ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলতে বিশেষ মহল তৎপর ছিল প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাঙালির গৌরবময় ঐতিহাসিক দলিলে ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, জনসাধারণের স্বার্থসুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস। একটি বিশেষ মহল বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এবং বাঙালিসত্তার বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে মুছে ফেলতে সবসময়ই তৎপর ছিল। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখার গোপন দলিল প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেসব অপতৎপরতা রুখে দেয়া সম্ভব হয়েছে। মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২১ উপলক্ষে গতকাল দেয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বাণীতে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে জীবন উৎসর্গকারী আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ বিশ্বের ভাষা-শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা ভাষা-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হয়। ঢাকায় এ খবর পৌঁছলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। এর কিছুদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব তার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বলেন, ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে খাজা নাজিমুদ্দিন আইনপরিষদে ঘোষণা দেয়, পূর্ববাংলার জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু নাজিমুদ্দিনের এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করতে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ তারা মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদভবন ঘেরাও করে, এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকেই আহত হন। ২১ মার্চ জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখে। ২৪ মার্চ কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। তিনি বলেন, ভাষা-আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপদান করতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফরকর্মসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারণা চালান। তিনি সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেপ্তার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পান। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার হলে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। প্রসঙ্গতই শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ রাখেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করার নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ৩ ফেব্রুয়ারি তিনজন দূত মারফত খবর পাঠান, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে এবং মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদের সভাস্থল ঘেরাও করতে হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে এই ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হয়। এইপর্যায়ে শেখ মুজিব আমরণ-অনশন ঘোষণা করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি কারাকর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের জন্য নির্ধারিত ছিল। শেখ মুজিবের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী ওইদিন সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মুসলীম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকাশহরে একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি এবং সব প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে এবং পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে কতগুলো তাজাপ্রাণ নিমেষেই ঝরে যায়, অনেকে আহত হন, অনেকে গ্রেপ্তার হন। প্রাদেশিক পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। উপায়ন্তর না দেখে সরকার সেনাবাহিনী তলব করে, কারফিউ জারি করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাভাষার প্রস্তাব গৃহীত হয়। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নৌকাপ্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ সদস্যরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এরই মধ্যে ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবসহ সব নেতারা গ্রেপ্তার হন।

তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়, প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এইদিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সেই সরকারই শহীদ মিনার তৈরি, বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্য-বিজ্ঞানের বইপ্রকাশ এবং বাংলা টাইপ-রাইটার উদ্ভাবনের জন্য প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্য, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির ফলে সেই আকাক্সক্ষাগুলো সে সময় আর পূরণ হয়নি।

মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাসহ বিশ্বের সব ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে চেতনায় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা-অর্জন করেছি, সেই একই চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বিগত ১২ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়ের রোল মডেল। আমরা ২০২০-২১ সাল মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। তিনি বলেন, আগামী মাসে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। আমরা ২০২১-২০৪১ পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অচিরেই জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন। বাঙালি মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা/রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়। ১৯৫২ সালের এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ-উৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে। তিনি এ দিনে বাংলাসহ বিশ্বের ভাষা-শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।’

বাংলাভাষার মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব ভাষা সৈনিকদের পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, তাদের দূরদর্শী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা সব দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমাদের সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে কানাডা প্রবাসী রফিক এবং ছালাম নামে দু’জন বাংলাদেশি কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য মিলে ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব প্রেরণ করে। তিনি বলেন, যেহেতু জাতিসংঘ ব্যক্তি-প্রস্তাব আমলে নেয় না, তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে প্রেরণ করার পরামর্শ দেয়। তখন আমাদের হাতে সময় ছিল না, আমরা মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর দ্রুত ফ্যাক্সবার্তার মাধ্যমে ইউনেস্কোতে আমাদের প্রস্তাব পাঠাই। আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন আদায় করি। যার ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছি। বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদারক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তন করেছি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে যেন বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়।

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলতে বিশেষ মহল তৎপর ছিল প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাঙালির গৌরবময় ঐতিহাসিক দলিলে ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, জনসাধারণের স্বার্থসুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস। একটি বিশেষ মহল বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এবং বাঙালিসত্তার বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে মুছে ফেলতে সবসময়ই তৎপর ছিল। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখার গোপন দলিল প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেসব অপতৎপরতা রুখে দেয়া সম্ভব হয়েছে। মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২১ উপলক্ষে গতকাল দেয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বাণীতে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে জীবন উৎসর্গকারী আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ বিশ্বের ভাষা-শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা ভাষা-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হয়। ঢাকায় এ খবর পৌঁছলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। এর কিছুদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব তার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বলেন, ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে খাজা নাজিমুদ্দিন আইনপরিষদে ঘোষণা দেয়, পূর্ববাংলার জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু নাজিমুদ্দিনের এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করতে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ তারা মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদভবন ঘেরাও করে, এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকেই আহত হন। ২১ মার্চ জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখে। ২৪ মার্চ কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। তিনি বলেন, ভাষা-আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপদান করতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফরকর্মসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারণা চালান। তিনি সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেপ্তার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পান। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার হলে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। প্রসঙ্গতই শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ রাখেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করার নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ৩ ফেব্রুয়ারি তিনজন দূত মারফত খবর পাঠান, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে এবং মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদের সভাস্থল ঘেরাও করতে হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে এই ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হয়। এইপর্যায়ে শেখ মুজিব আমরণ-অনশন ঘোষণা করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি কারাকর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের জন্য নির্ধারিত ছিল। শেখ মুজিবের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী ওইদিন সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মুসলীম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকাশহরে একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি এবং সব প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে এবং পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে কতগুলো তাজাপ্রাণ নিমেষেই ঝরে যায়, অনেকে আহত হন, অনেকে গ্রেপ্তার হন। প্রাদেশিক পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। উপায়ন্তর না দেখে সরকার সেনাবাহিনী তলব করে, কারফিউ জারি করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাভাষার প্রস্তাব গৃহীত হয়। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নৌকাপ্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ সদস্যরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এরই মধ্যে ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবসহ সব নেতারা গ্রেপ্তার হন।

তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়, প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এইদিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সেই সরকারই শহীদ মিনার তৈরি, বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্য-বিজ্ঞানের বইপ্রকাশ এবং বাংলা টাইপ-রাইটার উদ্ভাবনের জন্য প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্য, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির ফলে সেই আকাক্সক্ষাগুলো সে সময় আর পূরণ হয়নি।

মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাসহ বিশ্বের সব ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে চেতনায় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা-অর্জন করেছি, সেই একই চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বিগত ১২ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়ের রোল মডেল। আমরা ২০২০-২১ সাল মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। তিনি বলেন, আগামী মাসে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। আমরা ২০২১-২০৪১ পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অচিরেই জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন। বাঙালি মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা/রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়। ১৯৫২ সালের এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ-উৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে। তিনি এ দিনে বাংলাসহ বিশ্বের ভাষা-শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।’

বাংলাভাষার মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব ভাষা সৈনিকদের পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, তাদের দূরদর্শী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা সব দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমাদের সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে কানাডা প্রবাসী রফিক এবং ছালাম নামে দু’জন বাংলাদেশি কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য মিলে ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব প্রেরণ করে। তিনি বলেন, যেহেতু জাতিসংঘ ব্যক্তি-প্রস্তাব আমলে নেয় না, তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে প্রেরণ করার পরামর্শ দেয়। তখন আমাদের হাতে সময় ছিল না, আমরা মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর দ্রুত ফ্যাক্সবার্তার মাধ্যমে ইউনেস্কোতে আমাদের প্রস্তাব পাঠাই। আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন আদায় করি। যার ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছি। বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদারক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তন করেছি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে যেন বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়।