লকডাউনে রংপুরে দু’লাখ ক্ষেতমজুর-শ্রমিকসহ ভাসমান মানুষ কর্মহীন

রংপুরে প্রায় দু’লাখ ক্ষেতমজুর, দিনমজুরসহ সহায়-সম্বলহীন মানুষ করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য অব্যাহত লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতরভাবে দিন কাটাচ্ছেন। এ সব হতদরিদ্র মানুষকে বাঁচাতে এখন পর্যন্ত তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

রংপুর নগরের মেডিকেল পূর্বগেইট, শাপলা চত্বর, বেতপট্টি, মডার্ন মোড় এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে ভোর বেলায় মানুষ বেচাকেনার হাট বসে। নগরীর বস্তিসহ আশপাশের উপজেলা থেকে হাজার হাজার কর্মহীন মানুষ সেখানে কাজের জন্য অবস্থান নেয়। সকাল ৭টা থেকে শুরু হাট ৯/১০টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

কিন্তু এবার দ্বিতীয় দফা করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লকডাউনের কারণে উন্নয়ন কর্মকা-সহ সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ টাকা শ্রমের মূল্য পেলেও এবার দু’শ’ টাকায়ও শ্রম কিনছেন না কেউ।

রংপুর মেডিকেল পূর্ব গেইট এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো, সকাল থেকে কয়েক শতাধিক শ্রমিক, ক্ষেতমজুর কাজের সন্ধানে কোদাল, ঝুড়ি, খন্তি নিয়ে অপেক্ষা করছেন কিন্তু কেউ তাদের শ্রম কিনতে আসছেন না। একজন এলে ২০/২৫ জন তাকে ঘিরে ধরে।

নগরীর কেরানী পাড়া-মহল্লার বারী মিয়া মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন দুজন শ্রমিক নিতে তাকে ঘিরে ধরে ২০/২৫ জন ক্ষেতমজুর বলেন, তাদের কাজে দেয়ার জন্য কিন্তু বারী মিয়ার দরকার মাত্র দুজন মাটি কাটার কাজের জন্য। পরে দু’জনের পরিবর্তে তিনজন শ্রমিককে নিলেন। করোনার আগে যেখানে ৫শ’ টাকা আর একবেলা খাবার দিতে হতো, সেখানে জনপ্রতি তিনশ’ টাকায় তিনি তাদের নিয়ে গেলেন। এভাবেই কাজ না থাকায় ২/৩শ’ টাকা দরে শ্রম বিক্রি করতে চাইলেও নেয়ার কেউ নেই।

গঙ্গাচড়া এলাকার তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের বাসিন্দা আকালু মিয়া, মোতালেবসহ কয়েকজন জানালেন সেহরি খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন কাজের সন্ধানে। সকাল ৯টা পর্যন্ত কোন কাজ পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। তারা জানালেন গ্রামের সহায়-সম্বলহীন ভূমিহীন হতদরিদ্র পরিবারগুলোর ভয়াবহ অবস্থা। ৪/৫ দিনেও কাজ মিলছে না।

ধান কাট,া মাড়াই শুরু হতে আরও কয়েকদিন লাগবে। করোনার লকডাউনে নগরীতে সব ধরনের নির্মাণ কাজ বন্ধ। ফলে তারা পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতরভাবে দিন কাটাচ্ছেন।

একই অবস্থা দেখা গেল নগরীর বেতপট্টি এলাকায় শত শত মানুষ কাজের সন্ধানে এসে বসে আছেন, কাজ নেই। এবার সবচেয়ে বিপাকে রয়েছে তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার। তাদের কোন কাজ নেই অনেকেই শুধু মুড়ি ভিজিয়ে সেহরি করেছেন আর পানি মুখে দিয়ে ইফতার করেছেন বলে জানালেন কাউনিয়া ও পীরগাছার চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সহায়-সম্বলহীন মানুষ।

লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া ভ্যানচালক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মেসে কাজ করা নারী কর্মী, ছোট ছোট ব্যবসা করে, ফুটপাতে দোকানদার এমন হাজারো মানুষের রুটি রুজি পুরোপুরি বন্ধ।

নগরীর লালবাগ রেলওয়ে বস্তি এলাকায় গিয়ে এমন কোন পরিবার পাওয়া গেল না যারা দু’বেলা খেতে পেরেছে। বস্তির আলেমা বেগম, সালমা জানালেন আলু সিদ্ধ করে সেহরি আর ইফতার করেছেন। দু’দিন ধরে ভাতও জোটেনি। নগরীর লক্ষাধিক মানুষকে বাঁচাতে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। লকডাউনের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কেউ এসব দুস্থের মাঝে খাবার বিতরণ করেনি বলে বস্তিবাসীর অভিযোগ।

এ ব্যাপারে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বলেন, নগরীর এক লাখেরও বেশি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি জানান, সরকারিভাবে এখনও কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তার পরেও সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে কিছু চাল, ডাল, আলু দেবার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আখতার হোসেনের সঙ্গে গতকাল বিকেলে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এবার ঈদ উপলক্ষে দুস্থ পরিবারপ্রতি সাড়ে চারশ’ টাকা পরে আবার বাড়িয়ে ৫শ’ টাকা করে দেয়ার জন্য তাদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছিলো পরে তা আবার স্থগিত করা হয়েছে। নতুন করে আর কোন বরাদ্দ আসে নাই। তবে দ্রুতই বরাদ্দ পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সিপিবি নেতা শাহাদত হোসেন জরুরি ভিত্তিতে হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে খাবার বিতরণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

লকডাউনে রংপুরে দু’লাখ ক্ষেতমজুর-শ্রমিকসহ ভাসমান মানুষ কর্মহীন

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর

image

রংপুর : অব্যাহত লকডাউনের কারণে রংপুরে হাজার হাজার শ্রমিক দিনমজুর কাজ না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। ছবিটি নগরীর মেডিকেল মোড় থেকে তোলা -সংবাদ

রংপুরে প্রায় দু’লাখ ক্ষেতমজুর, দিনমজুরসহ সহায়-সম্বলহীন মানুষ করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য অব্যাহত লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতরভাবে দিন কাটাচ্ছেন। এ সব হতদরিদ্র মানুষকে বাঁচাতে এখন পর্যন্ত তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

রংপুর নগরের মেডিকেল পূর্বগেইট, শাপলা চত্বর, বেতপট্টি, মডার্ন মোড় এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে ভোর বেলায় মানুষ বেচাকেনার হাট বসে। নগরীর বস্তিসহ আশপাশের উপজেলা থেকে হাজার হাজার কর্মহীন মানুষ সেখানে কাজের জন্য অবস্থান নেয়। সকাল ৭টা থেকে শুরু হাট ৯/১০টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

কিন্তু এবার দ্বিতীয় দফা করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লকডাউনের কারণে উন্নয়ন কর্মকা-সহ সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ টাকা শ্রমের মূল্য পেলেও এবার দু’শ’ টাকায়ও শ্রম কিনছেন না কেউ।

রংপুর মেডিকেল পূর্ব গেইট এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো, সকাল থেকে কয়েক শতাধিক শ্রমিক, ক্ষেতমজুর কাজের সন্ধানে কোদাল, ঝুড়ি, খন্তি নিয়ে অপেক্ষা করছেন কিন্তু কেউ তাদের শ্রম কিনতে আসছেন না। একজন এলে ২০/২৫ জন তাকে ঘিরে ধরে।

নগরীর কেরানী পাড়া-মহল্লার বারী মিয়া মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন দুজন শ্রমিক নিতে তাকে ঘিরে ধরে ২০/২৫ জন ক্ষেতমজুর বলেন, তাদের কাজে দেয়ার জন্য কিন্তু বারী মিয়ার দরকার মাত্র দুজন মাটি কাটার কাজের জন্য। পরে দু’জনের পরিবর্তে তিনজন শ্রমিককে নিলেন। করোনার আগে যেখানে ৫শ’ টাকা আর একবেলা খাবার দিতে হতো, সেখানে জনপ্রতি তিনশ’ টাকায় তিনি তাদের নিয়ে গেলেন। এভাবেই কাজ না থাকায় ২/৩শ’ টাকা দরে শ্রম বিক্রি করতে চাইলেও নেয়ার কেউ নেই।

গঙ্গাচড়া এলাকার তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের বাসিন্দা আকালু মিয়া, মোতালেবসহ কয়েকজন জানালেন সেহরি খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন কাজের সন্ধানে। সকাল ৯টা পর্যন্ত কোন কাজ পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। তারা জানালেন গ্রামের সহায়-সম্বলহীন ভূমিহীন হতদরিদ্র পরিবারগুলোর ভয়াবহ অবস্থা। ৪/৫ দিনেও কাজ মিলছে না।

ধান কাট,া মাড়াই শুরু হতে আরও কয়েকদিন লাগবে। করোনার লকডাউনে নগরীতে সব ধরনের নির্মাণ কাজ বন্ধ। ফলে তারা পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতরভাবে দিন কাটাচ্ছেন।

একই অবস্থা দেখা গেল নগরীর বেতপট্টি এলাকায় শত শত মানুষ কাজের সন্ধানে এসে বসে আছেন, কাজ নেই। এবার সবচেয়ে বিপাকে রয়েছে তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার। তাদের কোন কাজ নেই অনেকেই শুধু মুড়ি ভিজিয়ে সেহরি করেছেন আর পানি মুখে দিয়ে ইফতার করেছেন বলে জানালেন কাউনিয়া ও পীরগাছার চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সহায়-সম্বলহীন মানুষ।

লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া ভ্যানচালক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মেসে কাজ করা নারী কর্মী, ছোট ছোট ব্যবসা করে, ফুটপাতে দোকানদার এমন হাজারো মানুষের রুটি রুজি পুরোপুরি বন্ধ।

নগরীর লালবাগ রেলওয়ে বস্তি এলাকায় গিয়ে এমন কোন পরিবার পাওয়া গেল না যারা দু’বেলা খেতে পেরেছে। বস্তির আলেমা বেগম, সালমা জানালেন আলু সিদ্ধ করে সেহরি আর ইফতার করেছেন। দু’দিন ধরে ভাতও জোটেনি। নগরীর লক্ষাধিক মানুষকে বাঁচাতে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। লকডাউনের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কেউ এসব দুস্থের মাঝে খাবার বিতরণ করেনি বলে বস্তিবাসীর অভিযোগ।

এ ব্যাপারে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বলেন, নগরীর এক লাখেরও বেশি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি জানান, সরকারিভাবে এখনও কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তার পরেও সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে কিছু চাল, ডাল, আলু দেবার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আখতার হোসেনের সঙ্গে গতকাল বিকেলে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এবার ঈদ উপলক্ষে দুস্থ পরিবারপ্রতি সাড়ে চারশ’ টাকা পরে আবার বাড়িয়ে ৫শ’ টাকা করে দেয়ার জন্য তাদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছিলো পরে তা আবার স্থগিত করা হয়েছে। নতুন করে আর কোন বরাদ্দ আসে নাই। তবে দ্রুতই বরাদ্দ পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সিপিবি নেতা শাহাদত হোসেন জরুরি ভিত্তিতে হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে খাবার বিতরণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।