করোনাকালে প্রান্তিকজন

শাকিল-সাইফুলদের দিন আর ফেরে না

সকাল সাতটায় রিকশা নিয়ে বের হন শাকিল। দুপুর একটায় পকেট হাতিয়ে দেখেন মাত্র ১৬০ টাকা। এদিকে গ্যারেজ মালিককেই জমা দিতে হবে ১০০ টাকা। নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় খালি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখেমুখে ক্লান্তির পাশাপাশি বিরক্তিরও ছাপ। জানালেন, কালিরবাজার থেকে একজন যাত্রী নিয়ে চাষাঢ়ায় এসেছেন প্রায় দেড় ঘণ্টা হতে চললো। দ্বিতীয় কোনো যাত্রীর দেখা পাচ্ছেন না।

শাকিলের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকায় একটি কক্ষে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকেন। স্বাভাবিক দিনগুলোতে একবেলা রিকশা চালালে ৫০০ টাকা উপার্জন হয়। গ্যারেজ মালিককে জমা দেয়ার পর বাকি টাকা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে তার। সঞ্চয় বলতে কিছু নেই।

এখন লকডাউনে শহরে মানুষের আনাগোনা কম হওয়াতে যাত্রীও কম। সাড়ে ছয় ঘণ্টায় কামাই মাত্র ১৬০ টাকা। শাকিল বলেন, ‘এই টাকা থেইকা জমা দিমু কী আর নিজেরাই বা খামু কী! দুই কেজি চাইলের দাম ১১০ টাকা। এক পোয়া তেলের দাম ৩৫ টাকা।’

গ্রীষ্মের তপ্ত গরমে দরদর করে ঘামছিলেন শাকিল। শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন কিছুটা। অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চোখ দু’টি ছলছল করছিল। ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘গতবারের লকডাউনেও কষ্ট করছি। এইবারও তাই। সবতের দিন ফেরে, আমাগো দিন ফেরে না।’

গত সোমবার দুপুরে চাষাঢ়া পুলিশ বক্সের সামনে কথা হচ্ছিল শাকিলের সঙ্গে। এর মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য তাড়া দেনÑ এখানে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে রিকশায় উঠে প্যাডেল মারেন। রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে জীবনের চাকা ঘোরানোর ক্ষীণ আশা নিয়ে।

সাইফুল, সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী। স্ত্রী ও চার শিশু কন্যা নিয়ে তার পরিবার। স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যায়। দুর্মূল্যের এই বাজারে একবেলা প্যাডেলের রিকশা চালিয়ে যা উপার্জন তাতে চলে যেত তাদের। কিন্তু এখন?

সাইফুল বলেন, ‘সকাল দশটায় বাইর হইয়া এখন পর্যন্ত ৮০ টাকা মারছি। এইটা থেইকা জমা দিমু কী আর আমরা খামু কী? করোনা মহামারীতে লকডাউন, ঘরতে লোকজন বাইর হয় না। আমরাও যাত্রী পাই না। কোনমতে ২৫০ হইলে যামু গা। তাও হয় কিনা সন্দেহ।’

গ্রীষ্মের এই দাবদাহে এত কায়িক পরিশ্রমের মধ্যেও রোজা রেখেছেন বলে জানালেন সাইফুল। তিনি বলেন, ‘রোজা রাখলে একবেলা খাওন কম লাগে।’

লকডাউন চলাকালে সড়কের কোথাও যাত্রীর আশায় দাঁড়াতে পারেন না রিকশাচালকরা। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রিকশা আটকে দেয় পুলিশ। লকডাউন অমান্য করে সড়কে বের হওয়াতে রিকশা উল্টে সড়কের ওপর ফেলে রাখা হয়। আগের দিন সাইফুলের রিকশা উল্টে রাখতে গেলে রিকশার ডানা (পেছনের একটি অংশ) ভেঙে যায়। নিজ খরচে তা মেরামত করে আবারও বেরিয়েছেন রাস্তায়।

সাইফুল বলেন, ‘ঘরে থাকলে তো আর কেউ খাওন দিয়াও জিগায় না।’

পুলিশ রিকশা আটক করতে পারে এমন ঝুঁকির পরও চাষাঢ়া পুলিশ বক্সের সামনে খালি রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় শাকিল-সাইফুলের মতো আরও কয়েকজন রিকশাচালক। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া পথচারীর কাছে জানতে চান রিকশা লাগবে কিনা। পথচারীদের ‘না’ শুনে এক চালক নিজ মনেই বলে ওঠেন, ‘সবতে হাইটা গেলে আমরা খামু কী?’

image
আরও খবর
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন : পাল্টাচ্ছে প্রচারণার কৌশল তবে প্রাধান্য বিভেদের
লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রদের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রীর
দুর্যোগ-সংকটে ‘লিপ সার্ভিস’ নয় বিএনপিকে কাদের
রাত পোহালেই ৬ষ্ঠ দফা ভোট
জনপ্রতি ফিতরা সর্বোচ্চ ২৩১০ সর্বনিম্ন ৭০ টাকা
চলে গেলেন নববিনির্মাণের স্রষ্টা কবি শঙ্খ ঘোষ
স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ থেকে গণপরিবহন চালু করতে চান শ্রমিক নেতারা
লকডাউনে সুযোগ নিচ্ছে ভূমিদস্যু খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ
হেফাজত নেতা সাখাওয়াত ও মঞ্জুরুল ২১ দিনের রিমান্ডে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশিত কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি স্কপের
ধর্ম, জাত, পরিচয়ই কি নিয়ামক?

