কাতারে ১০ বছরে ৬,৫০০ অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু

কাতারে গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে যাওয়া সাড়ে ছয় হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ১৮ জন বাংলাদেশি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে গেছেন এই শ্রমিকরা। কাতারকে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত মৃত অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা হিসাব করেছে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে কাতারকে ওই বিশ্বকাপের আয়োজক ঘোষণা করা হয়। এসব দেশের সরকারি উৎসে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি।

২০১০-২০২০ সময়ে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া ৫৯২৭ জন অভিবাসী শ্রমিক মারা যায়। আর কাতারে পাকিস্তানি দুতাবাসের তথ্য অনুযায়ী একই সময় তাদের দেশের মারা গেছে ৮২৪ জন। তবে এই সংখ্যা কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের মোট মৃত্যুর ঘটনার আংশিক চিত্র মাত্র। কেননা ফিলিপাইন ও কেনিয়ার মতো আরও দেশ আছে যারা কাতারে প্রচুর শ্রমিক পাঠায়, যাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে সে দেশে গিয়ে। এছাড়া ২০২০ সালের শেষদিকে যারা করোনার কারণে মারা গেছে তাদের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

আগামী বিশ্বকাপকে সামনে রেখে কাতার অভূতপূর্ব নির্মাণযজ্ঞ চালিয়েছে দেশজুড়ে। এরমধ্যে সাতটি নতুন স্টেডিয়াম ছাড়াও বিমানবন্দর, রাস্তা, যাতায়ত ব্যবস্থা, হোটেল, নতুন শহর ইত্যাদি বিশাল বিশাল অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ করছে।

ফেয়ার স্কয়ার প্রজেক্ট নামে উপসাগরীয় অঞ্চলে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের পরিচালক ম্যাকগেহান বলেন, যেহেতু মৃত এই শ্রমিকদের পেশা ও মৃত্যুর স্থান লিপিবদ্ধ করা হয়নি, তা ধারণা করা যায়, এদের অনেকেই বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নির্মিতব্য স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত ছিলেন।

তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে কাতারে বহু অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে শুধু কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার কারণে। মৃতদের অন্তত ৩৭ জন সরাসরি স্টেডিয়াম নির্মাণের সঙ্গে নিয়োজিত থাকলেও বিশ্বকাপের আয়োজক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘কাজের সঙ্গে অসম্পর্কিত’ কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলা হচ্ছে। নির্মাণস্থলে কাজ করার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াকে এভাবে ব্যাখ্যা করা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এর মানে এই, কাতার তার দেশে কর্মরত ২০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষার বিষয়ে মোটেই আন্তরিক নয়। এমনকি কেন সেখানে কাজ করতে আসা অল্প বয়সী এত ছেলে মারা যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোন তদন্ত করার বিষয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। তবে শুধু এই পরিসংখ্যানই নয়, এর নিচে চাপা পড়ে গেছে কত পরিবারের স্বজন, অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ফেলার মর্মন্তুদ ঘটনা।

বাংলাদেশি টাকার হিসাবে দশ লাখ টাকা রিক্রুটিং এজেন্সিকে দিয়ে বিশ্বকাপের একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্পে কাজ জুটিয়েছিলেন নেপালের ঘল সিং রাই। কাতার আসার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি আত্মহত্যা করেন। আরেকজন শ্রমিক বাংলাদেশের, শহিদ মিয়া, মৃত্যু হয়েছে তার থাকার জায়গায় পানিতে ডুবে থাকা বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে। আর ভারতের মধু বোলাপল্লীর পরিবার বুঝতেই পারছেন না কীভাবে ৪৩ বছরের সুঠাম দেহী, সুস্থ একজন মানুষ ‘স্বাভাবিক কারণে’ মৃত্যুবরণ করে থাকতে পারে। তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল তার ঘরের মেঝে থেকে। তবে কাতারের মৃত অভিবাসী শ্রমিকদের খতিয়ান দেখলে কারণ হিসেবে পাওয়া যায়- উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া, গলায় ফাঁস লেগে শ্বাসরোধ হওয়া, অথবা দেহ গলে যাওয়ায় কারণ না পাওয়া- এগুলো।

তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় স্বাভাবিক মৃত্যু। অনেক ক্ষেত্রে শুধু হৃদরোগ ও শ্বাসের সমস্যার কথা বলা হয়ে থাকে। গার্ডিয়ানের ওই তথ্যে দেখা গেছে, এই সাড়ে ছয়হাজারের মধ্যে ভারতীয়, বাংলাদেশি ও নেপালিদের ৬৯ শতাংশের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে ভারতীয়দের মধ্যে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে এই কারণ দেখানো হয়েছে।

