পৌর নির্বাচনের চতুর্থ ধাপ

বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ-বর্জনের মধ্য দিয়ে ভোট

নিহত ১, আহত অর্ধশত

বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, গোলাগুলি, জালভোট আর বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বর্জনের মধ্যে গতকাল চতুর্থ ধাপে দেশের ৫৫ পৌরসভায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে একজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অনিয়ম ও গোলযোগের কারণে সাতটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে।

নির্বাচনে প্রতিপক্ষের এজেন্ট বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল, জোর করে সিল মারা, ভোটে বাধাসহ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এসেছে বেশিরভাগ এলাকা থেকে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভালো নির্বাচন হয়েছে দাবি করে ইসি সচিব বলেছেন, নিহত হওয়ার ঘটনা দুঃখজনক, তবে এর জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাই দায়ী।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে দেশের ৩৪টি জেলার ৫৫টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে। এরমধ্যে ২৯ পৌরসভায় ভোট হয়েছে ইভিএমে, বাকি ২৬ পৌরসভায় ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ হয়। তবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ত্রুটির কারণে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। আবার একাধিক কেন্দ্রে আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারেননি অনেক ভোটার।

সংবাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানোর তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ আর গোলাগুলির ঘটনায় ছুরিকাঘাতে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাই নিহত হন। আহত হন বিশজনের বেশি। পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গৌবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গতকাল দুপুর ১টার দিকে কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল মান্নান ও ছরওয়ার কামাল রাজিবের সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল মান্নানের ভাই আবদুর মাবুদ নিহত হয়।

এদিকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী পৌরসভাতেও একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, বোমা বিস্ফোরণ, একজন গুলিবিদ্ধ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। বেলা ১১টায় ৬নং ওয়ার্ডের আলোক পাড়ায় এ সংঘর্ষ হয়। টাঙ্গাইলের কালিহাতী পৌরসভায় একটি কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত চারজন আহত হন।

লালমনিরহাটের সদর ও পাটগ্রাম পৌরসভায় প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় সাংবাদিকসহ ১৩ জন আহত হন। দুর্বৃত্তরা শহরের বত্রিশ হাজারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করে। এ পৌরসভায় প্রথম ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে জটিলতায় পড়েন অনেক ভোটার। অনেকের অভিযোগ ইভিএম মেশিন ক্রটিপূর্ণ। মেশিনে হাতের ছাপ না ওঠায় ভোট না দিয়ে ফিরে যান অনেক ভোটার।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌরসভার বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা ইভিএম দখলে নিয়ে ভোটারদের প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকাল ১০টার দিকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ তুলেছেন অনেক ভোটার। এছাড়া আরও কয়েকটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের এজেন্টরা ভোটারদের নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করেছেন অথবা নিজেই নৌকার বোতাম টিপে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দুই মেয়র প্রার্থী প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করাসহ নানা অনিয়মের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এদিকে চর হাসান হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে আঙ্গুলের ছাপ না মিলায় অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি বলে জানা গেছে।

নরসিংদী পৌরসভায় ককটেল বিস্ফোরণ, প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা, স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) প্রার্থীর সমর্থকদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। অনিয়মের কারণে ৪টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে কমিশন। স্থগিত করা ৮নং ওয়ার্ডের ইউএমসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর নাগরিয়াকান্দী মহিলা কেন্দ্র, পুরুষ কেন্দ্র ও ইউএমসি পুরাতন কলোনি, ব্রাহ্মণপাড়া অংশ নিয়ে গঠিত পুরুষ ও মহিলাকেন্দ্র এবং ৪নং ওয়ার্ডের বৌয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ৯ হাজার ১৩৭। এদিকে অনিয়মের কারণে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে একটি কেন্দ্রে এবং শরীয়তপুরের ডামুঢ্যায় দুটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হয়। এদিকে কেন্দ্রের ভেতর ‘হইচই’ করায় ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভার এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে আটক করে দুই ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভোটে বাধা, এজেন্ট বের করে দেয়া, জোর করে ভোট দেয়া, সিলমারা, হুমকি, মারধরসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে গতকাল বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও স্বতন্ত্রসহ অন্তত ২৫ জন মেয়র প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, নরসিংদীর মাধবদী, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, নাটোরের বড়াইগ্রাম, রাজশাহীর বাগমারার তাহেরপুর ও বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভার প্রার্থীরা রয়েছেন।

