নির্বাচনে অনিয়ম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও অনেকগুলো পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ চলছেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী; তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ডা. শাহাদাৎ হোসেন থেকে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৯ ভোট বেশি পেয়েছেন। এই নির্বাচনে শুধু অনিয়মের অভিযোগ নয়, সহিংস ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন এই সহিংস ঘটনায় এক সুরে কথা বলেছে-‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’। শুধু আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করে লাভ নেই, যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তারা আর নির্বাচন কমিশন এক সুরে কথা বলেছে। ক্ষমতায় থেকে ট্রাম্পের মতো কেউ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শোনা যায়নি। সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন আরও একটি কথা উল্লেখ করতে ভুল করে না- ‘এতগুলো মারামারি ও মৃত্যুই প্রমাণ করে যে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে’।

জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হলেও সবাই জানে দেশে এখন বিরোধী দল হচ্ছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলাম কার্যত এখন মাঠে নেই, মাঠে নেই বলে তারা যে দুর্বল তা কিন্তু নয়। রাজনীতিতে তারা তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে কৌশলে। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টেরা যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন তারা তাদের সমমনা দলে ভিড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিল; জামায়াতও সম্ভবত একই কৌশল গ্রহণ করেছে। রংপুর এলাকা ব্যতীত দেশের অন্যত্র জাতীয় পার্টির প্রভাব-প্রতিপত্তি আস্তে আস্তে কমছে। ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট এরশাদেরও বহু অন্ধ ভক্ত আছেন। এরশাদ সাহেবের মৃত্যুর পর দলীয় নেতৃত্বের কোন্দলেও দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দলীয় সমর্থকদের মধ্যে অনেকে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করতে চায়; কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মোহে নতুন আসা কারও আনুগত্য সহ্য করতে পারে না-হাইব্রিড, কাওয়্যা, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি বেসুরের শব্দ বলে তাদের শুধু দূরে সরিয়ে রাখে না, প্রতিহতও করে। আওয়ামী লীগে এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা যত বেশি হবে জাতীয় পার্টির সাধারণ সমর্থকরা তত বেশি বিএনপির প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠবে।

বিএনপি নির্বাচনকে ইদানীং হাল্কাভাবে গ্রহণ করেছে; নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য বিএনপির যেভাবে মাঠে থাকা প্রয়োজন সেভাবে তারা মাঠে নেই। কর্মীদের একটু চাঙ্গা রাখতে তারা নামকাওয়াস্তে এখন নির্বাচন করছে; সক্রিয় হয়ে কেউ মামলার সম্মুখীন হতে চাচ্ছে না। তাই বিএনপির চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও পুলিং এজেন্ট দেয়ার মতো কর্মীও সর্বত্র নেই, সাহস করে কেউ এগিয়ে আসছে না। আমাদের মতো দেশে সরকার যেমন বিরোধী দল সহ্য করতে পারে না, তদ্রƒপ বিরোধী দলও রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করা ছাড়া থাকতে পারে না। অবশ্য নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির গুরুত্ব সরকার দেয় না; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাই আগুন লাগাতে হয়, ভাঙচুর করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারও চায় কিছু ভাঙচুর হোক যাতে মামলা দিয়ে হয়রানি করা সম্ভব হয়। বিএনপি এই ফাঁদে পড়ে দিশেহারা। জনগণ মনে হয় স্থায়ীভাবে হরতাল ত্যাগ করেছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল এখন আর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয় না।

বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় আওয়ালী লীগের কর্মীদেরও অলস করে দিয়েছে, ভোটের দিন ঘরে বসে তারা আরাম আয়েশ করে টিভি দেখে মোবাইল ঘেটে দিন কাটান, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সামান্যতম তাগিদও অনুভব করেন না; কারণ তাদের বিশ্বাস আওয়ামী লীগ জিতবেই। মাঠপর্যায়ে বিএনপির কর্মীদের ভয় দেখানো হয়েছে এবং তারা ভয় পেয়েছেও। এই ভয় ভোটের আগেই বিএনপিকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এতদসত্ত্বেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, ভোটের দিন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আবদ্ধ ঘর থেকে জনগণ ভোট দিতে বের হবে, কিন্তু জনগণ বের হননি, ভোটের ফলাফল এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে, বিএনপির প্রায় সব প্রার্থী জামানত হারান। জামায়াতে ইসলামের সহযোগিতায় তাদের আগুন সন্ত্রাস, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড মেরে লোক হত্যার সঙ্গে বিএনপি সরকার ও বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতার সংশ্লিষ্টতা থাকায় বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুতি ঘটে, আওয়ামী লীগ সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের অনিয়মতান্ত্রিক রাস্তার আন্দোলন দমন করতে থাকে, বিএনপির রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিএনপির পল্টন অফিস থেকে প্রদত্ত বক্তব্য আর বিবৃতির মধ্যে।

নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও তারা তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারছে না। যে বিএনপি এতবার ক্ষমতায় ছিল সেই বিএনপির প্রার্থীরা কেন ব্যাপকভাবে জামানত হারাচ্ছেন তার হদিশ নেয়ার গরজ সরকার বা নির্বাচন কমিশনের নেই। বিএনপি আমলের মাগুরা নির্বাচনে জয়লাভের যে অপকৌশল তা আর থামছে না। বিএনপি প্রথমদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে উপহাস করেছে, তাদের আমলেই মহামান্য প্রেসিডেন্টকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের পছন্দের বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার অভিপ্রায়ে বিএনপি বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা না হলে এখন হয়তো বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করতে হতো না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও কোন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে পরাজিত দল স্বীকার করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতান্ত্রিক সরকার নয় বলে সংবিধান পরিপন্থি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালত বাতিল করল। তারপরও বিএনপি চায় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হোক। এই চাওয়াটা অপরাধ নয়, কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে বিএনপিও নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন করবে আর আওয়ামী লীগ হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করবে।

নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থার অভাব হলে তা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ এনেছেন ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক? অভিযোগের সত্যাসত্য নিরূপণের এখতিয়ার জনতার নেই। আইনের অনুসরণে সব অনিয়মকে বিধিবদ্ধ করা হয়তো সহজ, কিন্তু আইন ও বিধির প্রয়োগের বিশ্বাসযাগ্যতা দৃশ্যমান হওয়া জরুরী। বিরোধী দলে থাকলে সবাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চায়, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে। এর ফলে বৃত্তাবদ্ধ দলীয় স্বার্থসিদ্ধির অনিয়ম আস্তে আস্তে নিয়মে পর্যবসিত হচ্ছে। অনিয়ম যখন নিয়ম হয়ে যায় তখন স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। ভোটারবিহীন নির্বাচন বারবার করা হলে জনগণ এক সময় ভোটার হওয়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখা দরকার, বিএনপি প্রার্থীর জামানত রক্ষা করা জয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্যও জরুরি। নির্বাচনে জয়লাভ যদি রাজনৈতিক পেশায় পরিণত হয়ে যায় তাহলে তার জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন দায়ী হবে না, রাজনৈতিক দল ও ভোটারেরাও দায়ী হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক,

সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৪ মাঘ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

নির্বাচনে অনিয়ম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও অনেকগুলো পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ চলছেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী; তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ডা. শাহাদাৎ হোসেন থেকে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৯ ভোট বেশি পেয়েছেন। এই নির্বাচনে শুধু অনিয়মের অভিযোগ নয়, সহিংস ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন এই সহিংস ঘটনায় এক সুরে কথা বলেছে-‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’। শুধু আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করে লাভ নেই, যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তারা আর নির্বাচন কমিশন এক সুরে কথা বলেছে। ক্ষমতায় থেকে ট্রাম্পের মতো কেউ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শোনা যায়নি। সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন আরও একটি কথা উল্লেখ করতে ভুল করে না- ‘এতগুলো মারামারি ও মৃত্যুই প্রমাণ করে যে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে’।

জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হলেও সবাই জানে দেশে এখন বিরোধী দল হচ্ছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলাম কার্যত এখন মাঠে নেই, মাঠে নেই বলে তারা যে দুর্বল তা কিন্তু নয়। রাজনীতিতে তারা তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে কৌশলে। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টেরা যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন তারা তাদের সমমনা দলে ভিড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিল; জামায়াতও সম্ভবত একই কৌশল গ্রহণ করেছে। রংপুর এলাকা ব্যতীত দেশের অন্যত্র জাতীয় পার্টির প্রভাব-প্রতিপত্তি আস্তে আস্তে কমছে। ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট এরশাদেরও বহু অন্ধ ভক্ত আছেন। এরশাদ সাহেবের মৃত্যুর পর দলীয় নেতৃত্বের কোন্দলেও দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দলীয় সমর্থকদের মধ্যে অনেকে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করতে চায়; কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মোহে নতুন আসা কারও আনুগত্য সহ্য করতে পারে না-হাইব্রিড, কাওয়্যা, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি বেসুরের শব্দ বলে তাদের শুধু দূরে সরিয়ে রাখে না, প্রতিহতও করে। আওয়ামী লীগে এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা যত বেশি হবে জাতীয় পার্টির সাধারণ সমর্থকরা তত বেশি বিএনপির প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠবে।

