মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

নভেম্বর, ২০২০-এর সাধারণ নির্বাচনে সূচির রাজনৈতিক দল বিজয়ী হয়; ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনী সোচ্চার হলে নির্বাচনে বিজয়ী সূচির শাসক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে সেনাদের দ্বন্দ্ব বাধে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেনা ও সরকারের মধ্যে কিছুদিন সংঘাত চলার পর শেষমেশ মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করেছে। সেনারা বলছে, এই অভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল, কারণ নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় গুরুতর অনিয়ম রেখেই নির্বাচন করেছে এবং সরকার নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে পারেনি। গ্রেপ্তারের পূর্বে অং সান সূচি সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। চিকিৎসকদের একটি দল প্রথম কালোব্যাজ পরে অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ করেছে। পরবর্তীতে ‘সূচি মা জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, রাতের অন্ধকারে হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়েও জনগণ বিক্ষোভ করছে। সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সেদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে সামরিক শাসকদের ব্যবসাজাত পণ্য কেনা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে।

নোবলজয়ী ৭৫ বছর বয়সী সূচির দল নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০১৫ সনে ক্ষমতায় আসলেও বিদেশি নাগরিক বিয়ে করার কারণে সূচিকে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে দেয়া হয়নি, প্রধানমন্ত্রীর সমপদমর্যাদা সম্পন্ন ‘স্টেট কাউন্সিলর’ নামে একটি পদ তৈরি করে তা নিয়ে সূচিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তার আগে ১৯৯০ সনে নির্বাচনে জিতলেও তার দলকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। গত নভেম্বরের নির্বাচনে মায়ানমার সংসদের দুই কক্ষের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসন সূচির দল দখল করে, সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতে মাত্র ৩৩ আসনে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে এই নির্বাচন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি, সামরিক বাহিনী জালিয়াতির অভিযোগ করলেও অভিযোগের পক্ষে অকাট্য প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। তাই মনে হয়, সেনাবাহিনীর উত্থাপিত অভিযোগ ক্ষমতা দখলের অজুহাত মাত্র।

১৯৬২ সনে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ২০১১ সন পর্যন্ত ৫০ বছর ধরে মায়ানমারের সেনাবাহিনী সরাসরি দেশ শাসন করেছে। সেনারা ২০০৮ সনে সামরিক শাসনের সময় সংবিধানটিকে এমনভাবে তৈরি করেছে যাতে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেসামরিক সরকারের আমলেও অক্ষুণ্ণ থাকে। সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সামরিক বাহিনীর, সেনাপ্রধান কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন, রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সীমান্ত-সংক্রান্ত বিষয় সেনাবাহিনীর হাতে থাকবে। তাই এই সংবিধান বহাল থাকলে ক্ষমতা থেকে সামরিক বাহিনীকে হটানো সহজ হবে না। সংবিধানটি সংশোধন করার পথও প্রায় রুদ্ধ, কারণ সামরিক বাহিনীর হাতে ২৫ শতাংশ আসন থাকায় সংবিধান বদলাতে পার্লামেন্টের ৭৫ শতাংশ সমর্থনে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই এক হতে পারবে না। তাই এবারের নির্বাচনে ৮০% ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়ার পরও সূচির দলের পক্ষে সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে চলার ক্ষমতা ছিল না।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অহিংস প্রতিবাদ করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন সূচি; তার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেই মায়ানমারের সামরিক শাসনের অবসান হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার মোহে আবিষ্ট সেনাদের বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে রাখা সম্ভব হয়নি। সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন যারা জনগণের কল্যাণে জনতার সমতা বিধানে সোচ্চার তারা কিন্তু মায়ানমারে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে; এই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে নিরীহ একটি নিন্দা প্রস্তাবও গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের ঘটনায়ও নিরাপত্তা পরিষদে চীন মায়ানমারকে রক্ষা করেছে। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বা সেনা নিয়ন্ত্রিত শাসনের ওপর অন্য দেশের আধিপত্য বিস্তার করা সহজ, কারণ তখন ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। অন্যদিকে সত্যিকারের সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে না বলে অনেককে তুষ্ট করে আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন।

সূচি সরকারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধে সেনাদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা গুরুতর বলে মনে হয় না। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট করোনা সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা ভঙ্গ করে গাড়ির মহড়ায় অংশ নিয়েছিলেন। সূচির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, সূচি আমদানি-রপ্তানির আইন ভঙ্গ করা ছাড়াও তিনি তার কাছে অবৈধ যোগাযোগ ডিভাইস ওয়াকিটকি রেখেছিলেন। সূচি এক সময় সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সামরিক শাসনামলে বন্দি অবস্থায় তিনি ১৯৯১ সনে নোবেল পুরস্কারে ভূষিতও হন। কিন্তু তার দল যখন ক্ষমতায় তখন মায়ানমারে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে যে সেনাবাহিনীর পক্ষে সূচি জোরালো যুক্তি পেশ করেছেন সেই সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হারিয়ে তিনি আজ বন্দি। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সূচি রোহিঙ্গাদের প্রতি এত নির্দয় হওয়ার পেছনে সম্ভবত সেনাবাহিনীর চাপ ছিল, ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর সাহস তার ছিল না, রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হলে হয়তো আরও আগেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হতো।

পাকিস্তানেও এমন অবস্থা বিরাজ করছে, সেনাবাহিনীর সন্তুষ্টির ওপর গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতায় থাকা, না থাকা নির্ভর করে। রাজনীতিতে সেনাদের প্রভাবে যে সংস্কৃতি তৈরি হয় সেই সংস্কৃতির মডেল হচ্ছে পাকিস্তান। পেশওয়ার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াকার আহমদ শেঠ সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখলের জন্য জেনারেল পারভেজ মোশাররফের মৃত্যু দণ্ডাদেশ দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘দণ্ড কার্যকরের আগেই যদি মি. মুশাররফের মৃত্যু হয় তাহলে উচিত হবে তার মৃতদেহ ইসলামাবাদে পার্লামেন্টের বাইরে টেনে এনে তিন দিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখা’। করোনায় মৃত্যু না হলে এই বিচারপতির কাছ থেকে সেনার প্রভাব-প্রতিপত্তিনাশী আরও কিছু রায় পাওয়া যেত। সেনাবাহিনী ক্ষেপে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যে বিবৃতি দিয়েছিল তা হলো, ‘সেনাবাহিনী ব্যথিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ’। বিবৃতির পরপরই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভয় পেয়ে যান, সেনাদের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতা করেন।

ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভের আগেই বার্মিজ সেনাবাহিনী গঠিত হয় এবং তারাই দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। ফলে দেশটির সেনাবাহিনী স্বাধীনতা লাভের শুরু থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত এই কারণেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনীর শাসন চলেছে মায়ানমারে। জাতিগত সংঘাত নিরসনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হওয়ায় ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে তাদের বিচ্যুত করাও সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত রাখার জন্যই তারা রাজনীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, মায়ানমারের তেল, গ্যাস আর মাইনিং কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর কাছে। অসীম ক্ষমতা ভোগী মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহিতায় আনার মতো কোন প্রতিষ্ঠান মায়ানমারে নেই। সেনাদের হাতে রচিত সংবিধান মোতাবেক মায়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামোতে সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছর ধরে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার মহড়া চললেও পর্দার আড়ালে সেনারা সরকারের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। অবশ্য এই নিয়ন্ত্রণ বেআইনি ছিল না, ছিল দেশটির সংবিধান সম্মত। তাই রাজনীতিতে অরাজনৈতিক কর্তৃত্ব রোধে জনগণের সচেতনতা জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩১ মাঘ ১৪২৭, ৩১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

নভেম্বর, ২০২০-এর সাধারণ নির্বাচনে সূচির রাজনৈতিক দল বিজয়ী হয়; ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনী সোচ্চার হলে নির্বাচনে বিজয়ী সূচির শাসক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে সেনাদের দ্বন্দ্ব বাধে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেনা ও সরকারের মধ্যে কিছুদিন সংঘাত চলার পর শেষমেশ মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করেছে। সেনারা বলছে, এই অভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল, কারণ নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় গুরুতর অনিয়ম রেখেই নির্বাচন করেছে এবং সরকার নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে পারেনি। গ্রেপ্তারের পূর্বে অং সান সূচি সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। চিকিৎসকদের একটি দল প্রথম কালোব্যাজ পরে অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ করেছে। পরবর্তীতে ‘সূচি মা জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, রাতের অন্ধকারে হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়েও জনগণ বিক্ষোভ করছে। সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সেদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে সামরিক শাসকদের ব্যবসাজাত পণ্য কেনা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে।

নোবলজয়ী ৭৫ বছর বয়সী সূচির দল নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০১৫ সনে ক্ষমতায় আসলেও বিদেশি নাগরিক বিয়ে করার কারণে সূচিকে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে দেয়া হয়নি, প্রধানমন্ত্রীর সমপদমর্যাদা সম্পন্ন ‘স্টেট কাউন্সিলর’ নামে একটি পদ তৈরি করে তা নিয়ে সূচিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তার আগে ১৯৯০ সনে নির্বাচনে জিতলেও তার দলকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। গত নভেম্বরের নির্বাচনে মায়ানমার সংসদের দুই কক্ষের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টি আসন সূচির দল দখল করে, সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতে মাত্র ৩৩ আসনে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে এই নির্বাচন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি, সামরিক বাহিনী জালিয়াতির অভিযোগ করলেও অভিযোগের পক্ষে অকাট্য প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। তাই মনে হয়, সেনাবাহিনীর উত্থাপিত অভিযোগ ক্ষমতা দখলের অজুহাত মাত্র।