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

করোনাকালে প্রান্তিকজন

শাকিল-সাইফুলদের দিন আর ফেরে না

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

image

সকাল সাতটায় রিকশা নিয়ে বের হন শাকিল। দুপুর একটায় পকেট হাতিয়ে দেখেন মাত্র ১৬০ টাকা। এদিকে গ্যারেজ মালিককেই জমা দিতে হবে ১০০ টাকা। নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় খালি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখেমুখে ক্লান্তির পাশাপাশি বিরক্তিরও ছাপ। জানালেন, কালিরবাজার থেকে একজন যাত্রী নিয়ে চাষাঢ়ায় এসেছেন প্রায় দেড় ঘণ্টা হতে চললো। দ্বিতীয় কোনো যাত্রীর দেখা পাচ্ছেন না।

শাকিলের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকায় একটি কক্ষে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকেন। স্বাভাবিক দিনগুলোতে একবেলা রিকশা চালালে ৫০০ টাকা উপার্জন হয়। গ্যারেজ মালিককে জমা দেয়ার পর বাকি টাকা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে তার। সঞ্চয় বলতে কিছু নেই।

এখন লকডাউনে শহরে মানুষের আনাগোনা কম হওয়াতে যাত্রীও কম। সাড়ে ছয় ঘণ্টায় কামাই মাত্র ১৬০ টাকা। শাকিল বলেন, ‘এই টাকা থেইকা জমা দিমু কী আর নিজেরাই বা খামু কী! দুই কেজি চাইলের দাম ১১০ টাকা। এক পোয়া তেলের দাম ৩৫ টাকা।’

গ্রীষ্মের তপ্ত গরমে দরদর করে ঘামছিলেন শাকিল। শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন কিছুটা। অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চোখ দু’টি ছলছল করছিল। ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘গতবারের লকডাউনেও কষ্ট করছি। এইবারও তাই। সবতের দিন ফেরে, আমাগো দিন ফেরে না।’

গত সোমবার দুপুরে চাষাঢ়া পুলিশ বক্সের সামনে কথা হচ্ছিল শাকিলের সঙ্গে। এর মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য তাড়া দেনÑ এখানে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে রিকশায় উঠে প্যাডেল মারেন। রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে জীবনের চাকা ঘোরানোর ক্ষীণ আশা নিয়ে।

সাইফুল, সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী। স্ত্রী ও চার শিশু কন্যা নিয়ে তার পরিবার। স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যায়। দুর্মূল্যের এই বাজারে একবেলা প্যাডেলের রিকশা চালিয়ে যা উপার্জন তাতে চলে যেত তাদের। কিন্তু এখন?

সাইফুল বলেন, ‘সকাল দশটায় বাইর হইয়া এখন পর্যন্ত ৮০ টাকা মারছি। এইটা থেইকা জমা দিমু কী আর আমরা খামু কী? করোনা মহামারীতে লকডাউন, ঘরতে লোকজন বাইর হয় না। আমরাও যাত্রী পাই না। কোনমতে ২৫০ হইলে যামু গা। তাও হয় কিনা সন্দেহ।’

গ্রীষ্মের এই দাবদাহে এত কায়িক পরিশ্রমের মধ্যেও রোজা রেখেছেন বলে জানালেন সাইফুল। তিনি বলেন, ‘রোজা রাখলে একবেলা খাওন কম লাগে।’

লকডাউন চলাকালে সড়কের কোথাও যাত্রীর আশায় দাঁড়াতে পারেন না রিকশাচালকরা। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রিকশা আটকে দেয় পুলিশ। লকডাউন অমান্য করে সড়কে বের হওয়াতে রিকশা উল্টে সড়কের ওপর ফেলে রাখা হয়। আগের দিন সাইফুলের রিকশা উল্টে রাখতে গেলে রিকশার ডানা (পেছনের একটি অংশ) ভেঙে যায়। নিজ খরচে তা মেরামত করে আবারও বেরিয়েছেন রাস্তায়।

সাইফুল বলেন, ‘ঘরে থাকলে তো আর কেউ খাওন দিয়াও জিগায় না।’

পুলিশ রিকশা আটক করতে পারে এমন ঝুঁকির পরও চাষাঢ়া পুলিশ বক্সের সামনে খালি রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় শাকিল-সাইফুলের মতো আরও কয়েকজন রিকশাচালক। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া পথচারীর কাছে জানতে চান রিকশা লাগবে কিনা। পথচারীদের ‘না’ শুনে এক চালক নিজ মনেই বলে ওঠেন, ‘সবতে হাইটা গেলে আমরা খামু কী?’