বিএনপি নির্বাচনকে ইদানীং হাল্কাভাবে গ্রহণ করেছে; নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য বিএনপির যেভাবে মাঠে থাকা প্রয়োজন সেভাবে তারা মাঠে নেই। কর্মীদের একটু চাঙ্গা রাখতে তারা নামকাওয়াস্তে এখন নির্বাচন করছে; সক্রিয় হয়ে কেউ মামলার সম্মুখীন হতে চাচ্ছে না। তাই বিএনপির চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও পুলিং এজেন্ট দেয়ার মতো কর্মীও সর্বত্র নেই, সাহস করে কেউ এগিয়ে আসছে না। আমাদের মতো দেশে সরকার যেমন বিরোধী দল সহ্য করতে পারে না, তদ্রƒপ বিরোধী দলও রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করা ছাড়া থাকতে পারে না। অবশ্য নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির গুরুত্ব সরকার দেয় না; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাই আগুন লাগাতে হয়, ভাঙচুর করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারও চায় কিছু ভাঙচুর হোক যাতে মামলা দিয়ে হয়রানি করা সম্ভব হয়। বিএনপি এই ফাঁদে পড়ে দিশেহারা। জনগণ মনে হয় স্থায়ীভাবে হরতাল ত্যাগ করেছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল এখন আর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয় না।

বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় আওয়ালী লীগের কর্মীদেরও অলস করে দিয়েছে, ভোটের দিন ঘরে বসে তারা আরাম আয়েশ করে টিভি দেখে মোবাইল ঘেটে দিন কাটান, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সামান্যতম তাগিদও অনুভব করেন না; কারণ তাদের বিশ্বাস আওয়ামী লীগ জিতবেই। মাঠপর্যায়ে বিএনপির কর্মীদের ভয় দেখানো হয়েছে এবং তারা ভয় পেয়েছেও। এই ভয় ভোটের আগেই বিএনপিকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এতদসত্ত্বেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, ভোটের দিন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আবদ্ধ ঘর থেকে জনগণ ভোট দিতে বের হবে, কিন্তু জনগণ বের হননি, ভোটের ফলাফল এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে, বিএনপির প্রায় সব প্রার্থী জামানত হারান। জামায়াতে ইসলামের সহযোগিতায় তাদের আগুন সন্ত্রাস, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড মেরে লোক হত্যার সঙ্গে বিএনপি সরকার ও বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতার সংশ্লিষ্টতা থাকায় বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুতি ঘটে, আওয়ামী লীগ সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের অনিয়মতান্ত্রিক রাস্তার আন্দোলন দমন করতে থাকে, বিএনপির রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিএনপির পল্টন অফিস থেকে প্রদত্ত বক্তব্য আর বিবৃতির মধ্যে।

নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও তারা তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারছে না। যে বিএনপি এতবার ক্ষমতায় ছিল সেই বিএনপির প্রার্থীরা কেন ব্যাপকভাবে জামানত হারাচ্ছেন তার হদিশ নেয়ার গরজ সরকার বা নির্বাচন কমিশনের নেই। বিএনপি আমলের মাগুরা নির্বাচনে জয়লাভের যে অপকৌশল তা আর থামছে না। বিএনপি প্রথমদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে উপহাস করেছে, তাদের আমলেই মহামান্য প্রেসিডেন্টকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের পছন্দের বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার অভিপ্রায়ে বিএনপি বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা না হলে এখন হয়তো বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করতে হতো না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও কোন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে পরাজিত দল স্বীকার করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতান্ত্রিক সরকার নয় বলে সংবিধান পরিপন্থি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালত বাতিল করল। তারপরও বিএনপি চায় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হোক। এই চাওয়াটা অপরাধ নয়, কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে বিএনপিও নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন করবে আর আওয়ামী লীগ হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করবে।

নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থার অভাব হলে তা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ এনেছেন ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক? অভিযোগের সত্যাসত্য নিরূপণের এখতিয়ার জনতার নেই। আইনের অনুসরণে সব অনিয়মকে বিধিবদ্ধ করা হয়তো সহজ, কিন্তু আইন ও বিধির প্রয়োগের বিশ্বাসযাগ্যতা দৃশ্যমান হওয়া জরুরী। বিরোধী দলে থাকলে সবাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চায়, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে। এর ফলে বৃত্তাবদ্ধ দলীয় স্বার্থসিদ্ধির অনিয়ম আস্তে আস্তে নিয়মে পর্যবসিত হচ্ছে। অনিয়ম যখন নিয়ম হয়ে যায় তখন স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। ভোটারবিহীন নির্বাচন বারবার করা হলে জনগণ এক সময় ভোটার হওয়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখা দরকার, বিএনপি প্রার্থীর জামানত রক্ষা করা জয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্যও জরুরি। নির্বাচনে জয়লাভ যদি রাজনৈতিক পেশায় পরিণত হয়ে যায় তাহলে তার জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন দায়ী হবে না, রাজনৈতিক দল ও ভোটারেরাও দায়ী হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক,

সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com