কোন পথে গণতন্ত্র

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

ফ্রান্সের একজন খ্যাতনামা জেনারেল ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রেঞ্চ ফিফথ রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস দ্য গলের অবিস্মরণীয় একটি উক্তি স্মরণ করতে চাই। যদিও উক্তিটি আমাদের এখানে কোন তাৎপর্য বহন করে না। তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতিটা রাজনীতিবিদরাই করবেন; কিন্তু সুতোটি থাকতে হবে জনগণের হাতে এবং তাদের পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক শক্তির হাতে। তারা কোন রাজনীতিককে টেনে তুলবেন, আবার কাউকে নামাবেন।’

দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির মতো সিরিয়াস বিষয়টি গণতান্ত্রিক দেশে শুধু রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি, লাগামটি রাখা হয়েছে জনগণ ও তাদের পক্ষের সামাজিক শক্তিগুলোর হাতে। এই সংস্কৃতিটি প্রায় পাঁচ দশকেও এ দেশে গড়ে না ওঠার কারণ হচ্ছে, ভোট প্রদান ছাড়া (সেটিও আনেক সময় নিয়ন্ত্রিত) জনগণকে কোন পর্যায়ে ক্ষমতায়িত করা হয়নি।

এক. বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হচ্ছে, গণতন্ত্রের লেবাসে যখন যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারাই জনগণকে সীমাহীন অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। এমনকি নির্বাচনমুখী গণতন্ত্রের ধারায় ভোটারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়েও নানারকম ছলচাতুরীর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মালিক জনগণকে নিরাশ করা হয়েছে। যাদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া, তাদের প্রতি এরকম নিষ্ঠুর আচরণ অনেকটা ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সঙ্গে তুল্য হতে পারে।

আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার বাইরে থাকলে পরিবর্তন চান। গণতন্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট ধারাটি নিশ্চিত করতে চান। আবার তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে, যা বলেছিলেন তার উল্টো যাত্রা করে স্বেচ্ছাধীন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দেন। এজন্য প্রশ্ন- পরিবর্তন বলব কাকে? পরিবর্তন প্রত্যাশী যেসব মানুষ প্রতিনিয়ত দাবি জানাচ্ছেন, তারা আসলে কেমন পরিবর্তনের কথা বলছেন? যে দুই রকমের পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে তার প্রথমটি এই দেশে নাগরিকদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন, যাতে তারা অন্যায় করা ও প্রশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকেন।

এটি কী করে সম্ভব যে, গণতান্ত্রিকতার আদলে যে রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদীতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছার অধীন, অর্থনীতি জিম্মি হয়ে আছে ব্যাংক ঋণকারীদের হাতে- সেখানে কী করে রাতারাতি নাগরিকদের অন্যায় করা ও প্রশ্রয় দেয়া থেকে বিরত রাখা যাবে। মুশকিল হচ্ছে, যে রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যায্য-অন্যায়ের শিকার তাদের ঘাড়েই চাপানো হচ্ছে অন্যায় উৎপাটনের দায়িত্ব? এর চেয়ে বড় রসিকতা কী হতে পারে!

দ্বিতীয় যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বা ক্ষমতার পরিবর্তন! এক্ষেত্রে গণতন্ত্র-সুশাসন, বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। এই পরিবর্তন বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। এই পরিবর্তনের কথাটি জোরেশোরে যারা বলছেন তারা বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কখনও চ্যালেঞ্জ করছেন না। পরিবর্তনের দাবিদাররা জানেন যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ তার কাঠামোগত অবস্থান ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।

পরিবর্তন নিচ থেকে ওপরে না হয়ে ওপর থেকে নিচে আসতে হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন দিয়ে শুরু হতে হবে। সরকার পরিবর্তন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন-দুটি একেবারে আলাদা বিষয়, এই বোধ রাজনীতিকরা গুলিয়ে ফেলেছেন। বিদ্যমান কাঠামোয় সরকার বদলে যাওয়া হচ্ছে একটি লুটেরা শ্রেণীর পরিবর্তে আরেকটি লুটেরা শ্রেণীর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। হোক সেটি গণতন্ত্রের নামে বা সামরিক-বেসামরিক লেবাসে। এর সাথে যুক্ত হয় পূর্বতন ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন, যা মূলত সংস্কার।

