পত্রপাঠ

শ্রীতন্বী চক্রবর্তী

কলকাতা বইমেলার সাথে আমার চিরদিনের ভীষণ নিবিড় একটা যোগাযোগ; কিছু পাওয়ার, আর কিছু হারানোর। শহুরে স্মৃতি, ময়দানের মাঠভর্তি ধুলো, বইমেলার গন্ধমাখা বিকেলগুলো কিছু কিছু সময়ে বেমানান অপেক্ষাতেই কেটে গিয়েছে, আর কিছু সময় উপচে পড়েছে সেই হারানোর আকস্মিকতাগুলো। সে যাই হোক, ময়দান, কিংবা লবণহ্রদের ঝাঁ-চকচকে বইমেলার মাঠ, আমি আজ বিকেলেও সেই অপেক্ষাতেই আছি। আমার ভালোলাগা, ভালোবাসার মানুষ, সেই ফেরদৌসের জন্য অনন্ত এক অপেক্ষা।

“আজ তো বইমেলার শেষ দিন, তুমি একটু সময় করে আসবে? আমি হয়তো কয়েকটা কবিতার বই কিনতে যেতে পারি”, ফেরদৌস কাল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। ওর স্বরেও কি সেই অপেক্ষার ছোঁয়া খুঁজছিলাম আমি? খুব সন্তর্পণে সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকালাম, ও তখন সংবাদপত্রে শব্দছকের সমাধান খুঁজে চলেছিলো। কী করে বোঝাই! সকাল থেকে মনের মধ্যে কী পাশবিক এক ভালোলাগার অনুরণন হচ্ছে। সকাল থেকে দুপুর, মধ্যাহ্নের বসন্তবৌরি রোদের কেতাদুরস্ত আচরণ আজ একটুও খারাপ লাগছে না, শুধু মনে হচ্ছে কখন বিকেল হবে, বইমেলার বইগুলোতে নয়, কবিতা সৃষ্টি হচ্ছিলো আমার শরীরে, আর মনে। কে জানে, ফেরদৌস সাহেবও এইভাবে ভাবছেন কিনা। চান করলাম, সিঁথি-রাঙানো নিজের মুখটা আয়নায় দেখে বারবার ফেরদৌসের কথাগুলোই মনে পড়ে যাচ্ছিলো,

“যখনই তোমায় দেখি, কি স্নিগ্ধতায় মন ভরে যায়, যেন নরম পদ্মপাতার উপরে টলটলে এক শিশিরবিন্দু, জানি না কখন কীভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম, সব তো সমীকরণ মেনে হয় না শ্রীনন্দিতা...”

নিজের নামটা এত সুন্দর নিজের কানে কোনোদিনই লাগেনি, ফেরদৌসের ডাক রূপকথার মায়াজাল বিস্তার করতো, আর ছটফট করতাম আমি! ফেরদৌসের স্বরে এক অদ্ভুত মাদকতা, স্নেহপ্রচ্ছন্ন বিহ্বলতা ছিলো যা কোনো না কোনোভাবে আমার মধ্যে রোজ এক ধরনের আশঙ্কা জাগাতো, কিছু লুকোনোর আশঙ্কা, নিজের মনের কাছে নিজেই চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, হঠাৎ করে দীঘিভরা জলে ডুবে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে হাঁকপাঁক করে উঠে আসার যে আশঙ্কা, ঠিক সেইরকম। বিবাহিত জীবনের ছোট ছোট সুখদুঃখ নিয়ে, লেখালেখির মধ্যে, সময়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শরীর আর দৈনন্দিনতার আল্পনা এঁকে বেশ থাকছিলাম। আমার বিবাহিত জীবনে সেরকম কোনো আক্ষেপ কোনোদিনই ছিলো না, কিন্তু ওই যে, প্রবাদবাক্য বলে, ‘ভালোবাসার নৌকা পাহাড় বইয়ে যায়’, সেই হলো অবস্থা। তবে কি, সাথে সাথে সেই ভালোবাসার পরিণতি যে ঝড়ও হতে পারে তাও আমার অজানা ছিলো না।

