ধর্ম, জাত, পরিচয়ই কি নিয়ামক?

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ২৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে। এই প্রথম বার ৮ দফায় বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে। রাজ্যের মোট ২৩টি জেলায় বিধানসভার আসনসংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে ৬৮টি আসন তফসিলি জাতি ও ১৮টি আসন তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বা বিজেপি কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে নাÑ এমনই আভাস মিলেছে জনমত সমীক্ষায়। সিএনএক্সের সমীক্ষায় আভাস, তৃণমূল ও বিজেপি উভয়েই থমকে যাবে ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়ার আগেই। তৃণমূল ও বিজেপির ‘কাঁটে কা টক্করে’ কিং মেকার হয়ে উঠতে পারে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। ভোট শুরুর মুখে জনমত সমীক্ষায় আভাস তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটে থাবা বসাচ্ছে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। আগের জনমত সমীক্ষার তুলনায় তৃণমূলের ৩ শতাংশ ভোট কমছে। বিজেপির ভোট না বাড়লেও, তৃণমূলের ভোটে থাবা বসিয়ে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট সুবিধা করে দিচ্ছে গেরুয়া শিবিরের (বিজেপি)। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের ভোট ভাবনায় কেন্দ্রের প্রভাবসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ কাজ করছে বলে অনুমিত হচ্ছে। কি সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি জাতীয়তা, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, মুসলিম সেন্টিমেন্ট, হিন্দু সেন্টিমেন্ট, এনআরসি ইস্যু, করোনা মহামারী ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্নের মুখে একচেটিয়া সমর্থন বা জোয়ার কোন পক্ষেরই নেই মাঠে।

এক সাক্ষাৎকারে ‘প্রথম কলকাতা’কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর জানান, ‘কেন এই নির্বাচন ঐতিহাসিক? কেন আর পাঁচটা নির্বাচনের থেকে এই নির্বাচনকে আমরা আলাদা করে দেখছি? তার প্রধানত ৩টি কারণ। প্রথম হলো করোনা আবহ। বিশ্বব্যাপী যে অতিমারি। এই অতিমারি পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন। ইতোমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ছে ফলে এ রকম অতিমারি পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পূর্ণ করা এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি নির্বাচনে যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে নির্বাচন সম্পন্ন করা সত্যিই চ্যালেঞ্জ। সে কারণে এটা ঐতিহাসিক। দ্বিতীয়ত, যেটা মনে করা হচ্ছে গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পরই বিধানসভার ভোটের দামামা বেজে যায়। এমন কী, ২০১১ সালের পট পরিবর্তনের নির্বাচনেও এত বড় ভাবে ২০০৯-এর লোকসভার পরে প্রতিদিন মিটিং মিছিল এবং পাখির চোখ করা বিধানসভাকে। এ রকম কিন্তু ২০০৯ সালের পরেও এত ব্যাপক মিটিং মিছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখিনি। যেটা ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে আমরা দেখলাম। এমনকি অতিমারির মধ্যেও প্রতিনিয়ত তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির মধ্যে বাগবিতণ্ডা, সভা পাল্টা সভা, মিছিল পাল্টা মিছিল, প্রতিবাদ পাল্টা প্রতিবাদ এ রকম পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আমরা আগে কখনই দেখিনি।

তৃতীয়ত, এর আগে কখনও এইভাবে আইডেন্টিটি পলিটিক্সও আমরা দেখিনি। অর্থাৎ, পরিচয় সত্ত্বার রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে এই নির্বাচনটা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন ইস্যুভিত্তিক হতে দেখেছি আন্দোলনভিত্তিক হতে দেখেছি। নেতা বা নেত্রীর জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে হতে দেখেছি অর্থাৎ ইস্যু, প্রার্থী, কর্মসূচি এগুলোই স্থান পেয়েছে। কিন্তু এ প্রথম নির্বাচনে আইডেন্টিটি গুরুত্ব হয়ে উঠছে। যেমন মতুয়াদের নিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের কথা বলা হচ্ছে। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে মতুয়া ভোট ব্যাংক হিসেবে এবং বিজেপির ভোট পাওয়ার জায়গা থেকে দেখা হচ্ছে।’

