পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন : পাল্টাচ্ছে প্রচারণার কৌশল তবে প্রাধান্য বিভেদের

পশ্চিমবঙ্গ জয়ে ঐতিহাসিক মহারণ চলছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। গত দেড়মাস ধরে মরণপণ প্রচারণায় অবতীর্ণ দু-পক্ষই। লড়াইয়ে জিততে বারবার বদলাচ্ছে কৌশল, দুই দলই।

শুরু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রচারণার কেন্দ্রে ছিল- ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ আর বিজেপির- ‘দুয়ারে সরকার’।

তবে প্রচারণার এই পর্যায়ে, যখন ভোটগ্রহণের আর তিন পর্ব বাকি, কৌশল পাল্টেছেন মমতা। এবার তিনি সমালোচনার তোপ দাগছেন নরেন্দ্র মোদির কোভিড ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। করোনার দ্বিতীয় দফা বিস্তারের মুখে ভারতকে কতটা অরক্ষিত রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী, সেই অভিযোগ তুলেছেন। রাজ্যে করোনা বিস্তারের জন্য বিজেপির আনা বহিরাগতদের দায়ী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তার এই প্রচারণা কাজে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কেননা বিজেপি ব্যস্ত হয়ে গেছে আত্মপক্ষ সমর্থনে। এতদিন প্রচারণায় কাটমানি বা ঘুষ, দুর্নীতির অভিযোগে তৃণমূলকে ভালোই কোণঠাসা রাখতে পেরেছিল বিজেপি।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক, পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারণা সাড়া ফেলতে সমর্থ হলেও, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি আর তৃণমূলের দুর্নীতির সমালোচনাসহ বিজেপির প্রচারণা বেশি সংগঠিত ছিল। তাছাড়া বাঙালি সমাজের বিভক্তিগুলোকে প্রচারণায় ভালোই কাজে লাগিয়েছে বিজেপি।’

কলকাতার মাওলানা আজাদ ইনস্টিটিউটের এই প্রবীণ অধ্যাপক বলেন, ‘এখন মমতা হয়তো বুঝেছেন দেড় মাসব্যাপী নির্বাচনে শুধু উন্নয়ন আর ভাষার প্রসঙ্গ দিয়ে হবে না। কোভিড প্রসঙ্গটি আরও আগেই আনার জন্য তাকে পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল তার উপদেষ্টাদের।’

কলকাতা ছেয়ে আছে ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ লেখা হোর্ডিংয়ে। ৩৩০ বছরের পুরনো এই শহরে এই মন্ত্রে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের প্রচারণা রুখতে চাইছে তারা। এছাড়া রাজ্যে অন্য জায়গা থেকে আসা মানুষের সংখ্যা, ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যের বাঙালি মধ্যবিত্তের শঙ্কাও এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

তবে কলকাতা বরাবরই বিশ্বজনীন শহর। সেখানে হিন্দিভাষী, মারোয়াড়ি , গুজরাটি, তামিল, মালায়লাম, উর্দুভাষী এমনকি চীনা ভাষাভাষীরাও থাকে। ১৯৬০-এর দশকে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাজনীতির ছোট আলোড়ন দেখা দিলেও তা ১৯৮০’র দশকের দিকে মিলিয়ে যায়। তবে ভাষাভিত্তিক রাজনীতি আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাংলা পক্ষের’ মতো গ্রুপগুলোর তৎপরতার মাধ্যমে।

পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ৯ কোটির ওপরে। এক কোটি হিন্দিভাষী মানুষের বাস, যাদের একটি বড় অংশ কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের শিল্পাঞ্চলগুলোর বাসিন্দা। ফলে তৃণমূলের যে প্রচারণা তাতে কিন্তু তাদের অপরভাষী ভোটারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, বিজেপি কিন্তু বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহিরাগত বলতে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন এই প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিকভাবে শক্তি জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছে। তবে তৃণমূল বলতে চাইছে বহিরাগত বলতে তারা শুধু নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি যাদের রাজ্যে এনেছে, তাদের কথা বোঝাতে চাইছে। যারা অনেক প্রজন্ম ধরে এখানে আছে তাদের কথা বলছেন না। যাই হোক, বিজেপি কিন্তু এই প্রশ্নে তাদের জঙ্গি প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া তৃণমূল সরকারের সাবেক মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, ‘কলকাতায় সবসময় বিশ্বজনীন সংস্কৃতি ছিল। এটি পশ্চিমবঙ্গের সৌন্দর্য। যারাই এখানে এসেছে তারাই বাঙালি সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছে। ভারতের সব অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে শিল্পকলা, স্বাধীনতা আন্দোলন, জনজীবন যাপন করেছে বাঙালি। এখন এই বিভাজনের প্রশ্ন কেন আসছে?’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার বলেন, আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব এবং ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে সঙ্গে নিয়ে কিন্তু বিহার ও ঝাড়খন্ডের হিন্দিভাষীদের সঙ্গে পেতে পারতেন মমতা।

কিন্তু অনেকে অন্য কথাও বলেন। তাদের মতে, বাঙালির কন্যা হলেও মমতা গরিব হিন্দিভাষীদের মধ্যে জনপ্রিয়। ভোটের আগে-পরের অনেক জরিপেই দেখা গেছে, বস্তিগুলোতে ‘দিল্লি মে মোদি, বাঙাল মে দিদি’ স্লোগান দেখা যাচ্ছে।

আবার তৃণমূল তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের অগ্রগতির দিক তুলে ধরেছে। যেমন তাদের কন্যাশ্রী- যার আওতায় মেয়েদের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সরাসরি মেয়েদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে দেয়ার যে কর্মসূচি, যা জাতিসংঘেও প্রশংসিত, সেটির কথা বলা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নারীদের এই অগ্রগতির প্রচারণায় ভোটে পাবে তৃণমূল।

সমাদ্দার বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রগুলোতে নারীর উপস্থিতি মমতার জন্য সহায়ক হবে। নারীদের মাঝে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়।’

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বর্ণভেদ প্রকাশ্য না থাকলেও বিজেপি এবার মতুয়া, নমশূদ্র, মহিষ্যাদের কাছে গিয়েছে আলাদাভাবে। তাদের জন্য আলাদা কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে।

সিপিআই(এম)-এর সাবেক পলিটব্যুরো সদস্য এবং এমপি নীলোৎপল বসু বলেন, ‘এবার প্রধানমন্ত্রী একটি জনগোষ্ঠীর ভোটারদের কাছে পেতে পাশের দেশে পর্যন্ত গেছেন। এটা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের রাজনীতিতে আগে কখনও ঘটেনি।’

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষের অন্তত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বর্ণপ্রথার তেমন ভূমিকা ছিল না। বাঙালির উনিশ শতকি পুনর্জাগরণ এবং ১৯৪৭ সালকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলির জেরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে হিন্দুদের মধ্যকার বর্ণবিভেদের ভূমিকা সামনে আসতো না।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ১৯৪৭-এর দেশভাগের ধর্মীয় রাজনীতির কৌশলগুলোও ভিন্নভাবে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলে।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির বরাবরের অভিযোগ ভোট টানতে সংখ্যালঘু তোষণ আর তৃণমূল বলে আসছে ভোটের রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করতেই বিজেপির জয় শ্রীরাম সেøাগান। দীনেশ ত্রিবেদী অবশ্য বলেন, এই সেøাগান দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

হিন্দুত্ববাদীদের সমালোচনার জবাবেই নিজে যে ব্রাহ্মণ ঘরের কন্যা তা চন্ডীপাঠ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মমতা আবার নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষায় কোরআন পাঠও করেন জনসভায়।

নির্বাচনের ফলে এসবের কী প্রভাব পড়বে তা দেখা যাবে শীঘ্রই, কিন্তু আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে- যে বিভেদের রেখা প্রশস্ত হলো এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, তা আগামীতে রয়ে যাবে।

পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির সভাপতি ও সাবেক এমপি অভিজিত মুখার্জি বলেন, ‘বিজেপি ও তৃণমূল উভয়ই এখানে যেভাবে বিভক্তি তৈরি করেছে, তা আমাদের সমাজে গভীর ক্ষত রেখে যাবে। একটি সমাজ যার এমন গর্ব করার মতো প্রগতির ইতিহাস আছে, তার জন্য এটা খুব মর্মান্তিক। যারাই জিতুক বা হারুক, ভবিষ্যতে এই বিভক্তির বাইরে রাজনীতিকে নেয়া আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হবে।’

(ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইর বিশ্লেষণ আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত)

আরও খবর
লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রদের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রীর
দুর্যোগ-সংকটে ‘লিপ সার্ভিস’ নয় বিএনপিকে কাদের
রাত পোহালেই ৬ষ্ঠ দফা ভোট
জনপ্রতি ফিতরা সর্বোচ্চ ২৩১০ সর্বনিম্ন ৭০ টাকা
চলে গেলেন নববিনির্মাণের স্রষ্টা কবি শঙ্খ ঘোষ
শাকিল-সাইফুলদের দিন আর ফেরে না
স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ থেকে গণপরিবহন চালু করতে চান শ্রমিক নেতারা
লকডাউনে সুযোগ নিচ্ছে ভূমিদস্যু খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ
হেফাজত নেতা সাখাওয়াত ও মঞ্জুরুল ২১ দিনের রিমান্ডে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশিত কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি স্কপের
ধর্ম, জাত, পরিচয়ই কি নিয়ামক?