আমার এই এক বদ অভ্যাস যা কিছুতেই বর্জন করতে পারি না। এই যে এতক্ষণ বইমেলার তিন নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে সূর্যের শেষ আলোটা ফিকে হয়ে যেতে দেখছি, এর মধ্যেও ফেরদৌসের কথাই চিন্তা করে যাচ্ছি, এটা বদ অভ্যাস নয় তো কি। বেশ কিছক্ষণ অপেক্ষা করে একটা মেসেজ করলাম,

“কখন আসছো? আমি পৌঁছে গিয়েছি বইমেলায়।”

ঘুরতে লাগলাম এই দোকান থেকে সেই দোকান, লিট্ল ম্যাগাজিন স্টলগুলোতে চোখে পড়লো মণি-মুক্তোর সমাহার। কী যে সুন্দর কিছু কবিতা, নিটোল, কী সরল অথচ কী গভীর উপলব্ধি! অহেতুক শব্দের আতিশয্য নেই, কী সুন্দর দৃশ্যকল্প! শীতের বিকেলের পাতাঝরা শিরশিরানিতে শালটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। যদি ফেরদৌস থাকতো, এতক্ষণে হয়তো হাতে হাত দিয়ে হেঁটে নিতাম বেশ কিছুটা পথ, বই খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে দু’চোখ ভরে আহরণ করতাম ওর পুরুষালী আগুন, কাঁধে মাথা রেখে হয়তোবা জিরিয়েও নিতাম দু’দ-। এবারে বইমেলায় অনেক তরুণ কবিও লিখেছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই অসাধারণ তাদের কাব্যভাষা, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে যাবার মতো করে আমি ঘুরতে লাগলাম নতুন মলাটের ভেতর থেকে আমার ভালোলাগার কবিতাগুলো বেছে নেওয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ একটা বই নিয়ে মগ্ন হয়ে বসে ছিলাম, হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ ঢুকলো:

“মনে হয় আজ পৌঁছতে একটু দেরি হবে গো, আসলে নতুন একটা রিপোর্ট আর অফিসের বেশ কিছু কাজ নিয়ে আটকে পড়েছি। তবে চেষ্টা করছি দেখা করার। আমারও কি ভালো লাগে দেখা না করে থাকতে?”

জানি না, কিন্তু ভীষণ রাগ হলো, অসময়ে, অসমবয়সী প্রেম, ভালোবাসা সে যাই হোক, বড় বেশি কষ্টদায়ক। সারাক্ষণই কিছু না কিছু প্রশ্ন নিজের মনেই উঠতে থাকে, কিন্তু সেই একটা মুখ দেখলেই সব প্রশ্নের উত্তর কেমন গোলমাল হয়ে যায়, ফেরদৌসের স্বর একবার শুনলেই সেই উলোঝুলো মানুষটার কথা মনে পড়ে, স্নেহের কাঙাল, ভালোবাসার জন্য উদগ্রীব, কবির মন, কেতাদুরস্ত বহুজাতিক সংবাদ সংস্থায় আর বিজ্ঞাপনের অফিসে চাকরি করেও যার কলম-তুলিতে আমার রোজকার বেঁচে ওঠাটা আজ আর নিরর্থক মনে হয় না। ধুর, কী যে খারাপ লাগতে লাগলো! ছোট্ট করে একটা উত্তর লিখলাম:

“খবরের কাগজের অফিসে ব্রেকিং নিউজ বলে দাও যে আজ একজন খুব খুব মার খাবে, আবহাওয়া অত্যন্ত খারাপ হতে চলেছে।”

প্রায় সাথে সাথেই উত্তর এলো,

“তাই? কিন্তু আমি তো জানি যতই মার খাই, তারপরে এই অধমের কপালে একটু আধটু আদরও জুটবে, যাই হোক, যত তাড়াতাড়ি পারি আমি আসছি, চলে যেও না কিন্তু, আসছি।”

