সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হু হু করে বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার নতুন ঢেউ আঘাত হেনেছে। স্বাভাবিকভাবে, আমাদের দেশেও এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে, ধারণা করা হচ্ছিল, এটা শীতে আসবে। কিন্তু, বাস্তবে আসল গরমে। তবে, নতুন এ ধাক্কার পেছনে হেতু কি? নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যবিধি মানায় সাধারণের গাফিলতি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তবে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষিপ্রগতি এখানে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অবশেষে, সাম্প্রতিক সময়ে সিএইচআরএফ ও আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত দুটি গবেষণা থেকে বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়।

মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক করোনা রোগীদের ৮০-৮১ শতাংশ করোনাভাইরাসের সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং ১০-১২ শতাংশ ইউকে ভ্যারিয়েনটে সংক্রমিত হয়েছেন। দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের ইউকে ও সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় যথাক্রমে ৬ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

এরপর দ্রুত এর জায়গা দখল করে নেয় সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, যার শতকরা হার মার্চের শেষ নাগাদ ৮১ শতাংশে পৌঁছে। যদিও এ গবেষণাসমুহ স্বল্পসংখ্যক নমুনার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তথাপি এগুলো থেকে দেশে এসব ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতির একটি মোটামুটি চিত্র অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে।

একটি ভাইরাস যখন বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার প্রতিলিপি তৈরি করে, তখন মাঝে মাঝে এর জেনেটিক মেটেরিয়ালে ছোট-খাট ত্রুটি ঘটে। একেই আমরা মিউটেশন বলি এবং এভাবেই নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঘটে।

ভাইরাস জগতে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১৯ সালের শেষ পাদে আবির্ভাবের পর থেকে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ৪,০০০ -এর অধিক ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। এ ধরণের একটি ভ্যারিয়েন্ট কেবল তখনই বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন তা দ্রুততর গতিতে ছড়ায়, রোগের লক্ষণাদিতে পরিবর্তন আনে কিংবা অধিকতর শারীরিক সমস্যা কিংবা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, শনাক্তকরণের নিয়মিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে যায়, প্রচলিত ওষুধ কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে ইতিপূর্বেকার সংক্রমণ কিংবা টিকা গ্রহণের ফলে একজন ব্যক্তির শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তার প্রতি সাড়া না দেয়। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্টসমূহকে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন নামে অভিহিত করা হয়। বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এ ধরনের চারটি ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করেছেন, যথা- ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭), সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি.১) এবং ক্যালিফোর্নিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৪২৭ এবং বি.১.৪২৯)। দেশে গত মার্চে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে, তবে সম্ভবত এখনও ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির কোন তথ্য মেলেনি।

ইউকে, সাউথ আফ্রিকান ও ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট- এদের সবার স্পাইক প্রোটিনে N501Y নামে একটি কমন মিউটেশন ঘটেছে, যা তাদের মানবকোষের ACE2 রিসেপ্টরের সঙ্গে আরও ভালোভাবে আবদ্ধ হতে সাহায্য করে। এটিই এদের করোনাভাইরাসের মূল সংস্করণ (wild type)-এর চেয়ে অধিকতর সংক্রামক হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, মূল করোনাভাইরাসের তুলনায় ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ৩০-৫০%, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ৫০% এবং ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ১৫০% অধিকতর সংক্রামক।

সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে E484K এবং K417N নামে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন দেখা যায়। এই মিউটেশন সমূহের কারণে করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে মূল ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি ঠিক মতো যুক্ত হতে পারে না। এটার মানে দাঁড়াচ্ছে, ইতিপূর্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এমন ব্যক্তি এই ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, মূল করোনাভাইরাসকে টার্গেট করে ইতোমধ্যে যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নাও দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. এন্থনি ফাউসির ভাষায়: ‘সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে উদ্বেগের। কারণ এতে যে মিউটেশন ঘটেছে তা একে টিকা গ্রহণ বা ইতিপূর্বে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা থেকে লুকিয়ে; থাকতে সাহায্য করে এবং ফলে এর বিরুদ্ধে টিকার কার্যকরিতা হ্রাস পেতে পারে। (Covid mutations could prolong the pandemic another year, health officials warn| DailyMail, Jan 29, 2021) উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টেও অনুরূপ মিউটেশনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে (E484K, K417T)।

যুক্তরাজ্য সরকারের নিউ অ্যান্ড ইমার্জিং রেসপিরেটরি ভাইরাস থ্রেটস এডভাইজরি গ্রুপের (নার্ভট্যাগ) মতে, ইউকে

ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০-৪০% বেশি। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট অধিকতর প্রাণঘাতী বলে প্রতীয়মান না হলেও সাউথ আফ্রিকায় দেখা গেছে, সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে হাসপাতালসমূহ চাপে পড়ে যাওয়াতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এদেশেও দিনের পর দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে, দেশে ডাক্তাররা দেখছেন, সাম্প্রতিক সংক্রমণসমূহে অনেক রোগীর দ্রুত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে (৩০-৪০%) ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৪০-৫০ শতাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে।

তাছাড়া, রোগের উপসর্গেও এসেছে পরিবর্তন। সর্দি-কাশি কিংবা জ্বরের মতো প্রথাগত উপসর্গের পরিবর্তে অনেকেই মাথা-ব্যথা, ডায়রিয়ার ও অস্বাভাবিক আচরণসহ নানা উপসর্গ নিয়ে আসছেন এবং টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। এবারকার সংক্রমণে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এখানে তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।

এ মুহূর্তে সম্ভবত একটি প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে: এসব ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে বিদ্যমান টিকাসমূহ কতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় অকার্যকর।

অন্য একটি গবেষণা মতে, এক্ষেত্রে নোভাভ্যাক্সের কার্যকারিতা প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে, তীব্র সংক্রমণের বিরুদ্ধেও অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা নোভাভ্যাক্স কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে তা স্পষ্ট নয়। জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন নিয়ে পরিচালিত একটি বড় পরিসরের গবেষণায় এটি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের তীব্র সংক্রমণ রোধে ৮৫% কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে পরিচালিত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট

গবেষণায় এটি এমনকি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতেও শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণ

পাওয়া গেছে। (Vaccines And Variants: What We Know So Far : Goats and Soda : NPR, April 09, 2021)

দেশে ইতোমধ্যে টিকা দান কর্মসূচি চালু হয়েছে। আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিচ্ছি। যেহেতু, এ মুহূর্তে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকরিতা প্রশ্নসাপেক্ষ, আমাদের এ ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নেয়া এবং বিকল্প টিকা সংগ্রহের বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে করোনা উপদ্রুত এলাকাসমূহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বড় পরিসরে সমীক্ষা চালিয়ে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের অঞ্চলভিত্তিক বিস্তৃতি নির্ধারণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। অন্যথায়, টিকা দান কর্মসূচি কাক্সিক্ষত ফল দানে ব্যর্থ হতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি]

রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১ , ৫ বৈশাখ ১৪২৮ ৫ রমজান ১৪৪২

সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

image

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হু হু করে বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার নতুন ঢেউ আঘাত হেনেছে। স্বাভাবিকভাবে, আমাদের দেশেও এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে, ধারণা করা হচ্ছিল, এটা শীতে আসবে। কিন্তু, বাস্তবে আসল গরমে। তবে, নতুন এ ধাক্কার পেছনে হেতু কি? নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যবিধি মানায় সাধারণের গাফিলতি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তবে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষিপ্রগতি এখানে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অবশেষে, সাম্প্রতিক সময়ে সিএইচআরএফ ও আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত দুটি গবেষণা থেকে বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়।

মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক করোনা রোগীদের ৮০-৮১ শতাংশ করোনাভাইরাসের সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং ১০-১২ শতাংশ ইউকে ভ্যারিয়েনটে সংক্রমিত হয়েছেন। দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের ইউকে ও সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় যথাক্রমে ৬ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

এরপর দ্রুত এর জায়গা দখল করে নেয় সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, যার শতকরা হার মার্চের শেষ নাগাদ ৮১ শতাংশে পৌঁছে। যদিও এ গবেষণাসমুহ স্বল্পসংখ্যক নমুনার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তথাপি এগুলো থেকে দেশে এসব ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতির একটি মোটামুটি চিত্র অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে।

একটি ভাইরাস যখন বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার প্রতিলিপি তৈরি করে, তখন মাঝে মাঝে এর জেনেটিক মেটেরিয়ালে ছোট-খাট ত্রুটি ঘটে। একেই আমরা মিউটেশন বলি এবং এভাবেই নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঘটে।

ভাইরাস জগতে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১৯ সালের শেষ পাদে আবির্ভাবের পর থেকে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ৪,০০০ -এর অধিক ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। এ ধরণের একটি ভ্যারিয়েন্ট কেবল তখনই বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন তা দ্রুততর গতিতে ছড়ায়, রোগের লক্ষণাদিতে পরিবর্তন আনে কিংবা অধিকতর শারীরিক সমস্যা কিংবা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, শনাক্তকরণের নিয়মিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে যায়, প্রচলিত ওষুধ কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে ইতিপূর্বেকার সংক্রমণ কিংবা টিকা গ্রহণের ফলে একজন ব্যক্তির শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তার প্রতি সাড়া না দেয়। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্টসমূহকে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন নামে অভিহিত করা হয়। বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এ ধরনের চারটি ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করেছেন, যথা- ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭), সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি.১) এবং ক্যালিফোর্নিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৪২৭ এবং বি.১.৪২৯)। দেশে গত মার্চে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে, তবে সম্ভবত এখনও ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির কোন তথ্য মেলেনি।

ইউকে, সাউথ আফ্রিকান ও ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট- এদের সবার স্পাইক প্রোটিনে N501Y নামে একটি কমন মিউটেশন ঘটেছে, যা তাদের মানবকোষের ACE2 রিসেপ্টরের সঙ্গে আরও ভালোভাবে আবদ্ধ হতে সাহায্য করে। এটিই এদের করোনাভাইরাসের মূল সংস্করণ (wild type)-এর চেয়ে অধিকতর সংক্রামক হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, মূল করোনাভাইরাসের তুলনায় ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ৩০-৫০%, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ৫০% এবং ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ১৫০% অধিকতর সংক্রামক।

সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে E484K এবং K417N নামে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন দেখা যায়। এই মিউটেশন সমূহের কারণে করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে মূল ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি ঠিক মতো যুক্ত হতে পারে না। এটার মানে দাঁড়াচ্ছে, ইতিপূর্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এমন ব্যক্তি এই ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, মূল করোনাভাইরাসকে টার্গেট করে ইতোমধ্যে যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নাও দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. এন্থনি ফাউসির ভাষায়: ‘সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে উদ্বেগের। কারণ এতে যে মিউটেশন ঘটেছে তা একে টিকা গ্রহণ বা ইতিপূর্বে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা থেকে লুকিয়ে; থাকতে সাহায্য করে এবং ফলে এর বিরুদ্ধে টিকার কার্যকরিতা হ্রাস পেতে পারে। (Covid mutations could prolong the pandemic another year, health officials warn| DailyMail, Jan 29, 2021) উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টেও অনুরূপ মিউটেশনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে (E484K, K417T)।

যুক্তরাজ্য সরকারের নিউ অ্যান্ড ইমার্জিং রেসপিরেটরি ভাইরাস থ্রেটস এডভাইজরি গ্রুপের (নার্ভট্যাগ) মতে, ইউকে

ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০-৪০% বেশি। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট অধিকতর প্রাণঘাতী বলে প্রতীয়মান না হলেও সাউথ আফ্রিকায় দেখা গেছে, সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে হাসপাতালসমূহ চাপে পড়ে যাওয়াতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এদেশেও দিনের পর দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে, দেশে ডাক্তাররা দেখছেন, সাম্প্রতিক সংক্রমণসমূহে অনেক রোগীর দ্রুত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে (৩০-৪০%) ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৪০-৫০ শতাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে।

তাছাড়া, রোগের উপসর্গেও এসেছে পরিবর্তন। সর্দি-কাশি কিংবা জ্বরের মতো প্রথাগত উপসর্গের পরিবর্তে অনেকেই মাথা-ব্যথা, ডায়রিয়ার ও অস্বাভাবিক আচরণসহ নানা উপসর্গ নিয়ে আসছেন এবং টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। এবারকার সংক্রমণে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এখানে তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।

এ মুহূর্তে সম্ভবত একটি প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে: এসব ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে বিদ্যমান টিকাসমূহ কতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় অকার্যকর।

অন্য একটি গবেষণা মতে, এক্ষেত্রে নোভাভ্যাক্সের কার্যকারিতা প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে, তীব্র সংক্রমণের বিরুদ্ধেও অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা নোভাভ্যাক্স কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে তা স্পষ্ট নয়। জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন নিয়ে পরিচালিত একটি বড় পরিসরের গবেষণায় এটি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের তীব্র সংক্রমণ রোধে ৮৫% কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে পরিচালিত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট

গবেষণায় এটি এমনকি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতেও শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণ

পাওয়া গেছে। (Vaccines And Variants: What We Know So Far : Goats and Soda : NPR, April 09, 2021)

দেশে ইতোমধ্যে টিকা দান কর্মসূচি চালু হয়েছে। আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিচ্ছি। যেহেতু, এ মুহূর্তে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকরিতা প্রশ্নসাপেক্ষ, আমাদের এ ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নেয়া এবং বিকল্প টিকা সংগ্রহের বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে করোনা উপদ্রুত এলাকাসমূহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বড় পরিসরে সমীক্ষা চালিয়ে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের অঞ্চলভিত্তিক বিস্তৃতি নির্ধারণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। অন্যথায়, টিকা দান কর্মসূচি কাক্সিক্ষত ফল দানে ব্যর্থ হতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি]