দুর্নীতির সাজার হার কী কারণে শতভাগ হচ্ছে না?

গত ৫ বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় সাজা শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। গত (২০১৫-২০১৯) পর্যন্ত দুদকের মামলায় সাজার হার ৬৩ শতাংশ। গত বছর (২০২০) তা বেড়ে ৭৭ শতাংশ হলেও কমিশন এতে সন্তুষ্ট নয়। কি কারণে সাজার হার শতভাগ হচ্ছে না তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন মনে করছেন দুদকের আইনজীবীরা। তবে অসমর্থিত সূত্রে দাবি, তদন্তে কিছু কিছু কর্মকর্তার অসততা, সঠিক তথ্য-প্রমাণ ঠিকভাবে উপস্থাপন, তদন্তে নানা সীমাবন্ধতা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিকভাবে হাজির না হওয়াসহ নানা কারণে দুদকের মামলায় সাজার হার শতভাগ হচ্ছে না। যদিও দুদকের ভাষ্য, শতভাগ না হলেও দুদকের মামলায় সাজার হার বাড়ছে।

গতকাল পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রকাশিত ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ নিয়ে ভার্চুয়াল মতবিনিয়ম করেন। এর আগে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সাজার হার বাড়ছে। তবে শতভাগ সাজা এখনও নিশ্চিত হয়নি। মামলার অনুসন্ধান, তদন্তে নানারকম গাফলতি আছে। এসব নিয়ে দুদক কাজ করছে। কি কারণে সাজার হার শতভাগ করা যাচ্ছে না সেগুলো কমিশনে পর্যালোচনা করে ত্রুটিগুলো শুধরানোর চেষ্টা করছে। কমিশনের যেসব কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত করেন তাদের কাজের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিদেশেও কর্মকর্তাদের অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্তের বিষয়ে দফায় দফায় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। গত বছর এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে দুদক। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা প্রকাশ করে তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে। পরে এ নিয়ে তদন্ত শুরু হলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক এনামুল বাছিরকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঘুষ নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ মেলায় তাকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্তের পর ঘুষের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে জেলে আছেন দুদকের এ কর্মকর্তা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দুদকের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ থাকায় ব্যবস্থা নিতে হয়েছে দুদককে।

দুদকের একাধিক কর্মকতা বলেন, দুর্নীতির অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্তে দুদকের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখনও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকায় আছেন। সেই সঙ্গে কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অসততাও বাধা হয়েছে। একটি অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা এবং তদন্তে যতগুলো বিষয় প্রয়োজন হয় তা পুরোপুরি সাপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। প্রযুক্তিগত এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সুবিধাও মিলছে না অনেক ক্ষেত্রে। আবর অনেক সময় তদন্তে গিয়ে মিথ্যা তথ্য, সংশ্লিষ্ট বিভাগের অসহযোগিতায় মামলাগুলো সঠিকভাবে চার্জশিট দেয়া যাচ্ছে না।

দুদক কর্মকর্তা বলছেন, গত ২ বছর ধরে (২০১৮-১৯) সাজার হার স্থিতিশীল থাকলেও গত বছর (২০২০) সাজার হার ৬৩ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশে বেড়েছে বলে জানিয়েছে দুদক । গত ৫ বছরে দুদকের নানা পদক্ষেপ, নিজ দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে শুদ্ধি অভিযান, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েও দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় চার্জশিট দেয়ার পর বিচারিক কার্যক্রম চালিয়ে শতভাগ সাজা নিশ্চিত করা যায়নি। এ দু’বছর দুদকের মামলায় সাজার হার ৬৩%। গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব তথ্য উঠে আসে। সাজার হার শতভাগ না হওয়ায় কমিশনের চেয়ারম্যান অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তবে কি কারণে দুদকের মামলায় শতভাগ সাজা নিশ্চিত হচ্ছে না তা প্রকাশ করেনি দুদক। দুদকের ভাষ্য, তারা শতভাগ সাজা নিশ্চিত করার জন্য মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন।

বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদকের করা মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের সাজার হারে সন্তুষ্ট নয় দুদক। যদিও বিগত পাঁচ বছরে সাজার হার ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৭ শতাংশে পৌঁছেছে। কমিশন প্রত্যাশা করে মামলার সাজার হার হবে শতভাগ।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ২০১৫ সালে সাজার হার ছিল ৩৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৫৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ শতাংশ, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সাজার হার কিছুটা কমে ৬৩ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০২০ সালে এর পরিমাণ ৭৭ শতাংশ হয়েছে। কমিশন মনে করে, কিছু লোভী মানুষকে দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক শক্তি। সামাজিকভাবে দুর্নীতিপরায়ণদের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে শত্তিশালী অস্ত্র হতে পারে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা কমিশনে যোগ দিয়েই বলেছিলাম কমিশন সমালোচনাকে স্বাগত জানাবে। কারণ সমালোচনার মাধ্যমে কর্মপ্রক্রিয়ার ভুলত্রুটি উদ্ঘাটিত হয়, যা সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে পরিশুদ্ধ করা যায়।

মতবিনিময় সভায় দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক বিগত বছরগুলোতে মূলত প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ কৌশল পরিচালনা করছে। প্রশাসনিক কৌশলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সহজ।

দুদক কমিশনার এএফএম আমিনুল বলেন, আমরা দিবা-রাত্রি পরিশ্রম করেছি। মামলার অনুসন্ধান-তদন্তের নথি পর্যালোচনা করছি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মামলায় সাজার হার বাড়ছে।

মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৬ মাঘ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

দুর্নীতির সাজার হার কী কারণে শতভাগ হচ্ছে না?

