সারি সারি লাশের দাফন!

মোহাম্মদ আবু নোমান

গোরখোদকরা একটার পর একটা কবর খুঁড়ছেন। কিছু অগ্রিমও খুঁড়ে রাখছেন। পাশাপাশি সারি সারি লাশের দাফন শুরু হয়েছে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে। দূরে দাঁড়ানো স্বজনদের আহাজারির মধ্যেই পিপিই পরিহিত স্বেচ্ছাসেবীরা কিছুক্ষণ পরপর অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামাচ্ছেন কবরে। কে বা কার আপনজন অথবা প্রিয়জন এই সারির মধ্যে এসে যাবেন, তা আমরা কেউ জানি না। শুধু দেখছি করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই না, অস্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন মৃত্যুতে রেকর্ড ভাঙছে। দেশের কোভিড হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রথমসারির নাগরিকরাও আইসিইউ পাচ্ছেন না। কী ভয়ানক খবর! আরো কঠিন ভয়ের কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চোখ রাখা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রশাসনের কঠোরতা ও পরিকল্পিত লকডাউন ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর পর আবারও করোনার ভয়াল রূপ ও বিস্তার, শনাক্ত, মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মহামারি প্রতিরোধের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

আমাদের দেশের লোকজনের মনস্তত্ত্ব খুবই মিশ্র ও জটিল। জনগণের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। দেখা যায় কেউ বিষয়টাকে আমলেই নিচ্ছে না। আবার এক ধরনের লোক আছেন, তারা করোনাকে বিশ্বাসই করেন না। আবার আরেক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, তারা বলেন- আমাদের করোনা হবে না। করোনা বড়লোকদের হয়! এ ধরনের একটি জটিল ও মিশ্র মনোভাবের জনসাধারণকে কঠোরভাবে হলেও মোকাবিলা করতে হবে।

আসলে আমারা যাচ্ছি কোথায়, আমরাই জানি না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাঙালি করেছ, মানুষ করনি।’ রবীন্দ্রনাথের বাঙালিরা বাজার, দোকান, শপিংমলে যাবে এবং ভাইরাসকে ডেকে এনে ঘরে ঢোকাবে না এর নিশ্চয়তাই কে দেবে? আমরা যদি সতর্ক না হই তাহলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনসাধারণের কাছ থেকে যদি সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তবে সরকারকে কঠোর থেকে কঠোর হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ছিল করোনা মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এ কাজ করতে সরকার সফল হয়নি।

সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকায় দুই সপ্তাহের পূর্ণ লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। দুই সপ্তাহের লকডাউন শেষ হওয়ার আগে সংক্রমণ পরিস্থিতি ও আক্রান্তের হার বিবেচনায় আবার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৮টি নির্দেশনা এবং পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও বিধি-নিষেধ দেয়া হয়। এগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। এ কারণে সংক্রমণের হার বাড়ছে। বিধি-নিষেধ আরো শক্তভাবে অনুসরণ করা দরকার বলে আমরা মনে করছি।

দেশে করোনাভাইরাসে সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্যাটার্ন আগের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এবারে আক্রান্তদের অনেকের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের উপসর্গ আগের চেয়ে প্রকট দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে অনেকের প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছে বলে জানান। এছাড়া নিউরোসাইক্রিয়াটিক সমস্যা, যেমন কারো কারো মধ্যে পাগলামি আচরণের প্রবণতা কিংবা ব্রেইন ইনফেকশনের মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশজুড়ে এবার করোনার দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন ছড়িয়ে পড়েছে। তা বেশ সংক্রামক এবং এর তীব্রতাও ভয়াবহ উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের নতুন এ ভ্যারিয়েন্টটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে থার্ড ওয়েভ বা তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, টানা তিন সপ্তাহ মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর লকডাউন ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আর কোনো উপায় নেই। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অর্থাৎ মাস্ক পরা, তিন ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া ভয়াবহ এ ভ্যারিয়েন্ট থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর পথ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার চেয়ে মাস্ক পরা ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক দূরত্ব ও শারীরিক দূরত্বের থেকেও করোনা নিয়ন্ত্রণে মাস্কের ব্যবহার এবং ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা বেশি জরুরি। এ গবেষণার ফল গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে।

করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও সেখানে উন্নতি নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিই দায়ী। অক্সিজেনের খোঁজে মানুষকে অসহায় হতে হতো না। সারাদেশে থেকে অক্সিজেনের চাহিদায় সবাই যদি ঢাকামুখী হয় তাহলে অবস্থা কী হবে? সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অক্সিজেন না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই রোগীর মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতি গত বছরও দেখা গেছে।