পড়তে পড়তেই দেখলাম ইন্ডিয়া পোস্টের স্টলের সামনে এসে পড়েছি, থরে থরে সাজানো রঙিন স্ট্যাম্পের কালেকশন, কোনারকের ঘোড়া থেকে নটরাজ মূর্তি, বোধগয়ার মন্দির, সাঁচী স্তূপ, কাশ্মীর থেকে কেপ কমোরিন- কী নেই তাতে! অমলতাসের ছবি থেকে রাজকীয় শাহ-বুলবুল, ডাকটিকিট দেখতে দেখতেই বিশ্বভ্রমণ হয়ে যায়। সময় খুবই সংক্ষিপ্ত, বারবার মনে হচ্ছিলো এইখানে যদি একটা ডাকবাক্স লাগানো থাকতো, আর মেলার মাঠ থেকেই চিঠি লিখে ডাকহরকরার হাত দিয়ে ফেরদৌসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে সেই চিঠির উত্তরটা ঠিক কী রকম আসতো! অপেক্ষার মধ্যেই অনধিকার প্রবেশকারী মুঠোফোনের বিহ্বলতা। আবার একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য:

“আমাকে ভুল বুঝো না সোনা, আজ কিছুতেই যেতে পারলাম না, এতগুলো কাজে আটকে গেলাম, কিন্তু আমার রাজকন্যা রাগ করলেও আমায় যাতে ক্ষমা করে দেয়।”

ব্যস! আর কিচ্ছুটি নয়? রাগে, অভিমানে কোথায় মুখ লুকোবো ঠিক করে উঠতে পারলাম না, এই গোটা পৃথিবীতে হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ লাগা, বেঁচে থাকাটাই

যে যথেষ্ট লাঞ্ছনার ব্যাপার সেরকম একটা অনুভূতি হতে লাগলো। মানুষটার কাছে আমার গুরুত্বটা একেবারেই কিছু না, আমার সব লেখা, সব ছন্দ, সব আঁকা, সব ভালোলাগা যাকে নিয়ে সেইই এক মুহূর্তে আমার জীবনটা একদম অন্যরকম করে দিলো! চতুর্দিকের কোলাহল, প্রেমিকযুগল, দাম্পত্য এবং অপত্যস্নেহ, সন্ধে থেকে রাত হওয়া, বেলুনওয়ালা আর বুদ্বুদ পেরিয়ে যখন গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন মেলা প্রায় শেষের দিকে। লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন করলাম ফেরদৌসকে, কিন্তু কাজের তাগিদেই বোধ হয়, ফোন কেটে দিলো, শুধু লিখলো, “কল ইউ সুন”।

আমার তক্ষুণি কেন জানি না মনে হলো, জীবনের কিছু মুহূর্ত মুছে ফেলার জন্যে যদি একটা ডাস্টার থাকতো! সঞ্জয় ফোন করলো, আমি দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ আসছি, কয়েকটা বই খুঁজতে গিয়ে সময়ের খেয়াল ছিলো না।” জানি না আদৌ গলা কাঁপলো কিনা, কারণ সঞ্জয়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না।

উন্মাদের মতো একটা ট্যাক্সি খুঁজছিলাম, যদি বাড়ি না গিয়ে চলে যেতে পারতাম নিরুদ্দেশের পথে, কিন্তু মেয়েদের মনে হয় সেরকম ইচ্ছে করারও কোনো অধিকার নেই। হঠাৎ একটু দূর থেকে দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখে খুব চেনা চেনা লাগলো, সামনে যখন এসেই গেলো, তখন পুরুষ কণ্ঠটি বলে উঠলো:

“আরে তুমি এখনো বাড়ি যাওনি, দেখো না, এই যে, এই সুলগ্নার কাণ্ড, জোর করে ধরে নিয়ে এলো অফিসের পর, বইমেলার শেষ দিন ওকে কয়েকটা বই কেনা নিয়ে গাইড করে দিতে হবে।”

পাশের ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, “ও তাই না? চেনা মানুষ দেখে এখন আমার দোষ দেওয়া হচ্ছে।”

আমার হঠাৎ করে প্রচণ্ড শীত করতে লাগলো, বরফের মধ্যে মরা মাছের মতো এক অনুভূতি হতে লাগলো।