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন : পাল্টাচ্ছে প্রচারণার কৌশল তবে প্রাধান্য বিভেদের

জয়ন্ত রায় চৌধুরী, পিটিআই, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গ জয়ে ঐতিহাসিক মহারণ চলছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। গত দেড়মাস ধরে মরণপণ প্রচারণায় অবতীর্ণ দু-পক্ষই। লড়াইয়ে জিততে বারবার বদলাচ্ছে কৌশল, দুই দলই।

শুরু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রচারণার কেন্দ্রে ছিল- ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ আর বিজেপির- ‘দুয়ারে সরকার’।

তবে প্রচারণার এই পর্যায়ে, যখন ভোটগ্রহণের আর তিন পর্ব বাকি, কৌশল পাল্টেছেন মমতা। এবার তিনি সমালোচনার তোপ দাগছেন নরেন্দ্র মোদির কোভিড ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। করোনার দ্বিতীয় দফা বিস্তারের মুখে ভারতকে কতটা অরক্ষিত রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী, সেই অভিযোগ তুলেছেন। রাজ্যে করোনা বিস্তারের জন্য বিজেপির আনা বহিরাগতদের দায়ী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তার এই প্রচারণা কাজে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কেননা বিজেপি ব্যস্ত হয়ে গেছে আত্মপক্ষ সমর্থনে। এতদিন প্রচারণায় কাটমানি বা ঘুষ, দুর্নীতির অভিযোগে তৃণমূলকে ভালোই কোণঠাসা রাখতে পেরেছিল বিজেপি।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক, পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারণা সাড়া ফেলতে সমর্থ হলেও, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি আর তৃণমূলের দুর্নীতির সমালোচনাসহ বিজেপির প্রচারণা বেশি সংগঠিত ছিল। তাছাড়া বাঙালি সমাজের বিভক্তিগুলোকে প্রচারণায় ভালোই কাজে লাগিয়েছে বিজেপি।’

কলকাতার মাওলানা আজাদ ইনস্টিটিউটের এই প্রবীণ অধ্যাপক বলেন, ‘এখন মমতা হয়তো বুঝেছেন দেড় মাসব্যাপী নির্বাচনে শুধু উন্নয়ন আর ভাষার প্রসঙ্গ দিয়ে হবে না। কোভিড প্রসঙ্গটি আরও আগেই আনার জন্য তাকে পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল তার উপদেষ্টাদের।’

কলকাতা ছেয়ে আছে ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ লেখা হোর্ডিংয়ে। ৩৩০ বছরের পুরনো এই শহরে এই মন্ত্রে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের প্রচারণা রুখতে চাইছে তারা। এছাড়া রাজ্যে অন্য জায়গা থেকে আসা মানুষের সংখ্যা, ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যের বাঙালি মধ্যবিত্তের শঙ্কাও এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

তবে কলকাতা বরাবরই বিশ্বজনীন শহর। সেখানে হিন্দিভাষী, মারোয়াড়ি , গুজরাটি, তামিল, মালায়লাম, উর্দুভাষী এমনকি চীনা ভাষাভাষীরাও থাকে। ১৯৬০-এর দশকে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাজনীতির ছোট আলোড়ন দেখা দিলেও তা ১৯৮০’র দশকের দিকে মিলিয়ে যায়। তবে ভাষাভিত্তিক রাজনীতি আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাংলা পক্ষের’ মতো গ্রুপগুলোর তৎপরতার মাধ্যমে।

পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ৯ কোটির ওপরে। এক কোটি হিন্দিভাষী মানুষের বাস, যাদের একটি বড় অংশ কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের শিল্পাঞ্চলগুলোর বাসিন্দা। ফলে তৃণমূলের যে প্রচারণা তাতে কিন্তু তাদের অপরভাষী ভোটারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, বিজেপি কিন্তু বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহিরাগত বলতে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন এই প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিকভাবে শক্তি জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছে। তবে তৃণমূল বলতে চাইছে বহিরাগত বলতে তারা শুধু নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি যাদের রাজ্যে এনেছে, তাদের কথা বোঝাতে চাইছে। যারা অনেক প্রজন্ম ধরে এখানে আছে তাদের কথা বলছেন না। যাই হোক, বিজেপি কিন্তু এই প্রশ্নে তাদের জঙ্গি প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া তৃণমূল সরকারের সাবেক মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, ‘কলকাতায় সবসময় বিশ্বজনীন সংস্কৃতি ছিল। এটি পশ্চিমবঙ্গের সৌন্দর্য। যারাই এখানে এসেছে তারাই বাঙালি সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছে। ভারতের সব অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে শিল্পকলা, স্বাধীনতা আন্দোলন, জনজীবন যাপন করেছে বাঙালি। এখন এই বিভাজনের প্রশ্ন কেন আসছে?’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার বলেন, আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব এবং ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে সঙ্গে নিয়ে কিন্তু বিহার ও ঝাড়খন্ডের হিন্দিভাষীদের সঙ্গে পেতে পারতেন মমতা।

কিন্তু অনেকে অন্য কথাও বলেন। তাদের মতে, বাঙালির কন্যা হলেও মমতা গরিব হিন্দিভাষীদের মধ্যে জনপ্রিয়। ভোটের আগে-পরের অনেক জরিপেই দেখা গেছে, বস্তিগুলোতে ‘দিল্লি মে মোদি, বাঙাল মে দিদি’ স্লোগান দেখা যাচ্ছে।

আবার তৃণমূল তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের অগ্রগতির দিক তুলে ধরেছে। যেমন তাদের কন্যাশ্রী- যার আওতায় মেয়েদের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সরাসরি মেয়েদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে দেয়ার যে কর্মসূচি, যা জাতিসংঘেও প্রশংসিত, সেটির কথা বলা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নারীদের এই অগ্রগতির প্রচারণায় ভোটে পাবে তৃণমূল।

সমাদ্দার বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রগুলোতে নারীর উপস্থিতি মমতার জন্য সহায়ক হবে। নারীদের মাঝে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়।’

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বর্ণভেদ প্রকাশ্য না থাকলেও বিজেপি এবার মতুয়া, নমশূদ্র, মহিষ্যাদের কাছে গিয়েছে আলাদাভাবে। তাদের জন্য আলাদা কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে।

সিপিআই(এম)-এর সাবেক পলিটব্যুরো সদস্য এবং এমপি নীলোৎপল বসু বলেন, ‘এবার প্রধানমন্ত্রী একটি জনগোষ্ঠীর ভোটারদের কাছে পেতে পাশের দেশে পর্যন্ত গেছেন। এটা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের রাজনীতিতে আগে কখনও ঘটেনি।’

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষের অন্তত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বর্ণপ্রথার তেমন ভূমিকা ছিল না। বাঙালির উনিশ শতকি পুনর্জাগরণ এবং ১৯৪৭ সালকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলির জেরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে হিন্দুদের মধ্যকার বর্ণবিভেদের ভূমিকা সামনে আসতো না।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ১৯৪৭-এর দেশভাগের ধর্মীয় রাজনীতির কৌশলগুলোও ভিন্নভাবে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলে।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির বরাবরের অভিযোগ ভোট টানতে সংখ্যালঘু তোষণ আর তৃণমূল বলে আসছে ভোটের রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করতেই বিজেপির জয় শ্রীরাম সেøাগান। দীনেশ ত্রিবেদী অবশ্য বলেন, এই সেøাগান দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

হিন্দুত্ববাদীদের সমালোচনার জবাবেই নিজে যে ব্রাহ্মণ ঘরের কন্যা তা চন্ডীপাঠ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মমতা আবার নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষায় কোরআন পাঠও করেন জনসভায়।

নির্বাচনের ফলে এসবের কী প্রভাব পড়বে তা দেখা যাবে শীঘ্রই, কিন্তু আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে- যে বিভেদের রেখা প্রশস্ত হলো এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, তা আগামীতে রয়ে যাবে।

পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির সভাপতি ও সাবেক এমপি অভিজিত মুখার্জি বলেন, ‘বিজেপি ও তৃণমূল উভয়ই এখানে যেভাবে বিভক্তি তৈরি করেছে, তা আমাদের সমাজে গভীর ক্ষত রেখে যাবে। একটি সমাজ যার এমন গর্ব করার মতো প্রগতির ইতিহাস আছে, তার জন্য এটা খুব মর্মান্তিক। যারাই জিতুক বা হারুক, ভবিষ্যতে এই বিভক্তির বাইরে রাজনীতিকে নেয়া আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হবে।’

(ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইর বিশ্লেষণ আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত)