সুন্দরবনে শিকারি চক্র অবাধে মারছে হরিণ-বাঘ

লাগাম টানতে ব্যর্থ বন বিভাগ

কিছুতেই যেন লাগাম টানা যাচ্ছে না সুন্দরবনের চোরা শিকারি চক্রের। পাচারের ক্ষেত্রে ওইসব চক্রের প্রধান টার্গেট বনের মায়াবী হরিণ ও বাঘ। করোনার সুযোগ নিয়ে শিকারিরা বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন থেকে বাঘ ও হরিণ শিকারের এক প্রকার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। আর এসব শিকারি চক্রের অপরাধ দমনে ব্যর্থ হচ্ছেন বন-রক্ষার দ্বায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অভিযোগ রয়েছে বন সংলগ্ন এলাকায় পুলিশি টহল জোরদার না থাকাসহ বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতি লোভের কারণে বন্যপ্রাণীসহ বনসম্পদ পাচার কার্যক্রমের পুরোপুরি লাগাম টানা যাচ্ছে না।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ২০ দিনের ব্যাবধানে একটি বাঘ ও ১৯টি হরিণের চামড়া এবং তিন মণ হরিণের মাংসসহ ১১ জন চোরা শিকারি ও পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি শরণখোলা উপজেলার রাজৈর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি বাঘের চামড়াসহ উপজেলার সাউথখালী এলাকার বাসিন্দা জেলে মো. গাউস ফকিরকে (৫০) আটক করে র‌্যাব-৮ ও বনরক্ষীরা। জিজ্ঞাসাবাদে ওই জেলে জানায়, বাঘের চামড়াটি সুন্দরববন সংলগ্ন সোনাতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহরাপ হোসেনের ছেলে মো. ওহিদুল এবং মো. ওবায়দুল বিক্রির জন্য তার কাছে দেন ।

এছাড়া ২২ জানুয়ারি উপজেলার রায়েন্দা-রাজৈর কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জেলা (গোয়েন্দা পুলিশ) ডিবির একটি দল অভিযান চালিয়ে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ বাগেরহাট সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. মোশারফ শেখের ছেলে ড্রাইভার মো. মনির হোসেন শেখের (৪৫) বাসা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়া উদ্ধার করে। এ সময় তার স্বীকরোক্তি মতে, রাজৈর গ্রামের বাসিন্দা ও বন্যপ্রাণী পাচার চক্রের (সাবেক) সদস্য মো. মতিয়ার রহমান কাজী (ওরফে মতি কাজীর) ছেলে ও উপজেলা প্রসাশন মার্কেটের মুরগি ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস কাজীকে (৩৫) আটক করেন এবং ২৫ জানুযারি রাতে খুলনার পানখালী এলাকা থেকে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ২ শিকারিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অন্যদিকে, ৩০ জানুয়ারি মোংলা কোস্টর্গাড ৪৭ কেজি হরিণের মাংস ও একটি মাথাসহ খুলনার দাকোপ এলাকার মোনা সর্দার (৩২), রামপাল এলাকার জাহিদ শেখ (৩৮) ও মোংলার চিলা এলাকার বাসিন্দা শহীদুল শেখকে (৪৫) আটক করেন। তাছাড়া ৩১ জানুয়ারি শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর এলাকা থেকে ২০ কেজি হরিণের মাংসসহ যশোর ঝিকারগাছার দেওয়ালী গ্রামের বাসিন্দা আ. লতিফ মোড়লের ছেলে ও রায়েন্দা পুলিশ স্টেশন এলাকার ভাড়াটিয়া মো. মিলন শেখকে (৩৫) আটক করে বনরক্ষীরা। এ সময় মিলন জানায়, শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে তিনি বিয়ে করার সুবাদে বহুদিন আগে তার সঙ্গে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন ঢালীর ঘোপ এলাকার বাসিন্দা মো. হাবিব তালুকদার, মো. তানজের বয়াতী ও বকুল তলা গ্রামের বাসিন্দা মো. চান মিয়া হাওলাদারের (ওরফে চান্দু) সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সুন্দরবন হতে তাদের শিকার করা হরিণের মাংস সে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছিলেন। সর্বশেষ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ১ ফেব্রুয়ারি রামপাল উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৪২ কেজি হরিণের মাংস, ৩টি মাথাসহ মো. আ. রহমান শেখ (৫২) এবং তার ছেলে মো. মোস্তাকিন শেখকে (২৭) আটক করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন কায়দায় শিকার করে আনা ওইসব বন্যপ্রাণীর অঙ্গ-প্রতঙ্গ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের সীমানা পেরিয়ে চলে যায় আন্তর্জাতিক চোরাই বাজারে। তবে এসব চক্রের হোতারা রহস্যজনক কারণে সব সময় পর্দার অন্তরালে থাকায় বন্যপ্রাণী পাচারকারী চক্রের লাগাম টানা যাচ্ছে না বলে অভিমত বন-বিশেষজ্ঞদের। এ পর্যন্ত বন বিভাগের হিসাবে ৫৪টি বাঘের নানা কারণে মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় গ্রামবাসীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে ১৪টি। আর চোরা শিকারিরা বিভিন্নভাবে হত্যা করেছে সুন্দরবনের পাহারাদার ২৬টি (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) বাঘ। তবে জেলে গাউস ফকিরের স্ত্রী মোসা. তহমিনা বেগম (৪০) বলেন, আমার স্বামী একজন নিরীহ জেলে, ঘটনার কয়েক দিন আগে তার কাছে শুধু ফোন আসতে দেেিখছি। তাকে প্রভাবশালীরা টাকার লোভ দেখিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এছাড়া নাম গোপন রাখার শর্তে শরনখোলা এলাকার কয়েকজন ব্যাবসায়ী জানান, জেলে গাউস ফকির এক সময়ে চান্দুর সঙ্গে বনের বিভিন্ন এলাকায় মাছ ধরতেন। উদ্ধার হওয়া বাঘের চামড়ার সঙ্গে চান্দু জড়িত থাকতে পারে এবং শরণখোলা রেঞ্জের (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীনের খুব আস্থাভাজন লোক হচ্ছে জেলে নামধারী চান্দু হাওলাদার। সে এসিএফ-এর দোহাই দিয়ে সুন্দরবনের নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরেন। কোন জেলে মাছ না পেলেও চান্দু পাবেই এবং চান্দু ভাই মো. নাছির হাওলাদার সুন্দরবনের জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির ট্রলার ড্রাইভার থেকে হরিণ পাচারকারীদের সহয়তা করে যাচ্ছে। তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে চান্দু বলেন, এক সময় জয়নাল স্যার আমাকে কিছু কাজকর্ম দিতেন। এখন আর কোন কাজ দেন না। তাছাড়া সুন্দরবনে আমি বৈধভাবে প্রবেশ করে পাস পারমিট (অনুমতি) নিয়ে মাছ ধরি। তবে বন্যপ্রাণী ও বনসম্পদ পাচারের সঙ্গে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নাই। প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীরা আমার নামে মিথ্যা বদনাম রটাচ্ছে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ী ইলিয়াস কাজীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম বলেন, হরিণের চামড়ার বিষয়ে আমার স্বামী কিছুই জানে না। প্রতিপক্ষরা তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়েছেন।

