লকডাউনে নারী চিকিৎসকের পরিচয়পত্র দেখতে গিয়ে তোলপাড়

পাল্টাপাল্টি বিবৃতি আদালতে ধর্ণা

লকডাউন চলাকালে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে পুলিশ চেকপোস্টে এক নারী চিকিৎসকের পরিচয়পত্র দেখাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে বাকবিতণ্ডার ঘটনা নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাকবিতণ্ডার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনার ব্যাপারে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এক আইনজীবী। এছাড়াও পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন।

রোববার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি বিধিনিষেধের পঞ্চম দিনে ‘মুভমেন্ট পাস’ নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ান চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তা। তিনপক্ষের বাকবিতণ্ডার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ উৎসুক জনতার নানা পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য করতে দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, দুপুরে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনিকে বহনকারী গাড়ি ভ্রাম্যমাণ আদালতের চেকপোস্টে থামিয়ে পুলিশ তার আইডি কার্ড দেখতে চায়। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসন অফিসের সহকারী কমিশনার শেখ মো. মামুনুর রশিদ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছিলেন। অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনি সঙ্গে আইডি কার্ড আনেননি বলে জানান। এ সময় জেনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জিজ্ঞাসা করেন, ডাক্তারের মুভমেন্ট পাস লাগে? তিনি গাড়িতে বিএসএমএমইউ স্টিকার ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তার লিখিত পাস দেখান। এরপরও পুলিশ তার কাছে আইডি কার্ড দেখতে চায়। এ সময় ডা. জেনি আরও উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে বলেন, ‘আমি ডাক্তার। করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি। আপনারা কয়জন মরছেন। আমরা ১৩০ জন মরেছি।’ ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আপনি ধমক দিচ্ছেন কেন? আমরা প্রশাসনের লোক। আপনার কাছে আইডি কার্ড দেখতে চাইতে পারি। এ নিয়ে কিছুক্ষণ দুই পক্ষে তর্ক-বিতর্ক হয়। চিকিৎসক জেনি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলতে থাকেন, ‘ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে।’ তখন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘কোন ডাক্তার হয়রানি হচ্ছে না।’

এরপর একজন মন্ত্রী ফোন করেছেন বলে মোবাইল ফোন ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে এগিয়ে দেন চিকিৎসক জেনি। কিছু সময় কথা বলার পর মোবাইল তার কাছে ফেরত দেন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশিদ।

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি প্রশাসনের লোক। ইউনিফর্ম থাকার পরও সঙ্গে আইডি কার্ড আছে।’ তখন চিকিৎসক বলেন, ‘আমি ডাক্তার। গায়ে অ্যাপ্রোন আছে। এরপর চিকিৎসক জেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে ফোন দিয়ে কথা বলতে বলেন কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয়বার কথা বলেননি। তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। চিকিৎসক জেনি দীর্ঘ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশকে স্যরি বলতে বলেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ স্যরি বলেছে কিনা, তা জানা যায়নি। চিকিৎসক-ম্যাজিস্ট্রেটের বিতণ্ডার ভিডিওটি মুহূর্তে ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এ ঘটনা নিয়ে গতকাল দুইটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদে বলা হয়; ১৮ এপ্রিল দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন শেষে নিজ আবাসস্থলে ফেরত যাওয়ার পথে লকডাউনে পুলিশের টহল দলের সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথনের সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়েছে। চিকিৎসক হয়রানির ঘটনায় চিকিৎসক সমাজের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে এর ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ডা. সাঈদা শওকত দায়িত্ব পালন শেষে অত্র প্রতিষ্ঠানের লোগো সংবলিত গাড়িতে থাকা অবস্থায় পরিচয় চাওয়া হলে তিনি চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত বলে পরিচয় দেন। পক্ষান্তরে, পুলিশ কর্তৃক তার চিকিৎসক পরিচিতিকে ‘ভুয়া’ বলা হয় এবং অসৌজন্যমূলকভাবে তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়।

পরবর্তীতে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের আচরণে এবং তার পরিচিতি ভুয়া হিসেবে অভিহিত করার প্রেক্ষিতে ডা. সাঈদা শওকত বিক্ষুব্ধ হন এবং পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন, যার খণ্ডকালীন সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, রমনা ডিভিশন এবং ওসি, নিউমার্কেট থানার সঙ্গে মৌখিক আলোচনা হয়েছে।

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে দেশ সেবায় নিবেদিত চিকিৎসককে অপমান ও অপদস্থ করার কারণে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, যা দেশব্যাপী চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করার শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উক্ত ঘটনার মাধ্যমে একজন মহিলা চিকিৎসককে হয়রানি করার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে চলমান করোনা চিকিৎসার স্বার্থে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্বিঘে্ন চলাচল নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছে।

অপরদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলমের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্রে ১৮ এপ্রিল এলিফ্যান্ট রোডে মাঠ পর্যায়ের কর্মরত পুলিশ সদস্যদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়; একজন বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে চেকপোস্ট চলাকালে চিকিৎসককে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র দেখাতে বললে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। যা একজন পেশাদার ও সচেতন নাগরিকের কাছ থেকে কোনভাবে কাম্য নয়। তিনি শুধু পুলিশ সদস্যদের অপমান করেননি, গোটা পুলিশ বাহিনীকে কটাক্ষ ও হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। শুধু তাই না, তিনি নিজ পেশার পরিচয় বাদ দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক পরিচয় তুলে ধরে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন এবং জাতির সামনে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করেছেন। প্রতিবাদে আরও বলা হয়, ওই চিকিৎসক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাদানুবাদকালে যে শব্দ প্রয়োগ করেছেন তা অত্যন্ত অরুচিকর।

এদিকে স্বাধীনতা (স্বাচিপ) চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব প্রফেসর এমএ আজিজ এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাই। পরিচয় দেখানোর পরও একজন চিকিৎসককে ভুয়া ডাক্তার বলা হয়েছে। তিনি ঘটনায় জড়িতদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

এদিকে একজন আইনজীবী পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও নারী চিকিৎসকের বাকবিতণ্ডার ঘটনা হাইকোর্টের নজরে আনলে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ বলেন, যেহেতু বিষয়টি ডাক্তার নিজেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। আদালতে আসতে চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আসতে হবে। আদালত আইনজীবীকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কে? যদি আসতে হয়, উনি (ডাক্তার) আসবেন। তখন দেখা যাবে।’

গতকাল হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চে অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ ওই ঘটনা নজরে আনেন। অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ আদালতকে বলেন, লকডাউনে মুভমেন্ট পাস নিয়ে চিকিৎসক-পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বাকবিতণ্ডার ঘটনায় ডাক্তারকে হেনস্তা করা হয়েছে এমন ঘটনা নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমি জনস্বার্থে এই ঘটনা আপনাদের (আদালতের) কাছে উপস্থাপন করছি। পরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ বলে, যেহেতু বিষয়টি ডাক্তার নিজেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। আদালতে আসতে চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আসতে হবে।

মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল ২০২১ , ৭ বৈশাখ ১৪২৮ ৭ রমজান ১৪৪২

লকডাউনে নারী চিকিৎসকের পরিচয়পত্র দেখতে গিয়ে তোলপাড়

পাল্টাপাল্টি বিবৃতি আদালতে ধর্ণা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

লকডাউন চলাকালে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে পুলিশ চেকপোস্টে এক নারী চিকিৎসকের পরিচয়পত্র দেখাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে বাকবিতণ্ডার ঘটনা নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাকবিতণ্ডার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনার ব্যাপারে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এক আইনজীবী। এছাড়াও পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন।

রোববার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি বিধিনিষেধের পঞ্চম দিনে ‘মুভমেন্ট পাস’ নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ান চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তা। তিনপক্ষের বাকবিতণ্ডার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ উৎসুক জনতার নানা পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য করতে দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, দুপুরে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনিকে বহনকারী গাড়ি ভ্রাম্যমাণ আদালতের চেকপোস্টে থামিয়ে পুলিশ তার আইডি কার্ড দেখতে চায়। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসন অফিসের সহকারী কমিশনার শেখ মো. মামুনুর রশিদ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছিলেন। অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনি সঙ্গে আইডি কার্ড আনেননি বলে জানান। এ সময় জেনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জিজ্ঞাসা করেন, ডাক্তারের মুভমেন্ট পাস লাগে? তিনি গাড়িতে বিএসএমএমইউ স্টিকার ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তার লিখিত পাস দেখান। এরপরও পুলিশ তার কাছে আইডি কার্ড দেখতে চায়। এ সময় ডা. জেনি আরও উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে বলেন, ‘আমি ডাক্তার। করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি। আপনারা কয়জন মরছেন। আমরা ১৩০ জন মরেছি।’ ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আপনি ধমক দিচ্ছেন কেন? আমরা প্রশাসনের লোক। আপনার কাছে আইডি কার্ড দেখতে চাইতে পারি। এ নিয়ে কিছুক্ষণ দুই পক্ষে তর্ক-বিতর্ক হয়। চিকিৎসক জেনি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলতে থাকেন, ‘ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে।’ তখন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘কোন ডাক্তার হয়রানি হচ্ছে না।’

এরপর একজন মন্ত্রী ফোন করেছেন বলে মোবাইল ফোন ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে এগিয়ে দেন চিকিৎসক জেনি। কিছু সময় কথা বলার পর মোবাইল তার কাছে ফেরত দেন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশিদ।

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি প্রশাসনের লোক। ইউনিফর্ম থাকার পরও সঙ্গে আইডি কার্ড আছে।’ তখন চিকিৎসক বলেন, ‘আমি ডাক্তার। গায়ে অ্যাপ্রোন আছে। এরপর চিকিৎসক জেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে ফোন দিয়ে কথা বলতে বলেন কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয়বার কথা বলেননি। তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। চিকিৎসক জেনি দীর্ঘ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশকে স্যরি বলতে বলেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ স্যরি বলেছে কিনা, তা জানা যায়নি। চিকিৎসক-ম্যাজিস্ট্রেটের বিতণ্ডার ভিডিওটি মুহূর্তে ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এ ঘটনা নিয়ে গতকাল দুইটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদে বলা হয়; ১৮ এপ্রিল দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন শেষে নিজ আবাসস্থলে ফেরত যাওয়ার পথে লকডাউনে পুলিশের টহল দলের সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথনের সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়েছে। চিকিৎসক হয়রানির ঘটনায় চিকিৎসক সমাজের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে এর ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ডা. সাঈদা শওকত দায়িত্ব পালন শেষে অত্র প্রতিষ্ঠানের লোগো সংবলিত গাড়িতে থাকা অবস্থায় পরিচয় চাওয়া হলে তিনি চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত বলে পরিচয় দেন। পক্ষান্তরে, পুলিশ কর্তৃক তার চিকিৎসক পরিচিতিকে ‘ভুয়া’ বলা হয় এবং অসৌজন্যমূলকভাবে তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়।

পরবর্তীতে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের আচরণে এবং তার পরিচিতি ভুয়া হিসেবে অভিহিত করার প্রেক্ষিতে ডা. সাঈদা শওকত বিক্ষুব্ধ হন এবং পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন, যার খণ্ডকালীন সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, রমনা ডিভিশন এবং ওসি, নিউমার্কেট থানার সঙ্গে মৌখিক আলোচনা হয়েছে।

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে দেশ সেবায় নিবেদিত চিকিৎসককে অপমান ও অপদস্থ করার কারণে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, যা দেশব্যাপী চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করার শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উক্ত ঘটনার মাধ্যমে একজন মহিলা চিকিৎসককে হয়রানি করার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে চলমান করোনা চিকিৎসার স্বার্থে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্বিঘে্ন চলাচল নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছে।

অপরদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলমের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্রে ১৮ এপ্রিল এলিফ্যান্ট রোডে মাঠ পর্যায়ের কর্মরত পুলিশ সদস্যদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়; একজন বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে চেকপোস্ট চলাকালে চিকিৎসককে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র দেখাতে বললে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। যা একজন পেশাদার ও সচেতন নাগরিকের কাছ থেকে কোনভাবে কাম্য নয়। তিনি শুধু পুলিশ সদস্যদের অপমান করেননি, গোটা পুলিশ বাহিনীকে কটাক্ষ ও হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। শুধু তাই না, তিনি নিজ পেশার পরিচয় বাদ দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক পরিচয় তুলে ধরে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন এবং জাতির সামনে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করেছেন। প্রতিবাদে আরও বলা হয়, ওই চিকিৎসক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাদানুবাদকালে যে শব্দ প্রয়োগ করেছেন তা অত্যন্ত অরুচিকর।

এদিকে স্বাধীনতা (স্বাচিপ) চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব প্রফেসর এমএ আজিজ এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাই। পরিচয় দেখানোর পরও একজন চিকিৎসককে ভুয়া ডাক্তার বলা হয়েছে। তিনি ঘটনায় জড়িতদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

এদিকে একজন আইনজীবী পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও নারী চিকিৎসকের বাকবিতণ্ডার ঘটনা হাইকোর্টের নজরে আনলে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ বলেন, যেহেতু বিষয়টি ডাক্তার নিজেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। আদালতে আসতে চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আসতে হবে। আদালত আইনজীবীকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কে? যদি আসতে হয়, উনি (ডাক্তার) আসবেন। তখন দেখা যাবে।’

গতকাল হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চে অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ ওই ঘটনা নজরে আনেন। অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ আদালতকে বলেন, লকডাউনে মুভমেন্ট পাস নিয়ে চিকিৎসক-পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বাকবিতণ্ডার ঘটনায় ডাক্তারকে হেনস্তা করা হয়েছে এমন ঘটনা নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমি জনস্বার্থে এই ঘটনা আপনাদের (আদালতের) কাছে উপস্থাপন করছি। পরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ বলে, যেহেতু বিষয়টি ডাক্তার নিজেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। আদালতে আসতে চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আসতে হবে।