বিগত বেশ ক’বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের পক্ষে তোষণের অভিযোগ উঠেছে। আবার সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের বিরুদ্ধে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ যখন হচ্ছে তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার একের পর এক হিন্দুদের তুষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি হিন্দুদের জন্য কখনও উন্নয়ন বোর্ড। মতুয়াদের জন্য উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করা হয়েছে। এইভাবে পরিচয় স্বত্বাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী রাজনীতি এর আগে পশ্চিমবাংলার মানুষ কখনও দেখেনি। এমনকী বামেরা পর্যন্ত আইডেন্টিটি পলিটিক্স অস্বীকার করতে পারেনি। মুসলিম পরিচয় স্বত্বার ওপর ভিত্তি করে যে আব্বাস সিদ্দিকী আইএসএফ তৈরি করেছে। সেই সংগঠনের সঙ্গেও হাত মেলাতে কুণ্ঠা বোধ করেনি বামেরা। কারণ তারা জানে মুসলিম ভোট ফিরে না আসলে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে দাঁড়ানো যাবে না। ফলে বিজেপি হিন্দু আইডেন্টিটির জায়গা থেকে বামেরাও আইএসএফের সঙ্গে জোট করেছে মুসলিম আইডেন্টিটির জায়গা থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম আইডেন্টিটিকে সম্বোধন করার চেষ্টা করেছেন। সবটা মিলে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচয় স্বত্বার’ রাজনীতি এই নির্বাচনে জাকিয়ে বসেছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। সেই কারণেই এই নির্বাচনকে অনেকেই বলছে ঐতিহাসিক নির্বাচন। পাশাপাশি নির্বাচনী সভায় ‘খেলা হবে’ সেøাগান কোনদিন মানুষ ভাবতে পারেনি নির্বাচনকে খেলার পর্যায় নিয়ে যাওয়া হবে। তার বিপরীতে নানা রকম সেøাগান যেমন উঠে আসছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সবাই কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। গেরুয়া শিবির (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গকে রাজনৈতিকভাবে দখল করার চেষ্টা করছেন উল্টোদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা বাঙালির সেন্টিমেন্ট সামনে এনে তিনি বিজেপির অগ্রযাত্রাকে আটকানোর চেষ্টা করছেন।

কয়েক দিন ধরে ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে সফরের কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল। তার এ সফরকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতির অংশ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে খবরগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। কলকাতার আনন্দবাজার কিংবা দিল্লির হিন্দুস্তান টাইমস স্পষ্ট করে লিখেছে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সব ধরনের কৌশলই গ্রহণ করছে। আর সেই কৌশলেরই অংশ হচ্ছে মতুয়া সম্প্রদায়ের সমর্থন-সহানুভূতি আদায় করা। সফরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে হলেও তার সফরের অংশ হয়েছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় ওড়াকান্দির হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মন্দির এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালীমন্দির।

তৃণমূলের মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনের দিন বাংলাদেশে সফরের নামে ভোট প্রচারণায় তিনি খুবই ক্ষুব্ধ এবং ভোট প্রচারণার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তিনি নির্বাচন বিধি ভঙ্গ করেছেন বলে জানান। এমনকি তিনি এটাকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থি বলেও

আখ্যায়িত করেন। অন্য দেশের রাজনীতিতে, বিশেষত নির্বাচনে ভারতের প্রভাব খাটানোর চেষ্টার বিষয়ে অবশ্য নতুন করে বলার কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পকে জেতাতে ‘আব কা বার ট্রাম্প সরকার’স্লোগানটি মোদিই দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলগুলোর বর্জন ভাঙতে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের উদ্যোগের স্মৃতিও কারও বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ যে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি ইস্যু হয়ে আছে, তা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু মতুয়া ভোটব্যাংক প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের অংশ হয়ে যাওয়ায় এখন নিশ্চিত করে বলা চলে যে ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশের ভূমিকা কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর্তমান বাস্তবতায় বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমে পড়ায় এবং বাংলা দখলের অভিপ্রায়ের কারণে এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের আসন সংখ্যা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ২ মে চূড়ান্ত ফলাফলের দিনই নির্ধারিত হবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পরিচালনা ও নেতৃত্বে থাকবে কে আসছে- তৃণমূল, বিজেপি নাকি বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। ফলাফল যেটাই ঘটুক প্রতিবেশী পশ্চিবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির সম্পর্ক আরও গভীর ও হৃদ্যতার হবে এটাই উভয় বাংলার জনগণের প্রত্যাশা।

[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

আরও খবর
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন : পাল্টাচ্ছে প্রচারণার কৌশল তবে প্রাধান্য বিভেদের
লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রদের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রধানমন্ত্রীর
দুর্যোগ-সংকটে ‘লিপ সার্ভিস’ নয় বিএনপিকে কাদের
রাত পোহালেই ৬ষ্ঠ দফা ভোট
জনপ্রতি ফিতরা সর্বোচ্চ ২৩১০ সর্বনিম্ন ৭০ টাকা
চলে গেলেন নববিনির্মাণের স্রষ্টা কবি শঙ্খ ঘোষ
শাকিল-সাইফুলদের দিন আর ফেরে না
স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ থেকে গণপরিবহন চালু করতে চান শ্রমিক নেতারা
লকডাউনে সুযোগ নিচ্ছে ভূমিদস্যু খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ
হেফাজত নেতা সাখাওয়াত ও মঞ্জুরুল ২১ দিনের রিমান্ডে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশিত কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি স্কপের

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন

ধর্ম, জাত, পরিচয়ই কি নিয়ামক?

