মায়ানমারে সেনাশাসন : সু চি, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জাতিগত সংঘাত

আফসান চৌধুরী

নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই সু চিকে মায়ানমারের সেনাবাহিনী উৎখাত করেছে। এই ঘটনায় অনেক দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো হতাশ হয়েছে। এটাকে তাদের এক আইকনের পরাজয় এবং ‘গণতন্ত্রের’ ওপর অন্যায় আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেনাবাহিনী (যারা সব সময়ই দেশটির প্রচ্ছন্ন ক্ষমতায় ছিল) মায়ানমারের শাসনব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে সেটার চেয়েও দেশটির সমস্যা যে আরও গভীর হতে পারে তা নজরেই পড়েনি।

মায়নমারের সমস্যা কেবল বেসামরিক আর সামরিক শাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং দেশটিতে বিভক্ত অনেক বিদ্রোহপ্রবণ আধাশাসিত অঞ্চল এই সমস্যার উৎস। সামরিক শাসন বা পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র যার সমাধান নয়।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মায়ানমার পশ্চিমা বিশ্ব আর চীনের ‘বৈশ্বিক’ দ্বন্দ্বের করুণ শিকারে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম নিয়মিতই অভিযোগ করে আসছে যে, সেনাবাহিনির বিরুদ্ধে সু চির লড়াই-সংগ্রামকে চীন কখনও সমর্থন করেনি। ঠিক রোহিঙ্গাদের মতোই, যারা মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে দেশছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে, সু চি ও মায়ানমার বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার হয়েছে।

সু চি’র অভিরুচি

মায়ানমার রাষ্ট্রের জনক অং সান-এর মেয়ে সু চি একজন উত্তরাধিকারী শাসক। তিনি দৃঢ়ভাবে পাশ্চাত্যভাবধারা ধারণ করেন এবং পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও মনোভাবের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পাশ্চাত্যাধারার ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক বিশ্বাসবোধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কারণেই পাশ্চাত্যে তাকে এতো মহিমান্বিত করে দেখানো হয়। আবার একভাবে তিনি ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য আর বর্তমান মায়ানমারের দীর্ঘ ঐতিহাসিক যোগসূত্রের একটি অংশ। আজকের মায়ানমারের জাতিগত সমস্যাসহ অনেক সমস্যাই যে ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি সেটা তার সমর্থকরা ভুলেই গেছেন।

কারান্তরীণ থেকে ও রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণের সুযোগের অভাবে তাকে নিশ্চয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে মায়ানমারের সমস্যা কেবল এই একটিই নয় যে, সেনাবাহিনী নির্বাচিত একটি সরকারকে উৎখাত করেছে। তিনি সবসময়ই পাশ্চাত্য স্বার্থের, পাশ্চাত্য ধাঁচের ‘গণতন্ত্রের সমর্থক’। সু চি মায়ানমারের বাস্তবতাকে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন।

ক্ষমতার প্রয়োজনে চড়া মূল্য দিতেও কুণ্ঠিত হননি তিনি। রোহিঙ্গা বিতারণই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মায়ানমারের মানুষ বহু জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত। রোহিঙ্গা আর অল্পকিছু গোষ্ঠী ছাড়া তাদের প্রায় সবাই পূর্ব এশিয় ও মঙ্গোলীয়। আর রোহিঙ্গারা বাকি প্রায় সব জাতিগোষ্ঠী, মূলত বার্মিজ জাতির, বিদ্বেষের শিকার। মায়ানমারের ৬৮ ভাগ মানুষই বার্মিজ। বোঝা যায় যে ‘জাতি’, ‘জনগণ’, ‘নাগরিক’ প্রভৃতির গুরুত্ব মায়ানমারে কম, সেখানে জাতিগত (নৃতাত্ত্বিক) পরিচয়ই বড়। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র সুদূর পরাহত।

