে সাহায্য করবার নতুন কৌশল, ‘ভাষা-জাতপাতভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা’কে আরো উগ্র করে তুলতে বিজেপির রাজনৈতিক স্লোগানের অনুকরণে নিজের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’কে তুলে ধরতে শুরু করেছেন। এই স্লোগান টিকে মমতা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে কিন্তু তুলে ধরছেন না। এই স্লোগান মমতা তুলে ধরছেন ভাষা-জাতপাতকেন্দ্রিক অস্মিতাকে চাগিয়ে দিয়ে বিজেপিকে ভোট রাজনীতিতে সুবিধে করে দিতে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে সামনে রেখে হানাদার পাক বাহিনীকে মিত্রশক্তির সহায়তার পর্যুদস্ত করেছিল, সেই স্লোগানের মূলভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। মমতা কিন্তু কোনো অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে তার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে তুলে ধরছেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার দ্বারা নিজের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে মানুষের সামনে মেলে ধরছেন না।

ধর্মান্ধ চেতনাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতেই মমতা এই রাজ্যের বাঙালি অধিবাসীদের সঙ্গে অবাঙালি অধিবাসীদের একটা ভয়াবহ দ্বন্দ্ব তৈরি করতে, সংঘাত সৃষ্টি করতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে তুলে ধরছেন। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে উঠে এসে মুসলিম জাতীয়তার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, তার অন্তস্থলে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার চেতনাই ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের মতো বহুভাষী দেশে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংগ্রামঋদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার মূল স্লোগান ‘জয় বাংলার’ দর্শনজনিত সাদৃশ্য নেই। মমতা যে ‘জয় বাংলার’ স্লোগান দিচ্ছেন, সেই স্লোগান কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ ‘জয় বাংলার’ সঙ্গে কখনোই সম্পৃক্ত নয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির আন্তর্জাতিক মাত্রা পাওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো- স্লোগানটির অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার বিশ্বস্ত দোসর হিসেবে পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা।

মমতা এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে যে দ্যোতনায় তুলে ধরছেন, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার কোনো জায়গা নেই। বরং রয়েছে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলার নাম করে ভাষাভিত্তিক, জাতপাতভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ডিমে তা দেওয়ার একটা জঘন্য ষড়যন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক স্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির ভিতর দিয়ে পরীক্ষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভিত্তি স্থাপন করেছিল, মমতা সেই স্লোগানটিকে আঞ্চলিক ভেদবুদ্ধির নিরিখে তুলে ধরে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে একদম খুন করতেই, বিভাজনের উদ্দেশে, বাঙালি-অবাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বনাম ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের ভিতরে একটা সংঘাত তৈরি করে বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই এই স্লোগানটিকে তুলে ধরছেন।

মমতা যখন এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের ধর্ম-রাজনীতির মিশেল দেওয়া স্লোগান ‘জয় শ্রীরামের’ তৃণমূলীয় পরিপূরক হিসেবে তুলে ধরছেন, ঠিক তখনই মমতার এই স্লোগানযুদ্ধের লোক দেখানো খেলাকে বিজেপির দিলীপ ঘোষ বর্ণনা করছেন, মমতার ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ তৈরির উদ্যোগ হিসেবে। আরএসএস-বিজেপি বঙ্গবন্ধু উত্তর বাংলাদেশের সংবিধানে স্বৈরাচারী এরশাদ কর্তৃক রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অন্তর্ভুক্তিকে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এভাবে তুলে ধরতে চায় যে, বাংলাদেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান যে অর্থে ইসলামিক রাষ্ট্র, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যে সেই চেতনার অনুসারী আদৌ নয়, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি সেটা কিছুতেই স্বীকার করে না। এই প্রকৃত সত্যটা যে ভারতের সাধারণ মানুষ জানুক, সেটাও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি চায় না। তাই মমতা যে অর্থে বাংলাদেশে তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মবলিদানের ভিতর দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে বুকে ধারণ করে, যে স্লোগান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শাহাদাত বরণের পর জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ, খালেদা জিয়া কার্যত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশে, তাকে পশ্চিমবঙ্গে তুলে ধরছেন বিভাজনের রাজনীতিকেই উস্কে দিতে, বিজেপির প্রতি সাহায্যকারী মমতার এই ভূমিকাকেই ব্যবহার করছে আরএসএস-বিজেপি। মমতা যেভাবে বিজেপির সঙ্গে একটা ছদ্ম সংঘাতের পথে হেঁটে বিজেপিকে সবরকম ভাবে সাহায্য করছেন, বিজেপিও এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ঘিরে মমতার ভূমিকাকে কেন্দ্র করে, মমতার বিরুদ্ধে একটা ছদ্ম লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছে।

মমতা তার দশ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছেন। ফলে বাংলাদেশে প্রবহমান গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার, সেদেশের ইসলামীয় মৌলবাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। মমতার এ বাংলাদেশকে পানিতে মারার ষড়যন্ত্রের ভিতর দিয়ে একদিকে লাভবান হয়েছে বাংলাদেশের ইসলামীয় মৌলবাদীরা। তারা খুব সহজেই মমতার ব্যক্তিগত অভিসন্ধিকে ভারতের অভিসন্ধি হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। এ বিভ্রান্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেখানে যেমন সুযোগ পেয়েছে, বিক্ষিপ্তভাবে অত্যাচার চালিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার সেসব অত্যাচারের খবর পাওয়া মাত্রই চূড়ান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলেও, সেখানকার ইসলামীয় মৌলবাদীদের আচরণকে সম্বল করে ভারতের হিন্দু মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানেদের ওপর যেখানে যেভাবে পেরেছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অত্যাচার চালিয়েছে। মমতা আন্তর্জাতিকভাবে অভিনন্দিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কেনিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করে দিলীপ ঘোষের মতো বিজেপি নেতাদের ‘মমতা গ্রেটার বাংলাদেশ তৈরির ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত অভিযোগ তোলবার যে সুযোগ করে দিয়েছেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন ভোটে সীমান্তবর্তী এলাকাসহ রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় বিভাজনের পরিবেশ তৈরির একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল।