ইতোমধ্যে মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ‘লকডাউন মানি না, মানব না’ বলে সেøাগান করেছে। কিন্তু সবাইকে বুঝতে আগে জীবন বেঁচে থাকলে সব কিছু করা যাবে। আমরা মানছি, দেশে শিল্প উৎপাদন গতিশীল রাখা অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থেই প্রয়োজন। কিন্তু তা কখনই মানুষের জীবন সংশয়ের মধ্যে ফেলে নয়। সবকিছু খুলে দিয়ে, করোনার চাষ করলে ফল তো ঘরে আসবেই! সামনের ঈদকে বাহানা করে বিপণিবিতান খোলা রাখা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। মানুষের জীবন থেকে অর্থনৈতিই সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধিই সব নয়। মানুষ যদি না বাঁচে, কী হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু একই সঙ্গে করোনার প্রাণঘাতী ক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা। কেবল সতর্কতাই পারে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে।

সম্প্রতি সময়ের অভিজ্ঞতা ও বহির্বিশ্বের অবস্থাদৃষ্টে বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে আমাদের। যখন বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। তখন মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ সমাবেশ জেনে-শুনে বিষপান; না করোনার সাথে ছেলেখেলা! স্প্যানিশ ফ্লু’র ইতিহাস আমরা জানি। স্প্যানিশ ফ্লু দীর্ঘায়িত হয়েছিল ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ৩৬ মাস। ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, যা ওই সময়ের বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয় ২ কোটি থেকে ৫ কোটি। বলা হয়, সমসাময়িককালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি ছিল সেটা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোভিড-১৯ স্প্যানিশ ফ্লু’র মতো দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমরা ধৈর্যহীন হলে ক্ষয়-ক্ষতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। বণিকদের সঙ্গে আপস করে মহামারি বিস্তারের শত পথ খুলে দেয়া যাবে না। অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশের সংক্রমণ বা মৃত্যুর হিসাব দেখে শান্ত থাকার কোন কারণ নেই।

অন্যদিকে করোনা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসায় চিকিৎসক-পুলিশ সংক্রমিত ব্যক্তির বাড়ি লকডাউন করতে গিয়েছিলেন। এ সময় জানা গেল, ওই ব্যক্তি বোরো ধান কাটতে পাশের হাওরে চলে গেছেন। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নের জায়ফরনগর গ্রামের ঘটনা এটি। এক্ষেত্রে দেখতে হবে নমুনা জমা দেয়ার চার-পাঁচ দিন পর যদি রেজাল্ট আসে, তো করোনা বহনকারী ওই চার-পাঁচ দিন হেঁটে হেঁটে করোনা বিতরণ করবেই। ইতোপূর্বে আমরা খবর দেখেছি, করোনা পজিটিভ রোগী ইদ্রিস আলী কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। মৌলভীবাজারের জায়ফরনগর গ্রামের ওই ব্যক্তি ধান কাটতে গেছে ভালো কথা, আরেকটু খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, ধান কাটতে কাটতে একটি বিড়ি ২-৩ জন মিলে ভাগ করে খেয়েছে! এভাবে চললে মহামারির নতুন আঘাত সামলানো অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠবে।

মাস্ক পরাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় সাধারণ মানুষের অনীহা ও অবহেলায় আক্রান্ত ও মৃত্যু পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার একটা বড় কারণ। অথচ গত বছর মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ সতর্কতা দেখা গিয়েছিল, সেটি আর এবার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দিচ্ছে। আমরা মনে করি, সারা দেশে লকডাউন বিজ্ঞানসম্মত নয়। লকডাউন দিতে হবে জনগণের চলাচল সীমিত করার জন্য। যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ বেশি, সেখানে লকডাউন দেয়া যুক্তিযুক্ত। ওই সব এলাকা থেকে যাতে অন্যখানে সংক্রমণ না ঘটে। কিন্তু সারাদেশে একযোগে লকডাউন মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। যেসব এলাকায় সংক্রমণ কম, সেখানে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। এতে শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

এর বাইরে আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়া কিংবা কিছুই না থাকলে কনুই ভাঁজ করে হাতের আস্তিন দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। এটি খুবই সাধারণ শিষ্টাচারের বিষয়। অবশ্য এ শিষ্টাচারের শিক্ষা মানুষ পরিবার থেকেই পায়। যেখানে সেখানে থু-তু না ফেলাও এ শিষ্টাচারের অংশ। এছাড়া সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি কাজ করে।

বর্তমানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশের মানুষের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সাধারণ শিষ্টাচার মেনে চলাসহ সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। মানুষ যদি তাদের পূর্বের অভ্যাস, আচরণ ও কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে তা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ও সংক্রমণে সহায়ক হবে- এ কথা বলাই বাহুল্য।

abunoman1972@gmail.com

সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১ , ৬ বৈশাখ ১৪২৮ ৬ রমজান ১৪৪২

সারি সারি লাশের দাফন!

মোহাম্মদ আবু নোমান

গোরখোদকরা একটার পর একটা কবর খুঁড়ছেন। কিছু অগ্রিমও খুঁড়ে রাখছেন। পাশাপাশি সারি সারি লাশের দাফন শুরু হয়েছে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে। দূরে দাঁড়ানো স্বজনদের আহাজারির মধ্যেই পিপিই পরিহিত স্বেচ্ছাসেবীরা কিছুক্ষণ পরপর অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামাচ্ছেন কবরে। কে বা কার আপনজন অথবা প্রিয়জন এই সারির মধ্যে এসে যাবেন, তা আমরা কেউ জানি না। শুধু দেখছি করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই না, অস্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন মৃত্যুতে রেকর্ড ভাঙছে। দেশের কোভিড হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রথমসারির নাগরিকরাও আইসিইউ পাচ্ছেন না। কী ভয়ানক খবর! আরো কঠিন ভয়ের কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চোখ রাখা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রশাসনের কঠোরতা ও পরিকল্পিত লকডাউন ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর পর আবারও করোনার ভয়াল রূপ ও বিস্তার, শনাক্ত, মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মহামারি প্রতিরোধের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

আমাদের দেশের লোকজনের মনস্তত্ত্ব খুবই মিশ্র ও জটিল। জনগণের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। দেখা যায় কেউ বিষয়টাকে আমলেই নিচ্ছে না। আবার এক ধরনের লোক আছেন, তারা করোনাকে বিশ্বাসই করেন না। আবার আরেক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, তারা বলেন- আমাদের করোনা হবে না। করোনা বড়লোকদের হয়! এ ধরনের একটি জটিল ও মিশ্র মনোভাবের জনসাধারণকে কঠোরভাবে হলেও মোকাবিলা করতে হবে।

আসলে আমারা যাচ্ছি কোথায়, আমরাই জানি না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাঙালি করেছ, মানুষ করনি।’ রবীন্দ্রনাথের বাঙালিরা বাজার, দোকান, শপিংমলে যাবে এবং ভাইরাসকে ডেকে এনে ঘরে ঢোকাবে না এর নিশ্চয়তাই কে দেবে? আমরা যদি সতর্ক না হই তাহলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনসাধারণের কাছ থেকে যদি সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তবে সরকারকে কঠোর থেকে কঠোর হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ছিল করোনা মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এ কাজ করতে সরকার সফল হয়নি।

সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকায় দুই সপ্তাহের পূর্ণ লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। দুই সপ্তাহের লকডাউন শেষ হওয়ার আগে সংক্রমণ পরিস্থিতি ও আক্রান্তের হার বিবেচনায় আবার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৮টি নির্দেশনা এবং পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও বিধি-নিষেধ দেয়া হয়। এগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। এ কারণে সংক্রমণের হার বাড়ছে। বিধি-নিষেধ আরো শক্তভাবে অনুসরণ করা দরকার বলে আমরা মনে করছি।

দেশে করোনাভাইরাসে সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্যাটার্ন আগের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এবারে আক্রান্তদের অনেকের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের উপসর্গ আগের চেয়ে প্রকট দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে অনেকের প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছে বলে জানান। এছাড়া নিউরোসাইক্রিয়াটিক সমস্যা, যেমন কারো কারো মধ্যে পাগলামি আচরণের প্রবণতা কিংবা ব্রেইন ইনফেকশনের মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশজুড়ে এবার করোনার দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন ছড়িয়ে পড়েছে। তা বেশ সংক্রামক এবং এর তীব্রতাও ভয়াবহ উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের নতুন এ ভ্যারিয়েন্টটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে থার্ড ওয়েভ বা তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, টানা তিন সপ্তাহ মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর লকডাউন ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আর কোনো উপায় নেই। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অর্থাৎ মাস্ক পরা, তিন ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া ভয়াবহ এ ভ্যারিয়েন্ট থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর পথ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার চেয়ে মাস্ক পরা ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক দূরত্ব ও শারীরিক দূরত্বের থেকেও করোনা নিয়ন্ত্রণে মাস্কের ব্যবহার এবং ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা বেশি জরুরি। এ গবেষণার ফল গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে।

করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও সেখানে উন্নতি নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিই দায়ী। অক্সিজেনের খোঁজে মানুষকে অসহায় হতে হতো না। সারাদেশে থেকে অক্সিজেনের চাহিদায় সবাই যদি ঢাকামুখী হয় তাহলে অবস্থা কী হবে? সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অক্সিজেন না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই রোগীর মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতি গত বছরও দেখা গেছে।

