ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার

সাত

আগরতলা মামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জাগরণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছে যায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রায়ই বলতেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, একদিন শেখ মুজিব ইতিহাস সৃষ্টি করবে। অপরদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডকে বিভ্রান্তিপূর্ণ নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে যে, কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হঠাৎ করে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি অপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেস বিজ্ঞপ্তি পত্রপত্রিকায় প্রেরণ করা হয়। এতে বলা হয়, গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে জাতি বিরোধী এক পরিকল্পনা উদঘাটিত হয়েছিল এবং সেই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন সিএসপি অফিসার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী পিআইএ এবং ইপিআর এর লোক আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাকে তালিকায় দেখা যায়।

প্রেস নোটে আরও বলা হয়েছে যে, এদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। এই উদ্দেশ্যে এরা ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সেক্রেটারি ও আগরতলায় কর্মরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সরকার পূর্বপাকিস্তানে একটি চরম দমন-নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছিল তা এ ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৮ জানুয়ারি (১৯৬৮) তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানেরও সম্পর্ক ছিল। এটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা। তিনি আগে থেকেই ডিপিআর (ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস) অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। তবে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে ঢাকা জেলা থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা প্রথম কয়েক দিন কেউ জানতে পারেননি।

ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৬৮ সালের ২৫ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় ফিরলে তার শাশুড়ি বেগম মুজিব তাকে জানান, ‘গত ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে তোমার শ্বশুরকে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। গত সপ্তাহ থেকে বহু জায়গায় এবং বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এখন পর্যন্ত তাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, তিনি কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারিনি।’

এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব বই পড়ে, গুনগুন করে গান গেয়ে সময় কাটাতেন। ‘১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিনগত রাত ১টার দিকে হঠাৎ তাদের ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত শোনা গেল। শেখ মুজিব তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জনাব মোমেন একটি শব্দেই জেগে গেলেন। জিজ্ঞেস করে তিনি জানলেন যে, ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল হোসেন বাইরে অপেক্ষা করছেন। তোজাম্মেল হোসেন শেখ মুজিবকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মৃদু ও দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দরজা খুলতে হবে স্যার।’ মোমেন সাহেব দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন তোজাম্মেল হোসেন এবং সেপাই আম্বর আলী। শেখ সাহেব তখনো ঘুমাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম ভেঙে গেল, তিনি চোখ কচলিয়ে বললেন, ‘দুঃসংবাদ নয়, সুসংবাদ- কোন খবরই খারাপ নয়। বলুন কি খবর।’ তোজাম্মেল হোসেন একটি লিখিত আদেশ শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন স্যার, আপনাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।’

কয়েকদিন হলো নানা খবর বাতাসে কয়েদখানার মধ্যে শেখ মুজিবের কানেও পৌঁছেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাই নির্লিপ্তভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে খালাস দেয়া হলো কি নতুন কোন ফাঁদে নেবার জন্য?’ ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল হোসেন উত্তরে কোন কথা বললেন না, মাথা নিচু করে রইলেন। সেপাই আম্বর আলীরও একই অবস্থা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘বুঝলাম, সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, মুক্তি এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।’ বিদায়ের পূর্বে আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন:

‘বন্ধু বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানি না, কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে-হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাওয়ার সময় আপনাকে শুধু একটি কথা বলে গেলাম-বাংলাদেশের সঙ্গে কোনদিন আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, কোনদিন করব না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য’ শেখ মুজিবের দুই চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

শেষ পর্যন্ত মোনায়েম খান তার হুমকি ঠিক রাখলেন। শেখ মুজিবকে বাইরের মাটিতে বেশিক্ষণ পা রাখতে হয়নি। জেলগেট থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে একটি মিলিটারি ভ্যান সঙ্গিন উঁচিয়ে দাঁড়ালো তার সামনে। তাকে বিজাতীয় ভাষায় জানানো হলো, তুমি আবার বন্দি। কারাগারের সামনের পথ থেকে এক মুঠো মাটি তুলে কপালে স্পর্শ করে প্রার্থনা জানালেন, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতেই মরি’। শেখ মুজিবসহ সব বন্দিকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে রাখা হয়। প্রকাশ্য আদালতকে বাদ দিয়ে সামরিক আদালতে বিচারের পরিকল্পনা থেকেই নতুন এই মামলায় শেখ মুজিবসহ বন্দিদের সেনানিবাসে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে ধারণা সম্প্রসারিত হতে থাকে।

শেখ মুজিবকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ২১ জানুয়ারি ১৯৬৮ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরি সভা ডাকা হয়। সভায় শেখ মুজিবের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ দেশের প্রচলিত আদালতে বিচার কার্য ফিরিয়ে আনার দাবি করা হয়। পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগও প্রকাশ্যে আদালতে বিচারের আহ্বান জানিয়ে ২৫ জানুয়ারি বিবৃতি প্রদান করে। ২৬ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথসভায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানানো হয়। সম্ভবত এসব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেই পাকিস্তান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস অ্যাডমিরাল এ আর খান এক বিবৃতিতে জানান, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত আটক ২৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকার্য প্রায় সমাপ্ত হইয়াছে এবং শীঘ্রই দেশের আইন অনুসারে তাহাদের প্রকাশ্যে বিচার হইবে।’

সরকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্ত বিবৃতির পর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশেষত ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ উপলব্ধি করতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন উভয় গ্রুপ মিলিতভাবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক ব্যানারে দাবি দিবস পালন করে। এই তিনটি ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিও পালন করে। ১৭ মার্চ আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম জন্মবার্ষিকী পালন করে। মূলত উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইস্যুটিকে জনসম্মুখে নিয়ে আসা। ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব “Criminal Law Amendment (Special) Tribunal Ordinance 1968” নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। উক্ত অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী একটা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উক্ত মামলার বিচার হবে বলে জানানোর পর সকালে জানতে পারে যে, আসামিরা ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি আছেন। প্রেসিডেন্টের উক্ত অধ্যাদেশ বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসএ রহমান, বিচারপতি মুজিবুর রহমান এবং বিচারপতি মকসুমুল হাকিমকে নিয়ে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলার বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট আইনে এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে ৬৮ সাল থেকেই দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারা ১১ দফা প্রণয়ন করে। এই আন্দোলনের ফলেই আইয়ূব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে জেল থেকে করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ৬৯ হাজার হাজার সমর্থকদের এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। পাকিস্তানের কোন জনসমাবেশে এত মানুষ সমবেত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাকে প্রদান করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধি। (সমাপ্ত)

ঢাকা প্রথম লেখা : ১৬ অক্টোবর, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ৩ রজব ১৪৪২

ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার

সাত

আগরতলা মামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জাগরণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছে যায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রায়ই বলতেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, একদিন শেখ মুজিব ইতিহাস সৃষ্টি করবে। অপরদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডকে বিভ্রান্তিপূর্ণ নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে যে, কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হঠাৎ করে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি অপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেস বিজ্ঞপ্তি পত্রপত্রিকায় প্রেরণ করা হয়। এতে বলা হয়, গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে জাতি বিরোধী এক পরিকল্পনা উদঘাটিত হয়েছিল এবং সেই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন সিএসপি অফিসার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী পিআইএ এবং ইপিআর এর লোক আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাকে তালিকায় দেখা যায়।

প্রেস নোটে আরও বলা হয়েছে যে, এদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। এই উদ্দেশ্যে এরা ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সেক্রেটারি ও আগরতলায় কর্মরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সরকার পূর্বপাকিস্তানে একটি চরম দমন-নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছিল তা এ ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৮ জানুয়ারি (১৯৬৮) তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানেরও সম্পর্ক ছিল। এটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা। তিনি আগে থেকেই ডিপিআর (ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস) অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। তবে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে ঢাকা জেলা থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা প্রথম কয়েক দিন কেউ জানতে পারেননি।

ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৬৮ সালের ২৫ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় ফিরলে তার শাশুড়ি বেগম মুজিব তাকে জানান, ‘গত ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে তোমার শ্বশুরকে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। গত সপ্তাহ থেকে বহু জায়গায় এবং বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এখন পর্যন্ত তাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, তিনি কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারিনি।’

এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব বই পড়ে, গুনগুন করে গান গেয়ে সময় কাটাতেন। ‘১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিনগত রাত ১টার দিকে হঠাৎ তাদের ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত শোনা গেল। শেখ মুজিব তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জনাব মোমেন একটি শব্দেই জেগে গেলেন। জিজ্ঞেস করে তিনি জানলেন যে, ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল হোসেন বাইরে অপেক্ষা করছেন। তোজাম্মেল হোসেন শেখ মুজিবকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মৃদু ও দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দরজা খুলতে হবে স্যার।’ মোমেন সাহেব দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন তোজাম্মেল হোসেন এবং সেপাই আম্বর আলী। শেখ সাহেব তখনো ঘুমাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম ভেঙে গেল, তিনি চোখ কচলিয়ে বললেন, ‘দুঃসংবাদ নয়, সুসংবাদ- কোন খবরই খারাপ নয়। বলুন কি খবর।’ তোজাম্মেল হোসেন একটি লিখিত আদেশ শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন স্যার, আপনাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।’