বাঙালি জাতিসত্তার সম্যক বিকাশের যে ঐতিহাসিক পরম্পরা আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে ধারণ করছে, তার সঙ্গে ভারতের মতো একটি বহু ভাষাভাষী, সংস্কৃতির বৈচিত্রপূর্ণ দেশের একটি অঙ্গ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানা চরম বিভ্রান্তিকর। অথচ মমতা তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে অন্য রাজ্য থেকে বিজেপির যেসব নেতারা এই রাজ্যে তাদের দলের রাজনৈতিক প্রয়োজনে আসছেন, তাদের ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে দিচ্ছেন। এ ধরনের তকমাতে ভারতের একটি রাজ্য থেকে যে কোনো প্রয়োজনেই অপর একটি রাজ্যে আসা মানুষকে দেগে দেওয়ার অর্থ হলো- জাতি এবং ভাষা বিদ্বেষকে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া। মমতা বিজেপির যেসব নেতারা ভিন প্রদেশ থেকে আসছেন এই রাজ্যে, তাদের উদ্দেশ্যে কিন্তু একটিবারের জন্যও কোনো রাজনৈতিক আক্রমণ করছেন না। ভারতের মানুষকে এক রাজ্য থেকে রাজনৈতিক তাগিদে বা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে আসাটার পেছনে ‘বহিরাগত’ তত্ত্বের অবতারণা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব যে মমতার দলের ভিন রাজ্যের অধিবাসী সাংসদ দ্বিনেশ ত্রিবেদির উদ্দেশে খাটে কিনা বলে বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, সেই বিষয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি।

মমতা কর্তৃক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিষয়টিকে যেমন প্রতিবেশি বাংলাদেশের রক্তার্জিত স্বাধীনতার প্রতি বিজেপির চরম কদর্য মানসিকতায় পর্যবসিত করবার অভিপ্রায় আমরা দেখেছি, তেমনই এ ‘বহিরাগত তত্ত্ব’ ঘিরে তৃণমূলের লোকসভাতে পরাজয়ের পর রাজ্যসভার সাংসদ দ্বিনেশ ত্রিবেদিকে ঘিরে বিজেপির বিতর্র্কের অবতারণা, তা কেবল বাংলার রাজনীতিকেই আগামী দিনে প্রভাবিত করবে না। ধর্মান্ধতার পাশাপাশি ভাষা এবং জাতপাত ঘিরে বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতার’ গোটা দেশব্যাপী প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের রাস্তাটিকে নগ্নভাবে খুলে দেবে।

রাস্তাকে এভাবে নগ্ন করে তুলতেই মমতা চাইছিলেন। তিনি বিজেপির পশ্চিবঙ্গে পা রাখবার সিঁড়ি হিসেবে এতকাল ব্যবহৃত হয়েছেন। এখন মমতা চাইছেন, নিজের পিঠের ওপর বিজেপির ভার বহন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, গান্ধী হত্যাকারী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই উদ্দেশেই রাজ্য বিধানসভার সদ্য সমাপ্ত সংক্ষিপ্ততম অধিবেশনে বিজেপির স্লোগানের মোকাবিলায় নিজের স্লোগান ঘিরে শীবাকীর্তন গাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সিপিআই (এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বিধানসভার ভিতরে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে, স্লোগানটির মূল ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কীভাবে গঙ্গাযাত্রা ঘটাচ্ছেন, তা বোঝাতে চাইলেও আনন্দবাজার পত্রিকা সুজন বাবুর বক্তব্যকে ঘিরে একটা বিকৃত মানসিকতা তৈরিতে প্রবৃত্ত হলো। এই পত্রিকা এমনভাবে বিধানসভার ভিতরে স্লোগান বিতর্ককে উপস্থাপিত করলো, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয়- সিপিআই (এম) নেতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্লোগানটির বিরোধিতা করছেন।

মমতা যেহারে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন প্রতিদিন নিজের পেটোয়া খবরের কাগজগুলোতে দিচ্ছেন, তাতে সুজন বাবুকে বিকৃত করে মমতার প্রিয়পাত্র হওয়া ছাড়া আনন্দবাজারের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ অবশ্য ছিল না। বাবু যত বলে, পারিষদগণ বলে তার শতগুণ, দুই বিঘা জমিতে রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত আপ্তবাক্যের প্রতি মর্যাদা দিয়েই ওই কাগজের এক সাংবাদিক সামাজিক গণমাধ্যমে নিজের কাগজের অপব্যাখ্যার সমর্থনে সুজন চক্রবর্তীকে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিরোধী বলে মন্তব্য করতেও ছাড়েননি। এ বাংলাতেই কাঙাল হরিনাথ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মুজিবুর রহমান (দি মুসলমান), বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়রা সাংবাদিকতা করেছিলেন- এটা ভাবতেও এখন লজ্জা হয়।