তবে সুন্দরবনসহ ব্যাবস্থাপনা কমিটিরসহ সভাপতি ও উপজেলা কৃষক লীগ নেতা মো. ওয়াদুদ আকন বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী নিধনের ক্ষেত্রে বন সংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালীরা অনেকটা দায়ী। কিছু অসাধু লোক তাদের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপকর্ম করে থাকেন। পাশাপাশি বন-বিভাগসহ পুলিশের টহল ব্যবস্থা জোরদার না থাকার কারণে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকা, চট্রগ্রাম, বাগেরহাটসহ দেশের নানা প্রান্তে পাচার করার সাহস পাচ্ছেন। যার ২/১টি চালান মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও অধিকাংশই ধরা পড়ে না। নিয়ম অনুযায়ী জেলেদের সব নৌকা ও ট্রলার জঙ্গলে প্রবেশকালে এবং বের হওয়ার সময় বনরক্ষীরা তল্লাশি করবেন কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রে ম্যানেজ হয়ে সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। তাছাড়া পুলিশের টহল বৃদ্ধি করে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলসহ ঢাকা-চট্টগ্রামগামী পরিবহনগুলোর দিকে নজরদারি বাড়ানো হলে পাচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে জানতে শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি। তবে শরণখোলা থানার ওসি মো. সাইদুর রহমান জানান, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির কারণে পাচারকারীরা আটক হচ্ছে এবং শরণখোলা থানা পুলিশের টহল ব্যবস্থা আগের চেয়ে ইতোমধ্যে আরও জোরদার করা হয়েছে।

এছাড়া পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, চোরা শিকারিদের ধরতে অভিযান চলছে এবং বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের জন্য সুন্দরবনের ৫০ ভাগ এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া পাচারকারী চক্রের হোতাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রমাণ সাপেক্ষে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৪ মাঘ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সুন্দরবনে শিকারি চক্র অবাধে মারছে হরিণ-বাঘ