দুই. বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই বিভেদময়। গত তিন দশকে রাজনীতির যাত্রাপথ সেই বিভেদকে সংঘাত ও বিদ্বেষে রূপান্তরিত করেছে। সারা বিশ্বের সাথে তাল রেখেই গণতন্ত্রের নামে শাসনব্যবস্থা এগিয়েছে কর্তৃত্ববাদীতার দিকে। ব্যক্তির একক কর্তৃত্ব প্রবণতা রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষম করে তোলেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো আকৃষ্ট হয়েছে রাজনীতিপ্রবণ ও সুবিধাবাদীতার প্রতি। এজন্য যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকা অথবা যাওয়া একমাত্র অভীষ্ট হয়ে উঠেছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিনা ভোটে অধিকাংশ এমপি নির্বাচিত হওয়ার মতো সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় ক্ষমতাসীনরা ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছেন কিনা- সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর জোরে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার যে শক্তিমত্তার সংস্কৃতি বিজয়ী হয়েছে তা রাজনীতিতে অনেক প্রকাশ্য এবং গোপন ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে। এই ক্ষত উপশমের কোন বিধি-ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয় এবং এই উপশম ছাড়াই একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কতটা করা যাবে তা বলার সময় এখনও আসেনি।

এটা এখন পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আর অপরিবর্তনের পেছনে রয়েছে সমাজে নানা শ্রেণী-গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার ভাঙন ও গঠন। আছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ধনিকশ্রেণী ও আন্তর্জাতিক পূঁজির বাহক বা প্রতিনিধিরা। বেসামরিক সংস্থাগুলো বিকাশের মধ্য দিয়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের সৃষ্ট প্রতিনিধি এবং দলদাস সুশীল সমাজ বলে কথিত বুদ্ধিজীবীরা।

তাদের সবার জন্য জরুরি একটি নির্বাচিত সরকার। তাদের জন্য হুমকি হচ্ছে, প্রকৃত অর্থে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থাÑ যেখানে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে বা ক্ষমতায় আসার জন্য-ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাদের পুতুল হিসেবে অভিনয় করতে বাধ্য হন। এর সমস্ত কিছুর মূলে কাজ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সুুযোগে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ এবং ভোগ করা যায়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছেন দলদাসরা, যারা কিনা সুশীল সমাজ নামে পরিচিত। এরা অধিকাংশ দুই প্রধান দলের উচ্ছিষ্টভোগী হিসেবে নানা সময়ে এন্তার আলোচনা-সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এটি মূলত ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ দুই দলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা দিচ্ছে, কিংবা উস্কে দিচ্ছে তৃতীয় কোন পক্ষকে। এই বলয়ের বাইরে হাতেগোনা যে দুই-চারজন বিবেকবান মানুষ জনগণের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করছেন বা সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছেন, তারাও হালে পানি পাচ্ছেন না।

তিন. রাজনীতিবিদরা ভুলেই গেছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-হোক না সেটি নির্বাচনমুখী, ঐক্য হচ্ছে সেখানে সবচেয়ে বড় সূচক। বিভিন্ন মত, পথ ও চিন্তাধারার মানুষের ঐক্য। বিগত বছরগুলোতে রাজনীতি ও সমাজ বিভেদের বিষে নীল হয়ে আছে। সে কারণে জাতীয় জীবন এবং নিরাপত্তা নিয়ে জনগণ সবসময় শঙ্কিত থাকছে। এটি দূর করতে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য প্রয়োজন ছিল- শুরু থেকেই সে বিষয়ে রাজনীতিকরা উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

তাহলে বিরাজনীতিকরণ ধারাবাহিকতায় এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কী? এটি স্পষ্ট করে এখনই বলা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও রাজনীতি যেখানে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে দেয় সেখানে কোনকিছুর কার্যকারিতা থাকে না। রাজনীতির নেতিবাচক প্রবণতা নাগরিকদের মধ্যে বহুমাত্রিক নৈরাজ্যের জন্ম দিচ্ছে। এ প্রবণতাকে প্রধান দুই দল তাদের জন্য অনুকূল ভাবছে, অন্ধকারের শক্তিগুলোও অনুকূল ভাবছে। তবে ৯০ শতাংশ রাজনীতি সচেতন মানুষ কখনই মূলধারা থেকে ছিটকে যায়নি, ইতিহাসের দিকে তাকালে সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

প্রশ্নটি এতদিন গুঞ্জন আকারে ছিল, তা পল্লবিত হতে শুরু করেছে। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে একক ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বীহীন’ নির্বাচনের ওপর ভর করে গত এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষিপ্র ও দাপুটে শাসন জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। বলা হচ্ছে- ‘উন্নয়ন জোয়ার’ দেখে জনগণ অন্যদলকে ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সেজন্য তারা কেন্দ্রে খুব একটা উপস্থিত হচ্ছেন না। আগামীতেও এ ব্যবস্থা সচল রাখা হবে বলে ধরে নিতে আপত্তি কোথায়? এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর নেই। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার কর্তৃত্ববাদী ও কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে পড়েছে।

[লেখক: উন্নয়নকর্মী, সাবেক সংবাদকর্মী]

সোমবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৫ মাঘ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কোন পথে গণতন্ত্র

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

ফ্রান্সের একজন খ্যাতনামা জেনারেল ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রেঞ্চ ফিফথ রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস দ্য গলের অবিস্মরণীয় একটি উক্তি স্মরণ করতে চাই। যদিও উক্তিটি আমাদের এখানে কোন তাৎপর্য বহন করে না। তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতিটা রাজনীতিবিদরাই করবেন; কিন্তু সুতোটি থাকতে হবে জনগণের হাতে এবং তাদের পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক শক্তির হাতে। তারা কোন রাজনীতিককে টেনে তুলবেন, আবার কাউকে নামাবেন।’

দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির মতো সিরিয়াস বিষয়টি গণতান্ত্রিক দেশে শুধু রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি, লাগামটি রাখা হয়েছে জনগণ ও তাদের পক্ষের সামাজিক শক্তিগুলোর হাতে। এই সংস্কৃতিটি প্রায় পাঁচ দশকেও এ দেশে গড়ে না ওঠার কারণ হচ্ছে, ভোট প্রদান ছাড়া (সেটিও আনেক সময় নিয়ন্ত্রিত) জনগণকে কোন পর্যায়ে ক্ষমতায়িত করা হয়নি।

এক. বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হচ্ছে, গণতন্ত্রের লেবাসে যখন যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারাই জনগণকে সীমাহীন অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। এমনকি নির্বাচনমুখী গণতন্ত্রের ধারায় ভোটারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়েও নানারকম ছলচাতুরীর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মালিক জনগণকে নিরাশ করা হয়েছে। যাদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া, তাদের প্রতি এরকম নিষ্ঠুর আচরণ অনেকটা ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সঙ্গে তুল্য হতে পারে।

আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার বাইরে থাকলে পরিবর্তন চান। গণতন্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট ধারাটি নিশ্চিত করতে চান। আবার তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে, যা বলেছিলেন তার উল্টো যাত্রা করে স্বেচ্ছাধীন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দেন। এজন্য প্রশ্ন- পরিবর্তন বলব কাকে? পরিবর্তন প্রত্যাশী যেসব মানুষ প্রতিনিয়ত দাবি জানাচ্ছেন, তারা আসলে কেমন পরিবর্তনের কথা বলছেন? যে দুই রকমের পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে তার প্রথমটি এই দেশে নাগরিকদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন, যাতে তারা অন্যায় করা ও প্রশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকেন।

এটি কী করে সম্ভব যে, গণতান্ত্রিকতার আদলে যে রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদীতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছার অধীন, অর্থনীতি জিম্মি হয়ে আছে ব্যাংক ঋণকারীদের হাতে- সেখানে কী করে রাতারাতি নাগরিকদের অন্যায় করা ও প্রশ্রয় দেয়া থেকে বিরত রাখা যাবে। মুশকিল হচ্ছে, যে রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যায্য-অন্যায়ের শিকার তাদের ঘাড়েই চাপানো হচ্ছে অন্যায় উৎপাটনের দায়িত্ব? এর চেয়ে বড় রসিকতা কী হতে পারে!

দ্বিতীয় যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বা ক্ষমতার পরিবর্তন! এক্ষেত্রে গণতন্ত্র-সুশাসন, বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। এই পরিবর্তন বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। এই পরিবর্তনের কথাটি জোরেশোরে যারা বলছেন তারা বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কখনও চ্যালেঞ্জ করছেন না। পরিবর্তনের দাবিদাররা জানেন যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ তার কাঠামোগত অবস্থান ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।

পরিবর্তন নিচ থেকে ওপরে না হয়ে ওপর থেকে নিচে আসতে হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন দিয়ে শুরু হতে হবে। সরকার পরিবর্তন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন-দুটি একেবারে আলাদা বিষয়, এই বোধ রাজনীতিকরা গুলিয়ে ফেলেছেন। বিদ্যমান কাঠামোয় সরকার বদলে যাওয়া হচ্ছে একটি লুটেরা শ্রেণীর পরিবর্তে আরেকটি লুটেরা শ্রেণীর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। হোক সেটি গণতন্ত্রের নামে বা সামরিক-বেসামরিক লেবাসে। এর সাথে যুক্ত হয় পূর্বতন ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন, যা মূলত সংস্কার।

দুই. বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই বিভেদময়। গত তিন দশকে রাজনীতির যাত্রাপথ সেই বিভেদকে সংঘাত ও বিদ্বেষে রূপান্তরিত করেছে। সারা বিশ্বের সাথে তাল রেখেই গণতন্ত্রের নামে শাসনব্যবস্থা এগিয়েছে কর্তৃত্ববাদীতার দিকে। ব্যক্তির একক কর্তৃত্ব প্রবণতা রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষম করে তোলেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো আকৃষ্ট হয়েছে রাজনীতিপ্রবণ ও সুবিধাবাদীতার প্রতি। এজন্য যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকা অথবা যাওয়া একমাত্র অভীষ্ট হয়ে উঠেছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিনা ভোটে অধিকাংশ এমপি নির্বাচিত হওয়ার মতো সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় ক্ষমতাসীনরা ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছেন কিনা- সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর জোরে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার যে শক্তিমত্তার সংস্কৃতি বিজয়ী হয়েছে তা রাজনীতিতে অনেক প্রকাশ্য এবং গোপন ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে। এই ক্ষত উপশমের কোন বিধি-ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয় এবং এই উপশম ছাড়াই একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কতটা করা যাবে তা বলার সময় এখনও আসেনি।

এটা এখন পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আর অপরিবর্তনের পেছনে রয়েছে সমাজে নানা শ্রেণী-গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার ভাঙন ও গঠন। আছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ধনিকশ্রেণী ও আন্তর্জাতিক পূঁজির বাহক বা প্রতিনিধিরা। বেসামরিক সংস্থাগুলো বিকাশের মধ্য দিয়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের সৃষ্ট প্রতিনিধি এবং দলদাস সুশীল সমাজ বলে কথিত বুদ্ধিজীবীরা।

তাদের সবার জন্য জরুরি একটি নির্বাচিত সরকার। তাদের জন্য হুমকি হচ্ছে, প্রকৃত অর্থে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থাÑ যেখানে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে বা ক্ষমতায় আসার জন্য-ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাদের পুতুল হিসেবে অভিনয় করতে বাধ্য হন। এর সমস্ত কিছুর মূলে কাজ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সুুযোগে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ এবং ভোগ করা যায়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছেন দলদাসরা, যারা কিনা সুশীল সমাজ নামে পরিচিত। এরা অধিকাংশ দুই প্রধান দলের উচ্ছিষ্টভোগী হিসেবে নানা সময়ে এন্তার আলোচনা-সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এটি মূলত ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ দুই দলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা দিচ্ছে, কিংবা উস্কে দিচ্ছে তৃতীয় কোন পক্ষকে। এই বলয়ের বাইরে হাতেগোনা যে দুই-চারজন বিবেকবান মানুষ জনগণের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করছেন বা সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছেন, তারাও হালে পানি পাচ্ছেন না।

তিন. রাজনীতিবিদরা ভুলেই গেছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-হোক না সেটি নির্বাচনমুখী, ঐক্য হচ্ছে সেখানে সবচেয়ে বড় সূচক। বিভিন্ন মত, পথ ও চিন্তাধারার মানুষের ঐক্য। বিগত বছরগুলোতে রাজনীতি ও সমাজ বিভেদের বিষে নীল হয়ে আছে। সে কারণে জাতীয় জীবন এবং নিরাপত্তা নিয়ে জনগণ সবসময় শঙ্কিত থাকছে। এটি দূর করতে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য প্রয়োজন ছিল- শুরু থেকেই সে বিষয়ে রাজনীতিকরা উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

তাহলে বিরাজনীতিকরণ ধারাবাহিকতায় এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কী? এটি স্পষ্ট করে এখনই বলা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও রাজনীতি যেখানে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে দেয় সেখানে কোনকিছুর কার্যকারিতা থাকে না। রাজনীতির নেতিবাচক প্রবণতা নাগরিকদের মধ্যে বহুমাত্রিক নৈরাজ্যের জন্ম দিচ্ছে। এ প্রবণতাকে প্রধান দুই দল তাদের জন্য অনুকূল ভাবছে, অন্ধকারের শক্তিগুলোও অনুকূল ভাবছে। তবে ৯০ শতাংশ রাজনীতি সচেতন মানুষ কখনই মূলধারা থেকে ছিটকে যায়নি, ইতিহাসের দিকে তাকালে সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

প্রশ্নটি এতদিন গুঞ্জন আকারে ছিল, তা পল্লবিত হতে শুরু করেছে। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে একক ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বীহীন’ নির্বাচনের ওপর ভর করে গত এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষিপ্র ও দাপুটে শাসন জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। বলা হচ্ছে- ‘উন্নয়ন জোয়ার’ দেখে জনগণ অন্যদলকে ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সেজন্য তারা কেন্দ্রে খুব একটা উপস্থিত হচ্ছেন না। আগামীতেও এ ব্যবস্থা সচল রাখা হবে বলে ধরে নিতে আপত্তি কোথায়? এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর নেই। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার কর্তৃত্ববাদী ও কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে পড়েছে।

[লেখক: উন্নয়নকর্মী, সাবেক সংবাদকর্মী]