বিদেশে ‘গণতান্ত্রিক’ আর দেশে ‘বর্ণবাদী’ হওয়া সু চি’র জন্য ছিল বেশ বড় একটা সুবিধা। রোহিঙ্গা বিতারণের মাধ্যমে তিনি এমন এক চাল চেলেছেন যেটা মায়ানমারে বেশ কাজে এসেছে। যৎসামান্য যতটুকু ক্ষমতাই ছিল প্রথমে সেটা অর্জন করা আর তারপর তা আকড়ে থাকার ক্ষেত্রে এটা জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। যখন আন্তর্জাতিক আদালত বিচার শুরু করল, তখন তিনিও ‘জাতীয়তা’বোধের ধোয় তুললেন যেটা তার দেশে মূলত গড়ে উঠেছে বর্ণবিদ্বেষ বিশেষ করে রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বিদ্বেষের ভিত্তিতে।

কিছু সময়ের জন্য এটা কাজ করলেও তিনি যে অপশক্তিকে বশ করার চেষ্টা করছিলেন সেটাও একই খেলা খেলছিল এবং এর মূল্য তিনি পেয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে যখন পূর্ব-পশ্চিম বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে তখন পাশ্চাত্যের মিত্র হিসেবে তার এই অপসারণ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

বেসামরিক শাসনের পতনের কারণে মায়ানমারের জনগণের প্রতি পুরোপুরি সহানুভূতিশীল হওয়া বেশ কঠিন। কারণ সেদেশের মানুষ আদতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না, তারা রোহিঙ্গা বিতারণে আনন্দিত হয়। তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অমোঘ সত্য।

‘বেসামরিক শাসন’কে পুঁজি করে এবং পাশ্চাত্য সমর্থনে নিজে সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য সু চি ক্ষমতাকেই বেছে নিয়েছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, ঠিক রোহিঙ্গারা যেমন তার ঘুঁটি, আরও বড় খেলা চলছিল এবং সেই খেলায় তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন, রাষ্ট্র মায়ানমারসহ নিজে পরিণত হয়েছেন এক ঘুঁটিতে।

পূর্ব-পশ্চিম বিরোধ ও আঞ্চলিক রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা জোট সু চিকেই সমর্থন দিচ্ছে, কারণ তিনি পশ্চিমাদের বিশ্বস্ত মিত্র। রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ। অনেকেই তাকে এই অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ হিসেবে দেখতেন। রোহিঙ্গা সংকট যখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণ হলো তখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই মায়ানমার নীতি ছিল অস্পষ্ট।

অবশ্য এটা কখনওই বড় কোন ইস্যু ছিল না, কারণ- না রোহিঙ্গা না বাংলাদেশের কৌশলগত কোন গুরুত্ব আছে। রোহিঙ্গা বিতারণের ঘটনায় তারা সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু কেউই কাজের কাজ কিছ্ইু করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল এখানে বড় কিছু ঘটছে না। আর রাখাইন রাজ্যে, যেখানে আর যে কারও চেয়ে চীনের অবস্থান অনেক শক্তিশালী, সুবিধা নেয়ার জন্য মায়ানমার সরকারের নীতিকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছিল ভারত।

মায়ানমারে চীনকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে ভারত অবশ্য পাশ্চাত্যের প্রক্সি হয়ে উঠেছে তবে দেশটি এখনও যথেষ্ট প্রভাবদায়ী আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। মায়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলে পাশ্চাত্য ঘরানার ভারতের একটু ক্ষতিই হলো।

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটকে উপেক্ষা করে মায়ানমারকে আনুকূল্য দেখানো ভারতের জন্য ঠিকই ছিল। তবে মায়ানমারের এই ভাগ্য বিপর্যেয়ের কারণে এখন দেশটির অর্জনের ঝুলিতে দেখাবার মতো সামান্য কিছুই অবশিষ্ট আছে। ভারত হয়তো ভুলে গিয়েছিল যে, তারা যখন মায়ানমারে ঢোকার পথ খুঁজছে তার অনেক আগেই চীন সেখানে ডেরা গেড়ে বসে আছে।

