বিচারপ্রার্থী নারী ও আদালত

দেবাহুতি চক্রবর্তী

নারীর নানাবিধ নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা দেশে-বিদেশে অব্যাহত আলোচনার বিষয়। নারী-পুরুষের বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কম-বেশি বিদ্যমান রয়েছে। এবং কম-বেশি নারী দেশে দেশে এই অসংগতির শিকার। আমাদের দেশে যার মাত্রা নিয়ত বিবেকবান মানুষের যন্ত্রণার অন্যতম কারণ। ‘ওপরে ঈশ্বর, নিচে আদালত’- আমাদের বিচারপ্রার্থী নারীদের প্রধান সে্লাগান। যদিও প্রত্যাশিত ফলাফলের অনেকক্ষেত্রেই রকমফের হয়। তারও নানাবিধ কারণ আছে। আদালত কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান নয়।

সংবিধান, প্রচলিত আইন, প্রচলিত বিচারব্যবস্থা, ক্ষমতাসীন সরকারের চরিত্র নানাভাবে আদালতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। এই সীমাবদ্ধতার সঙ্গে ব্যক্তি বিচারকের প্রজ্ঞা, মেধা, সাহস, জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টিও থেকে যায়। ঔপনিবেশিক আমলের আইন দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে সংযোজন-বিয়োজন- সংস্করণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন দেশেই আইন নতুন নতুন প্রণয়ন হয়েছে, হচ্ছে। আমাদের দেশে সর্বরকম নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যা অনেক দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তারপরেও প্রচলিত আইনের সংজ্ঞা ও ভাষায় কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। আদালত বিভিন্ন সময় বিচারের ক্ষেত্রে তার অন্তর্দৃষ্টি আর প্রজ্ঞা দিয়ে তাকে প্রাঞ্জল করে। প্রতিবন্ধকতাগুলো দৃশ্যমান করে। এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, যা অনেকসময় সরকার ও শাসনতন্ত্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করে।

উচ্চতর আদালতের রায়গুলো রেফারেন্স হিসেবে নিম্ন আদালতেও ব্যবহৃত হয়। সব ধরনের বিচারের ক্ষেত্রেই সংগতি বিচারে বিদেশি আদালতের রেফারেন্স পর্যালোচনার সুযোগ থাকে। নারী নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যার ভারতীয় আদালতের একটি বহুল আলোচিত রায় আমাদের বিচার কার্যেও প্রভাব রেখেছে। বিশাখা বনাম রাজস্থান রাজ্য শিরোনামের একটি রিট মামলায় ১৯৯৭ সনে তৎকালীন ভারতীয় প্রধান বিচারপতি জেএস ভার্মা রায়ে উল্লেখ করেন সংবিধান উল্লেখিত ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে অধিকার কার্যকরী করার দায়িত্ব সরকার ও শাসনতন্ত্রের। এবং চতুর্থ বেজিং সম্মেলন, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপমূলক আন্তর্জাতিক আইন যা সিডো আইন হিসেবে পরিচিত, মানবাধিকার আইন রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মানতে বাধ্য। এই রায় মূলত নারীর বিচার পাওয়ার অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি জানায়। এ রায়ের উল্লেখে ভারতে বিভিন্ন আদালতে অনেক উল্লেখযোগ্য বিচার সম্পন্ন হয়েছে।

কিন্তু সম্প্রতি মহারাষ্ট্র হাইকোর্টের এক নারী বিচারপতি ১২ বছরের কিশোরীর পোশাকের ওপর দিয়ে যৌন নির্যাতনকে উপেক্ষা করে আইনের ব্যাখ্যায় বলেন, মেয়েটির ত্বক স্পর্শ না করায় প্রতিকার দেয়া সম্ভব নয়। এই রায় দেশে বিদেশে তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছে। যদিও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যে এই বিতর্কিত রায় স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। আইনের সীমাবদ্ধতা সুনির্দিষ্টকরণের যে দায় আদালতের রয়েছে কার্যত উক্ত বিচারপতি তা এড়িয়ে গেছেন। এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমাদের দেশে আদালত বিভিন্ন সময় নারী অধিকার রক্ষায় বহু উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ২০০৪ সনে গাইবান্ধার কিশোরী তৃষা হত্যা মামলায় বিচারপতি একে বদরুল হক ও মো. আবু তারেক এর দ্বৈত বেঞ্চের রায় আমাদের দেশ ও সরকারের জন্য অন্যতম দিকনির্দেশনা বটে। প্রচলিত আইন অনেকসময় সংবিধান ও নারী অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। আদালত সেক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে। আদালতের নির্দেশেই ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যাশিশুর টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ হওয়া, সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠিত হওয়া, হিন্দু বিধবা নারীর কৃষিজমিতে জীবনস্বত্বর ব্যাখ্যা প্রাঞ্জল হওয়া প্রভৃতি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তারপরেও সম্প্রতিকালে আমাদের উচ্চতর আদালতে মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার অধিকার প্রত্যাশায় আয়শা সিদ্দিকা আনীত রিট মামলার রায় বাংলাদেশের নারী সমাজ ও প্রগতিশীল সমাজকে বিস্মিত করেছে।

স্পষ্টত এখানে নারীর সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। এবং ঋতুস্রাব জনিত প্রাকৃতিক বিষয়কে নারীর Physical Disqualification ব্যাখ্যায় নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই রায় প্রদানকারীর একজন নারী বিচারপতি। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারী পুরুষ যে সমভাবেই বহন ও লালন করতে পারে ভারত ও বাংলাদেশের এই দুই মামলার রায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই রায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে পরিবর্তিত হোক, আমরা অবশ্যই আশা করব। সম্প্রতিকালে উচ্চতর আদালতের এক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে অভিযোগকারী ও আসামির কারাগারে বিয়ে হয়। তার প্রতিফলন দেখা যায় দেশের বিভিন্ন কারাগারে এমন বিয়ে।

আদালতের রায় আমাদের হাতে নেই। কিন্তু একটা কথা বলা যায়, জনমনে বিশ্বাস জন্মেছে আদালতের মাধ্যমে ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার নারীর আপোষ বিয়ে হচ্ছে। এটা ভুল বার্তা কি না-তা এখনও তেমন কোন ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু বিচারপ্রার্থী নারীর বিচারের অধিকার সংকুচিত করার জন্য সমাজের যে অপশক্তি সর্বদা সক্রিয় তাদের উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এক দিনে ৬৫টি মামলার রায়ের মধ্যে ৫৪টি আপোষ নিষ্পত্তি হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। বহু মামলা এর মধ্যে দীর্ঘদিনের। দ্রুতি মামলা নিষ্পত্তি প্রত্যাশার। কিন্তু আদালতকে যন্ত্র ভেবে নেয়াও কঠিন। জট ধরে থাকা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির হাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। তা অবশ্যই ইতিবাচক। আদালত অবশ্যই বিচারের ক্ষেত্রে যৌক্তিক পরিসরে মানবিক ভূমিকা রাখতেই পারে। সাধারণভাবে অহেতুক ভোগান্তি কারও কাম্য নয়। মামলা থেকে শেষ অবধি নারী নানাভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার শিকার হয়।

উপযুক্ত আইনের অভাবে বা পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার কারণে বা অন্যকোনভাবে প্রভাবিত বা প্রতারিত হয়ে ট্রাইবুনালে বহু মোকদ্দমা দায়ের হয়। আইনজীবীদের একাংশের ভূমিকাও সেখানে একটা বিষয়। এই সব অসংগতির প্রতিবিধানের পথ সংশ্লিষ্ট সবার খুঁজে বের করা জরুরি। আজ সেটা আলোচ্য নয়।

আমাদের সন্তান, পরিবার, সমাজ বা দেশের স্বার্থরক্ষার দায় সবার রয়েছে। আদালত সেই দায় রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে মামলা খারিজ করতেই পারে। কিন্তু চুন খেয়ে গলা পোড়া, তাই দই প্রমাণিত না হওয়া অবধি সাধারণ নারী সমাজ আশঙ্কিত হতেই পারে। দেশব্যাপী এই আপোষ নিষ্পত্তির বাতাস আদৌ বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়াই হয়ে থাকবে না জমাট নিম্নচাপ পর্যুদস্ত করবে নারীর ন্যূনতম নিরাপত্তা, মানবাধিকার সেটাই প্রশ্ন হয়ে উঠছে? যাইহোক, এই দেশে, এই সমাজে বিচারপ্রার্থী নারীর কাছে অনিরাপদ ও অবমাননাকর ও নির্যাতিত জীবনের বিপরীতে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আদালত নির্ভরতর আশ্রয়, আদালতের জন্যও তা অধিকতর অনুধাবন আবশ্যক।

[লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি,

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]

শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ১৩ রজব ১৪৪২

বিচারপ্রার্থী নারী ও আদালত

দেবাহুতি চক্রবর্তী

নারীর নানাবিধ নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা দেশে-বিদেশে অব্যাহত আলোচনার বিষয়। নারী-পুরুষের বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কম-বেশি বিদ্যমান রয়েছে। এবং কম-বেশি নারী দেশে দেশে এই অসংগতির শিকার। আমাদের দেশে যার মাত্রা নিয়ত বিবেকবান মানুষের যন্ত্রণার অন্যতম কারণ। ‘ওপরে ঈশ্বর, নিচে আদালত’- আমাদের বিচারপ্রার্থী নারীদের প্রধান সে্লাগান। যদিও প্রত্যাশিত ফলাফলের অনেকক্ষেত্রেই রকমফের হয়। তারও নানাবিধ কারণ আছে। আদালত কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান নয়।

সংবিধান, প্রচলিত আইন, প্রচলিত বিচারব্যবস্থা, ক্ষমতাসীন সরকারের চরিত্র নানাভাবে আদালতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। এই সীমাবদ্ধতার সঙ্গে ব্যক্তি বিচারকের প্রজ্ঞা, মেধা, সাহস, জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টিও থেকে যায়। ঔপনিবেশিক আমলের আইন দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে সংযোজন-বিয়োজন- সংস্করণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন দেশেই আইন নতুন নতুন প্রণয়ন হয়েছে, হচ্ছে। আমাদের দেশে সর্বরকম নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যা অনেক দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তারপরেও প্রচলিত আইনের সংজ্ঞা ও ভাষায় কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। আদালত বিভিন্ন সময় বিচারের ক্ষেত্রে তার অন্তর্দৃষ্টি আর প্রজ্ঞা দিয়ে তাকে প্রাঞ্জল করে। প্রতিবন্ধকতাগুলো দৃশ্যমান করে। এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, যা অনেকসময় সরকার ও শাসনতন্ত্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করে।

উচ্চতর আদালতের রায়গুলো রেফারেন্স হিসেবে নিম্ন আদালতেও ব্যবহৃত হয়। সব ধরনের বিচারের ক্ষেত্রেই সংগতি বিচারে বিদেশি আদালতের রেফারেন্স পর্যালোচনার সুযোগ থাকে। নারী নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যার ভারতীয় আদালতের একটি বহুল আলোচিত রায় আমাদের বিচার কার্যেও প্রভাব রেখেছে। বিশাখা বনাম রাজস্থান রাজ্য শিরোনামের একটি রিট মামলায় ১৯৯৭ সনে তৎকালীন ভারতীয় প্রধান বিচারপতি জেএস ভার্মা রায়ে উল্লেখ করেন সংবিধান উল্লেখিত ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে অধিকার কার্যকরী করার দায়িত্ব সরকার ও শাসনতন্ত্রের। এবং চতুর্থ বেজিং সম্মেলন, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপমূলক আন্তর্জাতিক আইন যা সিডো আইন হিসেবে পরিচিত, মানবাধিকার আইন রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মানতে বাধ্য। এই রায় মূলত নারীর বিচার পাওয়ার অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি জানায়। এ রায়ের উল্লেখে ভারতে বিভিন্ন আদালতে অনেক উল্লেখযোগ্য বিচার সম্পন্ন হয়েছে।

কিন্তু সম্প্রতি মহারাষ্ট্র হাইকোর্টের এক নারী বিচারপতি ১২ বছরের কিশোরীর পোশাকের ওপর দিয়ে যৌন নির্যাতনকে উপেক্ষা করে আইনের ব্যাখ্যায় বলেন, মেয়েটির ত্বক স্পর্শ না করায় প্রতিকার দেয়া সম্ভব নয়। এই রায় দেশে বিদেশে তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছে। যদিও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যে এই বিতর্কিত রায় স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। আইনের সীমাবদ্ধতা সুনির্দিষ্টকরণের যে দায় আদালতের রয়েছে কার্যত উক্ত বিচারপতি তা এড়িয়ে গেছেন। এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমাদের দেশে আদালত বিভিন্ন সময় নারী অধিকার রক্ষায় বহু উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ২০০৪ সনে গাইবান্ধার কিশোরী তৃষা হত্যা মামলায় বিচারপতি একে বদরুল হক ও মো. আবু তারেক এর দ্বৈত বেঞ্চের রায় আমাদের দেশ ও সরকারের জন্য অন্যতম দিকনির্দেশনা বটে। প্রচলিত আইন অনেকসময় সংবিধান ও নারী অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। আদালত সেক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে। আদালতের নির্দেশেই ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যাশিশুর টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ হওয়া, সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠিত হওয়া, হিন্দু বিধবা নারীর কৃষিজমিতে জীবনস্বত্বর ব্যাখ্যা প্রাঞ্জল হওয়া প্রভৃতি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তারপরেও সম্প্রতিকালে আমাদের উচ্চতর আদালতে মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার অধিকার প্রত্যাশায় আয়শা সিদ্দিকা আনীত রিট মামলার রায় বাংলাদেশের নারী সমাজ ও প্রগতিশীল সমাজকে বিস্মিত করেছে।

স্পষ্টত এখানে নারীর সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। এবং ঋতুস্রাব জনিত প্রাকৃতিক বিষয়কে নারীর Physical Disqualification ব্যাখ্যায় নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই রায় প্রদানকারীর একজন নারী বিচারপতি। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারী পুরুষ যে সমভাবেই বহন ও লালন করতে পারে ভারত ও বাংলাদেশের এই দুই মামলার রায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই রায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে পরিবর্তিত হোক, আমরা অবশ্যই আশা করব। সম্প্রতিকালে উচ্চতর আদালতের এক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে অভিযোগকারী ও আসামির কারাগারে বিয়ে হয়। তার প্রতিফলন দেখা যায় দেশের বিভিন্ন কারাগারে এমন বিয়ে।

আদালতের রায় আমাদের হাতে নেই। কিন্তু একটা কথা বলা যায়, জনমনে বিশ্বাস জন্মেছে আদালতের মাধ্যমে ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার নারীর আপোষ বিয়ে হচ্ছে। এটা ভুল বার্তা কি না-তা এখনও তেমন কোন ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু বিচারপ্রার্থী নারীর বিচারের অধিকার সংকুচিত করার জন্য সমাজের যে অপশক্তি সর্বদা সক্রিয় তাদের উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এক দিনে ৬৫টি মামলার রায়ের মধ্যে ৫৪টি আপোষ নিষ্পত্তি হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। বহু মামলা এর মধ্যে দীর্ঘদিনের। দ্রুতি মামলা নিষ্পত্তি প্রত্যাশার। কিন্তু আদালতকে যন্ত্র ভেবে নেয়াও কঠিন। জট ধরে থাকা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির হাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। তা অবশ্যই ইতিবাচক। আদালত অবশ্যই বিচারের ক্ষেত্রে যৌক্তিক পরিসরে মানবিক ভূমিকা রাখতেই পারে। সাধারণভাবে অহেতুক ভোগান্তি কারও কাম্য নয়। মামলা থেকে শেষ অবধি নারী নানাভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার শিকার হয়।

উপযুক্ত আইনের অভাবে বা পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার কারণে বা অন্যকোনভাবে প্রভাবিত বা প্রতারিত হয়ে ট্রাইবুনালে বহু মোকদ্দমা দায়ের হয়। আইনজীবীদের একাংশের ভূমিকাও সেখানে একটা বিষয়। এই সব অসংগতির প্রতিবিধানের পথ সংশ্লিষ্ট সবার খুঁজে বের করা জরুরি। আজ সেটা আলোচ্য নয়।

আমাদের সন্তান, পরিবার, সমাজ বা দেশের স্বার্থরক্ষার দায় সবার রয়েছে। আদালত সেই দায় রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে মামলা খারিজ করতেই পারে। কিন্তু চুন খেয়ে গলা পোড়া, তাই দই প্রমাণিত না হওয়া অবধি সাধারণ নারী সমাজ আশঙ্কিত হতেই পারে। দেশব্যাপী এই আপোষ নিষ্পত্তির বাতাস আদৌ বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়াই হয়ে থাকবে না জমাট নিম্নচাপ পর্যুদস্ত করবে নারীর ন্যূনতম নিরাপত্তা, মানবাধিকার সেটাই প্রশ্ন হয়ে উঠছে? যাইহোক, এই দেশে, এই সমাজে বিচারপ্রার্থী নারীর কাছে অনিরাপদ ও অবমাননাকর ও নির্যাতিত জীবনের বিপরীতে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আদালত নির্ভরতর আশ্রয়, আদালতের জন্যও তা অধিকতর অনুধাবন আবশ্যক।

[লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি,

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]