চলে গেলেন নববিনির্মাণের স্রষ্টা কবি শঙ্খ ঘোষ

‘এই সেই অনেক দিনের ঘর তার দেয়াল ফাটছে, আশা ফাটছে।’ ঘরটি ফাটতে ফাটতে আজ ভূলুণ্ঠিত হলো মাটিতে। আজ ‘ঘুমিয়ে পড়েছে অ্যালবাম’।

অ্যালবামের পাতায় পাতায় মুদ্রিত দীর্ঘ ৮৯ বছরের প্রতিটি ক্ষণ-প্রহর আজ স্তব্ধ, নির্বাক। নিষ্প্রাণ নিথর দেহে অবাক সাবলীল ডানায় চড়ে বসেছে অগণিত পাঠক-ভক্ত-বন্ধু-শুভাকাক্সক্ষী ও স্বজনদের স্মৃতিমুখরতায়। ছবিগুলো শুধুই ছবি। এতো এতো কর্মমুখরতার ভার আজ হয়ে গেল অভিভাবকশূন্য, কিন্তু প্রবল শক্তিধর।

চৌত্রিশটি কাব্যগ্রন্থ, অর্ধশতাধিত গদ্যগ্রন্থসহ বিবিধ বিষয়ের শতাধিক গ্রন্থের জনক বাংলা ভাষার প্রবল ক্ষমতাধর কবি শঙ্খ ঘোষকে কোন দিন আর আমরা দেখতে পাবো না। যার কলমের একটি খোঁচাকে ভয় করতো সমগ্র ভারতবর্ষ, যার দুটি লাইনই কাঁপিয়ে দিতো একশত ত্রিশ কোটি মানুষের শাসকের সিংহাসন, যার ভয়ে তটস্থ থাকতো অরাজকতার দ-মু-েরা, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও বরণীয় সেই কবি বিরাট অভিমান করে দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে, নিজের বাড়িতে শুয়েই করোনা সংক্রমণের কাছে হার মানলেন, চলে গেলেন অজানা পরপারে।

কয়েক মাস ধরেই শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এ বছর জানুয়ারি মাসে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয় তাকে। ১৪ এপ্রিল জানা যায় তিনি করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। তবে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ঝুঁকি না নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। সেখানেই চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। গতকাল সকালে তাকে ভেন্টিলেটরে দেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টার পরও বেলা ১২টা নাগাদ ভেন্টিলেটর খুলে নেয়া হয়।

তার শেষ কথাগুলো বলা হয়ে গেছে। আর কোন কথা তিনি বলবেন না। যা বলবেন তা মিলিয়ে যাবে অন্ধকারে। যেভাবে বলেছিলেন তিনি, ‘আমাদের শেষ কথাগুলি গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে/ আমাদের শেষ কথাগুলি।’ সব কথা আজ সত্যি সত্যি নিজেই অন্ধকারে দেহে মীমাংসিত হলো।

শঙ্খ ঘোষ এমন একজন কবি, এমন একজন ¯্রষ্টা, এমন একজন রবীন্দ্র গবেষক, এমন একজন চেতনা, যাকে পরিমাপ করা, সংজ্ঞায়িত করা, কিংবা ব্যাখ্যা করাÑ কোন গড়পড়তা ভাষা কিংবা চিন্তায় সম্ভব নয়। আসলে শঙ্খ ঘোষ বিশ শতকের কবিতায় একটি আবির্ভাবের নাম।

ত্রিশ পরবর্তী পঞ্চাশের বাংলা কবিতার অপর পঞ্চপা-বের একজন বলে আমরা আসলে তাকে খ-িত করে মূল্যায়ন করি। শঙ্খ এতো বড় মাপের প্রতিভা যে, ত্রিশের ওই পঞ্চপা-বের কারো কারো চেয়েও তিনি ব্যাপক প্রতিভাবান। তিনি রবীন্দ্র গবেষক ছিলেন বলে আমরা তাকে যেমন রবীন্দ্রনাথের অনুসারী বলতে পারি না, তেমনি তাকে জীবনানন্দ অনুসারী বলেও আমরা খ-িতভাবেই মূল্যায়ন করি।

