সন্তানকে বাঁচাতে রিকশা চালিয়ে ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন বাবা

অ্যাম্বুলেন্স কিংবা গাড়ি ভাড়া করার অর্থ জোগাড় করতে না পেরে গুরুতর অসুস্থ সন্তানকে বাঁচাতে রিকশা চালিয়ে একশ’ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন বাবা তারেক ইসলাম।

ঠাকুরগাঁওয়ে বাসা থেকে গত শনিবার ভোরে বের হয়ে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তারেক।

রিকশাচালক তারেক জানান, তার ৭ মাস বয়সী শিশু জান্নাতের মলের সঙ্গে রক্ত বের হচ্ছে। ১৩ এপ্রিল রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা প্রাথমিক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন শিশুটির পেটের নাড়ি উল্টে গেছে। একদিন পর চিকিৎসকরা শিশু জান্নাতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। একদিকে লকডাউনে যান চলাচল বন্ধ, অন্যদিকে অ্যাম্বুলেন্স কিংবা গাড়ি ভাড়া করার মতো টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়ে নিজের রিকশায় স্ত্রী ও অসুস্থ সন্তানতে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন তিনি।

গুরুতর অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পৌঁছান রমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সুদূর ঠাকুরগাঁও থেকে নিজেই রিকশা চালিয়ে অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেলে আসার কথা শুনে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সালমান শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। তাকে হাসপাতালের ১৮ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

সকালে এ সংবাদের প্রতিনিধি হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনার একটি খবর সংগ্রহ করতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখতে পান রিকশাচালক তারেক ইসলাম হাউমাউ করে কাঁদছেন। তিনি জানান, ঠাকুরগাঁও থেকে নিজেই রিকশা চালিয়ে হাসপাতালে এসেছেন কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাকে ওষুধের বড় ফর্দ ধরিয়ে দেয়া হয়। তার সঙ্গে আছে মাত্র ২০ টাকা। তারেক জানান, হাসপাতালের পার্শ্বেই এক দোকানে গিয়ে ওষুধের দাম জানতে চাইলে তাকে বলা হয় দেড় হাজার টাকা লাগবে। এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি? শেষ পর্যন্ত টাকার অভাবে কি তার সন্তানের চিকিৎসা হবে না?

তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে রংপুরে এসেছি। আমি রিকশা চালাই, অ্যাম্বুলেন্সে করে বাচ্চাকে নিয়ে আসার সামর্থ্য আমার নেই। চারদিন আগেই ডাক্তার বাচ্চাকে রংপুরে আনার জন্য বলেছিল কিন্তু অর্থের অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখার পর কিছু ওষুধ ও স্যালাইন দিয়েছেন। পর্যবেক্ষণ শেষে অপারেশন করা লাগতে পারে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

রিকশাচালক তারেক ইসলামের আহাজারি দেখে কয়েকজন মিলে কিছু টাকা জোগাড় করে দেয়। তা দিয়ে ওষুধ কিনে তার চিকিৎসা শুরু হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রংপুর নগরীর ধাপ এলাকার এক ব্যবসায়ী শিশুটির চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন।

রিকশাচালক তারেক ইসলাম জানান, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ সালন্দর গ্রামের রামবাবুর গোডাউন এলাকায় তাদের বাড়ি। তার বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। দিনমজুর বাবার সংসার সামলানোর জন্য অল্প বয়সেই রিকশা চালানো শুরু করেন। বিয়ের পর স্ত্রী সুলতানা বেগমকে নিয়ে কোন রকমে চলছিল সংসার। তার ৯ ও ৩ বছর বয়সী আরও দুটি মেয়ে আছে।

তারেক আরও জানান, রিকশা চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলে সাউন্ড সিস্টেম অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন কিন্তু করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে অনুষ্ঠান না থাকায় তার বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতিতে ঠিকমতো রিকশা চালাতে না পেরে অসহনীয় কষ্ট নেমে এসেছে তার পরিবারে।

সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১ , ৬ বৈশাখ ১৪২৮ ৬ রমজান ১৪৪২

সন্তানকে বাঁচাতে রিকশা চালিয়ে ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন বাবা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, রংপুর

image

হাসপাতালে সন্তান কোলে মা -সংবাদ

অ্যাম্বুলেন্স কিংবা গাড়ি ভাড়া করার অর্থ জোগাড় করতে না পেরে গুরুতর অসুস্থ সন্তানকে বাঁচাতে রিকশা চালিয়ে একশ’ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন বাবা তারেক ইসলাম।

ঠাকুরগাঁওয়ে বাসা থেকে গত শনিবার ভোরে বের হয়ে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তারেক।

রিকশাচালক তারেক জানান, তার ৭ মাস বয়সী শিশু জান্নাতের মলের সঙ্গে রক্ত বের হচ্ছে। ১৩ এপ্রিল রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা প্রাথমিক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন শিশুটির পেটের নাড়ি উল্টে গেছে। একদিন পর চিকিৎসকরা শিশু জান্নাতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। একদিকে লকডাউনে যান চলাচল বন্ধ, অন্যদিকে অ্যাম্বুলেন্স কিংবা গাড়ি ভাড়া করার মতো টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়ে নিজের রিকশায় স্ত্রী ও অসুস্থ সন্তানতে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন তিনি।

গুরুতর অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পৌঁছান রমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সুদূর ঠাকুরগাঁও থেকে নিজেই রিকশা চালিয়ে অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেলে আসার কথা শুনে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সালমান শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। তাকে হাসপাতালের ১৮ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

সকালে এ সংবাদের প্রতিনিধি হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনার একটি খবর সংগ্রহ করতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখতে পান রিকশাচালক তারেক ইসলাম হাউমাউ করে কাঁদছেন। তিনি জানান, ঠাকুরগাঁও থেকে নিজেই রিকশা চালিয়ে হাসপাতালে এসেছেন কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাকে ওষুধের বড় ফর্দ ধরিয়ে দেয়া হয়। তার সঙ্গে আছে মাত্র ২০ টাকা। তারেক জানান, হাসপাতালের পার্শ্বেই এক দোকানে গিয়ে ওষুধের দাম জানতে চাইলে তাকে বলা হয় দেড় হাজার টাকা লাগবে। এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি? শেষ পর্যন্ত টাকার অভাবে কি তার সন্তানের চিকিৎসা হবে না?

তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে রংপুরে এসেছি। আমি রিকশা চালাই, অ্যাম্বুলেন্সে করে বাচ্চাকে নিয়ে আসার সামর্থ্য আমার নেই। চারদিন আগেই ডাক্তার বাচ্চাকে রংপুরে আনার জন্য বলেছিল কিন্তু অর্থের অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখার পর কিছু ওষুধ ও স্যালাইন দিয়েছেন। পর্যবেক্ষণ শেষে অপারেশন করা লাগতে পারে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

রিকশাচালক তারেক ইসলামের আহাজারি দেখে কয়েকজন মিলে কিছু টাকা জোগাড় করে দেয়। তা দিয়ে ওষুধ কিনে তার চিকিৎসা শুরু হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রংপুর নগরীর ধাপ এলাকার এক ব্যবসায়ী শিশুটির চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন।

রিকশাচালক তারেক ইসলাম জানান, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ সালন্দর গ্রামের রামবাবুর গোডাউন এলাকায় তাদের বাড়ি। তার বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। দিনমজুর বাবার সংসার সামলানোর জন্য অল্প বয়সেই রিকশা চালানো শুরু করেন। বিয়ের পর স্ত্রী সুলতানা বেগমকে নিয়ে কোন রকমে চলছিল সংসার। তার ৯ ও ৩ বছর বয়সী আরও দুটি মেয়ে আছে।

তারেক আরও জানান, রিকশা চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলে সাউন্ড সিস্টেম অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন কিন্তু করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে অনুষ্ঠান না থাকায় তার বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতিতে ঠিকমতো রিকশা চালাতে না পেরে অসহনীয় কষ্ট নেমে এসেছে তার পরিবারে।