মামলা ১৩০টি, গ্রেপ্তার ৭৯৯৯ হেফাজত নেতাকর্মী 

২০১৩ সালে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো সচল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশের আকস্মিক এ তৎপরতায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তেই হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মামলাগুলো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে অভিমত পুলিশ কর্মকর্তাদের। এছাড়া গত ২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা যে সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে দেশের বাইরে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং) হায়দার আলী সংবাদকে জানান, রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন সময়ে হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী মিলিয়ে ৩০৪৪ জনের নাম এজাহারে আছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামিও আছে। এ পর্যন্ত হেফাজতের ৭৯৯ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের একাধিক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হতে পারেন। মাওলানা মামুনুল হকের গ্রেপ্তারে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসে তা পর্যালোচনা করে গ্রেপ্তার অভিযান চলমান রাখবে পুলিশ। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের যেসব শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদের প্রত্যেককেই গ্রেপ্তার করবে পুলিশ। কোন অবস্থাতেই হেফাজত নেতাদের ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের হাইকমান্ডও এ বিষয়ে ব্যাপক কঠোর অবস্থানে আছেন।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম ও ধর্মীয় নানা ইস্যুতে গড়ে ওঠা এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৮ বছর আগের মামলাগুলোর বিষয়ে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠেছে। এতদিন মামলাগুলো হিমাগারে থাকলেও গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী এবং মুজিব জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা ঘটানোর কারণে হেফাজত ইস্যুতে এ অবস্থান পুলিশের। পুরনো মামলা ও নতুন মামলা মিলিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে হেফাজত নেতাকর্মীদের। তালিকা অনুযায়ী সহিংসতার মামলায় যেসব হেফাজত নেতাকর্মী আসামি তাদের ধরতে সারাদেশেই চলছে পুলিশি অভিযান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালে ৫ মে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলাম সমাবেশ ডাকে। ওই সমাবেশকে ঘিরে সারাদেশে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। রাজধানীতে সড়কের গাছ কাটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেয়া এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে হেফাজত নেতাকর্মীরা। ঢাকায় এ সহিংসতার সূত্র ধরে ঢাকার বাইরেও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে ৯২টি মামলা হয়। এসব মামলার অধিকাংশ পুলিশ বাদী হয়। মামলায় সে সময় হেফাজতের তৎকালীন আমির আল্লামা আহমেদ শফীকে আসামি না করলেও অন্য সব শীর্ষ নেতাকে আসামি করা হয়। তখন তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, প্রয়াত মুফতি আমিনীসহ অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হন। তবে এরপরই মামলার তদন্ত কার্যক্রম এবং হেফাজত নেতা বিশেষ করে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার অভিযান থমকে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ও সমাবেশকে ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলেও পরবর্তীতে তা আপোষ হয়ে যায়। সে সময় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কার্যক্রমও থমকে যায়। সরকারের সঙ্গে হেফাজত নেতাদের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে হেফাজতের ওই সমাবেশে সহিংসতার ঘটনা তাদের ভুল ছিল স্বীকার করে মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানান। সে সময় তারা সরকারের সঙ্গে থাকারও ঘোষণা দেন। সরকার হেফাজতের বেশকিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে।

সূত্র মতে, এতদিন চুপচাপ থাকলেও গত ২৬ মে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মোদিবিরোধী এ সমাবেশ থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই সংঘাতের সূত্র ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে সারাদেশে সংঘাত-সংঘর্ষে সরকারি সম্পদ ও জনসাধারণের সম্পদে আগুন দেয়া, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় ১৭ জনের। এসব ঘটনায় সারাদেশে কিছু মামলা হয়। সব মিলিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। এর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় হেফাজত। ওই সমাবেশ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। সব মিলিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