তার সময়ে, সেই পঞ্চাশের দশকে অনেক কবি কাব্যযাত্রা শুরু করেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ ও আলোক সরকার সম্পাদিত ‘শতভিষা’ পত্রিকা তাদের মুখপত্রের কাজ করেছে বটে, কিন্তু প্রতিটি প্রতিভাই স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এবং বিশেষ করে শতভিষা সম্পাদক কবি আলোক সরকারের সরাসরি জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে’র সঙ্গে যোগাযোগ, তাদের লেখাপত্র প্রকাশ শতভিষাকে অন্য মাত্রা এনে দেয়।

একইভাবে কৃত্তিবাসের সুনীল, শক্তি, বিনয়, উৎপল, শঙ্খ তাদের কাব্যযাত্রাও শেষ পর্যন্ত প্রবল স্বকীয়তায় পরিচিতি পায়। আবার উৎপল কিংবা শক্তির হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে একাত্মতা তাদের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয়।

আমেরিকার আইওয়া লেখক কর্মশালায় যোগ দেন সুনীল ও শঙ্খ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সুনীলের বেলায় শেষ পর্যন্ত কথাসাহিত্যিক পরিচয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে, এমনকি ত্রিশের একমাত্র জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্য সবাইকে ছাপিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ যে নতুন ও অভিনব এক কাব্যভাষা সৃষ্টি করেন, তা বাংলা কবিতাকে একটি নতুন পথের ইঙ্গিত করে, যে ধারা এখনও প্রবহমান এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে, এখনকার একজন তরুণ কবি পর্যন্ত কবি শঙ্খ ঘোষকে আইডল মনে করে। তার মতো কবিতা লিখতে চেষ্টা করে।

এ সময়ের বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী একে নয়, ওকে নয়, তার গুরুর আসনে বসিয়ে রেখেছেন এই শঙ্খ ঘোষকেই। সত্যিকার অর্থে কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষার জাদুময়তা এবং সম্মোহনী ক্ষমতা যেন সম্পূর্ণ ঐশ^রিক এবং অভাবনীয় কৌতূহল উদ্দীপক। এমনকি তার শেষ সময়ের কবিতাগুলোও ছিল এমন যাদুকরী ভাষা, উপমা, মেটাফোর, চিত্রকল্পের সমাহার যে, আমরা তাকিয়ে থেকেছি গুরুর শেষ পঙ্ক্তিটির যাদুশক্তির দিকে। তাকে সত্যিকার অর্থে বলা যায় নতুন নতুন বিনির্মাণের ¯্রষ্টা। তিনি প্রচলিতকে ভেঙে নির্মাণ করতেন নতুন পথ।

নানা আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথ তাকিয়ে থেকেছে শঙ্খ ঘোষের একটি কি দুটি পঙ্ক্তির জন্য। কেন না যতো বড় শক্তিশালী শাসকই হোক না কেন, শঙ্খ ঘোষ তার মুখোশ উন্মোচন করতে পিছপা হতেন না। কত হুমকি ধমকি, জীবননাশের হুঙ্কার শুনেছেন তবু জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কোন দিন আপস করেননি। তার কবিতার নীরবতার পঙ্ক্তিটিকেও শাসক ভয় পেত।

শঙ্খ ঘোষের এই চলে যাওয়াকে শুধুই চলে যাওয়া বলা যায় না। বর্তমান সাম্প্রদায়িক সরকারের আগ্রাসনের মুখে শঙ্খ ঘোষের ভারতবর্ষ আজ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ল, সন্দেহ নেই। একটি নির্মোহ কবিপ্রাণ কিংবা শিল্পী সত্তা যে কত বেশি শক্তিমান হতে পারে, ভারতবর্ষের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে কবি শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, মূর্খ বড় সামাজিক নয়, দিনগুলি রাতগুলি, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, বাবরের প্রার্থনা, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ- এ জাতীয় অসংখ্য জনপ্রিয় কাব্যগন্থ রচনা করেছেন শঙ্খ ঘোষ সত্যি, কিন্তু জনপ্রিয়তার জন্য তিনি কখনও লেখেননি। যে মানবিক মূল্যবোধের কমিটমেন্ট তাকে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই কমিটমেন্ট তিনি আজীবন ধরে রেখেছেন।

