রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

মোস্তাফা জব্বার

সাত

১১ অক্টোবর আরমানিটোলায় বিরাট সভা হলো। সমস্ত ময়দান ও আশেপাশের রাস্তা লোকে ভরে গেল। শামসুল হক সাহেব বক্তৃতা করার পর বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করলেন। সভায় গোলমাল হওয়ার ভয় ছিল বলে ভাসানী সাহেব প্রথমে বক্তৃতা করেছেন। ভাসানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শোভাযাত্রা করতে হবে সেইভাবে বক্তৃতা কর। বক্তৃতা শেষ করে বললেন, “চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্ববাংলার লোক কি চায়!” শোভাযাত্র বের হলো। মওলানা সাহেব, হক সাহেব ও বঙ্গবন্ধু শোভাযাত্রার সামনে ছিলেন। যখন নবাবপুর রেলক্রসিংয়ে উপস্থিত হলেন, তখন পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বন্দুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রেলস্টেশনের দিকে মোড় নিলেন শোভাযাত্রা নিয়ে। প্ল্যান হলো নাজিরাবাজার রেললাইন পার হয়ে নিমতলিতে ঢাকা মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে আবার আরমানিটোলায় ফিরে আসবেন। নাজিরাবাজারে এসেও পুলিশ রাস্তা আটক করেছে, শোভাযাত্রা যেতে দেবে না। তখন নামাজের সময় হয়ে গেছে। মওলানা সাহেব রাস্তার ওপরই নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। শামসুল হক সাহেবও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ালেন। এর মধ্যেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। আর জনসাধারণও ইট ছুড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচ মিনিট এভাবে চলল। পুলিশ লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসছে। একদল কর্মী মওলানা সাহেবকে কোলে করে নিয়ে এক হোটেলের ভেতর রাখলেন। কয়েকজন কর্মী ভীষণভাবে আহত হলো ও গ্রেপ্তার হলো। শামসুল হক সাহেবকেও গ্রেপ্তার করল। বঙ্গবন্ধুর ওপরও অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে একপাশের নর্দমায় পড়ে গেলেন তিনি। কয়েকজন লোক ধরে রিকশায় উঠিয়ে মোগলটুলী নিয়ে আসল। পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। ইনজেকশন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে দিল, কারণ বেদনায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। প্রায় ৩০ জন লোক গ্রেপ্তার হয়েছিল। প্রায় রাত ২টায় মোগলটুলীর অফিস, যেখানে বঙ্গবন্ধু রয়েছেন, পুলিশ সেটি ঘিরে ফেলল এবং দরজা খুলতে বলল। লোহার দরজা, ভেতরে তালা-খোলা ও ভাঙা এত সহজ ছিল না। সাইফুদ্দিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধু, কাজী গোলাম মাহবুব ও মফিজকে ডেকে উঠাল এবং বলল, “পুলিশ এসেছে তোমাদের গ্রেপ্তার করতে।” বঙ্গবন্ধু যখন ঘুমিয়ে ছিলেন ইনজেকশন নিয়ে, তখন ভাসানী সাহেব খবর দিয়েছিলেন, তিনি যেন গ্রেপ্তার না হয়।

১৯৪৯ সালের অক্টোবরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংগঠনিক কাজে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। সেখানে তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে লাহোরের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত করেন। তবে দেশে ফেরার পরই তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ঢাকা জেলের সুরক্ষা বন্দী হন।

১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। আবদুর রউফ, ফজলুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। মওলানা সাহেবও জেলে ফিরে এলেন, কারণ তিনিও নিরাপত্তা বন্দি। আতাউর রহমান সাহেব, কামরুদ্দিন সাহেব ও আরও অনেকে মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ বন্দিদের পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ডিভিশন দেয়া হয়েছিল। আপিল দায়ের করলেও খাটতে হলো। কিছুদিন পর গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। মওলানা সাহেবের কাছে এতদিন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে ছেড়ে যেতে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। ঢাকা জেলে বঙ্গবন্ধুকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ হয়ে খুলনা মেলে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল বঙ্গবন্ধুকে। শেষ রাতে গোপালগঞ্জ পৌঁছলেন। পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হলো বঙ্গবন্ধুকে। সকালবেলা খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। ১০টার সময় বঙ্গবন্ধুকে কোর্টে হাজির করা হলো। অনেক লোক জমা হয়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, বঙ্গবন্ধুকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। গোপালগঞ্জ সাবজেলে ডিভিশন কয়েদি ও নিরাপত্তা বন্দী রাখার কোন ব্যবস্থাই নেই। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলেন, তারিখ পড়ে গেল। কারণ ফরিদপুর থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর এসেছেন। তিনি জানালেন, সরকার পক্ষের থেকে মামলাটা পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হলো। ফরিদপুর যেতে হবে, সেখান থেকেই মাসে মাসে আসতে হবে তাকে, মামলার তারিখের দিনে। অনেকে তাকে দেখতে এলো। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফরিদপুর জেলে এলেন। জেল কর্তৃপক্ষ পূর্বেই ডিআইজি থেকে খবর পেয়েছে। জেলগেটে পৌঁছান সকাল বেলা। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাগজপত্র দেখে বললেন আপনার তো সাজাও আছে তিন মাস। আবার নিরাপত্তা আইনেও আটকে আছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন বেশিদিন সাজা নাই, এক মাসের বেশি বোধহয় হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন।

এই প্রথম তিনি ফরিদপুর জেলে এলেন তিনি। একমাস পার হয়ে গেল। আবার গোপালগঞ্জ যাওয়ার সময় হয়েছে। এইভাবে মামলার জন্য তিন চার মাস বঙ্গবন্ধুকে যাওয়া-আসা করতে হলো ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত।

ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধু লিখলেন আমাকে বরিশাল বা খুলনা জেলে রাখলে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসা সুবিধা হবে। সোজা খুলনা বা বরিশাল থেকে জাহাজে উঠলে গোপালগঞ্জ যাওয়া যায়। কোন জায়গায় উঠা-নামা করতে হয় না। সরকার সে মতো আদেশ দিলেন, বরিশাল বা খুলনায় বঙ্গবন্ধুকে রাখতে। কর্তৃপক্ষ খুলনা জেলে পাঠিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুকে। রাজবাড়ী, যশোর হয়ে খুলনা যেতে হলো। খুলনা জেলে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন দেখলেন কোন জায়গাই নাই। একটা মাত্র দালান। তার মধ্যেই কয়েদি ও হাজতি সবাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। জেলার সাহেব বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। বললেন, ‘দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট জেল।’ বঙ্গবন্ধু বলেন আমি আবার রাজনৈতিক বন্দী হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। অন্য কোন রাজনৈতিক বন্দীও এ জেলে নাই। একটা সেলে অবশেষে রাখা হলো আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিলে তাই খেতে হতো, রোগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিঁড়া মুড়ি বিস্কুট দিয়েছিল। তাই খেয়ে বাঁচতে হত। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মামলার তারিখ। প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছেন। নিরাপত্তা আইনের বন্দীরা ছয় মাস পরপর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। বঙ্গবন্ধুকে ১৮ মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন অর্ডার এসে খুলনা জেলে পৌঁছায় নাই। বঙ্গবন্ধু বলেন জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিক্তি করে জেলে রাখবেন? “অর্ডার যখন আসেনাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দী রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা করে দেব।” জেল কর্তৃপক্ষ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সঙ্গে আলাপ করলেন, তারা জানালেন তাদের কাছেও কোন অর্ডার নাই যে বঙ্গবন্ধুকে জেলে বন্দী করে রাখতে বলতে পারেন। তবে তার ওপরে একটা প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল, গোপালগঞ্জ মামলার। কাস্টডি ওয়ারেন্ট নাই যে জেলে রাখবে। অনেক পরামর্শ করে তারা ঠিক করলেন আমাকে গোপালগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দেবে এবং রেড়িওগ্রাম করবে ঢাকায়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অর্ডার গোপালগঞ্জে পৌঁছাতে পারবে। জাহাজে পুলিশ পাহারায় গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দিল বঙ্গবন্ধুকে। গোপালগঞ্জ কোর্টে জামিন দিয়ে দিল পরের দিন। বিরাট শোভাযাত্রা করল জনগণ। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। রাতে বাড়িতে পৌঁছাব। নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছে। যখন নৌকা এসে গেছে, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন রওয়ানা করবেন এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে বলল, “একটা কথা আছে।” বঙ্গবন্ধু উঠে একটু আলাদা হয়ে ওদের কাছে যান। তারা বঙ্গবন্ধুকে একটা কাগজ দিল। রেড়িওগ্রামে অর্ডার এসেছে তাকে আবার গ্রেপ্তার করতে, নিরাপত্তা আইনে। বঙ্গবন্ধু বললেন “ঠিক আছে চলুন”। কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, “আমাদের সঙ্গে আসতে হবে না। আপনি থানায় গেলেই চলবে।” কারণ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রওয়ানা হলে একটা গোলমাল হতে পারে। বঙ্গবন্ধু সবাইকে ডেকে বললেন, “আপনারা হইচই করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেপ্তার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোন দোষ নেই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি।” নৌকা বিদায় করে দিতে বললেন বঙ্গবন্ধু। কয়েকজন কর্মী কেঁদে ফেলল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো।, “না যেতে দেব না, তারা কেড়ে নিয়ে যাক।” আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল।

বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি করতে সরকার সবসময়-ই ব্যস্ত থাকত দেখা যায়। তিনি এমনই এক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যাকে এভাবে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপই সরকার নেয়। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড এক মনস্তাত্তিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, জেলগেটে গ্রেপ্তার, নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার- এসবই এক ধরনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। একই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে তার মুক্তি ও পুনরায় গ্রেপ্তার করার আদেশও লক্ষ্য করা যায়। ৭ মার্চ ১৯৫১ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির সরকারি আদেশ বিলি করা হলেও ১৮ ধারায় পুনরায় গ্রেপ্তার করা হোক বলে নতুন আদেশ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারের মনে সবসময়ই ভয়ের উদ্রেক করতো। তাকে বন্দী না করা পর্যন্ত পুলিশ বিভাগের ঘুম হারাম হয়ে যেত। এ কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হতো যে, বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা স্বস্তি পেত না। পুলিশ বিভাগ, কারা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য এজেন্সি বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার, পুনরায় গ্রেপ্তার ইত্যাদি কাজ নিয়ে যে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতো তা উক্ত আদেশ থেকে বোঝা যায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন তারিখে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর ইত্যাদি কাজ এত ঘন ঘন করার মূল লক্ষ্যই ছিল তার মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনোই ভেঙে পড়েননি। তাকে নিয়ে জেলের অভ্যন্তরে এ ধরনের আদেশ-নির্দেশ জারি, চালাচালি দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে তাকে জড়ানোর চক্রান্ত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই করা হয়েছে। যে কোন উপায়ে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংহার করতে বদ্ধপরিকর ছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কিত তথ্য ও বিবরণী তৈরি করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে প্রেরণ করত। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এতটাই ঐকান্তিক ও পেশাদারি ছিল যে সোহরাওয়ার্দী তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, যদি শেখ মুজিবের মতো তার পাঁচজন মানুষ থাকতো, তাহলে গোটা দেশই তার সঙ্গে থাকতো।

সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় এটি স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ৪৯ থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত সময়টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দী থাকায় গণতান্ত্রিক বা স্বাভাবিক রাজনীতি করার কোন সুযোগ ছিল না। তিনি যদি মুক্ত থাকতেন তবে ছাত্র-আওয়ামী লীগের সম্প্রসারণই নয় পুরো পূর্ব বাংলার রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা পেত। তবুও সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির একটি বিকল্প ধারা গড়ে তুলেন।

অন্যদিকে জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে বিপক্ষে অবদান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলনে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তার সমর্থন আদায় করেন।

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। সর্বশেষ সম্পাদিত : ১৭ এপ্রিল, ২০২১

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল ২০২১ , ৭ বৈশাখ ১৪২৮ ৭ রমজান ১৪৪২

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

মোস্তাফা জব্বার

সাত

১১ অক্টোবর আরমানিটোলায় বিরাট সভা হলো। সমস্ত ময়দান ও আশেপাশের রাস্তা লোকে ভরে গেল। শামসুল হক সাহেব বক্তৃতা করার পর বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করলেন। সভায় গোলমাল হওয়ার ভয় ছিল বলে ভাসানী সাহেব প্রথমে বক্তৃতা করেছেন। ভাসানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শোভাযাত্রা করতে হবে সেইভাবে বক্তৃতা কর। বক্তৃতা শেষ করে বললেন, “চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্ববাংলার লোক কি চায়!” শোভাযাত্র বের হলো। মওলানা সাহেব, হক সাহেব ও বঙ্গবন্ধু শোভাযাত্রার সামনে ছিলেন। যখন নবাবপুর রেলক্রসিংয়ে উপস্থিত হলেন, তখন পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বন্দুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রেলস্টেশনের দিকে মোড় নিলেন শোভাযাত্রা নিয়ে। প্ল্যান হলো নাজিরাবাজার রেললাইন পার হয়ে নিমতলিতে ঢাকা মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে আবার আরমানিটোলায় ফিরে আসবেন। নাজিরাবাজারে এসেও পুলিশ রাস্তা আটক করেছে, শোভাযাত্রা যেতে দেবে না। তখন নামাজের সময় হয়ে গেছে। মওলানা সাহেব রাস্তার ওপরই নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। শামসুল হক সাহেবও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ালেন। এর মধ্যেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। আর জনসাধারণও ইট ছুড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচ মিনিট এভাবে চলল। পুলিশ লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসছে। একদল কর্মী মওলানা সাহেবকে কোলে করে নিয়ে এক হোটেলের ভেতর রাখলেন। কয়েকজন কর্মী ভীষণভাবে আহত হলো ও গ্রেপ্তার হলো। শামসুল হক সাহেবকেও গ্রেপ্তার করল। বঙ্গবন্ধুর ওপরও অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে একপাশের নর্দমায় পড়ে গেলেন তিনি। কয়েকজন লোক ধরে রিকশায় উঠিয়ে মোগলটুলী নিয়ে আসল। পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। ইনজেকশন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে দিল, কারণ বেদনায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। প্রায় ৩০ জন লোক গ্রেপ্তার হয়েছিল। প্রায় রাত ২টায় মোগলটুলীর অফিস, যেখানে বঙ্গবন্ধু রয়েছেন, পুলিশ সেটি ঘিরে ফেলল এবং দরজা খুলতে বলল। লোহার দরজা, ভেতরে তালা-খোলা ও ভাঙা এত সহজ ছিল না। সাইফুদ্দিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধু, কাজী গোলাম মাহবুব ও মফিজকে ডেকে উঠাল এবং বলল, “পুলিশ এসেছে তোমাদের গ্রেপ্তার করতে।” বঙ্গবন্ধু যখন ঘুমিয়ে ছিলেন ইনজেকশন নিয়ে, তখন ভাসানী সাহেব খবর দিয়েছিলেন, তিনি যেন গ্রেপ্তার না হয়।

১৯৪৯ সালের অক্টোবরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংগঠনিক কাজে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। সেখানে তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে লাহোরের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত করেন। তবে দেশে ফেরার পরই তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ঢাকা জেলের সুরক্ষা বন্দী হন।

১৯৫০ সালের শেষের দিকে মামলার শুনানি শেষ হলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যে রায় দিলেন, তাতে মওলানা সাহেব ও শামসুল হক সাহেবকে মুক্তি দিলেন। আবদুর রউফ, ফজলুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। মওলানা সাহেবও জেলে ফিরে এলেন, কারণ তিনিও নিরাপত্তা বন্দি। আতাউর রহমান সাহেব, কামরুদ্দিন সাহেব ও আরও অনেকে মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ বন্দিদের পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ডিভিশন দেয়া হয়েছিল। আপিল দায়ের করলেও খাটতে হলো। কিছুদিন পর গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিল, কারণ গোপালগঞ্জে আরও একটা মামলা দায়ের করেছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। মওলানা সাহেবের কাছে এতদিন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে ছেড়ে যেতে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। ঢাকা জেলে বঙ্গবন্ধুকে সুতা কাটতে দিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ হয়ে খুলনা মেলে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল বঙ্গবন্ধুকে। শেষ রাতে গোপালগঞ্জ পৌঁছলেন। পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হলো বঙ্গবন্ধুকে। সকালবেলা খবর রটে গেছে গোপালগঞ্জ শহরে। ১০টার সময় বঙ্গবন্ধুকে কোর্টে হাজির করা হলো। অনেক লোক জমা হয়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, বঙ্গবন্ধুকে থানা এরিয়ার মধ্যে রাখতে। পরের দিন মামলার তারিখ। গোপালগঞ্জ সাবজেলে ডিভিশন কয়েদি ও নিরাপত্তা বন্দী রাখার কোন ব্যবস্থাই নেই। কোর্ট থেকে থানা প্রায় এক মাইল। কোর্টে পরের দিন হাজিরা দিলেন, তারিখ পড়ে গেল। কারণ ফরিদপুর থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর এসেছেন। তিনি জানালেন, সরকার পক্ষের থেকে মামলাটা পরিচালনা করবেন সরকারি উকিল রায় বাহাদুর বিনোদ ভদ্র। তিনি আসতে পারেন নাই। এক মাস পরে তারিখ পড়ল এবং বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে রাখবার হুকুম হলো। ফরিদপুর যেতে হবে, সেখান থেকেই মাসে মাসে আসতে হবে তাকে, মামলার তারিখের দিনে। অনেকে তাকে দেখতে এলো। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফরিদপুর জেলে এলেন। জেল কর্তৃপক্ষ পূর্বেই ডিআইজি থেকে খবর পেয়েছে। জেলগেটে পৌঁছান সকাল বেলা। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাগজপত্র দেখে বললেন আপনার তো সাজাও আছে তিন মাস। আবার নিরাপত্তা আইনেও আটকে আছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন বেশিদিন সাজা নাই, এক মাসের বেশি বোধহয় হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন।

এই প্রথম তিনি ফরিদপুর জেলে এলেন তিনি। একমাস পার হয়ে গেল। আবার গোপালগঞ্জ যাওয়ার সময় হয়েছে। এইভাবে মামলার জন্য তিন চার মাস বঙ্গবন্ধুকে যাওয়া-আসা করতে হলো ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত।

ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া আসা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধু লিখলেন আমাকে বরিশাল বা খুলনা জেলে রাখলে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসা সুবিধা হবে। সোজা খুলনা বা বরিশাল থেকে জাহাজে উঠলে গোপালগঞ্জ যাওয়া যায়। কোন জায়গায় উঠা-নামা করতে হয় না। সরকার সে মতো আদেশ দিলেন, বরিশাল বা খুলনায় বঙ্গবন্ধুকে রাখতে। কর্তৃপক্ষ খুলনা জেলে পাঠিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুকে। রাজবাড়ী, যশোর হয়ে খুলনা যেতে হলো। খুলনা জেলে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন দেখলেন কোন জায়গাই নাই। একটা মাত্র দালান। তার মধ্যেই কয়েদি ও হাজতি সবাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। জেলার সাহেব বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। বললেন, ‘দেখুন অবস্থা, কোথায় রাখব আপনাকে, ছোট জেল।’ বঙ্গবন্ধু বলেন আমি আবার রাজনৈতিক বন্দী হয়ে গেছি। সাজা আমার খাটা হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস জেল দিয়েছিল। অন্য কোন রাজনৈতিক বন্দীও এ জেলে নাই। একটা সেলে অবশেষে রাখা হলো আর হাসপাতাল থেকে ভাত তরকারি দিলে তাই খেতে হতো, রোগীরা যা খায়। বাড়ি থেকে কিছু চিঁড়া মুড়ি বিস্কুট দিয়েছিল। তাই খেয়ে বাঁচতে হত। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মামলার তারিখ। প্রায় তিন মাস হয়েছে খুলনা জেলে এসেছেন। নিরাপত্তা আইনের বন্দীরা ছয় মাস পরপর সরকার থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। বঙ্গবন্ধুকে ১৮ মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন অর্ডার এসে খুলনা জেলে পৌঁছায় নাই। বঙ্গবন্ধু বলেন জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে কোন হুকুমের ওপর ভিক্তি করে জেলে রাখবেন? “অর্ডার যখন আসেনাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যদি আমাকে বন্দী রাখেন, তবে আমি বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য মামলা করে দেব।” জেল কর্তৃপক্ষ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সঙ্গে আলাপ করলেন, তারা জানালেন তাদের কাছেও কোন অর্ডার নাই যে বঙ্গবন্ধুকে জেলে বন্দী করে রাখতে বলতে পারেন। তবে তার ওপরে একটা প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল, গোপালগঞ্জ মামলার। কাস্টডি ওয়ারেন্ট নাই যে জেলে রাখবে। অনেক পরামর্শ করে তারা ঠিক করলেন আমাকে গোপালগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দেবে এবং রেড়িওগ্রাম করবে ঢাকায়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অর্ডার গোপালগঞ্জে পৌঁছাতে পারবে। জাহাজে পুলিশ পাহারায় গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দিল বঙ্গবন্ধুকে। গোপালগঞ্জ কোর্টে জামিন দিয়ে দিল পরের দিন। বিরাট শোভাযাত্রা করল জনগণ। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। রাতে বাড়িতে পৌঁছাব। নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছে। যখন নৌকা এসে গেছে, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন রওয়ানা করবেন এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে বলল, “একটা কথা আছে।” বঙ্গবন্ধু উঠে একটু আলাদা হয়ে ওদের কাছে যান। তারা বঙ্গবন্ধুকে একটা কাগজ দিল। রেড়িওগ্রামে অর্ডার এসেছে তাকে আবার গ্রেপ্তার করতে, নিরাপত্তা আইনে। বঙ্গবন্ধু বললেন “ঠিক আছে চলুন”। কর্মচারীরা ভদ্রতা করে বলল, “আমাদের সঙ্গে আসতে হবে না। আপনি থানায় গেলেই চলবে।” কারণ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রওয়ানা হলে একটা গোলমাল হতে পারে। বঙ্গবন্ধু সবাইকে ডেকে বললেন, “আপনারা হইচই করবেন না, আমি মুক্তি পেলাম না। আবার হুকুম এসেছে আমাকে গ্রেপ্তার করতে। আমাকে থানায় যেতে হবে। এদের কোন দোষ নেই। আমি নিজে হুকুম দেখেছি।” নৌকা বিদায় করে দিতে বললেন বঙ্গবন্ধু। কয়েকজন কর্মী কেঁদে ফেলল। আর কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো।, “না যেতে দেব না, তারা কেড়ে নিয়ে যাক।” আমি ওদের বুঝিয়ে বললাম, তারা বুঝতে পারল।

বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি করতে সরকার সবসময়-ই ব্যস্ত থাকত দেখা যায়। তিনি এমনই এক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যাকে এভাবে নিরস্ত্র করার পদক্ষেপই সরকার নেয়। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড এক মনস্তাত্তিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার, জেলগেটে গ্রেপ্তার, নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার- এসবই এক ধরনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। একই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে তার মুক্তি ও পুনরায় গ্রেপ্তার করার আদেশও লক্ষ্য করা যায়। ৭ মার্চ ১৯৫১ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির সরকারি আদেশ বিলি করা হলেও ১৮ ধারায় পুনরায় গ্রেপ্তার করা হোক বলে নতুন আদেশ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারের মনে সবসময়ই ভয়ের উদ্রেক করতো। তাকে বন্দী না করা পর্যন্ত পুলিশ বিভাগের ঘুম হারাম হয়ে যেত। এ কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হতো যে, বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা স্বস্তি পেত না। পুলিশ বিভাগ, কারা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য এজেন্সি বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার, পুনরায় গ্রেপ্তার ইত্যাদি কাজ নিয়ে যে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতো তা উক্ত আদেশ থেকে বোঝা যায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন তারিখে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর ইত্যাদি কাজ এত ঘন ঘন করার মূল লক্ষ্যই ছিল তার মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনোই ভেঙে পড়েননি। তাকে নিয়ে জেলের অভ্যন্তরে এ ধরনের আদেশ-নির্দেশ জারি, চালাচালি দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে তাকে জড়ানোর চক্রান্ত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই করা হয়েছে। যে কোন উপায়ে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংহার করতে বদ্ধপরিকর ছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কিত তথ্য ও বিবরণী তৈরি করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে প্রেরণ করত। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এতটাই ঐকান্তিক ও পেশাদারি ছিল যে সোহরাওয়ার্দী তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, যদি শেখ মুজিবের মতো তার পাঁচজন মানুষ থাকতো, তাহলে গোটা দেশই তার সঙ্গে থাকতো।

সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় এটি স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ৪৯ থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত সময়টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দী থাকায় গণতান্ত্রিক বা স্বাভাবিক রাজনীতি করার কোন সুযোগ ছিল না। তিনি যদি মুক্ত থাকতেন তবে ছাত্র-আওয়ামী লীগের সম্প্রসারণই নয় পুরো পূর্ব বাংলার রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা পেত। তবুও সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির একটি বিকল্প ধারা গড়ে তুলেন।

অন্যদিকে জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে বিপক্ষে অবদান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলনে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তার সমর্থন আদায় করেন।

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। সর্বশেষ সম্পাদিত : ১৭ এপ্রিল, ২০২১

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com