গত ৫ বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় সাজা শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। গত (২০১৫-২০১৯) পর্যন্ত দুদকের মামলায় সাজার হার ৬৩ শতাংশ। গত বছর (২০২০) তা বেড়ে ৭৭ শতাংশ হলেও কমিশন এতে সন্তুষ্ট নয়। কি কারণে সাজার হার শতভাগ হচ্ছে না তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন মনে করছেন দুদকের আইনজীবীরা। তবে অসমর্থিত সূত্রে দাবি, তদন্তে কিছু কিছু কর্মকর্তার অসততা, সঠিক তথ্য-প্রমাণ ঠিকভাবে উপস্থাপন, তদন্তে নানা সীমাবন্ধতা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিকভাবে হাজির না হওয়াসহ নানা কারণে দুদকের মামলায় সাজার হার শতভাগ হচ্ছে না। যদিও দুদকের ভাষ্য, শতভাগ না হলেও দুদকের মামলায় সাজার হার বাড়ছে।

গতকাল পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রকাশিত ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ নিয়ে ভার্চুয়াল মতবিনিয়ম করেন। এর আগে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সাজার হার বাড়ছে। তবে শতভাগ সাজা এখনও নিশ্চিত হয়নি। মামলার অনুসন্ধান, তদন্তে নানারকম গাফলতি আছে। এসব নিয়ে দুদক কাজ করছে। কি কারণে সাজার হার শতভাগ করা যাচ্ছে না সেগুলো কমিশনে পর্যালোচনা করে ত্রুটিগুলো শুধরানোর চেষ্টা করছে। কমিশনের যেসব কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত করেন তাদের কাজের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিদেশেও কর্মকর্তাদের অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্তের বিষয়ে দফায় দফায় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। গত বছর এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে দুদক। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা প্রকাশ করে তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে। পরে এ নিয়ে তদন্ত শুরু হলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক এনামুল বাছিরকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঘুষ নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ মেলায় তাকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্তের পর ঘুষের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে জেলে আছেন দুদকের এ কর্মকর্তা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দুদকের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ থাকায় ব্যবস্থা নিতে হয়েছে দুদককে।

দুদকের একাধিক কর্মকতা বলেন, দুর্নীতির অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্তে দুদকের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখনও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকায় আছেন। সেই সঙ্গে কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অসততাও বাধা হয়েছে। একটি অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা এবং তদন্তে যতগুলো বিষয় প্রয়োজন হয় তা পুরোপুরি সাপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। প্রযুক্তিগত এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সুবিধাও মিলছে না অনেক ক্ষেত্রে। আবর অনেক সময় তদন্তে গিয়ে মিথ্যা তথ্য, সংশ্লিষ্ট বিভাগের অসহযোগিতায় মামলাগুলো সঠিকভাবে চার্জশিট দেয়া যাচ্ছে না।

দুদক কর্মকর্তা বলছেন, গত ২ বছর ধরে (২০১৮-১৯) সাজার হার স্থিতিশীল থাকলেও গত বছর (২০২০) সাজার হার ৬৩ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশে বেড়েছে বলে জানিয়েছে দুদক । গত ৫ বছরে দুদকের নানা পদক্ষেপ, নিজ দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে শুদ্ধি অভিযান, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েও দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় চার্জশিট দেয়ার পর বিচারিক কার্যক্রম চালিয়ে শতভাগ সাজা নিশ্চিত করা যায়নি। এ দু’বছর দুদকের মামলায় সাজার হার ৬৩%। গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব তথ্য উঠে আসে। সাজার হার শতভাগ না হওয়ায় কমিশনের চেয়ারম্যান অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তবে কি কারণে দুদকের মামলায় শতভাগ সাজা নিশ্চিত হচ্ছে না তা প্রকাশ করেনি দুদক। দুদকের ভাষ্য, তারা শতভাগ সাজা নিশ্চিত করার জন্য মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন।

বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদকের করা মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের সাজার হারে সন্তুষ্ট নয় দুদক। যদিও বিগত পাঁচ বছরে সাজার হার ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৭ শতাংশে পৌঁছেছে। কমিশন প্রত্যাশা করে মামলার সাজার হার হবে শতভাগ।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ২০১৫ সালে সাজার হার ছিল ৩৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৫৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ শতাংশ, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সাজার হার কিছুটা কমে ৬৩ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০২০ সালে এর পরিমাণ ৭৭ শতাংশ হয়েছে। কমিশন মনে করে, কিছু লোভী মানুষকে দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক শক্তি। সামাজিকভাবে দুর্নীতিপরায়ণদের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে শত্তিশালী অস্ত্র হতে পারে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা কমিশনে যোগ দিয়েই বলেছিলাম কমিশন সমালোচনাকে স্বাগত জানাবে। কারণ সমালোচনার মাধ্যমে কর্মপ্রক্রিয়ার ভুলত্রুটি উদ্ঘাটিত হয়, যা সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে পরিশুদ্ধ করা যায়।

মতবিনিময় সভায় দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক বিগত বছরগুলোতে মূলত প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ কৌশল পরিচালনা করছে। প্রশাসনিক কৌশলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সহজ।

দুদক কমিশনার এএফএম আমিনুল বলেন, আমরা দিবা-রাত্রি পরিশ্রম করেছি। মামলার অনুসন্ধান-তদন্তের নথি পর্যালোচনা করছি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মামলায় সাজার হার বাড়ছে।