একাধিক নেতা নজরদারিতে

হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির ৯ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া জেলা ও উপজেলা মিলিয়ে এবং হেফাজতের কমিটিতে না থাকলেও কর্মকা-ে সমর্থন করেন এমন কিছু মিলিয়ে মোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ২০১৩ সালে ঢাকা অবরোধ পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় ৮ বছর আগের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী উদ্যাপন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায়। সূত্রমে হেফাজতের আরও ৩৫ নেতা নজরদারিতে আছেন, যাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় নেতা আছেন অন্তত ২৫ জন। নজরদারিতে থাকা এসব নেতার প্রায় সবাই ২০১৩ সালে সহিংসতার ঘটনায় কোন না কোন মামলার আসামি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার মামলায়ও অনেকে আসামি। ওই তিনদিনের সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৭টি মামলা হয়েছে। তাতে আসামি ৪৯ হাজারের বেশি।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে গত ২৬ ও ২৭ মার্চ বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি এলাকায় সহিংসতায় জড়ায় হেফাজতে ইসলাম। পুলিশের সঙ্গে সহিংসতার জেরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এসব এলাকায়। এ সময় সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ গুলি চালালে ১৭ জনের মৃত্যু হয় যাদের অধিকাংশই হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ বিভিন্ন এলাকায় মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজতের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এসব সহিংসতার পরবর্তীতে গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক এক নারীসহ অবরুদ্ধ করার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘাত ঘটে। ওই ঘটনার পর পরই সারাদশে সহিংসতার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে ৪টি মামলা হয়। এরপর রাজধানীতে ৩টি মামলা হয়। মামুনুলের ঘটনার পর পরই হেফাজতে ইসলাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানে নামে পুলিশ। ২০১৩ সালের মামলায় অধিকাংশকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১ সপ্তাহে হেফাজতের শীর্ষ ১২ নেতাসহ ১৯ নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মোহাম্মদপুরের একটি পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা মামুনুল হককে। এর আগে ১২ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে গ্রেপ্ততারের পর তাকে ঢাকার ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ২০১৩ সালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে রিমান্ড হেফাজতে নেয় ডিবি। একই দিন গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৪ এপ্রিল আদালত তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তার বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যে নাশকতা করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে তিনি মদত দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিরোধী ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ১২ এপ্রিল ময়মনসিংহের সানকিপাড়া এলাকার সেনবাড়ি রোড থেকে হেফাজতে ইসলামের অনুসারী ও প্রভাবশালী বক্তা ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানীকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানী হেফাজতের কোন সাংগঠনিক পদে না থাকলেও তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী হেফাজত নেতা এবং স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি উপস্থিত থাকেন বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ। ফেইসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস প্রদান এবং সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগে গত ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় হেফাজতে ইসলামের অনুসারী ও স্থানীয় মতুর্জাবাদ জামে মসজিদের খতিব লোকমান হোসেন আমিনীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে ১১ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। হেফাজতে ইসলামের সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজীকে ১৪ এপ্রিল রাজধানীর লালবাগ থেকে ডিবির একটি টিম গ্রেপ্তার করে। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর একাধিক থানায় কয়েকটি মামলায় এবং ২০১৩ সালের ৬ মে যাত্রাবাড়ী থানায় এক মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর গ্রীন রোড এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীকে (৫৫) গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৩ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মুফতি বশির উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মুফতি বশির উল্লাহর বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ হেফাজতের ডাকা হরতালে নেতৃত্ব দেয়া হরতালে লাঠি, রড, ইটপাটকেল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, যানবাহন ভাঙচুর করার অভিযোগ আনা হয়। এর আগে ১২ এপ্রিল ২০১৩ সালের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফ উল্লাহকে। ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয় হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহসভাপতি মাওলানা জুবায়েরকে। ২০১৩ সালের মামলায় ১৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিনকে। একই দিন গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্র্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি আল্লামা জুনায়েদ আল হাবিবকে।৭ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের সমর্থক ও ধর্মীয় বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানীকে রাষ্ট্রবিরোধী ও উসকানিমূলক কথাবার্তা এবং রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে কটাক্ষ করার অভিযোগে নেত্রকোনা থেকে আটক করা হয়। পরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাছা থানায় তার বিরুদ্ধে একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এছাড়া রাজধানীর মতিঝিল থানাও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে হেফাজতে ইসলামের সাবেক প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম ও হেফাজত নেতা আতাউল করীম মাকসুদকেও গ্রেপ্তার করে। নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টে ভাঙচুর ও মহাসড়কে নাশকতা সৃষ্টির মামলায় ১২ এপ্রিল রাজধানীর জুরাইন থেকে হেফাজতের ৪ মাওলানা ইকবাল (প্রধান আসামি), মাওলানা মহিউদ্দিন, মাওলানা শাহজাহান শিবলী ও মাওলানা মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার হয়।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের সহিংসতার পর ঢাকাসহ সাত জেলায় ৮৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। তবে হেফাজতের তৎকালীন আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে কোন মামলাতেই আসামি করা হয়নি। হেফাজত ছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। মামলায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন মহাসচিব বর্তমানে আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাস, বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েক শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তারা জামিন পান। রাজধানীতে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে ৪টি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বাকি ৪৯টি মামলা তদন্তের পর্যায়ে পড়ে রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় আড়াইশ’ নেতার নামসহ অন্তত ৪০ হাজার লোক আসামি। ঢাকার ঘটনার পরদিন ৬ মে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সড়ক অবরোধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানার পুলিশ একটি মামলা করে। মামলায় ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আসামিরা সবাই স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী এবং হেফাজতের সমর্থক। বাগেরহাটে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দু’জন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত, স্থানীয় বিএনপির ৮৮নেতা-কর্মীসহ ১০-১২ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-শিমরাইল এলাকায় হেফাজত নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষ এবং নিহত হওয়ার ঘটনায় সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাতটি মামলা হয়।

মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল ২০২১ , ৭ বৈশাখ ১৪২৮ ৭ রমজান ১৪৪২

রাজধানীসহ সারাদেশে

মামলা ১৩০টি, গ্রেপ্তার ৭৯৯৯ হেফাজত নেতাকর্মী 

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

২০১৩ সালে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো সচল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশের আকস্মিক এ তৎপরতায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তেই হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মামলাগুলো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে অভিমত পুলিশ কর্মকর্তাদের। এছাড়া গত ২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা যে সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে দেশের বাইরে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং) হায়দার আলী সংবাদকে জানান, রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন সময়ে হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী মিলিয়ে ৩০৪৪ জনের নাম এজাহারে আছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামিও আছে। এ পর্যন্ত হেফাজতের ৭৯৯ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের একাধিক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হতে পারেন। মাওলানা মামুনুল হকের গ্রেপ্তারে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসে তা পর্যালোচনা করে গ্রেপ্তার অভিযান চলমান রাখবে পুলিশ। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের যেসব শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদের প্রত্যেককেই গ্রেপ্তার করবে পুলিশ। কোন অবস্থাতেই হেফাজত নেতাদের ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের হাইকমান্ডও এ বিষয়ে ব্যাপক কঠোর অবস্থানে আছেন।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম ও ধর্মীয় নানা ইস্যুতে গড়ে ওঠা এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৮ বছর আগের মামলাগুলোর বিষয়ে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠেছে। এতদিন মামলাগুলো হিমাগারে থাকলেও গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী এবং মুজিব জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা ঘটানোর কারণে হেফাজত ইস্যুতে এ অবস্থান পুলিশের। পুরনো মামলা ও নতুন মামলা মিলিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে হেফাজত নেতাকর্মীদের। তালিকা অনুযায়ী সহিংসতার মামলায় যেসব হেফাজত নেতাকর্মী আসামি তাদের ধরতে সারাদেশেই চলছে পুলিশি অভিযান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালে ৫ মে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলাম সমাবেশ ডাকে। ওই সমাবেশকে ঘিরে সারাদেশে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। রাজধানীতে সড়কের গাছ কাটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেয়া এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে হেফাজত নেতাকর্মীরা। ঢাকায় এ সহিংসতার সূত্র ধরে ঢাকার বাইরেও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে ৯২টি মামলা হয়। এসব মামলার অধিকাংশ পুলিশ বাদী হয়। মামলায় সে সময় হেফাজতের তৎকালীন আমির আল্লামা আহমেদ শফীকে আসামি না করলেও অন্য সব শীর্ষ নেতাকে আসামি করা হয়। তখন তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, প্রয়াত মুফতি আমিনীসহ অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হন। তবে এরপরই মামলার তদন্ত কার্যক্রম এবং হেফাজত নেতা বিশেষ করে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার অভিযান থমকে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ও সমাবেশকে ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলেও পরবর্তীতে তা আপোষ হয়ে যায়। সে সময় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কার্যক্রমও থমকে যায়। সরকারের সঙ্গে হেফাজত নেতাদের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে হেফাজতের ওই সমাবেশে সহিংসতার ঘটনা তাদের ভুল ছিল স্বীকার করে মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানান। সে সময় তারা সরকারের সঙ্গে থাকারও ঘোষণা দেন। সরকার হেফাজতের বেশকিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে।

সূত্র মতে, এতদিন চুপচাপ থাকলেও গত ২৬ মে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মোদিবিরোধী এ সমাবেশ থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই সংঘাতের সূত্র ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে সারাদেশে সংঘাত-সংঘর্ষে সরকারি সম্পদ ও জনসাধারণের সম্পদে আগুন দেয়া, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় ১৭ জনের। এসব ঘটনায় সারাদেশে কিছু মামলা হয়। সব মিলিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। এর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় হেফাজত। ওই সমাবেশ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। সব মিলিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

একাধিক নেতা নজরদারিতে

হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির ৯ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া জেলা ও উপজেলা মিলিয়ে এবং হেফাজতের কমিটিতে না থাকলেও কর্মকা-ে সমর্থন করেন এমন কিছু মিলিয়ে মোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ২০১৩ সালে ঢাকা অবরোধ পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় ৮ বছর আগের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী উদ্যাপন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায়। সূত্রমে হেফাজতের আরও ৩৫ নেতা নজরদারিতে আছেন, যাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় নেতা আছেন অন্তত ২৫ জন। নজরদারিতে থাকা এসব নেতার প্রায় সবাই ২০১৩ সালে সহিংসতার ঘটনায় কোন না কোন মামলার আসামি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার মামলায়ও অনেকে আসামি। ওই তিনদিনের সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৭টি মামলা হয়েছে। তাতে আসামি ৪৯ হাজারের বেশি।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে গত ২৬ ও ২৭ মার্চ বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি এলাকায় সহিংসতায় জড়ায় হেফাজতে ইসলাম। পুলিশের সঙ্গে সহিংসতার জেরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এসব এলাকায়। এ সময় সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশ গুলি চালালে ১৭ জনের মৃত্যু হয় যাদের অধিকাংশই হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ বিভিন্ন এলাকায় মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজতের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এসব সহিংসতার পরবর্তীতে গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক এক নারীসহ অবরুদ্ধ করার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘাত ঘটে। ওই ঘটনার পর পরই সারাদশে সহিংসতার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে ৪টি মামলা হয়। এরপর রাজধানীতে ৩টি মামলা হয়। মামুনুলের ঘটনার পর পরই হেফাজতে ইসলাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানে নামে পুলিশ। ২০১৩ সালের মামলায় অধিকাংশকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১ সপ্তাহে হেফাজতের শীর্ষ ১২ নেতাসহ ১৯ নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মোহাম্মদপুরের একটি পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা মামুনুল হককে। এর আগে ১২ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে গ্রেপ্ততারের পর তাকে ঢাকার ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ২০১৩ সালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে রিমান্ড হেফাজতে নেয় ডিবি। একই দিন গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৪ এপ্রিল আদালত তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তার বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যে নাশকতা করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে তিনি মদত দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিরোধী ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ১২ এপ্রিল ময়মনসিংহের সানকিপাড়া এলাকার সেনবাড়ি রোড থেকে হেফাজতে ইসলামের অনুসারী ও প্রভাবশালী বক্তা ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানীকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানী হেফাজতের কোন সাংগঠনিক পদে না থাকলেও তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী হেফাজত নেতা এবং স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি উপস্থিত থাকেন বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ। ফেইসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস প্রদান এবং সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগে গত ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় হেফাজতে ইসলামের অনুসারী ও স্থানীয় মতুর্জাবাদ জামে মসজিদের খতিব লোকমান হোসেন আমিনীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে ১১ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। হেফাজতে ইসলামের সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজীকে ১৪ এপ্রিল রাজধানীর লালবাগ থেকে ডিবির একটি টিম গ্রেপ্তার করে। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর একাধিক থানায় কয়েকটি মামলায় এবং ২০১৩ সালের ৬ মে যাত্রাবাড়ী থানায় এক মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর গ্রীন রোড এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীকে (৫৫) গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৩ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মুফতি বশির উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মুফতি বশির উল্লাহর বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ হেফাজতের ডাকা হরতালে নেতৃত্ব দেয়া হরতালে লাঠি, রড, ইটপাটকেল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, যানবাহন ভাঙচুর করার অভিযোগ আনা হয়। এর আগে ১২ এপ্রিল ২০১৩ সালের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফ উল্লাহকে। ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয় হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহসভাপতি মাওলানা জুবায়েরকে। ২০১৩ সালের মামলায় ১৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিনকে। একই দিন গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্র্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি আল্লামা জুনায়েদ আল হাবিবকে।৭ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের সমর্থক ও ধর্মীয় বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানীকে রাষ্ট্রবিরোধী ও উসকানিমূলক কথাবার্তা এবং রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে কটাক্ষ করার অভিযোগে নেত্রকোনা থেকে আটক করা হয়। পরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাছা থানায় তার বিরুদ্ধে একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এছাড়া রাজধানীর মতিঝিল থানাও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে হেফাজতে ইসলামের সাবেক প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম ও হেফাজত নেতা আতাউল করীম মাকসুদকেও গ্রেপ্তার করে। নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টে ভাঙচুর ও মহাসড়কে নাশকতা সৃষ্টির মামলায় ১২ এপ্রিল রাজধানীর জুরাইন থেকে হেফাজতের ৪ মাওলানা ইকবাল (প্রধান আসামি), মাওলানা মহিউদ্দিন, মাওলানা শাহজাহান শিবলী ও মাওলানা মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার হয়।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের সহিংসতার পর ঢাকাসহ সাত জেলায় ৮৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। তবে হেফাজতের তৎকালীন আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে কোন মামলাতেই আসামি করা হয়নি। হেফাজত ছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। মামলায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন মহাসচিব বর্তমানে আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাস, বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েক শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তারা জামিন পান। রাজধানীতে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে ৪টি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বাকি ৪৯টি মামলা তদন্তের পর্যায়ে পড়ে রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় আড়াইশ’ নেতার নামসহ অন্তত ৪০ হাজার লোক আসামি। ঢাকার ঘটনার পরদিন ৬ মে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সড়ক অবরোধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানার পুলিশ একটি মামলা করে। মামলায় ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আসামিরা সবাই স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী এবং হেফাজতের সমর্থক। বাগেরহাটে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দু’জন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত, স্থানীয় বিএনপির ৮৮নেতা-কর্মীসহ ১০-১২ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-শিমরাইল এলাকায় হেফাজত নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষ এবং নিহত হওয়ার ঘটনায় সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাতটি মামলা হয়।