আ-মরি বাংলা ভাষা

ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতিসত্তার প্রথম ও অন্তরতম স্ফুরণ

সাদেকুর রহমান

ভাষা আন্দোলন মানে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, বাংলা ভাষা অর্জনের আন্দোলন। মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল তা দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তুলনারহিত ঘটনা। বিশ্বময় তোলপাড় করা এ আন্দোলন আমাদের জাতিসত্তার প্রথম ও অন্তরতম স্ফুরণ। এর নিহিত শক্তি তাই আজো নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলিত করছে। নেপথ্যে শক্তি সঞ্চারে পরিচালিত করেছিল এই জাতিকে সংকটে, বিজয়ে এবং জাতীয় বিবর্তনে। ১৯৫২ সালের সেই আগুনঝরা দিনগুলোতে দেশের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন বাংলার দাবিতে সেদিনকার আন্দোলনে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

আজ ১২ ফেব্রুয়ারি। কোন কোন ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, ধারাবাহিক আন্দোলনে বায়ান্নর এদিন এবং পরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালন করা হয়। এতে বিপুল সাড়া পাওয়া যায় এবং রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মনের ভাব প্রকাশ থেকে শুরু করে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে রাষ্ট্রভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাতৃভাষা আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে তো অবশ্যই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠার অসম্ভব চেষ্টা চালানো হচ্ছিল প্রশাসনে উর্দুভাষী আমলাদের প্রাধান্য থাকার সুবাদে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালিয়ে দেয়ার ফল কখনও শুভ হয় না- এ কথা পাকিস্তান সরকার ভুলেই গিয়েছিল। এ অঞ্চলের মানুষ সেদিন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘ষড়যন্ত্রকে’ বানচাল করে দিয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের উপযোগিতা প্রমাণে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘(উনিশশ’) সাতচল্লিশের আগেও আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার জন্যই। সাতচল্লিশে বলা হলো, স্বাধীন হয়েছে দেশ। তার আগে রক্তপাত হয়েছে প্রচুর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হতাহত হয়েছে বহু মানুষ। অসংখ্য পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে এপার এবং ওপারের। কিন্তু সেই রক্তাক্ত স্বাধীনতা দেখা গেল প্রতিশ্রুত স্বপ্নকে মোটেই সার্থক করছে না। হ্যাঁ, স্বাধীনতা এসেছিল, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। বাকি সবাই বঞ্চিত হয়েছে। আর সেই বঞ্চনার সত্যটা অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠলো যখন ‘জাতির জনকে’র নিজের মুখ থেকে ঘোষণা এলো ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

ভাষার ওপর পাকিস্তানের শাসকদের হামলার ঘটনা বিভিন্নভাবে ঘটেছে। শব্দ তাড়ানো, বর্ণমালা সংস্কার, সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে খন্ডিতকরণ, নতুন শব্দ চাপিয়ে দেয়া, উর্দু শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এসব চেষ্টার কোন অবধি ছিল না। কিন্তু সব নষ্টামির চূড়ান্তটি হলো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ। শিক্ষিত বাঙালি সেদিন আতঙ্কিত হয়েছে। যখন দেখে তার ভাষা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। তাকে বোবা করে দেবার ফন্দি পাকাপোক্ত করে দেয়া হচ্ছে। কিসের স্বাধীনতা? কোথায় মুক্তি? ভাষা হারানোর সেই আতঙ্ক থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ। এই প্রবন্ধটি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে পাঠ করেছিলেন এবং তা একাডেমির ‘অমর একুশে বক্তৃতা ১৯৮৫-’৯৪’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৯ মাঘ ১৪২৭, ২৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতিসত্তার প্রথম ও অন্তরতম স্ফুরণ

সাদেকুর রহমান

image

ভাষা আন্দোলন মানে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, বাংলা ভাষা অর্জনের আন্দোলন। মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল তা দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তুলনারহিত ঘটনা। বিশ্বময় তোলপাড় করা এ আন্দোলন আমাদের জাতিসত্তার প্রথম ও অন্তরতম স্ফুরণ। এর নিহিত শক্তি তাই আজো নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলিত করছে। নেপথ্যে শক্তি সঞ্চারে পরিচালিত করেছিল এই জাতিকে সংকটে, বিজয়ে এবং জাতীয় বিবর্তনে। ১৯৫২ সালের সেই আগুনঝরা দিনগুলোতে দেশের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন বাংলার দাবিতে সেদিনকার আন্দোলনে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

আজ ১২ ফেব্রুয়ারি। কোন কোন ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, ধারাবাহিক আন্দোলনে বায়ান্নর এদিন এবং পরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালন করা হয়। এতে বিপুল সাড়া পাওয়া যায় এবং রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মনের ভাব প্রকাশ থেকে শুরু করে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে রাষ্ট্রভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাতৃভাষা আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে তো অবশ্যই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠার অসম্ভব চেষ্টা চালানো হচ্ছিল প্রশাসনে উর্দুভাষী আমলাদের প্রাধান্য থাকার সুবাদে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালিয়ে দেয়ার ফল কখনও শুভ হয় না- এ কথা পাকিস্তান সরকার ভুলেই গিয়েছিল। এ অঞ্চলের মানুষ সেদিন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘ষড়যন্ত্রকে’ বানচাল করে দিয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের উপযোগিতা প্রমাণে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘(উনিশশ’) সাতচল্লিশের আগেও আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার জন্যই। সাতচল্লিশে বলা হলো, স্বাধীন হয়েছে দেশ। তার আগে রক্তপাত হয়েছে প্রচুর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হতাহত হয়েছে বহু মানুষ। অসংখ্য পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে এপার এবং ওপারের। কিন্তু সেই রক্তাক্ত স্বাধীনতা দেখা গেল প্রতিশ্রুত স্বপ্নকে মোটেই সার্থক করছে না। হ্যাঁ, স্বাধীনতা এসেছিল, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। বাকি সবাই বঞ্চিত হয়েছে। আর সেই বঞ্চনার সত্যটা অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠলো যখন ‘জাতির জনকে’র নিজের মুখ থেকে ঘোষণা এলো ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

ভাষার ওপর পাকিস্তানের শাসকদের হামলার ঘটনা বিভিন্নভাবে ঘটেছে। শব্দ তাড়ানো, বর্ণমালা সংস্কার, সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে খন্ডিতকরণ, নতুন শব্দ চাপিয়ে দেয়া, উর্দু শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এসব চেষ্টার কোন অবধি ছিল না। কিন্তু সব নষ্টামির চূড়ান্তটি হলো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ। শিক্ষিত বাঙালি সেদিন আতঙ্কিত হয়েছে। যখন দেখে তার ভাষা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। তাকে বোবা করে দেবার ফন্দি পাকাপোক্ত করে দেয়া হচ্ছে। কিসের স্বাধীনতা? কোথায় মুক্তি? ভাষা হারানোর সেই আতঙ্ক থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ। এই প্রবন্ধটি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে পাঠ করেছিলেন এবং তা একাডেমির ‘অমর একুশে বক্তৃতা ১৯৮৫-’৯৪’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।