কয়েকদিন হলো নানা খবর বাতাসে কয়েদখানার মধ্যে শেখ মুজিবের কানেও পৌঁছেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাই নির্লিপ্তভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে খালাস দেয়া হলো কি নতুন কোন ফাঁদে নেবার জন্য?’ ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল হোসেন উত্তরে কোন কথা বললেন না, মাথা নিচু করে রইলেন। সেপাই আম্বর আলীরও একই অবস্থা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘বুঝলাম, সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, মুক্তি এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।’ বিদায়ের পূর্বে আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন:

‘বন্ধু বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানি না, কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে-হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাওয়ার সময় আপনাকে শুধু একটি কথা বলে গেলাম-বাংলাদেশের সঙ্গে কোনদিন আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, কোনদিন করব না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য’ শেখ মুজিবের দুই চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

শেষ পর্যন্ত মোনায়েম খান তার হুমকি ঠিক রাখলেন। শেখ মুজিবকে বাইরের মাটিতে বেশিক্ষণ পা রাখতে হয়নি। জেলগেট থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে একটি মিলিটারি ভ্যান সঙ্গিন উঁচিয়ে দাঁড়ালো তার সামনে। তাকে বিজাতীয় ভাষায় জানানো হলো, তুমি আবার বন্দি। কারাগারের সামনের পথ থেকে এক মুঠো মাটি তুলে কপালে স্পর্শ করে প্রার্থনা জানালেন, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতেই মরি’। শেখ মুজিবসহ সব বন্দিকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে রাখা হয়। প্রকাশ্য আদালতকে বাদ দিয়ে সামরিক আদালতে বিচারের পরিকল্পনা থেকেই নতুন এই মামলায় শেখ মুজিবসহ বন্দিদের সেনানিবাসে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে ধারণা সম্প্রসারিত হতে থাকে।

শেখ মুজিবকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ২১ জানুয়ারি ১৯৬৮ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরি সভা ডাকা হয়। সভায় শেখ মুজিবের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ দেশের প্রচলিত আদালতে বিচার কার্য ফিরিয়ে আনার দাবি করা হয়। পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগও প্রকাশ্যে আদালতে বিচারের আহ্বান জানিয়ে ২৫ জানুয়ারি বিবৃতি প্রদান করে। ২৬ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথসভায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানানো হয়। সম্ভবত এসব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেই পাকিস্তান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস অ্যাডমিরাল এ আর খান এক বিবৃতিতে জানান, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত আটক ২৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকার্য প্রায় সমাপ্ত হইয়াছে এবং শীঘ্রই দেশের আইন অনুসারে তাহাদের প্রকাশ্যে বিচার হইবে।’

সরকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্ত বিবৃতির পর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশেষত ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ উপলব্ধি করতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন উভয় গ্রুপ মিলিতভাবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক ব্যানারে দাবি দিবস পালন করে। এই তিনটি ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিও পালন করে। ১৭ মার্চ আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম জন্মবার্ষিকী পালন করে। মূলত উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইস্যুটিকে জনসম্মুখে নিয়ে আসা। ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব “Criminal Law Amendment (Special) Tribunal Ordinance 1968” নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। উক্ত অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী একটা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উক্ত মামলার বিচার হবে বলে জানানোর পর সকালে জানতে পারে যে, আসামিরা ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি আছেন। প্রেসিডেন্টের উক্ত অধ্যাদেশ বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসএ রহমান, বিচারপতি মুজিবুর রহমান এবং বিচারপতি মকসুমুল হাকিমকে নিয়ে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলার বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট আইনে এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে ৬৮ সাল থেকেই দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারা ১১ দফা প্রণয়ন করে। এই আন্দোলনের ফলেই আইয়ূব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে জেল থেকে করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ৬৯ হাজার হাজার সমর্থকদের এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। পাকিস্তানের কোন জনসমাবেশে এত মানুষ সমবেত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাকে প্রদান করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধি। (সমাপ্ত)

ঢাকা প্রথম লেখা : ১৬ অক্টোবর, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com