লাগাম টানতে ব্যর্থ বন বিভাগ

image

এমাদুল হক (শামীম), শরণখোলা (বাগেরহাট)

কিছুতেই যেন লাগাম টানা যাচ্ছে না সুন্দরবনের চোরা শিকারি চক্রের। পাচারের ক্ষেত্রে ওইসব চক্রের প্রধান টার্গেট বনের মায়াবী হরিণ ও বাঘ। করোনার সুযোগ নিয়ে শিকারিরা বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন থেকে বাঘ ও হরিণ শিকারের এক প্রকার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। আর এসব শিকারি চক্রের অপরাধ দমনে ব্যর্থ হচ্ছেন বন-রক্ষার দ্বায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অভিযোগ রয়েছে বন সংলগ্ন এলাকায় পুলিশি টহল জোরদার না থাকাসহ বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতি লোভের কারণে বন্যপ্রাণীসহ বনসম্পদ পাচার কার্যক্রমের পুরোপুরি লাগাম টানা যাচ্ছে না।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ২০ দিনের ব্যাবধানে একটি বাঘ ও ১৯টি হরিণের চামড়া এবং তিন মণ হরিণের মাংসসহ ১১ জন চোরা শিকারি ও পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি শরণখোলা উপজেলার রাজৈর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি বাঘের চামড়াসহ উপজেলার সাউথখালী এলাকার বাসিন্দা জেলে মো. গাউস ফকিরকে (৫০) আটক করে র‌্যাব-৮ ও বনরক্ষীরা। জিজ্ঞাসাবাদে ওই জেলে জানায়, বাঘের চামড়াটি সুন্দরববন সংলগ্ন সোনাতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহরাপ হোসেনের ছেলে মো. ওহিদুল এবং মো. ওবায়দুল বিক্রির জন্য তার কাছে দেন ।