তার গদ্যভাষা ছিল ঈর্ষণীয় রকমের আগ্রহোদ্দীপক। তিনি অর্ধশতাধিক গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম, কবির অভিপ্রায়, হে মহাজীবন : রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, আইওয়ার ডায়েরি, সন্ধ্যানদীর জলে, সময়ের জলছবি, ছন্দের বারান্দা, নিঃশব্দের তর্জনী প্রভৃতি গ্রন্থ বলতে গেলে উঁচু উঁচু চিন্তাবিদদেরও শিক্ষিত করেছে।

শঙ্খ ঘোষ ছিলেন সত্যিকার অর্থে তারুণ্য-বান্ধব (তরুণ-বান্ধব নয়) কবি। বয়স নয়, ভেতরের তারুণ্যকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করতেন লিটল ম্যাগাজিনে। তরুণ কবিগণ তাদের বহুশ্রমের গ্রন্থটি প্রকাশ করে শঙ্খ ঘোষকে দিয়ে আসতেন একটি মন্তব্যের জন্য। শঙ্খ ঘোষের সেই সুখ্যাতি রয়েছে যে, তিনি প্রতিটি গ্রন্থ পাঠ করতেন এবং সে সম্পর্কে লিখিত বা মৌখিক মন্তব্য করতেন। বইটি সংরক্ষণ করতেন।

বাংলাদেশের চাঁদপুরের সন্তান কবি শঙ্খ ঘোষ ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে। কবির পরেই তাকে একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার তার উল্লে?খযোগ?্য গদ?্য রচনা ‘বটপাকুড়ের ফেনা’র জন্য। ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পুরস্কারেও ভূষিত করেছে, দিয়েছে দেশিকোত্তম পুরস্কার। এছাড়া সারা জীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। আর তার জীবনের সেরা পুরস্কারটি ছিল সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে মানুষের ভালোবাসা। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।

image
আরও খবর
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন : পাল্টাচ্ছে প্রচারণার কৌশল তবে প্রাধান্য বিভেদের
লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রদের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রীর
দুর্যোগ-সংকটে ‘লিপ সার্ভিস’ নয় বিএনপিকে কাদের
রাত পোহালেই ৬ষ্ঠ দফা ভোট
জনপ্রতি ফিতরা সর্বোচ্চ ২৩১০ সর্বনিম্ন ৭০ টাকা
শাকিল-সাইফুলদের দিন আর ফেরে না
স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ থেকে গণপরিবহন চালু করতে চান শ্রমিক নেতারা
লকডাউনে সুযোগ নিচ্ছে ভূমিদস্যু খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ
হেফাজত নেতা সাখাওয়াত ও মঞ্জুরুল ২১ দিনের রিমান্ডে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশিত কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি স্কপের
ধর্ম, জাত, পরিচয়ই কি নিয়ামক?

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

চলে গেলেন নববিনির্মাণের স্রষ্টা কবি শঙ্খ ঘোষ

ওবায়েদ আকাশ

image

‘এই সেই অনেক দিনের ঘর তার দেয়াল ফাটছে, আশা ফাটছে।’ ঘরটি ফাটতে ফাটতে আজ ভূলুণ্ঠিত হলো মাটিতে। আজ ‘ঘুমিয়ে পড়েছে অ্যালবাম’।

অ্যালবামের পাতায় পাতায় মুদ্রিত দীর্ঘ ৮৯ বছরের প্রতিটি ক্ষণ-প্রহর আজ স্তব্ধ, নির্বাক। নিষ্প্রাণ নিথর দেহে অবাক সাবলীল ডানায় চড়ে বসেছে অগণিত পাঠক-ভক্ত-বন্ধু-শুভাকাক্সক্ষী ও স্বজনদের স্মৃতিমুখরতায়। ছবিগুলো শুধুই ছবি। এতো এতো কর্মমুখরতার ভার আজ হয়ে গেল অভিভাবকশূন্য, কিন্তু প্রবল শক্তিধর।

চৌত্রিশটি কাব্যগ্রন্থ, অর্ধশতাধিত গদ্যগ্রন্থসহ বিবিধ বিষয়ের শতাধিক গ্রন্থের জনক বাংলা ভাষার প্রবল ক্ষমতাধর কবি শঙ্খ ঘোষকে কোন দিন আর আমরা দেখতে পাবো না। যার কলমের একটি খোঁচাকে ভয় করতো সমগ্র ভারতবর্ষ, যার দুটি লাইনই কাঁপিয়ে দিতো একশত ত্রিশ কোটি মানুষের শাসকের সিংহাসন, যার ভয়ে তটস্থ থাকতো অরাজকতার দ-মু-েরা, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও বরণীয় সেই কবি বিরাট অভিমান করে দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে, নিজের বাড়িতে শুয়েই করোনা সংক্রমণের কাছে হার মানলেন, চলে গেলেন অজানা পরপারে।