ইতোমধ্যে মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ‘লকডাউন মানি না, মানব না’ বলে সেøাগান করেছে। কিন্তু সবাইকে বুঝতে আগে জীবন বেঁচে থাকলে সব কিছু করা যাবে। আমরা মানছি, দেশে শিল্প উৎপাদন গতিশীল রাখা অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থেই প্রয়োজন। কিন্তু তা কখনই মানুষের জীবন সংশয়ের মধ্যে ফেলে নয়। সবকিছু খুলে দিয়ে, করোনার চাষ করলে ফল তো ঘরে আসবেই! সামনের ঈদকে বাহানা করে বিপণিবিতান খোলা রাখা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। মানুষের জীবন থেকে অর্থনৈতিই সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধিই সব নয়। মানুষ যদি না বাঁচে, কী হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু একই সঙ্গে করোনার প্রাণঘাতী ক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা। কেবল সতর্কতাই পারে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে।

সম্প্রতি সময়ের অভিজ্ঞতা ও বহির্বিশ্বের অবস্থাদৃষ্টে বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে আমাদের। যখন বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। তখন মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ সমাবেশ জেনে-শুনে বিষপান; না করোনার সাথে ছেলেখেলা! স্প্যানিশ ফ্লু’র ইতিহাস আমরা জানি। স্প্যানিশ ফ্লু দীর্ঘায়িত হয়েছিল ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ৩৬ মাস। ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, যা ওই সময়ের বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয় ২ কোটি থেকে ৫ কোটি। বলা হয়, সমসাময়িককালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি ছিল সেটা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোভিড-১৯ স্প্যানিশ ফ্লু’র মতো দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমরা ধৈর্যহীন হলে ক্ষয়-ক্ষতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। বণিকদের সঙ্গে আপস করে মহামারি বিস্তারের শত পথ খুলে দেয়া যাবে না। অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশের সংক্রমণ বা মৃত্যুর হিসাব দেখে শান্ত থাকার কোন কারণ নেই।

অন্যদিকে করোনা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসায় চিকিৎসক-পুলিশ সংক্রমিত ব্যক্তির বাড়ি লকডাউন করতে গিয়েছিলেন। এ সময় জানা গেল, ওই ব্যক্তি বোরো ধান কাটতে পাশের হাওরে চলে গেছেন। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নের জায়ফরনগর গ্রামের ঘটনা এটি। এক্ষেত্রে দেখতে হবে নমুনা জমা দেয়ার চার-পাঁচ দিন পর যদি রেজাল্ট আসে, তো করোনা বহনকারী ওই চার-পাঁচ দিন হেঁটে হেঁটে করোনা বিতরণ করবেই। ইতোপূর্বে আমরা খবর দেখেছি, করোনা পজিটিভ রোগী ইদ্রিস আলী কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। মৌলভীবাজারের জায়ফরনগর গ্রামের ওই ব্যক্তি ধান কাটতে গেছে ভালো কথা, আরেকটু খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, ধান কাটতে কাটতে একটি বিড়ি ২-৩ জন মিলে ভাগ করে খেয়েছে! এভাবে চললে মহামারির নতুন আঘাত সামলানো অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠবে।

মাস্ক পরাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় সাধারণ মানুষের অনীহা ও অবহেলায় আক্রান্ত ও মৃত্যু পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার একটা বড় কারণ। অথচ গত বছর মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ সতর্কতা দেখা গিয়েছিল, সেটি আর এবার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দিচ্ছে। আমরা মনে করি, সারা দেশে লকডাউন বিজ্ঞানসম্মত নয়। লকডাউন দিতে হবে জনগণের চলাচল সীমিত করার জন্য। যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ বেশি, সেখানে লকডাউন দেয়া যুক্তিযুক্ত। ওই সব এলাকা থেকে যাতে অন্যখানে সংক্রমণ না ঘটে। কিন্তু সারাদেশে একযোগে লকডাউন মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। যেসব এলাকায় সংক্রমণ কম, সেখানে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। এতে শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

এর বাইরে আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়া কিংবা কিছুই না থাকলে কনুই ভাঁজ করে হাতের আস্তিন দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। এটি খুবই সাধারণ শিষ্টাচারের বিষয়। অবশ্য এ শিষ্টাচারের শিক্ষা মানুষ পরিবার থেকেই পায়। যেখানে সেখানে থু-তু না ফেলাও এ শিষ্টাচারের অংশ। এছাড়া সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি কাজ করে।

বর্তমানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশের মানুষের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সাধারণ শিষ্টাচার মেনে চলাসহ সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। মানুষ যদি তাদের পূর্বের অভ্যাস, আচরণ ও কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে তা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ও সংক্রমণে সহায়ক হবে- এ কথা বলাই বাহুল্য।

abunoman1972@gmail.com