“হাই, আমি সুলগ্না, এই পাগলটাকে চেনেন নিশ্চয়ই। এদিকে সারাদিন বলে যাচ্ছে আমি ওনার একমাত্র রাজকন্যে, বইমেলার ইন্ডিয়ান পোস্টের স্টলে যদি একটা লাল ডাকবাক্স লাগানো থাকতো তাহলে নাকি উনি আমায় হাজার হাজার চিঠি পাঠাতেন এখান থেকেই। আর এখন? যতই বয়স হোক আমাদের, এই রকম কুঁড়ে প্রেমিক হলে ভালো লাগে বলুন তো!”

সুলগ্না হেসে আমার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বললো, “কী আর করি বলুন, পাগল একটা, এই দেখুন আজকে সন্ধ্যেবেলা দেখা হওয়ার পর এই বুড়ো বয়সে হাতে চিরকুট গুঁজে দিলো। কী সুন্দর কয়েকটা শব্দ, এই মানুষটাকে ভালো না বেসে পারা যায়?”

“যাই হোক আমরা যাই, একটু ঘুরে নিই, ভালো থাকবেন।” যাওয়ার সময় ফেরদৌস একবারই আমার দিকে তাকালো। চোখ ফিরিয়ে নিলাম, এই স্বপ্নভঙ্গের দায় তো আমারই, কিছু যন্ত্রণার উপশম সারাজীবনই হয় না। ট্যাক্সিতে বসে হঠাৎ খেয়াল হলো, চিরকুটটা আমার হাতেই রয়ে গিয়েছে, ফেলে দিতে গিয়েও কী মনে হলো, চিরকুটটা খুললাম...

কয়েকটা অক্ষর, খুব চেনা কয়েকটা শব্দ:

“যখনই তোমায় দেখি, কী স্নিগ্ধতায় মন ভরে যায়, যেন নরম পদ্মপাতার উপরে টলটলে এক শিশিরবিন্দু, জানি না কখন কীভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম, সব তো সমীকরণ মেনে হয় না সুলগ্না...”

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

পত্রপাঠ

শ্রীতন্বী চক্রবর্তী

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

কলকাতা বইমেলার সাথে আমার চিরদিনের ভীষণ নিবিড় একটা যোগাযোগ; কিছু পাওয়ার, আর কিছু হারানোর। শহুরে স্মৃতি, ময়দানের মাঠভর্তি ধুলো, বইমেলার গন্ধমাখা বিকেলগুলো কিছু কিছু সময়ে বেমানান অপেক্ষাতেই কেটে গিয়েছে, আর কিছু সময় উপচে পড়েছে সেই হারানোর আকস্মিকতাগুলো। সে যাই হোক, ময়দান, কিংবা লবণহ্রদের ঝাঁ-চকচকে বইমেলার মাঠ, আমি আজ বিকেলেও সেই অপেক্ষাতেই আছি। আমার ভালোলাগা, ভালোবাসার মানুষ, সেই ফেরদৌসের জন্য অনন্ত এক অপেক্ষা।

“আজ তো বইমেলার শেষ দিন, তুমি একটু সময় করে আসবে? আমি হয়তো কয়েকটা কবিতার বই কিনতে যেতে পারি”, ফেরদৌস কাল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। ওর স্বরেও কি সেই অপেক্ষার ছোঁয়া খুঁজছিলাম আমি? খুব সন্তর্পণে সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকালাম, ও তখন সংবাদপত্রে শব্দছকের সমাধান খুঁজে চলেছিলো। কী করে বোঝাই! সকাল থেকে মনের মধ্যে কী পাশবিক এক ভালোলাগার অনুরণন হচ্ছে। সকাল থেকে দুপুর, মধ্যাহ্নের বসন্তবৌরি রোদের কেতাদুরস্ত আচরণ আজ একটুও খারাপ লাগছে না, শুধু মনে হচ্ছে কখন বিকেল হবে, বইমেলার বইগুলোতে নয়, কবিতা সৃষ্টি হচ্ছিলো আমার শরীরে, আর মনে। কে জানে, ফেরদৌস সাহেবও এইভাবে ভাবছেন কিনা। চান করলাম, সিঁথি-রাঙানো নিজের মুখটা আয়নায় দেখে বারবার ফেরদৌসের কথাগুলোই মনে পড়ে যাচ্ছিলো,

“যখনই তোমায় দেখি, কি স্নিগ্ধতায় মন ভরে যায়, যেন নরম পদ্মপাতার উপরে টলটলে এক শিশিরবিন্দু, জানি না কখন কীভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম, সব তো সমীকরণ মেনে হয় না শ্রীনন্দিতা...”

নিজের নামটা এত সুন্দর নিজের কানে কোনোদিনই লাগেনি, ফেরদৌসের ডাক রূপকথার মায়াজাল বিস্তার করতো, আর ছটফট করতাম আমি! ফেরদৌসের স্বরে এক অদ্ভুত মাদকতা, স্নেহপ্রচ্ছন্ন বিহ্বলতা ছিলো যা কোনো না কোনোভাবে আমার মধ্যে রোজ এক ধরনের আশঙ্কা জাগাতো, কিছু লুকোনোর আশঙ্কা, নিজের মনের কাছে নিজেই চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, হঠাৎ করে দীঘিভরা জলে ডুবে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে হাঁকপাঁক করে উঠে আসার যে আশঙ্কা, ঠিক সেইরকম। বিবাহিত জীবনের ছোট ছোট সুখদুঃখ নিয়ে, লেখালেখির মধ্যে, সময়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শরীর আর দৈনন্দিনতার আল্পনা এঁকে বেশ থাকছিলাম। আমার বিবাহিত জীবনে সেরকম কোনো আক্ষেপ কোনোদিনই ছিলো না, কিন্তু ওই যে, প্রবাদবাক্য বলে, ‘ভালোবাসার নৌকা পাহাড় বইয়ে যায়’, সেই হলো অবস্থা। তবে কি, সাথে সাথে সেই ভালোবাসার পরিণতি যে ঝড়ও হতে পারে তাও আমার অজানা ছিলো না।

আমার এই এক বদ অভ্যাস যা কিছুতেই বর্জন করতে পারি না। এই যে এতক্ষণ বইমেলার তিন নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে সূর্যের শেষ আলোটা ফিকে হয়ে যেতে দেখছি, এর মধ্যেও ফেরদৌসের কথাই চিন্তা করে যাচ্ছি, এটা বদ অভ্যাস নয় তো কি। বেশ কিছক্ষণ অপেক্ষা করে একটা মেসেজ করলাম,

“কখন আসছো? আমি পৌঁছে গিয়েছি বইমেলায়।”

ঘুরতে লাগলাম এই দোকান থেকে সেই দোকান, লিট্ল ম্যাগাজিন স্টলগুলোতে চোখে পড়লো মণি-মুক্তোর সমাহার। কী যে সুন্দর কিছু কবিতা, নিটোল, কী সরল অথচ কী গভীর উপলব্ধি! অহেতুক শব্দের আতিশয্য নেই, কী সুন্দর দৃশ্যকল্প! শীতের বিকেলের পাতাঝরা শিরশিরানিতে শালটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। যদি ফেরদৌস থাকতো, এতক্ষণে হয়তো হাতে হাত দিয়ে হেঁটে নিতাম বেশ কিছুটা পথ, বই খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে দু’চোখ ভরে আহরণ করতাম ওর পুরুষালী আগুন, কাঁধে মাথা রেখে হয়তোবা জিরিয়েও নিতাম দু’দ-। এবারে বইমেলায় অনেক তরুণ কবিও লিখেছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই অসাধারণ তাদের কাব্যভাষা, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে যাবার মতো করে আমি ঘুরতে লাগলাম নতুন মলাটের ভেতর থেকে আমার ভালোলাগার কবিতাগুলো বেছে নেওয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ একটা বই নিয়ে মগ্ন হয়ে বসে ছিলাম, হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ ঢুকলো:

“মনে হয় আজ পৌঁছতে একটু দেরি হবে গো, আসলে নতুন একটা রিপোর্ট আর অফিসের বেশ কিছু কাজ নিয়ে আটকে পড়েছি। তবে চেষ্টা করছি দেখা করার। আমারও কি ভালো লাগে দেখা না করে থাকতে?”

জানি না, কিন্তু ভীষণ রাগ হলো, অসময়ে, অসমবয়সী প্রেম, ভালোবাসা সে যাই হোক, বড় বেশি কষ্টদায়ক। সারাক্ষণই কিছু না কিছু প্রশ্ন নিজের মনেই উঠতে থাকে, কিন্তু সেই একটা মুখ দেখলেই সব প্রশ্নের উত্তর কেমন গোলমাল হয়ে যায়, ফেরদৌসের স্বর একবার শুনলেই সেই উলোঝুলো মানুষটার কথা মনে পড়ে, স্নেহের কাঙাল, ভালোবাসার জন্য উদগ্রীব, কবির মন, কেতাদুরস্ত বহুজাতিক সংবাদ সংস্থায় আর বিজ্ঞাপনের অফিসে চাকরি করেও যার কলম-তুলিতে আমার রোজকার বেঁচে ওঠাটা আজ আর নিরর্থক মনে হয় না। ধুর, কী যে খারাপ লাগতে লাগলো! ছোট্ট করে একটা উত্তর লিখলাম:

“খবরের কাগজের অফিসে ব্রেকিং নিউজ বলে দাও যে আজ একজন খুব খুব মার খাবে, আবহাওয়া অত্যন্ত খারাপ হতে চলেছে।”

প্রায় সাথে সাথেই উত্তর এলো,

“তাই? কিন্তু আমি তো জানি যতই মার খাই, তারপরে এই অধমের কপালে একটু আধটু আদরও জুটবে, যাই হোক, যত তাড়াতাড়ি পারি আমি আসছি, চলে যেও না কিন্তু, আসছি।”

পড়তে পড়তেই দেখলাম ইন্ডিয়া পোস্টের স্টলের সামনে এসে পড়েছি, থরে থরে সাজানো রঙিন স্ট্যাম্পের কালেকশন, কোনারকের ঘোড়া থেকে নটরাজ মূর্তি, বোধগয়ার মন্দির, সাঁচী স্তূপ, কাশ্মীর থেকে কেপ কমোরিন- কী নেই তাতে! অমলতাসের ছবি থেকে রাজকীয় শাহ-বুলবুল, ডাকটিকিট দেখতে দেখতেই বিশ্বভ্রমণ হয়ে যায়। সময় খুবই সংক্ষিপ্ত, বারবার মনে হচ্ছিলো এইখানে যদি একটা ডাকবাক্স লাগানো থাকতো, আর মেলার মাঠ থেকেই চিঠি লিখে ডাকহরকরার হাত দিয়ে ফেরদৌসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে সেই চিঠির উত্তরটা ঠিক কী রকম আসতো! অপেক্ষার মধ্যেই অনধিকার প্রবেশকারী মুঠোফোনের বিহ্বলতা। আবার একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য:

“আমাকে ভুল বুঝো না সোনা, আজ কিছুতেই যেতে পারলাম না, এতগুলো কাজে আটকে গেলাম, কিন্তু আমার রাজকন্যা রাগ করলেও আমায় যাতে ক্ষমা করে দেয়।”

ব্যস! আর কিচ্ছুটি নয়? রাগে, অভিমানে কোথায় মুখ লুকোবো ঠিক করে উঠতে পারলাম না, এই গোটা পৃথিবীতে হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ লাগা, বেঁচে থাকাটাই

যে যথেষ্ট লাঞ্ছনার ব্যাপার সেরকম একটা অনুভূতি হতে লাগলো। মানুষটার কাছে আমার গুরুত্বটা একেবারেই কিছু না, আমার সব লেখা, সব ছন্দ, সব আঁকা, সব ভালোলাগা যাকে নিয়ে সেইই এক মুহূর্তে আমার জীবনটা একদম অন্যরকম করে দিলো! চতুর্দিকের কোলাহল, প্রেমিকযুগল, দাম্পত্য এবং অপত্যস্নেহ, সন্ধে থেকে রাত হওয়া, বেলুনওয়ালা আর বুদ্বুদ পেরিয়ে যখন গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন মেলা প্রায় শেষের দিকে। লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন করলাম ফেরদৌসকে, কিন্তু কাজের তাগিদেই বোধ হয়, ফোন কেটে দিলো, শুধু লিখলো, “কল ইউ সুন”।