ওয়াশিংটন ডিসির চীনবিরোধী সংঘাতপূর্ণ মনোভাব মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্বাচনে কোন আঁচড় ফেলেনি। তাইওয়ান নিয়ে বাড়তে থাকা উত্তেজনা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র এটা নিয়ে উত্তেজনা বাড়াতে চাচ্ছে, চীনও থেমে নেই। ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা মানে যুদ্ধ’- চীনের নেতাদের এই বক্তব্যে দুই পক্ষের বৈরী অবস্থান প্রকাশ পায়।

ট্রাম্পের বিদায়ে মনে হতে পারে যে, নতুন যুগের শুরু হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্র্কের ক্ষত সম্ভবত পূরণ হওয়ার নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার ভাগাভাগির বৈশ্বিক মডেলে বিশ্বাস করে না। দেশটির কৌশলই হচ্ছে ‘স্থায়ী শ্রেষ্ঠত্ব’ বজায় রাখা। কারণ তারা এক্ষেত্রে কখনও যূথবদ্ধ হয়ে চলেনি, একা চলেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় তার শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন সবসময় অদক্ষ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কারণে হোঁচট খেয়েছে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে তার বৈশ্বিক বাজার নিয়ে কোন হুমকি মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে চীনের বেলায় চিত্রটা ভিন্ন। বেইজিংয়ের বাজারনির্ভর অর্থনীতি তার জন্য অনেক বড় আর বহুমুখী হুমকি তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয়দিক দিয়ে শক্তিশালী চীনকে মোকাবিলা করার জন্য তারা এখনও যুতসই কোন কৌশল খুঁজে পায়নি।

চীন যেটা করছে সেটা হচ্ছে ‘আমার এলাকা’ ছাড়ো নীতি। এ কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমাদের প্রবেশে সে বাদ সাধছে। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় দক্ষিণ আমেরিকায় যেমনটা করেছিল। কাজেই পাশ্চাত্য যোগসূত্রের সু চিকে বিশ্বাস করা যায় না। চীনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা মায়ানমারের সেনাবাহিনী। এক সময় কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে, মায়ানমার হয়তো চীনকে সামলাতে পারবে তাদের ভাবনা বদলানোর সময় এসেছে।

মায়ানমারের কী হবে?

ঐকতানের দেশ- এমন মডেল মায়ানমারে হয়তো খাটবে না। সেখানে সাত-আটটি বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় আছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তাদের সেনাবাহিনীই মদদ দিচ্ছে। সেখানে উপরাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এর শেকড় অনেক গভীরে বিস্তৃৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঔপনিবেশিক সংঘাতের ফলেই সেখানে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। প্রায় এক শতাব্দি ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিদ্রোহীরা ইয়াঙ্গুনের কর্তৃত্ব মেনে অস্ত্র ত্যাগ করবে বলে মনে হয় না।

হয় সংঘাত স্থায়ী হবে, নয়তো বড়জোর ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করা যাবে। এর অর্থ হচ্ছে ছোট ছোট, কার্যত স্বাধীন, রাজ্যের উত্থান অনিবার্য। কী হবে সেটা কোন ব্যপার না। চীনের যাবে-আসবে না কিছুই। কাজেই চীন মায়ানমারে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।

রোহিঙ্গাদের মায়ানমার তাদের বড় ‘শত্রু’ হিসেবে দেখে। জাতিগত নিধন রাষ্ট্রের এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। মায়ানমারে যে জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত বড় একটা সমস্যা সেটা তারা ভুলে গেছে। দেশটির এই সংকটের সুযোগ না নেয়ার কোন কারণ চীনের নেই। আর মায়ানমারের বেসামরিক কি সামরিক কোন নের্তৃত্বই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো যোগ্যতা রাখে না।

আর মায়ানমারে চলমান জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যদি চীন একাধিক গোষ্ঠীকে মদদ দেয় তাহলে চীনকে ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। চীন কেবল অঙ্গুলি হেলনেই মায়ানমারে কর্তৃত্ব করছে না, দেশটিকে তারা মুঠোবন্দী করে রেখেছে।

[লেখক: সাংবাদিক,

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিয়ে গবেষণারত]

সোমবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৫ মাঘ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মায়ানমারে সেনাশাসন : সু চি, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জাতিগত সংঘাত

আফসান চৌধুরী

image

নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই সু চিকে মায়ানমারের সেনাবাহিনী উৎখাত করেছে। এই ঘটনায় অনেক দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো হতাশ হয়েছে। এটাকে তাদের এক আইকনের পরাজয় এবং ‘গণতন্ত্রের’ ওপর অন্যায় আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেনাবাহিনী (যারা সব সময়ই দেশটির প্রচ্ছন্ন ক্ষমতায় ছিল) মায়ানমারের শাসনব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে সেটার চেয়েও দেশটির সমস্যা যে আরও গভীর হতে পারে তা নজরেই পড়েনি।

মায়নমারের সমস্যা কেবল বেসামরিক আর সামরিক শাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং দেশটিতে বিভক্ত অনেক বিদ্রোহপ্রবণ আধাশাসিত অঞ্চল এই সমস্যার উৎস। সামরিক শাসন বা পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র যার সমাধান নয়।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মায়ানমার পশ্চিমা বিশ্ব আর চীনের ‘বৈশ্বিক’ দ্বন্দ্বের করুণ শিকারে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম নিয়মিতই অভিযোগ করে আসছে যে, সেনাবাহিনির বিরুদ্ধে সু চির লড়াই-সংগ্রামকে চীন কখনও সমর্থন করেনি। ঠিক রোহিঙ্গাদের মতোই, যারা মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে দেশছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে, সু চি ও মায়ানমার বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার হয়েছে।

সু চি’র অভিরুচি

মায়ানমার রাষ্ট্রের জনক অং সান-এর মেয়ে সু চি একজন উত্তরাধিকারী শাসক। তিনি দৃঢ়ভাবে পাশ্চাত্যভাবধারা ধারণ করেন এবং পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও মনোভাবের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পাশ্চাত্যাধারার ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক বিশ্বাসবোধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কারণেই পাশ্চাত্যে তাকে এতো মহিমান্বিত করে দেখানো হয়। আবার একভাবে তিনি ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য আর বর্তমান মায়ানমারের দীর্ঘ ঐতিহাসিক যোগসূত্রের একটি অংশ। আজকের মায়ানমারের জাতিগত সমস্যাসহ অনেক সমস্যাই যে ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি সেটা তার সমর্থকরা ভুলেই গেছেন।

কারান্তরীণ থেকে ও রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণের সুযোগের অভাবে তাকে নিশ্চয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে মায়ানমারের সমস্যা কেবল এই একটিই নয় যে, সেনাবাহিনী নির্বাচিত একটি সরকারকে উৎখাত করেছে। তিনি সবসময়ই পাশ্চাত্য স্বার্থের, পাশ্চাত্য ধাঁচের ‘গণতন্ত্রের সমর্থক’। সু চি মায়ানমারের বাস্তবতাকে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন।

ক্ষমতার প্রয়োজনে চড়া মূল্য দিতেও কুণ্ঠিত হননি তিনি। রোহিঙ্গা বিতারণই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মায়ানমারের মানুষ বহু জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত। রোহিঙ্গা আর অল্পকিছু গোষ্ঠী ছাড়া তাদের প্রায় সবাই পূর্ব এশিয় ও মঙ্গোলীয়। আর রোহিঙ্গারা বাকি প্রায় সব জাতিগোষ্ঠী, মূলত বার্মিজ জাতির, বিদ্বেষের শিকার। মায়ানমারের ৬৮ ভাগ মানুষই বার্মিজ। বোঝা যায় যে ‘জাতি’, ‘জনগণ’, ‘নাগরিক’ প্রভৃতির গুরুত্ব মায়ানমারে কম, সেখানে জাতিগত (নৃতাত্ত্বিক) পরিচয়ই বড়। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র সুদূর পরাহত।

বিদেশে ‘গণতান্ত্রিক’ আর দেশে ‘বর্ণবাদী’ হওয়া সু চি’র জন্য ছিল বেশ বড় একটা সুবিধা। রোহিঙ্গা বিতারণের মাধ্যমে তিনি এমন এক চাল চেলেছেন যেটা মায়ানমারে বেশ কাজে এসেছে। যৎসামান্য যতটুকু ক্ষমতাই ছিল প্রথমে সেটা অর্জন করা আর তারপর তা আকড়ে থাকার ক্ষেত্রে এটা জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। যখন আন্তর্জাতিক আদালত বিচার শুরু করল, তখন তিনিও ‘জাতীয়তা’বোধের ধোয় তুললেন যেটা তার দেশে মূলত গড়ে উঠেছে বর্ণবিদ্বেষ বিশেষ করে রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বিদ্বেষের ভিত্তিতে।

কিছু সময়ের জন্য এটা কাজ করলেও তিনি যে অপশক্তিকে বশ করার চেষ্টা করছিলেন সেটাও একই খেলা খেলছিল এবং এর মূল্য তিনি পেয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে যখন পূর্ব-পশ্চিম বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে তখন পাশ্চাত্যের মিত্র হিসেবে তার এই অপসারণ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

বেসামরিক শাসনের পতনের কারণে মায়ানমারের জনগণের প্রতি পুরোপুরি সহানুভূতিশীল হওয়া বেশ কঠিন। কারণ সেদেশের মানুষ আদতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না, তারা রোহিঙ্গা বিতারণে আনন্দিত হয়। তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অমোঘ সত্য।

‘বেসামরিক শাসন’কে পুঁজি করে এবং পাশ্চাত্য সমর্থনে নিজে সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য সু চি ক্ষমতাকেই বেছে নিয়েছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, ঠিক রোহিঙ্গারা যেমন তার ঘুঁটি, আরও বড় খেলা চলছিল এবং সেই খেলায় তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন, রাষ্ট্র মায়ানমারসহ নিজে পরিণত হয়েছেন এক ঘুঁটিতে।

পূর্ব-পশ্চিম বিরোধ ও আঞ্চলিক রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা জোট সু চিকেই সমর্থন দিচ্ছে, কারণ তিনি পশ্চিমাদের বিশ্বস্ত মিত্র। রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ। অনেকেই তাকে এই অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ হিসেবে দেখতেন। রোহিঙ্গা সংকট যখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণ হলো তখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই মায়ানমার নীতি ছিল অস্পষ্ট।

অবশ্য এটা কখনওই বড় কোন ইস্যু ছিল না, কারণ- না রোহিঙ্গা না বাংলাদেশের কৌশলগত কোন গুরুত্ব আছে। রোহিঙ্গা বিতারণের ঘটনায় তারা সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু কেউই কাজের কাজ কিছ্ইু করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল এখানে বড় কিছু ঘটছে না। আর রাখাইন রাজ্যে, যেখানে আর যে কারও চেয়ে চীনের অবস্থান অনেক শক্তিশালী, সুবিধা নেয়ার জন্য মায়ানমার সরকারের নীতিকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছিল ভারত।

মায়ানমারে চীনকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে ভারত অবশ্য পাশ্চাত্যের প্রক্সি হয়ে উঠেছে তবে দেশটি এখনও যথেষ্ট প্রভাবদায়ী আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। মায়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলে পাশ্চাত্য ঘরানার ভারতের একটু ক্ষতিই হলো।

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটকে উপেক্ষা করে মায়ানমারকে আনুকূল্য দেখানো ভারতের জন্য ঠিকই ছিল। তবে মায়ানমারের এই ভাগ্য বিপর্যেয়ের কারণে এখন দেশটির অর্জনের ঝুলিতে দেখাবার মতো সামান্য কিছুই অবশিষ্ট আছে। ভারত হয়তো ভুলে গিয়েছিল যে, তারা যখন মায়ানমারে ঢোকার পথ খুঁজছে তার অনেক আগেই চীন সেখানে ডেরা গেড়ে বসে আছে।

ওয়াশিংটন ডিসির চীনবিরোধী সংঘাতপূর্ণ মনোভাব মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্বাচনে কোন আঁচড় ফেলেনি। তাইওয়ান নিয়ে বাড়তে থাকা উত্তেজনা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র এটা নিয়ে উত্তেজনা বাড়াতে চাচ্ছে, চীনও থেমে নেই। ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা মানে যুদ্ধ’- চীনের নেতাদের এই বক্তব্যে দুই পক্ষের বৈরী অবস্থান প্রকাশ পায়।

ট্রাম্পের বিদায়ে মনে হতে পারে যে, নতুন যুগের শুরু হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্র্কের ক্ষত সম্ভবত পূরণ হওয়ার নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার ভাগাভাগির বৈশ্বিক মডেলে বিশ্বাস করে না। দেশটির কৌশলই হচ্ছে ‘স্থায়ী শ্রেষ্ঠত্ব’ বজায় রাখা। কারণ তারা এক্ষেত্রে কখনও যূথবদ্ধ হয়ে চলেনি, একা চলেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় তার শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন সবসময় অদক্ষ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কারণে হোঁচট খেয়েছে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে তার বৈশ্বিক বাজার নিয়ে কোন হুমকি মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে চীনের বেলায় চিত্রটা ভিন্ন। বেইজিংয়ের বাজারনির্ভর অর্থনীতি তার জন্য অনেক বড় আর বহুমুখী হুমকি তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয়দিক দিয়ে শক্তিশালী চীনকে মোকাবিলা করার জন্য তারা এখনও যুতসই কোন কৌশল খুঁজে পায়নি।

চীন যেটা করছে সেটা হচ্ছে ‘আমার এলাকা’ ছাড়ো নীতি। এ কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমাদের প্রবেশে সে বাদ সাধছে। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় দক্ষিণ আমেরিকায় যেমনটা করেছিল। কাজেই পাশ্চাত্য যোগসূত্রের সু চিকে বিশ্বাস করা যায় না। চীনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা মায়ানমারের সেনাবাহিনী। এক সময় কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে, মায়ানমার হয়তো চীনকে সামলাতে পারবে তাদের ভাবনা বদলানোর সময় এসেছে।

মায়ানমারের কী হবে?

ঐকতানের দেশ- এমন মডেল মায়ানমারে হয়তো খাটবে না। সেখানে সাত-আটটি বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় আছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তাদের সেনাবাহিনীই মদদ দিচ্ছে। সেখানে উপরাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এর শেকড় অনেক গভীরে বিস্তৃৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঔপনিবেশিক সংঘাতের ফলেই সেখানে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। প্রায় এক শতাব্দি ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিদ্রোহীরা ইয়াঙ্গুনের কর্তৃত্ব মেনে অস্ত্র ত্যাগ করবে বলে মনে হয় না।

হয় সংঘাত স্থায়ী হবে, নয়তো বড়জোর ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করা যাবে। এর অর্থ হচ্ছে ছোট ছোট, কার্যত স্বাধীন, রাজ্যের উত্থান অনিবার্য। কী হবে সেটা কোন ব্যপার না। চীনের যাবে-আসবে না কিছুই। কাজেই চীন মায়ানমারে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।

রোহিঙ্গাদের মায়ানমার তাদের বড় ‘শত্রু’ হিসেবে দেখে। জাতিগত নিধন রাষ্ট্রের এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। মায়ানমারে যে জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত বড় একটা সমস্যা সেটা তারা ভুলে গেছে। দেশটির এই সংকটের সুযোগ না নেয়ার কোন কারণ চীনের নেই। আর মায়ানমারের বেসামরিক কি সামরিক কোন নের্তৃত্বই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো যোগ্যতা রাখে না।

আর মায়ানমারে চলমান জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যদি চীন একাধিক গোষ্ঠীকে মদদ দেয় তাহলে চীনকে ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। চীন কেবল অঙ্গুলি হেলনেই মায়ানমারে কর্তৃত্ব করছে না, দেশটিকে তারা মুঠোবন্দী করে রেখেছে।

[লেখক: সাংবাদিক,

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিয়ে গবেষণারত]