জমি-জমা বণ্টন কেন, কখন, কীভাবে?

সিরাজ প্রামাণিক

জমি বণ্টন বা ভাগ-বাটোয়ারা সম্পর্কিত যে মামলা আদালতে করা হয় সেগুলো বিভাগ বণ্টন মামলা, বাটোয়ারা মামলা, পারটিশান স্যুট বা বিভাগ মামলা নামে অভিহিত। পৈতৃক সম্পত্তি ওয়ারিশদের মাঝে সমবণ্টন না হলে কিংবা ফিতা বণ্টন চিহ্নিত না হলে কিংবা জমির সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ হলে কিংবা সম্পত্তি অন্যান্য শরিকরা জোর করে দখলে রাখলে, প্রাপ্য অংশ কম কিংবা প্রাপ্য অংশ দিতে অস্বীকার করলে সাধারণত এ মামলার উদ্ভব হয়।

আইনটি পার্টিশন অ্যাক্ট-১৮৯৩ নামে পরিচিত। এ মামলাগুলো রক্তসম্পর্কীয় শরিকদের সাথে বেশি হয়ে থাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আপনাদের মাঝে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

নয়ন আর চয়ন দুই ভাই। তার বাবার মোট ১৪ বিঘা জমি আছে। বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাইয়ের মধ্যে এ সম্পত্তি সমভাবে বণ্টিত হবে, আইনও তাই বলে। কিন্তু নয়নের ৮ বিঘা আর চয়নের নামে ৬ বিঘা জমি আরএস রেকর্ডে প্রস্তুত হয়। সে অনুযায়ী তারা জমি ভোগ দখলরত অবস্থায় আছে। এক্ষেত্রে চয়নের যেকোন ওয়ারিশ বাদী হয়ে, নয়ন বা নয়নের যেকোনো ওয়ারিশকে বিবাদী করে সমবণ্টনের নিমিত্তে বিভাগ বণ্টন মামলা করতে পারে। আদালতের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন করে নিলে জটিলতা কম থাকে বলে আদালতে এ মামলার সংখ্যাও বেশি।

সম্পত্তির শরিক দুই ধরনের। এক- উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক; যা ইংরেজিতে কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিটেন্স বলা হয়। আর দ্বিতীয়টি খরিদ সূত্রে শরিক; যা ইংরেজিতে কো-শেয়ারার বাই পারচেজ বলা হয়। বাটোয়ারা মামলা করার সময় সব অংশীদারকে মামলায় পক্ষভুক্ত করতে হয়। কোনো একজন শরিক বাদ থাকলে বণ্টননামা শুদ্ধ হয় না। এ মামলা করতে হলে কিন্তু সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র যেমন ভূমি জরিপ খতিয়ান, নামজারি খতিয়ান, মালিকানা দলিল, উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।

সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে ভাগবণ্টন করে বণ্টননামা দলিল করে নেয়াই ভালো। তবে দলিলটি অবশ্যই রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে। কারণ ওয়ারিশি সম্পত্তির নামজারি করতে, বিক্রি করতে, রেকর্ড করাতে, ব্যাংক থেকে লোন করাতে গেলে, ভবিষ্যতে মামলা মোকদ্দমা থেকে বাঁচতে বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি অবশ্যই দরকার হবে। এ মামলায় বিরোধ দেখা দেওয়ার ছয় বছরের মধ্যে আদালতে যেতে হয়। নতুবা তামাদি দোষে বারিত হয়ে যায়। এ মোকদ্দমা চলাকালে কেউ মারা গেলে সেই মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মামলায় পক্ষভুক্ত করতে হয়।

বাটোয়ারা মামলা করার পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে যে, সম্পত্তি আগে উইল বা হেবা করা হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তাহলে উইলের ক্ষেত্রে ১/৩ অংশ বাদ দিয়ে কিংবা হেবা করা হলে হেবার দলিলে যে পরিমাণ মালিকানা আছে সেটা বাদ দিয়ে অন্য সহ-শরিকের অংশ বের করতে হবে। আপনাদের জানিয়ে রাখি, এ মামলায় দুইবার ডিক্রি হয়।

প্রাথমিক ডিক্রির পর বণ্টন না করা হলে আদালত অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ করে অংশ নির্ধারণ করে দেন এবং চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদান করেন। মামলা চলাকালীন আদালতের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। বণ্টন ডিক্রি পাওয়ার পরও দখল না পেলে কিংবা পক্ষগণ দখল বুঝিয়ে না দিলে কিংবা হিস্যা বুঝিয়ে না দিলে ‘উচ্ছেদের মামলা’ করা যেতে পারে, স্বত্ব দখলের মামলা করা যেতে পারে।

এছাড়া অংশীদারদের ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট ও নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা যেতে পারে। ভয়-ভীতি-হুমকি ও জীবননাশের আশঙ্কায় আদালতে ফৌজদারি মামলাও করা যায়। এ মামলা করার আগে মনে রাখবেন, বর্তমান রেকর্ড যদি বাদীর নাম বা তার পূর্বসূরীর নামে না থাকে কিংবা খতিয়ানে যেভাবে উল্লেখ আছে তা নালিশি সম্পত্তির সাথে না মিলে থাকে তাহলে বাদীর স্বত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। সুতরাং স্বত্বের আবেদন না করে শুধু পার্টিশন মামলা করলে মামলা খারিজ হতে পারে। এ বিষয়ে ১৭ বিএলডি, ১৭৯ পৃষ্ঠায় অ্যাপিলেড ডিভিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে।

আর পার্টিশন মামলায় বর্তমান রেকর্ডেড মালিককে অবশ্যই পক্ষ করতে হবে কেননা এই পক্ষভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্যথায় মামলা খারিজ হবে বলে ৩৭ ডিএলআর, ২১৬ পৃষ্ঠায় অ্যাপিলেড ডিভিশনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে।

তাছাড়া রেকর্ডেড মালিকের পক্ষভুক্তি ছাড়াই যদি মামলার বাদী ডিক্রিপ্রাপ্ত হন এবং সেই ডিক্রি রদ করার জন্য রেকর্ডেড মালিক আবেদন করলে উক্ত ডিক্রি বাতিল হবেÑ এমনটিই আইনে বলা আছে।

[লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট]

seraj.pramanik@gmail.com

সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১ , ৬ বৈশাখ ১৪২৮ ৬ রমজান ১৪৪২

জমি-জমা বণ্টন কেন, কখন, কীভাবে?

সিরাজ প্রামাণিক

জমি বণ্টন বা ভাগ-বাটোয়ারা সম্পর্কিত যে মামলা আদালতে করা হয় সেগুলো বিভাগ বণ্টন মামলা, বাটোয়ারা মামলা, পারটিশান স্যুট বা বিভাগ মামলা নামে অভিহিত। পৈতৃক সম্পত্তি ওয়ারিশদের মাঝে সমবণ্টন না হলে কিংবা ফিতা বণ্টন চিহ্নিত না হলে কিংবা জমির সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ হলে কিংবা সম্পত্তি অন্যান্য শরিকরা জোর করে দখলে রাখলে, প্রাপ্য অংশ কম কিংবা প্রাপ্য অংশ দিতে অস্বীকার করলে সাধারণত এ মামলার উদ্ভব হয়।

আইনটি পার্টিশন অ্যাক্ট-১৮৯৩ নামে পরিচিত। এ মামলাগুলো রক্তসম্পর্কীয় শরিকদের সাথে বেশি হয়ে থাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আপনাদের মাঝে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

নয়ন আর চয়ন দুই ভাই। তার বাবার মোট ১৪ বিঘা জমি আছে। বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাইয়ের মধ্যে এ সম্পত্তি সমভাবে বণ্টিত হবে, আইনও তাই বলে। কিন্তু নয়নের ৮ বিঘা আর চয়নের নামে ৬ বিঘা জমি আরএস রেকর্ডে প্রস্তুত হয়। সে অনুযায়ী তারা জমি ভোগ দখলরত অবস্থায় আছে। এক্ষেত্রে চয়নের যেকোন ওয়ারিশ বাদী হয়ে, নয়ন বা নয়নের যেকোনো ওয়ারিশকে বিবাদী করে সমবণ্টনের নিমিত্তে বিভাগ বণ্টন মামলা করতে পারে। আদালতের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন করে নিলে জটিলতা কম থাকে বলে আদালতে এ মামলার সংখ্যাও বেশি।