১৯৬২ সনে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ২০১১ সন পর্যন্ত ৫০ বছর ধরে মায়ানমারের সেনাবাহিনী সরাসরি দেশ শাসন করেছে। সেনারা ২০০৮ সনে সামরিক শাসনের সময় সংবিধানটিকে এমনভাবে তৈরি করেছে যাতে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেসামরিক সরকারের আমলেও অক্ষুণ্ণ থাকে। সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সামরিক বাহিনীর, সেনাপ্রধান কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন, রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সীমান্ত-সংক্রান্ত বিষয় সেনাবাহিনীর হাতে থাকবে। তাই এই সংবিধান বহাল থাকলে ক্ষমতা থেকে সামরিক বাহিনীকে হটানো সহজ হবে না। সংবিধানটি সংশোধন করার পথও প্রায় রুদ্ধ, কারণ সামরিক বাহিনীর হাতে ২৫ শতাংশ আসন থাকায় সংবিধান বদলাতে পার্লামেন্টের ৭৫ শতাংশ সমর্থনে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই এক হতে পারবে না। তাই এবারের নির্বাচনে ৮০% ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়ার পরও সূচির দলের পক্ষে সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে চলার ক্ষমতা ছিল না।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অহিংস প্রতিবাদ করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন সূচি; তার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেই মায়ানমারের সামরিক শাসনের অবসান হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার মোহে আবিষ্ট সেনাদের বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে রাখা সম্ভব হয়নি। সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন যারা জনগণের কল্যাণে জনতার সমতা বিধানে সোচ্চার তারা কিন্তু মায়ানমারে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে; এই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে নিরীহ একটি নিন্দা প্রস্তাবও গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের ঘটনায়ও নিরাপত্তা পরিষদে চীন মায়ানমারকে রক্ষা করেছে। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বা সেনা নিয়ন্ত্রিত শাসনের ওপর অন্য দেশের আধিপত্য বিস্তার করা সহজ, কারণ তখন ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। অন্যদিকে সত্যিকারের সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে না বলে অনেককে তুষ্ট করে আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন।

সূচি সরকারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধে সেনাদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা গুরুতর বলে মনে হয় না। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট করোনা সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা ভঙ্গ করে গাড়ির মহড়ায় অংশ নিয়েছিলেন। সূচির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, সূচি আমদানি-রপ্তানির আইন ভঙ্গ করা ছাড়াও তিনি তার কাছে অবৈধ যোগাযোগ ডিভাইস ওয়াকিটকি রেখেছিলেন। সূচি এক সময় সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সামরিক শাসনামলে বন্দি অবস্থায় তিনি ১৯৯১ সনে নোবেল পুরস্কারে ভূষিতও হন। কিন্তু তার দল যখন ক্ষমতায় তখন মায়ানমারে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে যে সেনাবাহিনীর পক্ষে সূচি জোরালো যুক্তি পেশ করেছেন সেই সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হারিয়ে তিনি আজ বন্দি। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সূচি রোহিঙ্গাদের প্রতি এত নির্দয় হওয়ার পেছনে সম্ভবত সেনাবাহিনীর চাপ ছিল, ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর সাহস তার ছিল না, রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হলে হয়তো আরও আগেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হতো।

পাকিস্তানেও এমন অবস্থা বিরাজ করছে, সেনাবাহিনীর সন্তুষ্টির ওপর গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতায় থাকা, না থাকা নির্ভর করে। রাজনীতিতে সেনাদের প্রভাবে যে সংস্কৃতি তৈরি হয় সেই সংস্কৃতির মডেল হচ্ছে পাকিস্তান। পেশওয়ার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াকার আহমদ শেঠ সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখলের জন্য জেনারেল পারভেজ মোশাররফের মৃত্যু দণ্ডাদেশ দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘দণ্ড কার্যকরের আগেই যদি মি. মুশাররফের মৃত্যু হয় তাহলে উচিত হবে তার মৃতদেহ ইসলামাবাদে পার্লামেন্টের বাইরে টেনে এনে তিন দিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখা’। করোনায় মৃত্যু না হলে এই বিচারপতির কাছ থেকে সেনার প্রভাব-প্রতিপত্তিনাশী আরও কিছু রায় পাওয়া যেত। সেনাবাহিনী ক্ষেপে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যে বিবৃতি দিয়েছিল তা হলো, ‘সেনাবাহিনী ব্যথিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ’। বিবৃতির পরপরই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভয় পেয়ে যান, সেনাদের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতা করেন।

ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভের আগেই বার্মিজ সেনাবাহিনী গঠিত হয় এবং তারাই দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। ফলে দেশটির সেনাবাহিনী স্বাধীনতা লাভের শুরু থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত এই কারণেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনীর শাসন চলেছে মায়ানমারে। জাতিগত সংঘাত নিরসনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হওয়ায় ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে তাদের বিচ্যুত করাও সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত রাখার জন্যই তারা রাজনীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, মায়ানমারের তেল, গ্যাস আর মাইনিং কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর কাছে। অসীম ক্ষমতা ভোগী মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহিতায় আনার মতো কোন প্রতিষ্ঠান মায়ানমারে নেই। সেনাদের হাতে রচিত সংবিধান মোতাবেক মায়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামোতে সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছর ধরে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার মহড়া চললেও পর্দার আড়ালে সেনারা সরকারের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। অবশ্য এই নিয়ন্ত্রণ বেআইনি ছিল না, ছিল দেশটির সংবিধান সম্মত। তাই রাজনীতিতে অরাজনৈতিক কর্তৃত্ব রোধে জনগণের সচেতনতা জরুরি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com