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১১ ফাল্গুন ১৪২৭ ১১ রজব ১৪৪২

কাতারে ১০ বছরে ৬,৫০০ অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু

সংবাদ ডেস্ক

কাতারে গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে যাওয়া সাড়ে ছয় হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ১৮ জন বাংলাদেশি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে গেছেন এই শ্রমিকরা। কাতারকে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত মৃত অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা হিসাব করেছে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে কাতারকে ওই বিশ্বকাপের আয়োজক ঘোষণা করা হয়। এসব দেশের সরকারি উৎসে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি।

২০১০-২০২০ সময়ে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া ৫৯২৭ জন অভিবাসী শ্রমিক মারা যায়। আর কাতারে পাকিস্তানি দুতাবাসের তথ্য অনুযায়ী একই সময় তাদের দেশের মারা গেছে ৮২৪ জন। তবে এই সংখ্যা কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের মোট মৃত্যুর ঘটনার আংশিক চিত্র মাত্র। কেননা ফিলিপাইন ও কেনিয়ার মতো আরও দেশ আছে যারা কাতারে প্রচুর শ্রমিক পাঠায়, যাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে সে দেশে গিয়ে। এছাড়া ২০২০ সালের শেষদিকে যারা করোনার কারণে মারা গেছে তাদের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

আগামী বিশ্বকাপকে সামনে রেখে কাতার অভূতপূর্ব নির্মাণযজ্ঞ চালিয়েছে দেশজুড়ে। এরমধ্যে সাতটি নতুন স্টেডিয়াম ছাড়াও বিমানবন্দর, রাস্তা, যাতায়ত ব্যবস্থা, হোটেল, নতুন শহর ইত্যাদি বিশাল বিশাল অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ করছে।

ফেয়ার স্কয়ার প্রজেক্ট নামে উপসাগরীয় অঞ্চলে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের পরিচালক ম্যাকগেহান বলেন, যেহেতু মৃত এই শ্রমিকদের পেশা ও মৃত্যুর স্থান লিপিবদ্ধ করা হয়নি, তা ধারণা করা যায়, এদের অনেকেই বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নির্মিতব্য স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত ছিলেন।

তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে কাতারে বহু অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে শুধু কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার কারণে। মৃতদের অন্তত ৩৭ জন সরাসরি স্টেডিয়াম নির্মাণের সঙ্গে নিয়োজিত থাকলেও বিশ্বকাপের আয়োজক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘কাজের সঙ্গে অসম্পর্কিত’ কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলা হচ্ছে। নির্মাণস্থলে কাজ করার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াকে এভাবে ব্যাখ্যা করা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এর মানে এই, কাতার তার দেশে কর্মরত ২০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষার বিষয়ে মোটেই আন্তরিক নয়। এমনকি কেন সেখানে কাজ করতে আসা অল্প বয়সী এত ছেলে মারা যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোন তদন্ত করার বিষয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। তবে শুধু এই পরিসংখ্যানই নয়, এর নিচে চাপা পড়ে গেছে কত পরিবারের স্বজন, অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ফেলার মর্মন্তুদ ঘটনা।

বাংলাদেশি টাকার হিসাবে দশ লাখ টাকা রিক্রুটিং এজেন্সিকে দিয়ে বিশ্বকাপের একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্পে কাজ জুটিয়েছিলেন নেপালের ঘল সিং রাই। কাতার আসার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি আত্মহত্যা করেন। আরেকজন শ্রমিক বাংলাদেশের, শহিদ মিয়া, মৃত্যু হয়েছে তার থাকার জায়গায় পানিতে ডুবে থাকা বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে। আর ভারতের মধু বোলাপল্লীর পরিবার বুঝতেই পারছেন না কীভাবে ৪৩ বছরের সুঠাম দেহী, সুস্থ একজন মানুষ ‘স্বাভাবিক কারণে’ মৃত্যুবরণ করে থাকতে পারে। তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল তার ঘরের মেঝে থেকে। তবে কাতারের মৃত অভিবাসী শ্রমিকদের খতিয়ান দেখলে কারণ হিসেবে পাওয়া যায়- উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া, গলায় ফাঁস লেগে শ্বাসরোধ হওয়া, অথবা দেহ গলে যাওয়ায় কারণ না পাওয়া- এগুলো।

তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় স্বাভাবিক মৃত্যু। অনেক ক্ষেত্রে শুধু হৃদরোগ ও শ্বাসের সমস্যার কথা বলা হয়ে থাকে। গার্ডিয়ানের ওই তথ্যে দেখা গেছে, এই সাড়ে ছয়হাজারের মধ্যে ভারতীয়, বাংলাদেশি ও নেপালিদের ৬৯ শতাংশের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে ভারতীয়দের মধ্যে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে এই কারণ দেখানো হয়েছে।