হেফাজত নেতা মামুনুল গ্রেপ্তার

তাণ্ডবের মূল পরিকল্পনাকারী একাধিক মামলার আসামি

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল দুপুর পৌনে ১টার দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাকে তেজগাঁও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নেয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) কার্যালয়ে। গত কয়েকদিন ধরেই মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের হওয়া এক মামলায়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম জানান, মামুনুল হক ২০১৩ সালের সহিংসতা এবং সাম্প্রতিক সহিংসতায়ও নিজে সম্পৃক্ত ও উসকানি দিয়েছেন। তাকে প্রথমে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হবে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড হেফাজতে আনার জন্য আবেদন করা হবে। মামুনুল হক ২০১৩ সালের হেফাজতের সমাবেশ পূর্ব সহিংসতার মামলা ছাড়াও সম্প্রতি স্বাধীনতার সূর্বণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলাও আসামি। সব মিলিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তবে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. হারুন-অর-রশিদের ভাষ্য, বেশ কিছুদিন ধরে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরদারিতে ছিলেন। এরপর গতকাল দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিসি হারুনের দাবি, ‘২০২০ সালের মোহাম্মদপুর থানার একটি ভাঙচুর ও নাশকতার মামলার তদন্ত চলছিল। তদন্তে হেফাজত নেতা মামুনুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ায় আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ডিসি হারুনের ভাষ্য, ‘জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারীর ঘটনার পর থেকেই তিনি নজরদারিতে ছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আপাতত মোহাম্মদপুর থানার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আজ তাকে আদালতে হাজির করা হবে। তবে রিমান্ড চাওয়া হবে কিনা তা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

পুলিশের দাবি, মোদিবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এই তাণ্ডবের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নেপথ্যে ছিলেন হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক । মোদিবিরোধী বিক্ষোভের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমে একাধিক মামলা করলেও তাতে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের নাম ছিল না। তবে ৩ এপ্রিল এক নারী সঙ্গীসহ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে আওয়ামী লীগ নেতাকর্র্মী হাতে অবরুদ্ধ হওয়ার পর হেফাজতকে কোণঠাসা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপরই রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন থানায় নতুন করে হওয়া একাধিক মামলায় মামুনুল হকসহ হেফাজতের একাধিক শীর্ষ নেতাকে আসামি করা হয়।

যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয় মামুনুল হককে

নারায়ণগঞ্জের এক রিসোর্টে কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে অবকাশকালীণ সময় কাটাতে গিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে অবরুদ্ধ হওয়া, হেফাজতের নেতকর্মীরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পরবর্তীতে একাধিক বিয়ে নিয়ে মামুনুলের তথ্য প্রকাশ, নানা ধরনের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার পর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান নেন মাওলানা মামুনুল। ওই মাদ্রাসা থেকেই নারায়ণহঞ্জের রিসোর্টের ঘটনা, একাধিক বিয়ে নিয়ে নিজের যুক্তি ফেইসবুকে তুলে ধরেন মামুনুল হক। গণমাধ্যমের সামনে না আসলেও সেখানে অবস্থান করেই মামুনুল হক হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে শুরু থেকেই গুঞ্জন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে মোহাম্মদপুরের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, তারা অপেক্ষায় ছিলেন মামুনুল হকের মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই রাখা হয়েছিল তাকে। এরমধ্যে হেফাজতের মধ্যম সারির একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামুনুল মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা করলেও গত রোববার তাকে মাদ্রাসা থেকেই গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে মাদ্রাসায় কতজন শিক্ষার্র্র্থী অবস্থান করছেন সেই তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় মামুনুল হকের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এরপরই পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাসহ গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিম তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। অভিযানে অংশ নেয়া গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মাদ্রাসার গেটে সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়েছিলেন মামুনুল হক। পুলিশের শতাধিক ফোর্স নিয়ে তারা মাদ্রাসায় গেলে প্রথম দিকে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিযানের মুখে পিছু হটেন তারা। পরে মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় মামুনুল হকের কক্ষে গিয়ে তাকে পুলিশের সঙ্গে যেতে বলেন। তিনি নিজেও বুঝতে পারেন বাধা দিয়ে কোন লাভ হবে না। তাই স্বেচ্ছায় হেঁটে গাড়িতে ওঠেন তিনি।