আমার তক্ষুণি কেন জানি না মনে হলো, জীবনের কিছু মুহূর্ত মুছে ফেলার জন্যে যদি একটা ডাস্টার থাকতো! সঞ্জয় ফোন করলো, আমি দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ আসছি, কয়েকটা বই খুঁজতে গিয়ে সময়ের খেয়াল ছিলো না।” জানি না আদৌ গলা কাঁপলো কিনা, কারণ সঞ্জয়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না।

উন্মাদের মতো একটা ট্যাক্সি খুঁজছিলাম, যদি বাড়ি না গিয়ে চলে যেতে পারতাম নিরুদ্দেশের পথে, কিন্তু মেয়েদের মনে হয় সেরকম ইচ্ছে করারও কোনো অধিকার নেই। হঠাৎ একটু দূর থেকে দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখে খুব চেনা চেনা লাগলো, সামনে যখন এসেই গেলো, তখন পুরুষ কণ্ঠটি বলে উঠলো:

“আরে তুমি এখনো বাড়ি যাওনি, দেখো না, এই যে, এই সুলগ্নার কাণ্ড, জোর করে ধরে নিয়ে এলো অফিসের পর, বইমেলার শেষ দিন ওকে কয়েকটা বই কেনা নিয়ে গাইড করে দিতে হবে।”

পাশের ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, “ও তাই না? চেনা মানুষ দেখে এখন আমার দোষ দেওয়া হচ্ছে।”

আমার হঠাৎ করে প্রচণ্ড শীত করতে লাগলো, বরফের মধ্যে মরা মাছের মতো এক অনুভূতি হতে লাগলো।

“হাই, আমি সুলগ্না, এই পাগলটাকে চেনেন নিশ্চয়ই। এদিকে সারাদিন বলে যাচ্ছে আমি ওনার একমাত্র রাজকন্যে, বইমেলার ইন্ডিয়ান পোস্টের স্টলে যদি একটা লাল ডাকবাক্স লাগানো থাকতো তাহলে নাকি উনি আমায় হাজার হাজার চিঠি পাঠাতেন এখান থেকেই। আর এখন? যতই বয়স হোক আমাদের, এই রকম কুঁড়ে প্রেমিক হলে ভালো লাগে বলুন তো!”

সুলগ্না হেসে আমার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বললো, “কী আর করি বলুন, পাগল একটা, এই দেখুন আজকে সন্ধ্যেবেলা দেখা হওয়ার পর এই বুড়ো বয়সে হাতে চিরকুট গুঁজে দিলো। কী সুন্দর কয়েকটা শব্দ, এই মানুষটাকে ভালো না বেসে পারা যায়?”

“যাই হোক আমরা যাই, একটু ঘুরে নিই, ভালো থাকবেন।” যাওয়ার সময় ফেরদৌস একবারই আমার দিকে তাকালো। চোখ ফিরিয়ে নিলাম, এই স্বপ্নভঙ্গের দায় তো আমারই, কিছু যন্ত্রণার উপশম সারাজীবনই হয় না। ট্যাক্সিতে বসে হঠাৎ খেয়াল হলো, চিরকুটটা আমার হাতেই রয়ে গিয়েছে, ফেলে দিতে গিয়েও কী মনে হলো, চিরকুটটা খুললাম...

কয়েকটা অক্ষর, খুব চেনা কয়েকটা শব্দ:

“যখনই তোমায় দেখি, কী স্নিগ্ধতায় মন ভরে যায়, যেন নরম পদ্মপাতার উপরে টলটলে এক শিশিরবিন্দু, জানি না কখন কীভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম, সব তো সমীকরণ মেনে হয় না সুলগ্না...”