কয়েক মাস ধরেই শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এ বছর জানুয়ারি মাসে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয় তাকে। ১৪ এপ্রিল জানা যায় তিনি করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। তবে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ঝুঁকি না নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। সেখানেই চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। গতকাল সকালে তাকে ভেন্টিলেটরে দেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টার পরও বেলা ১২টা নাগাদ ভেন্টিলেটর খুলে নেয়া হয়।

তার শেষ কথাগুলো বলা হয়ে গেছে। আর কোন কথা তিনি বলবেন না। যা বলবেন তা মিলিয়ে যাবে অন্ধকারে। যেভাবে বলেছিলেন তিনি, ‘আমাদের শেষ কথাগুলি গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে/ আমাদের শেষ কথাগুলি।’ সব কথা আজ সত্যি সত্যি নিজেই অন্ধকারে দেহে মীমাংসিত হলো।

শঙ্খ ঘোষ এমন একজন কবি, এমন একজন ¯্রষ্টা, এমন একজন রবীন্দ্র গবেষক, এমন একজন চেতনা, যাকে পরিমাপ করা, সংজ্ঞায়িত করা, কিংবা ব্যাখ্যা করাÑ কোন গড়পড়তা ভাষা কিংবা চিন্তায় সম্ভব নয়। আসলে শঙ্খ ঘোষ বিশ শতকের কবিতায় একটি আবির্ভাবের নাম।

ত্রিশ পরবর্তী পঞ্চাশের বাংলা কবিতার অপর পঞ্চপা-বের একজন বলে আমরা আসলে তাকে খ-িত করে মূল্যায়ন করি। শঙ্খ এতো বড় মাপের প্রতিভা যে, ত্রিশের ওই পঞ্চপা-বের কারো কারো চেয়েও তিনি ব্যাপক প্রতিভাবান। তিনি রবীন্দ্র গবেষক ছিলেন বলে আমরা তাকে যেমন রবীন্দ্রনাথের অনুসারী বলতে পারি না, তেমনি তাকে জীবনানন্দ অনুসারী বলেও আমরা খ-িতভাবেই মূল্যায়ন করি।

তার সময়ে, সেই পঞ্চাশের দশকে অনেক কবি কাব্যযাত্রা শুরু করেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ ও আলোক সরকার সম্পাদিত ‘শতভিষা’ পত্রিকা তাদের মুখপত্রের কাজ করেছে বটে, কিন্তু প্রতিটি প্রতিভাই স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এবং বিশেষ করে শতভিষা সম্পাদক কবি আলোক সরকারের সরাসরি জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে’র সঙ্গে যোগাযোগ, তাদের লেখাপত্র প্রকাশ শতভিষাকে অন্য মাত্রা এনে দেয়।

একইভাবে কৃত্তিবাসের সুনীল, শক্তি, বিনয়, উৎপল, শঙ্খ তাদের কাব্যযাত্রাও শেষ পর্যন্ত প্রবল স্বকীয়তায় পরিচিতি পায়। আবার উৎপল কিংবা শক্তির হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে একাত্মতা তাদের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয়।

আমেরিকার আইওয়া লেখক কর্মশালায় যোগ দেন সুনীল ও শঙ্খ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সুনীলের বেলায় শেষ পর্যন্ত কথাসাহিত্যিক পরিচয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে, এমনকি ত্রিশের একমাত্র জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্য সবাইকে ছাপিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ যে নতুন ও অভিনব এক কাব্যভাষা সৃষ্টি করেন, তা বাংলা কবিতাকে একটি নতুন পথের ইঙ্গিত করে, যে ধারা এখনও প্রবহমান এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে, এখনকার একজন তরুণ কবি পর্যন্ত কবি শঙ্খ ঘোষকে আইডল মনে করে। তার মতো কবিতা লিখতে চেষ্টা করে।

এ সময়ের বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী একে নয়, ওকে নয়, তার গুরুর আসনে বসিয়ে রেখেছেন এই শঙ্খ ঘোষকেই। সত্যিকার অর্থে কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষার জাদুময়তা এবং সম্মোহনী ক্ষমতা যেন সম্পূর্ণ ঐশ^রিক এবং অভাবনীয় কৌতূহল উদ্দীপক। এমনকি তার শেষ সময়ের কবিতাগুলোও ছিল এমন যাদুকরী ভাষা, উপমা, মেটাফোর, চিত্রকল্পের সমাহার যে, আমরা তাকিয়ে থেকেছি গুরুর শেষ পঙ্ক্তিটির যাদুশক্তির দিকে। তাকে সত্যিকার অর্থে বলা যায় নতুন নতুন বিনির্মাণের ¯্রষ্টা। তিনি প্রচলিতকে ভেঙে নির্মাণ করতেন নতুন পথ।

নানা আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথ তাকিয়ে থেকেছে শঙ্খ ঘোষের একটি কি দুটি পঙ্ক্তির জন্য। কেন না যতো বড় শক্তিশালী শাসকই হোক না কেন, শঙ্খ ঘোষ তার মুখোশ উন্মোচন করতে পিছপা হতেন না। কত হুমকি ধমকি, জীবননাশের হুঙ্কার শুনেছেন তবু জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কোন দিন আপস করেননি। তার কবিতার নীরবতার পঙ্ক্তিটিকেও শাসক ভয় পেত।

শঙ্খ ঘোষের এই চলে যাওয়াকে শুধুই চলে যাওয়া বলা যায় না। বর্তমান সাম্প্রদায়িক সরকারের আগ্রাসনের মুখে শঙ্খ ঘোষের ভারতবর্ষ আজ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ল, সন্দেহ নেই। একটি নির্মোহ কবিপ্রাণ কিংবা শিল্পী সত্তা যে কত বেশি শক্তিমান হতে পারে, ভারতবর্ষের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে কবি শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, মূর্খ বড় সামাজিক নয়, দিনগুলি রাতগুলি, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, বাবরের প্রার্থনা, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ- এ জাতীয় অসংখ্য জনপ্রিয় কাব্যগন্থ রচনা করেছেন শঙ্খ ঘোষ সত্যি, কিন্তু জনপ্রিয়তার জন্য তিনি কখনও লেখেননি। যে মানবিক মূল্যবোধের কমিটমেন্ট তাকে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই কমিটমেন্ট তিনি আজীবন ধরে রেখেছেন।

তার গদ্যভাষা ছিল ঈর্ষণীয় রকমের আগ্রহোদ্দীপক। তিনি অর্ধশতাধিক গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম, কবির অভিপ্রায়, হে মহাজীবন : রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, আইওয়ার ডায়েরি, সন্ধ্যানদীর জলে, সময়ের জলছবি, ছন্দের বারান্দা, নিঃশব্দের তর্জনী প্রভৃতি গ্রন্থ বলতে গেলে উঁচু উঁচু চিন্তাবিদদেরও শিক্ষিত করেছে।

শঙ্খ ঘোষ ছিলেন সত্যিকার অর্থে তারুণ্য-বান্ধব (তরুণ-বান্ধব নয়) কবি। বয়স নয়, ভেতরের তারুণ্যকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করতেন লিটল ম্যাগাজিনে। তরুণ কবিগণ তাদের বহুশ্রমের গ্রন্থটি প্রকাশ করে শঙ্খ ঘোষকে দিয়ে আসতেন একটি মন্তব্যের জন্য। শঙ্খ ঘোষের সেই সুখ্যাতি রয়েছে যে, তিনি প্রতিটি গ্রন্থ পাঠ করতেন এবং সে সম্পর্কে লিখিত বা মৌখিক মন্তব্য করতেন। বইটি সংরক্ষণ করতেন।

বাংলাদেশের চাঁদপুরের সন্তান কবি শঙ্খ ঘোষ ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে। কবির পরেই তাকে একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার তার উল্লে?খযোগ?্য গদ?্য রচনা ‘বটপাকুড়ের ফেনা’র জন্য। ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পুরস্কারেও ভূষিত করেছে, দিয়েছে দেশিকোত্তম পুরস্কার। এছাড়া সারা জীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। আর তার জীবনের সেরা পুরস্কারটি ছিল সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে মানুষের ভালোবাসা। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।