মামুলুলের বিরুদ্ধে যত মামলা

২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীতে ব্যাপক নাশকতার ঘটনা ঘটে। এছাড়া সমাবেশ পূর্ববর্তী দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা, ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ সারাদেশে মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে রাজধানীতে ১৫টির বেশি মামলা হয়। এসব মামলায় মাওলানা মামুনুল হক আসামি ছিলেন। এছাড়া সম্প্রতি মোদিবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ করতে গিয়ে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকারমে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামেও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে এক নারীকে নিয়ে রিসোর্টে যান মাওলানা মামুনুল। পরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করলে পুলিশ সেখানে যায়। খবর পেয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সেখানে রিসোর্টে ভাঙচুর চালিয়ে মামুনুলকে ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁ থানায় মামলা দায়ের হয়। সেসব মামলায় মাওলানা মামুনুলকে আসামি করা হয়। এরপর দুই নারীর নিখোঁজের ঘটনায় তাদের স্বজনরা মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। যদিও বলা হয় ওই দুই নারীই মামুনুলের স্ত্রী। ২৬ মার্চ জাতীয় মসজিদে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলার আসামিও মামুনুল।

এ পর্যন্ত হেফাজতের যেসব নেতাদের গেপ্তার করা হলো

মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের ৯ কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। প্রত্যেককেই ২০১৩ সালে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল দুপুরে গ্রেপ্তার হন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। এরপর আরেক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ১১ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলামাবাদী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহ-সভাপতি মুফতি ইলিয়াসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহ, ১৪ এপ্রিল সহকারী মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি ও কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা যুবায়ের আহমেদ ও ১৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ নামে হেফাজতের এক নেতাকে।

মামনুল গ্রেপ্তারের পর জরুরি বৈঠকে হেফাজত

এদিকে মাওলানা মামুনুল হক গ্রেপ্তারের পর জরুরি বৈঠকে বসেছেন হেফাজত নেতারা। ভার্চুয়ালি এ বৈঠকে মাওলানা মামুনুল গ্রেপ্তার এবং এর আগে হেফাজতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোচানয় আসে। এছাড়া সারাদেশে হেফাজতের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার এবং ২০১৩ সালের মামলায় হেফাজত নেতাতের গ্রেপ্তারের ঘটনায় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হয়। তবে আলোচনার বক্তব্যগুলো প্রকাশ করেননি হেফাজত নেতারা।

সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১ , ৬ বৈশাখ ১৪২৮ ৬ রমজান ১৪৪২

হেফাজত নেতা মামুনুল গ্রেপ্তার

তাণ্ডবের মূল পরিকল্পনাকারী একাধিক মামলার আসামি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল দুপুর পৌনে ১টার দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাকে তেজগাঁও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নেয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) কার্যালয়ে। গত কয়েকদিন ধরেই মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের হওয়া এক মামলায়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম জানান, মামুনুল হক ২০১৩ সালের সহিংসতা এবং সাম্প্রতিক সহিংসতায়ও নিজে সম্পৃক্ত ও উসকানি দিয়েছেন। তাকে প্রথমে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হবে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড হেফাজতে আনার জন্য আবেদন করা হবে। মামুনুল হক ২০১৩ সালের হেফাজতের সমাবেশ পূর্ব সহিংসতার মামলা ছাড়াও সম্প্রতি স্বাধীনতার সূর্বণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলাও আসামি। সব মিলিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তবে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. হারুন-অর-রশিদের ভাষ্য, বেশ কিছুদিন ধরে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরদারিতে ছিলেন। এরপর গতকাল দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিসি হারুনের দাবি, ‘২০২০ সালের মোহাম্মদপুর থানার একটি ভাঙচুর ও নাশকতার মামলার তদন্ত চলছিল। তদন্তে হেফাজত নেতা মামুনুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ায় আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ডিসি হারুনের ভাষ্য, ‘জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারীর ঘটনার পর থেকেই তিনি নজরদারিতে ছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আপাতত মোহাম্মদপুর থানার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আজ তাকে আদালতে হাজির করা হবে। তবে রিমান্ড চাওয়া হবে কিনা তা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

পুলিশের দাবি, মোদিবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এই তাণ্ডবের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নেপথ্যে ছিলেন হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক । মোদিবিরোধী বিক্ষোভের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমে একাধিক মামলা করলেও তাতে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের নাম ছিল না। তবে ৩ এপ্রিল এক নারী সঙ্গীসহ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে আওয়ামী লীগ নেতাকর্র্মী হাতে অবরুদ্ধ হওয়ার পর হেফাজতকে কোণঠাসা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপরই রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন থানায় নতুন করে হওয়া একাধিক মামলায় মামুনুল হকসহ হেফাজতের একাধিক শীর্ষ নেতাকে আসামি করা হয়।

যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয় মামুনুল হককে

নারায়ণগঞ্জের এক রিসোর্টে কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে অবকাশকালীণ সময় কাটাতে গিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে অবরুদ্ধ হওয়া, হেফাজতের নেতকর্মীরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পরবর্তীতে একাধিক বিয়ে নিয়ে মামুনুলের তথ্য প্রকাশ, নানা ধরনের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার পর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান নেন মাওলানা মামুনুল। ওই মাদ্রাসা থেকেই নারায়ণহঞ্জের রিসোর্টের ঘটনা, একাধিক বিয়ে নিয়ে নিজের যুক্তি ফেইসবুকে তুলে ধরেন মামুনুল হক। গণমাধ্যমের সামনে না আসলেও সেখানে অবস্থান করেই মামুনুল হক হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে শুরু থেকেই গুঞ্জন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে মোহাম্মদপুরের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, তারা অপেক্ষায় ছিলেন মামুনুল হকের মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই রাখা হয়েছিল তাকে। এরমধ্যে হেফাজতের মধ্যম সারির একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামুনুল মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা করলেও গত রোববার তাকে মাদ্রাসা থেকেই গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে মাদ্রাসায় কতজন শিক্ষার্র্র্থী অবস্থান করছেন সেই তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় মামুনুল হকের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এরপরই পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাসহ গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিম তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। অভিযানে অংশ নেয়া গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মাদ্রাসার গেটে সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়েছিলেন মামুনুল হক। পুলিশের শতাধিক ফোর্স নিয়ে তারা মাদ্রাসায় গেলে প্রথম দিকে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিযানের মুখে পিছু হটেন তারা। পরে মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় মামুনুল হকের কক্ষে গিয়ে তাকে পুলিশের সঙ্গে যেতে বলেন। তিনি নিজেও বুঝতে পারেন বাধা দিয়ে কোন লাভ হবে না। তাই স্বেচ্ছায় হেঁটে গাড়িতে ওঠেন তিনি।

মামুলুলের বিরুদ্ধে যত মামলা

২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীতে ব্যাপক নাশকতার ঘটনা ঘটে। এছাড়া সমাবেশ পূর্ববর্তী দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা, ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ সারাদেশে মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে রাজধানীতে ১৫টির বেশি মামলা হয়। এসব মামলায় মাওলানা মামুনুল হক আসামি ছিলেন। এছাড়া সম্প্রতি মোদিবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ করতে গিয়ে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকারমে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামেও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে এক নারীকে নিয়ে রিসোর্টে যান মাওলানা মামুনুল। পরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করলে পুলিশ সেখানে যায়। খবর পেয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সেখানে রিসোর্টে ভাঙচুর চালিয়ে মামুনুলকে ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁ থানায় মামলা দায়ের হয়। সেসব মামলায় মাওলানা মামুনুলকে আসামি করা হয়। এরপর দুই নারীর নিখোঁজের ঘটনায় তাদের স্বজনরা মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। যদিও বলা হয় ওই দুই নারীই মামুনুলের স্ত্রী। ২৬ মার্চ জাতীয় মসজিদে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলার আসামিও মামুনুল।

এ পর্যন্ত হেফাজতের যেসব নেতাদের গেপ্তার করা হলো

মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের ৯ কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। প্রত্যেককেই ২০১৩ সালে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল দুপুরে গ্রেপ্তার হন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। এরপর আরেক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ১১ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলামাবাদী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহ-সভাপতি মুফতি ইলিয়াসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহ, ১৪ এপ্রিল সহকারী মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি ও কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা যুবায়ের আহমেদ ও ১৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ নামে হেফাজতের এক নেতাকে।

মামনুল গ্রেপ্তারের পর জরুরি বৈঠকে হেফাজত

এদিকে মাওলানা মামুনুল হক গ্রেপ্তারের পর জরুরি বৈঠকে বসেছেন হেফাজত নেতারা। ভার্চুয়ালি এ বৈঠকে মাওলানা মামুনুল গ্রেপ্তার এবং এর আগে হেফাজতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোচানয় আসে। এছাড়া সারাদেশে হেফাজতের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার এবং ২০১৩ সালের মামলায় হেফাজত নেতাতের গ্রেপ্তারের ঘটনায় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হয়। তবে আলোচনার বক্তব্যগুলো প্রকাশ করেননি হেফাজত নেতারা।