ভোটে সন্তুষ্ট ইসি : খুনের দায় প্রার্থীদের

চতুর্থ ধাপে ৫৫টি পৌরসভার ভোটে নির্বাচনী সহিংসতায় একজন নিহত ও সাতটি ভোটকেন্দ্র বন্ধের বিষয়টি স্বীকার করলেও সার্বিকভাবে নির্বাচন ভালো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসি। রোববার ভোট শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, ৫৫টি পৌরসভার ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। পুরো দেশেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিছু অনিয়মের কারণে সাতটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হয়। বাকি ৫০৩টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় একজন নিহত হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল একটি প্রাণও যেন না ঝরে। সেখানে কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য দুঃখজনক।’ এর দায় নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। যে দুই প্রার্থী মারামারি করেছেন, খুনের দায় তাদের। কারণ, তারা নিজেরা মারামারি করেছেন, খুন হয়েছেন।’ এ ঘটনার পরও সেখানে ভোট দেয়ার মতো পরিবেশ ছিল বলে দাবি করেন সচিব।

ভোটে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনকে প্রতি ঘণ্টায় যে প্রতিবেদন দিয়েছেন এবং গণমাধ্যমে যা দেখেছে কমিশন, তাতে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভোট ভালো হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট।’

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এবার পাঁচ ধাপে পৌরসভায় নির্বাচন করছে ইসি। এর মধ্যে তিন ধাপের ভোট শেষ হয়েছে। সে সময়ও গোলযোগ-সহিংসতা ঘটেছে কিছু এলাকায়। পৌর ভোটে গোলযোগের অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন বলে আসছে, ভোটার উপস্থিতির মধ্যে দুয়েকটি ঘটনা ছাড়া ভালো নির্বাচন হচ্ছে।

চতুর্থ ধাপে ৩৪ জেলার ৫৫ পৌরসভায় ভোটার ছিলেন প্রায় ১৭ লাখ। মেয়র পদে ২১৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২০৭০ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬১৮ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশ নিলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর মধ্যেই। প্রথম তিন ধাপের ভোটে গোলযোগ-সংঘর্ষ হওয়ায় এবার বাড়তি সতর্কতা নেয়ার কথা জানিয়েছিল ইসি। তাতেও কিছু এলাকায় সংঘাত এড়ানো যায়নি। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম ধাপে ৩১ পৌরসভায় ভোট হবে।

আগের তিন ধাপে দেশের ১৪৭টি পৌরসভায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে গত ২৮ ডিসেম্বর ২৪ পৌরসভায়, দ্বিতীয় ধাপে ১৬ জানুয়ারি ৬০ পৌরসভায় এবং তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি আরও ৬৩ পৌরসভায় ভোট নেয়া হয়। ইসির তথ্যানুযায়ী, প্রথম ধাপে ৬৫ শতাংশ , দ্বিতীয় ধাপে ৬২ শতাংশ এবং তৃতীয় ধাপে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে।

প্রথম তিন ধাপে আওয়ামী লীগের ১০৯ জন, বিএনপির ৯ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) একজন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একজন এবং স্বতন্ত্র ২৫ জন প্রার্থী মেয়র পদে জয় পান। এরমধ্যে তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৬ জন, বিএনপির ৩ জন ও স্বতন্ত্র ১৪ জন বিজয়ী হন। দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৫ জন, বিএনপির ৪ জন, জাতীয় পার্টির একজন, জাসদের একজন ও ৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন। প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীদের মধ্যে ১৮ জন, বিএনপির ধানের শীষের ২ জন এবং ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন।

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২ ফাল্গুন ১৪২৭ ২ রজব ১৪৪২

পৌর নির্বাচনের চতুর্থ ধাপ

বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ-বর্জনের মধ্য দিয়ে ভোট

নিহত ১, আহত অর্ধশত

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, গোলাগুলি, জালভোট আর বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বর্জনের মধ্যে গতকাল চতুর্থ ধাপে দেশের ৫৫ পৌরসভায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে একজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অনিয়ম ও গোলযোগের কারণে সাতটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে।

নির্বাচনে প্রতিপক্ষের এজেন্ট বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল, জোর করে সিল মারা, ভোটে বাধাসহ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এসেছে বেশিরভাগ এলাকা থেকে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভালো নির্বাচন হয়েছে দাবি করে ইসি সচিব বলেছেন, নিহত হওয়ার ঘটনা দুঃখজনক, তবে এর জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাই দায়ী।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে দেশের ৩৪টি জেলার ৫৫টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে। এরমধ্যে ২৯ পৌরসভায় ভোট হয়েছে ইভিএমে, বাকি ২৬ পৌরসভায় ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ হয়। তবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ত্রুটির কারণে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। আবার একাধিক কেন্দ্রে আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারেননি অনেক ভোটার।

সংবাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানোর তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ আর গোলাগুলির ঘটনায় ছুরিকাঘাতে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাই নিহত হন। আহত হন বিশজনের বেশি। পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গৌবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গতকাল দুপুর ১টার দিকে কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল মান্নান ও ছরওয়ার কামাল রাজিবের সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল মান্নানের ভাই আবদুর মাবুদ নিহত হয়।

এদিকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী পৌরসভাতেও একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, বোমা বিস্ফোরণ, একজন গুলিবিদ্ধ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। বেলা ১১টায় ৬নং ওয়ার্ডের আলোক পাড়ায় এ সংঘর্ষ হয়। টাঙ্গাইলের কালিহাতী পৌরসভায় একটি কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত চারজন আহত হন।

লালমনিরহাটের সদর ও পাটগ্রাম পৌরসভায় প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় সাংবাদিকসহ ১৩ জন আহত হন। দুর্বৃত্তরা শহরের বত্রিশ হাজারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করে। এ পৌরসভায় প্রথম ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে জটিলতায় পড়েন অনেক ভোটার। অনেকের অভিযোগ ইভিএম মেশিন ক্রটিপূর্ণ। মেশিনে হাতের ছাপ না ওঠায় ভোট না দিয়ে ফিরে যান অনেক ভোটার।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌরসভার বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা ইভিএম দখলে নিয়ে ভোটারদের প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকাল ১০টার দিকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ তুলেছেন অনেক ভোটার। এছাড়া আরও কয়েকটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের এজেন্টরা ভোটারদের নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করেছেন অথবা নিজেই নৌকার বোতাম টিপে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দুই মেয়র প্রার্থী প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করাসহ নানা অনিয়মের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এদিকে চর হাসান হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে আঙ্গুলের ছাপ না মিলায় অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি বলে জানা গেছে।

নরসিংদী পৌরসভায় ককটেল বিস্ফোরণ, প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা, স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) প্রার্থীর সমর্থকদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। অনিয়মের কারণে ৪টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে কমিশন। স্থগিত করা ৮নং ওয়ার্ডের ইউএমসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর নাগরিয়াকান্দী মহিলা কেন্দ্র, পুরুষ কেন্দ্র ও ইউএমসি পুরাতন কলোনি, ব্রাহ্মণপাড়া অংশ নিয়ে গঠিত পুরুষ ও মহিলাকেন্দ্র এবং ৪নং ওয়ার্ডের বৌয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ৯ হাজার ১৩৭। এদিকে অনিয়মের কারণে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে একটি কেন্দ্রে এবং শরীয়তপুরের ডামুঢ্যায় দুটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হয়। এদিকে কেন্দ্রের ভেতর ‘হইচই’ করায় ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভার এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে আটক করে দুই ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভোটে বাধা, এজেন্ট বের করে দেয়া, জোর করে ভোট দেয়া, সিলমারা, হুমকি, মারধরসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে গতকাল বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও স্বতন্ত্রসহ অন্তত ২৫ জন মেয়র প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, নরসিংদীর মাধবদী, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, নাটোরের বড়াইগ্রাম, রাজশাহীর বাগমারার তাহেরপুর ও বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভার প্রার্থীরা রয়েছেন।