সম্পত্তির শরিক দুই ধরনের। এক- উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক; যা ইংরেজিতে কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিটেন্স বলা হয়। আর দ্বিতীয়টি খরিদ সূত্রে শরিক; যা ইংরেজিতে কো-শেয়ারার বাই পারচেজ বলা হয়। বাটোয়ারা মামলা করার সময় সব অংশীদারকে মামলায় পক্ষভুক্ত করতে হয়। কোনো একজন শরিক বাদ থাকলে বণ্টননামা শুদ্ধ হয় না। এ মামলা করতে হলে কিন্তু সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র যেমন ভূমি জরিপ খতিয়ান, নামজারি খতিয়ান, মালিকানা দলিল, উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।

সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে ভাগবণ্টন করে বণ্টননামা দলিল করে নেয়াই ভালো। তবে দলিলটি অবশ্যই রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে। কারণ ওয়ারিশি সম্পত্তির নামজারি করতে, বিক্রি করতে, রেকর্ড করাতে, ব্যাংক থেকে লোন করাতে গেলে, ভবিষ্যতে মামলা মোকদ্দমা থেকে বাঁচতে বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি অবশ্যই দরকার হবে। এ মামলায় বিরোধ দেখা দেওয়ার ছয় বছরের মধ্যে আদালতে যেতে হয়। নতুবা তামাদি দোষে বারিত হয়ে যায়। এ মোকদ্দমা চলাকালে কেউ মারা গেলে সেই মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মামলায় পক্ষভুক্ত করতে হয়।

বাটোয়ারা মামলা করার পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে যে, সম্পত্তি আগে উইল বা হেবা করা হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তাহলে উইলের ক্ষেত্রে ১/৩ অংশ বাদ দিয়ে কিংবা হেবা করা হলে হেবার দলিলে যে পরিমাণ মালিকানা আছে সেটা বাদ দিয়ে অন্য সহ-শরিকের অংশ বের করতে হবে। আপনাদের জানিয়ে রাখি, এ মামলায় দুইবার ডিক্রি হয়।

প্রাথমিক ডিক্রির পর বণ্টন না করা হলে আদালত অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ করে অংশ নির্ধারণ করে দেন এবং চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদান করেন। মামলা চলাকালীন আদালতের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। বণ্টন ডিক্রি পাওয়ার পরও দখল না পেলে কিংবা পক্ষগণ দখল বুঝিয়ে না দিলে কিংবা হিস্যা বুঝিয়ে না দিলে ‘উচ্ছেদের মামলা’ করা যেতে পারে, স্বত্ব দখলের মামলা করা যেতে পারে।

এছাড়া অংশীদারদের ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট ও নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা যেতে পারে। ভয়-ভীতি-হুমকি ও জীবননাশের আশঙ্কায় আদালতে ফৌজদারি মামলাও করা যায়। এ মামলা করার আগে মনে রাখবেন, বর্তমান রেকর্ড যদি বাদীর নাম বা তার পূর্বসূরীর নামে না থাকে কিংবা খতিয়ানে যেভাবে উল্লেখ আছে তা নালিশি সম্পত্তির সাথে না মিলে থাকে তাহলে বাদীর স্বত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। সুতরাং স্বত্বের আবেদন না করে শুধু পার্টিশন মামলা করলে মামলা খারিজ হতে পারে। এ বিষয়ে ১৭ বিএলডি, ১৭৯ পৃষ্ঠায় অ্যাপিলেড ডিভিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে।

আর পার্টিশন মামলায় বর্তমান রেকর্ডেড মালিককে অবশ্যই পক্ষ করতে হবে কেননা এই পক্ষভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্যথায় মামলা খারিজ হবে বলে ৩৭ ডিএলআর, ২১৬ পৃষ্ঠায় অ্যাপিলেড ডিভিশনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে।

তাছাড়া রেকর্ডেড মালিকের পক্ষভুক্তি ছাড়াই যদি মামলার বাদী ডিক্রিপ্রাপ্ত হন এবং সেই ডিক্রি রদ করার জন্য রেকর্ডেড মালিক আবেদন করলে উক্ত ডিক্রি বাতিল হবেÑ এমনটিই আইনে বলা আছে।

[লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট]

seraj.pramanik@gmail.com