এছাড়া ২২ জানুয়ারি উপজেলার রায়েন্দা-রাজৈর কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জেলা (গোয়েন্দা পুলিশ) ডিবির একটি দল অভিযান চালিয়ে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ বাগেরহাট সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. মোশারফ শেখের ছেলে ড্রাইভার মো. মনির হোসেন শেখের (৪৫) বাসা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়া উদ্ধার করে। এ সময় তার স্বীকরোক্তি মতে, রাজৈর গ্রামের বাসিন্দা ও বন্যপ্রাণী পাচার চক্রের (সাবেক) সদস্য মো. মতিয়ার রহমান কাজী (ওরফে মতি কাজীর) ছেলে ও উপজেলা প্রসাশন মার্কেটের মুরগি ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস কাজীকে (৩৫) আটক করেন এবং ২৫ জানুযারি রাতে খুলনার পানখালী এলাকা থেকে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ২ শিকারিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অন্যদিকে, ৩০ জানুয়ারি মোংলা কোস্টর্গাড ৪৭ কেজি হরিণের মাংস ও একটি মাথাসহ খুলনার দাকোপ এলাকার মোনা সর্দার (৩২), রামপাল এলাকার জাহিদ শেখ (৩৮) ও মোংলার চিলা এলাকার বাসিন্দা শহীদুল শেখকে (৪৫) আটক করেন। তাছাড়া ৩১ জানুয়ারি শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর এলাকা থেকে ২০ কেজি হরিণের মাংসসহ যশোর ঝিকারগাছার দেওয়ালী গ্রামের বাসিন্দা আ. লতিফ মোড়লের ছেলে ও রায়েন্দা পুলিশ স্টেশন এলাকার ভাড়াটিয়া মো. মিলন শেখকে (৩৫) আটক করে বনরক্ষীরা। এ সময় মিলন জানায়, শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে তিনি বিয়ে করার সুবাদে বহুদিন আগে তার সঙ্গে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন ঢালীর ঘোপ এলাকার বাসিন্দা মো. হাবিব তালুকদার, মো. তানজের বয়াতী ও বকুল তলা গ্রামের বাসিন্দা মো. চান মিয়া হাওলাদারের (ওরফে চান্দু) সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সুন্দরবন হতে তাদের শিকার করা হরিণের মাংস সে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছিলেন। সর্বশেষ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ১ ফেব্রুয়ারি রামপাল উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৪২ কেজি হরিণের মাংস, ৩টি মাথাসহ মো. আ. রহমান শেখ (৫২) এবং তার ছেলে মো. মোস্তাকিন শেখকে (২৭) আটক করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন কায়দায় শিকার করে আনা ওইসব বন্যপ্রাণীর অঙ্গ-প্রতঙ্গ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের সীমানা পেরিয়ে চলে যায় আন্তর্জাতিক চোরাই বাজারে। তবে এসব চক্রের হোতারা রহস্যজনক কারণে সব সময় পর্দার অন্তরালে থাকায় বন্যপ্রাণী পাচারকারী চক্রের লাগাম টানা যাচ্ছে না বলে অভিমত বন-বিশেষজ্ঞদের। এ পর্যন্ত বন বিভাগের হিসাবে ৫৪টি বাঘের নানা কারণে মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় গ্রামবাসীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে ১৪টি। আর চোরা শিকারিরা বিভিন্নভাবে হত্যা করেছে সুন্দরবনের পাহারাদার ২৬টি (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) বাঘ। তবে জেলে গাউস ফকিরের স্ত্রী মোসা. তহমিনা বেগম (৪০) বলেন, আমার স্বামী একজন নিরীহ জেলে, ঘটনার কয়েক দিন আগে তার কাছে শুধু ফোন আসতে দেেিখছি। তাকে প্রভাবশালীরা টাকার লোভ দেখিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এছাড়া নাম গোপন রাখার শর্তে শরনখোলা এলাকার কয়েকজন ব্যাবসায়ী জানান, জেলে গাউস ফকির এক সময়ে চান্দুর সঙ্গে বনের বিভিন্ন এলাকায় মাছ ধরতেন। উদ্ধার হওয়া বাঘের চামড়ার সঙ্গে চান্দু জড়িত থাকতে পারে এবং শরণখোলা রেঞ্জের (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীনের খুব আস্থাভাজন লোক হচ্ছে জেলে নামধারী চান্দু হাওলাদার। সে এসিএফ-এর দোহাই দিয়ে সুন্দরবনের নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরেন। কোন জেলে মাছ না পেলেও চান্দু পাবেই এবং চান্দু ভাই মো. নাছির হাওলাদার সুন্দরবনের জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির ট্রলার ড্রাইভার থেকে হরিণ পাচারকারীদের সহয়তা করে যাচ্ছে। তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে চান্দু বলেন, এক সময় জয়নাল স্যার আমাকে কিছু কাজকর্ম দিতেন। এখন আর কোন কাজ দেন না। তাছাড়া সুন্দরবনে আমি বৈধভাবে প্রবেশ করে পাস পারমিট (অনুমতি) নিয়ে মাছ ধরি। তবে বন্যপ্রাণী ও বনসম্পদ পাচারের সঙ্গে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নাই। প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীরা আমার নামে মিথ্যা বদনাম রটাচ্ছে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ী ইলিয়াস কাজীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম বলেন, হরিণের চামড়ার বিষয়ে আমার স্বামী কিছুই জানে না। প্রতিপক্ষরা তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়েছেন।

তবে সুন্দরবনসহ ব্যাবস্থাপনা কমিটিরসহ সভাপতি ও উপজেলা কৃষক লীগ নেতা মো. ওয়াদুদ আকন বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী নিধনের ক্ষেত্রে বন সংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালীরা অনেকটা দায়ী। কিছু অসাধু লোক তাদের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপকর্ম করে থাকেন। পাশাপাশি বন-বিভাগসহ পুলিশের টহল ব্যবস্থা জোরদার না থাকার কারণে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকা, চট্রগ্রাম, বাগেরহাটসহ দেশের নানা প্রান্তে পাচার করার সাহস পাচ্ছেন। যার ২/১টি চালান মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও অধিকাংশই ধরা পড়ে না। নিয়ম অনুযায়ী জেলেদের সব নৌকা ও ট্রলার জঙ্গলে প্রবেশকালে এবং বের হওয়ার সময় বনরক্ষীরা তল্লাশি করবেন কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রে ম্যানেজ হয়ে সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। তাছাড়া পুলিশের টহল বৃদ্ধি করে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলসহ ঢাকা-চট্টগ্রামগামী পরিবহনগুলোর দিকে নজরদারি বাড়ানো হলে পাচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে জানতে শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি। তবে শরণখোলা থানার ওসি মো. সাইদুর রহমান জানান, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির কারণে পাচারকারীরা আটক হচ্ছে এবং শরণখোলা থানা পুলিশের টহল ব্যবস্থা আগের চেয়ে ইতোমধ্যে আরও জোরদার করা হয়েছে।

এছাড়া পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, চোরা শিকারিদের ধরতে অভিযান চলছে এবং বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের জন্য সুন্দরবনের ৫০ ভাগ এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া পাচারকারী চক্রের হোতাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রমাণ সাপেক্ষে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।