ভোটে সন্তুষ্ট ইসি : খুনের দায় প্রার্থীদের

চতুর্থ ধাপে ৫৫টি পৌরসভার ভোটে নির্বাচনী সহিংসতায় একজন নিহত ও সাতটি ভোটকেন্দ্র বন্ধের বিষয়টি স্বীকার করলেও সার্বিকভাবে নির্বাচন ভালো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসি। রোববার ভোট শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, ৫৫টি পৌরসভার ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। পুরো দেশেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিছু অনিয়মের কারণে সাতটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হয়। বাকি ৫০৩টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় একজন নিহত হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল একটি প্রাণও যেন না ঝরে। সেখানে কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য দুঃখজনক।’ এর দায় নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। যে দুই প্রার্থী মারামারি করেছেন, খুনের দায় তাদের। কারণ, তারা নিজেরা মারামারি করেছেন, খুন হয়েছেন।’ এ ঘটনার পরও সেখানে ভোট দেয়ার মতো পরিবেশ ছিল বলে দাবি করেন সচিব।

ভোটে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনকে প্রতি ঘণ্টায় যে প্রতিবেদন দিয়েছেন এবং গণমাধ্যমে যা দেখেছে কমিশন, তাতে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভোট ভালো হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট।’

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এবার পাঁচ ধাপে পৌরসভায় নির্বাচন করছে ইসি। এর মধ্যে তিন ধাপের ভোট শেষ হয়েছে। সে সময়ও গোলযোগ-সহিংসতা ঘটেছে কিছু এলাকায়। পৌর ভোটে গোলযোগের অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন বলে আসছে, ভোটার উপস্থিতির মধ্যে দুয়েকটি ঘটনা ছাড়া ভালো নির্বাচন হচ্ছে।

চতুর্থ ধাপে ৩৪ জেলার ৫৫ পৌরসভায় ভোটার ছিলেন প্রায় ১৭ লাখ। মেয়র পদে ২১৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২০৭০ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬১৮ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশ নিলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর মধ্যেই। প্রথম তিন ধাপের ভোটে গোলযোগ-সংঘর্ষ হওয়ায় এবার বাড়তি সতর্কতা নেয়ার কথা জানিয়েছিল ইসি। তাতেও কিছু এলাকায় সংঘাত এড়ানো যায়নি। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম ধাপে ৩১ পৌরসভায় ভোট হবে।

আগের তিন ধাপে দেশের ১৪৭টি পৌরসভায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে গত ২৮ ডিসেম্বর ২৪ পৌরসভায়, দ্বিতীয় ধাপে ১৬ জানুয়ারি ৬০ পৌরসভায় এবং তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি আরও ৬৩ পৌরসভায় ভোট নেয়া হয়। ইসির তথ্যানুযায়ী, প্রথম ধাপে ৬৫ শতাংশ , দ্বিতীয় ধাপে ৬২ শতাংশ এবং তৃতীয় ধাপে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে।

প্রথম তিন ধাপে আওয়ামী লীগের ১০৯ জন, বিএনপির ৯ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) একজন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একজন এবং স্বতন্ত্র ২৫ জন প্রার্থী মেয়র পদে জয় পান। এরমধ্যে তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৬ জন, বিএনপির ৩ জন ও স্বতন্ত্র ১৪ জন বিজয়ী হন। দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৫ জন, বিএনপির ৪ জন, জাতীয় পার্টির একজন, জাসদের একজন ও ৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন। প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীদের মধ্যে ১৮ জন, বিএনপির ধানের শীষের ২ জন এবং ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন।