‘বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচনের পথ খুঁজে পেতে হবে ‘আপনাদেরই’

মনজুরুল হক

দার্শনিক প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বর্ণিত গণতন্ত্র কিংবা ইউরোপীয় আধুনিক গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় সেটি আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথায় ঢুকবে না, কারণ তারা মাথাটাকে ‘প্রিসাইজড’ করে রেখেছেন চাকরি-প্রমোশন-স্পিডমানির সিলসিলায়। সেজন্য বারে বারে আমাদের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের গল্পই শুধু শোনানো হয়, যার কোন কোনটা সিংহভাগ মানুষের ভাগ্যে জোটে না। যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ নির্বাচন। আরও খুলে বললে; নির্বাচন ব্যবস্থা। এটিই যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন জনসাধারণের আর ভরসার জায়গা থাকে না। আর ভয়াবহ বাস্তবতা হলো নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে অশনি সংকেত!

অনেক বছর ধরে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপদের কথাগুলো দায়িত্ববোধ নিয়ে জবাবদিহিহীন সুশীল সমাজ বলে আসছে। হারাধনের অবশিষ্ট তিন ছেলে, তিন ঘরানার বিরোধী দলগুলো বলে আসছে। একটু সাহস-টাহস রাখে এমন লিখিয়েরাও ঠারে-ঠোরে বলে আসছে। ওই বলা পর্যন্তই। স্টাবলিশমেন্ট ওসবে কান দেয়নি। তার মানে কি স্টাবলিশমেন্ট এই বিপদ সম্পর্কে জানে না? আলবত জানে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। এই না হতে হতে এমনই এক অবিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে দেশে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ চালু হয়েছিল। সেই ব্যবস্থাও ২০০৬ সালে ‘নিজেদের রুলস’ ব্রেক করেছিল। ৩ মাসের জায়গায় দুই বছর শাসন করেছিল আধা সামরিক-আধা বেসরকারি সিস্টেমে। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও নিরপেক্ষ নয়’! তাহলে আর বাকি রইল কী? কিচ্ছু না। তারপর ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। তারপর সংবিধানের পঞ্চাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গোঁড়াপত্তন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। ১৯৮২ থেকে গণতন্ত্রের দাবিতে দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে সব বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন? শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ আনেন। কিন্তু তিনি এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেন। পঞ্চম সংসদের যাত্রা শুরু হয়। বিএনপি সরকার গঠন করার কিছুদিন পর থেকেই বিরোধী দলগুলো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজনের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে? ১৯৯৪ সাল থেকেই সেই ক্রমাগত চাপের ফলে বিএনপি সরকার এই ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করতে বাধ্য হয়। তখন বেগম জিয়ার একটি বিস্ময়কর উক্তি ছিল-‘একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।’ এর পরে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে গৌরবজনক এবং কলঙ্কজনক পালক যোগ হয়েছে। আয়রনি হলো এখনকার মহাজোট সরকার সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংশোধনী এনে বাতিল করে দিয়েছে, আর বিরোধী বিএনপি সেই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে।

দেশে এখন সব ধরনের নির্বাচন হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এর ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলাটাও বিপদ! যদি বলি- ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বচান সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় না’, তাহলে সরকার ধরে নেবে ‘এরা বিরোধী দলের পারপাস সার্ভ করছে’! আবার যদি বলি- ‘সারা বিশ্বে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, সেটাই নিয়ম।’ তখন আরেক দল ধরে নেবে-এরা সরকারের ‘দালালি’ করছে! তবে এটা ঠিক, সারা বিশ্বেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। কোন কোন দেশের বিরোধী দল পরাজিত হলে সরকারের ওপর দোষারোপ করে-‘সরকার নির্বাচনে কারচুপি করেছে’, কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়। সংসদেও নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশে তেমনটি ঘটে না। এখানে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেন ‘সোনার হরিণ’! এখানে ক্ষমতাসীন সরকার এমন কোন আস্থা বিরোধী দলকে দিতে পারেনি যাতে করে তারা আশ্বস্ত হবে। সরকার এমন কোন নজির রাখতে পারেনি যাতে করে নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের ওজর-আপত্তি থাকলেও তা অবিশ্বাসে পরিণত হবে না। এখানে ক্ষমতাসীন সরকার এমন কোন ‘ব্যবস্থা’ চালু করতে পারেনি যার মাধ্যমে বিরোধী দলেরও কথা বলার সুযোগ থাকে। মোটের ওপর সরকার যে এসব করেনি তেমন নয়, করতে চায়নি বলেই করেনি। যার ফলে আজকে জাতীয় নির্বাচন দূরের কথা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন বা আঞ্চলিক নির্বাচনও হাস্যকর হয়ে উঠেছে।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সরকারের পক্ষে কাজ করে। সেটা নিম তেতো গেলার মতো হলেও বিরোধীরা মেনে নেয়, কিন্তু এখন যা হচ্ছে তাকে আর নির্বাচন বলার সুযোগ নেই! খোদ একজন নির্বাচন কমিশনারই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অরাজকতা গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন। তিনি এই নির্বাচনকে অনিয়মের নির্বাচনের একটি মডেল বলে মন্তব্য করেছেন!

তিনি বলেছেন- ‘আগামীতে দেশব্যাপী যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে এই মডেল অনুসরণ করা হলে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসভায় আমরা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারব না।’ গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ বিফ্রিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে আমার বক্তব্য’ শিরোনামে এর আগে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে অরাজকতা দেখা গেছে, তাতে আমি হতাশ। আমার আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো এবং সাবধান বাণীতে কোন কাজ হলো না। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনকালে মোট চারজনের প্রাণহানি প্রকারান্তরে চারটি পরিবারের প্রাণহানির নামান্তর। সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, পুলিশের গাড়ি ও ইভিএম মেশিন ভাঙচুর ইত্যাদি ঘটনা এই নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে। এ ধরনের তাণ্ডব বন্ধ করতে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুঁজে পেতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ব্যতীত তা সম্ভব হবে না। এজন্য দল-মত নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য প্রয়োজন (সংবাদ, ২৮ জানুয়ারি ২০২১)

এই নির্বাচন কমিশনারের মতো আরও অনেকেই এই একই ধরনের বক্তব্য দেবেন, কারণ বছরের পর বছর এই একই রকম অনিয়ম, অরাজকতা, পক্ষপাতিত্ব ঘটছে নির্বাচনগুলোতে। তাহলে এর সমাধান কী? সংবিধানের সংশোধনী এনে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন? তা কি করে হয়? একবার তো সেই ব্যবস্থা আইন করেই বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু যদি সেই ব্যবস্থার বদলে বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা বা আরও ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্রকেই ভূলুণ্ঠিত করে তাহলে বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন করা যাবে না কেন? কেনই বা নতুন কোন সবর্জন গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।

এখন যত দ্রুত সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে ততই গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল। তা না হলে আর কিছুদিন পর নির্বাচন ব্যবস্থাটাই অকেজো হয়ে পড়বে। তখন কি সরকার বদলের জন্য আগেরকার সেই রাজ-রাজড়াদের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে? রাজার মৃত্যু হলে তার পুত্র-কন্যা মসনদে বসবে! আজকের আধুনিক বিশ্বে সে সব কল্পনাও করা যায় না। তাই রাজনৈতিক দলসমূহকে এবং রাজনীতিবিদগণকেই একটা ‘উপায়’ খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটা তাদের স্বার্থেই। জনগণের ভালো-মন্দ সে তো সোনার পাথর বাটি!

monjuraul@gmail.com

শনিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৩ মাঘ ১৪২৭, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২

‘বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচনের পথ খুঁজে পেতে হবে ‘আপনাদেরই’

মনজুরুল হক

image

দার্শনিক প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বর্ণিত গণতন্ত্র কিংবা ইউরোপীয় আধুনিক গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় সেটি আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথায় ঢুকবে না, কারণ তারা মাথাটাকে ‘প্রিসাইজড’ করে রেখেছেন চাকরি-প্রমোশন-স্পিডমানির সিলসিলায়। সেজন্য বারে বারে আমাদের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের গল্পই শুধু শোনানো হয়, যার কোন কোনটা সিংহভাগ মানুষের ভাগ্যে জোটে না। যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ নির্বাচন। আরও খুলে বললে; নির্বাচন ব্যবস্থা। এটিই যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন জনসাধারণের আর ভরসার জায়গা থাকে না। আর ভয়াবহ বাস্তবতা হলো নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে অশনি সংকেত!

অনেক বছর ধরে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপদের কথাগুলো দায়িত্ববোধ নিয়ে জবাবদিহিহীন সুশীল সমাজ বলে আসছে। হারাধনের অবশিষ্ট তিন ছেলে, তিন ঘরানার বিরোধী দলগুলো বলে আসছে। একটু সাহস-টাহস রাখে এমন লিখিয়েরাও ঠারে-ঠোরে বলে আসছে। ওই বলা পর্যন্তই। স্টাবলিশমেন্ট ওসবে কান দেয়নি। তার মানে কি স্টাবলিশমেন্ট এই বিপদ সম্পর্কে জানে না? আলবত জানে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। এই না হতে হতে এমনই এক অবিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে দেশে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ চালু হয়েছিল। সেই ব্যবস্থাও ২০০৬ সালে ‘নিজেদের রুলস’ ব্রেক করেছিল। ৩ মাসের জায়গায় দুই বছর শাসন করেছিল আধা সামরিক-আধা বেসরকারি সিস্টেমে। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও নিরপেক্ষ নয়’! তাহলে আর বাকি রইল কী? কিচ্ছু না। তারপর ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। তারপর সংবিধানের পঞ্চাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গোঁড়াপত্তন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। ১৯৮২ থেকে গণতন্ত্রের দাবিতে দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে সব বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন? শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ আনেন। কিন্তু তিনি এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেন। পঞ্চম সংসদের যাত্রা শুরু হয়। বিএনপি সরকার গঠন করার কিছুদিন পর থেকেই বিরোধী দলগুলো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজনের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে? ১৯৯৪ সাল থেকেই সেই ক্রমাগত চাপের ফলে বিএনপি সরকার এই ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করতে বাধ্য হয়। তখন বেগম জিয়ার একটি বিস্ময়কর উক্তি ছিল-‘একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।’ এর পরে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে গৌরবজনক এবং কলঙ্কজনক পালক যোগ হয়েছে। আয়রনি হলো এখনকার মহাজোট সরকার সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংশোধনী এনে বাতিল করে দিয়েছে, আর বিরোধী বিএনপি সেই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে।

দেশে এখন সব ধরনের নির্বাচন হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এর ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলাটাও বিপদ! যদি বলি- ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বচান সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় না’, তাহলে সরকার ধরে নেবে ‘এরা বিরোধী দলের পারপাস সার্ভ করছে’! আবার যদি বলি- ‘সারা বিশ্বে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, সেটাই নিয়ম।’ তখন আরেক দল ধরে নেবে-এরা সরকারের ‘দালালি’ করছে! তবে এটা ঠিক, সারা বিশ্বেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। কোন কোন দেশের বিরোধী দল পরাজিত হলে সরকারের ওপর দোষারোপ করে-‘সরকার নির্বাচনে কারচুপি করেছে’, কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়। সংসদেও নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশে তেমনটি ঘটে না। এখানে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেন ‘সোনার হরিণ’! এখানে ক্ষমতাসীন সরকার এমন কোন আস্থা বিরোধী দলকে দিতে পারেনি যাতে করে তারা আশ্বস্ত হবে। সরকার এমন কোন নজির রাখতে পারেনি যাতে করে নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের ওজর-আপত্তি থাকলেও তা অবিশ্বাসে পরিণত হবে না। এখানে ক্ষমতাসীন সরকার এমন কোন ‘ব্যবস্থা’ চালু করতে পারেনি যার মাধ্যমে বিরোধী দলেরও কথা বলার সুযোগ থাকে। মোটের ওপর সরকার যে এসব করেনি তেমন নয়, করতে চায়নি বলেই করেনি। যার ফলে আজকে জাতীয় নির্বাচন দূরের কথা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন বা আঞ্চলিক নির্বাচনও হাস্যকর হয়ে উঠেছে।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সরকারের পক্ষে কাজ করে। সেটা নিম তেতো গেলার মতো হলেও বিরোধীরা মেনে নেয়, কিন্তু এখন যা হচ্ছে তাকে আর নির্বাচন বলার সুযোগ নেই! খোদ একজন নির্বাচন কমিশনারই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অরাজকতা গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন। তিনি এই নির্বাচনকে অনিয়মের নির্বাচনের একটি মডেল বলে মন্তব্য করেছেন!

তিনি বলেছেন- ‘আগামীতে দেশব্যাপী যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে এই মডেল অনুসরণ করা হলে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসভায় আমরা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারব না।’ গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ বিফ্রিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে আমার বক্তব্য’ শিরোনামে এর আগে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে অরাজকতা দেখা গেছে, তাতে আমি হতাশ। আমার আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো এবং সাবধান বাণীতে কোন কাজ হলো না। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনকালে মোট চারজনের প্রাণহানি প্রকারান্তরে চারটি পরিবারের প্রাণহানির নামান্তর। সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, পুলিশের গাড়ি ও ইভিএম মেশিন ভাঙচুর ইত্যাদি ঘটনা এই নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে। এ ধরনের তাণ্ডব বন্ধ করতে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুঁজে পেতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ব্যতীত তা সম্ভব হবে না। এজন্য দল-মত নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য প্রয়োজন (সংবাদ, ২৮ জানুয়ারি ২০২১)

এই নির্বাচন কমিশনারের মতো আরও অনেকেই এই একই ধরনের বক্তব্য দেবেন, কারণ বছরের পর বছর এই একই রকম অনিয়ম, অরাজকতা, পক্ষপাতিত্ব ঘটছে নির্বাচনগুলোতে। তাহলে এর সমাধান কী? সংবিধানের সংশোধনী এনে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন? তা কি করে হয়? একবার তো সেই ব্যবস্থা আইন করেই বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু যদি সেই ব্যবস্থার বদলে বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা বা আরও ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্রকেই ভূলুণ্ঠিত করে তাহলে বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন করা যাবে না কেন? কেনই বা নতুন কোন সবর্জন গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।

এখন যত দ্রুত সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে ততই গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল। তা না হলে আর কিছুদিন পর নির্বাচন ব্যবস্থাটাই অকেজো হয়ে পড়বে। তখন কি সরকার বদলের জন্য আগেরকার সেই রাজ-রাজড়াদের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে? রাজার মৃত্যু হলে তার পুত্র-কন্যা মসনদে বসবে! আজকের আধুনিক বিশ্বে সে সব কল্পনাও করা যায় না। তাই রাজনৈতিক দলসমূহকে এবং রাজনীতিবিদগণকেই একটা ‘উপায়’ খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটা তাদের স্বার্থেই। জনগণের ভালো-মন্দ সে তো সোনার পাথর বাটি!

monjuraul@gmail.com