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ২৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে। এই প্রথম বার ৮ দফায় বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে। রাজ্যের মোট ২৩টি জেলায় বিধানসভার আসনসংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে ৬৮টি আসন তফসিলি জাতি ও ১৮টি আসন তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বা বিজেপি কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে নাÑ এমনই আভাস মিলেছে জনমত সমীক্ষায়। সিএনএক্সের সমীক্ষায় আভাস, তৃণমূল ও বিজেপি উভয়েই থমকে যাবে ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়ার আগেই। তৃণমূল ও বিজেপির ‘কাঁটে কা টক্করে’ কিং মেকার হয়ে উঠতে পারে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। ভোট শুরুর মুখে জনমত সমীক্ষায় আভাস তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটে থাবা বসাচ্ছে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। আগের জনমত সমীক্ষার তুলনায় তৃণমূলের ৩ শতাংশ ভোট কমছে। বিজেপির ভোট না বাড়লেও, তৃণমূলের ভোটে থাবা বসিয়ে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট সুবিধা করে দিচ্ছে গেরুয়া শিবিরের (বিজেপি)। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের ভোট ভাবনায় কেন্দ্রের প্রভাবসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ কাজ করছে বলে অনুমিত হচ্ছে। কি সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি জাতীয়তা, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, মুসলিম সেন্টিমেন্ট, হিন্দু সেন্টিমেন্ট, এনআরসি ইস্যু, করোনা মহামারী ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্নের মুখে একচেটিয়া সমর্থন বা জোয়ার কোন পক্ষেরই নেই মাঠে।

এক সাক্ষাৎকারে ‘প্রথম কলকাতা’কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর জানান, ‘কেন এই নির্বাচন ঐতিহাসিক? কেন আর পাঁচটা নির্বাচনের থেকে এই নির্বাচনকে আমরা আলাদা করে দেখছি? তার প্রধানত ৩টি কারণ। প্রথম হলো করোনা আবহ। বিশ্বব্যাপী যে অতিমারি। এই অতিমারি পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন। ইতোমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ছে ফলে এ রকম অতিমারি পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পূর্ণ করা এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি নির্বাচনে যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে নির্বাচন সম্পন্ন করা সত্যিই চ্যালেঞ্জ। সে কারণে এটা ঐতিহাসিক। দ্বিতীয়ত, যেটা মনে করা হচ্ছে গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পরই বিধানসভার ভোটের দামামা বেজে যায়। এমন কী, ২০১১ সালের পট পরিবর্তনের নির্বাচনেও এত বড় ভাবে ২০০৯-এর লোকসভার পরে প্রতিদিন মিটিং মিছিল এবং পাখির চোখ করা বিধানসভাকে। এ রকম কিন্তু ২০০৯ সালের পরেও এত ব্যাপক মিটিং মিছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখিনি। যেটা ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে আমরা দেখলাম। এমনকি অতিমারির মধ্যেও প্রতিনিয়ত তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির মধ্যে বাগবিতণ্ডা, সভা পাল্টা সভা, মিছিল পাল্টা মিছিল, প্রতিবাদ পাল্টা প্রতিবাদ এ রকম পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আমরা আগে কখনই দেখিনি।

তৃতীয়ত, এর আগে কখনও এইভাবে আইডেন্টিটি পলিটিক্সও আমরা দেখিনি। অর্থাৎ, পরিচয় সত্ত্বার রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে এই নির্বাচনটা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন ইস্যুভিত্তিক হতে দেখেছি আন্দোলনভিত্তিক হতে দেখেছি। নেতা বা নেত্রীর জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে হতে দেখেছি অর্থাৎ ইস্যু, প্রার্থী, কর্মসূচি এগুলোই স্থান পেয়েছে। কিন্তু এ প্রথম নির্বাচনে আইডেন্টিটি গুরুত্ব হয়ে উঠছে। যেমন মতুয়াদের নিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের কথা বলা হচ্ছে। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে মতুয়া ভোট ব্যাংক হিসেবে এবং বিজেপির ভোট পাওয়ার জায়গা থেকে দেখা হচ্ছে।’

বিগত বেশ ক’বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের পক্ষে তোষণের অভিযোগ উঠেছে। আবার সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের বিরুদ্ধে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ যখন হচ্ছে তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার একের পর এক হিন্দুদের তুষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি হিন্দুদের জন্য কখনও উন্নয়ন বোর্ড। মতুয়াদের জন্য উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করা হয়েছে। এইভাবে পরিচয় স্বত্বাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী রাজনীতি এর আগে পশ্চিমবাংলার মানুষ কখনও দেখেনি। এমনকী বামেরা পর্যন্ত আইডেন্টিটি পলিটিক্স অস্বীকার করতে পারেনি। মুসলিম পরিচয় স্বত্বার ওপর ভিত্তি করে যে আব্বাস সিদ্দিকী আইএসএফ তৈরি করেছে। সেই সংগঠনের সঙ্গেও হাত মেলাতে কুণ্ঠা বোধ করেনি বামেরা। কারণ তারা জানে মুসলিম ভোট ফিরে না আসলে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে দাঁড়ানো যাবে না। ফলে বিজেপি হিন্দু আইডেন্টিটির জায়গা থেকে বামেরাও আইএসএফের সঙ্গে জোট করেছে মুসলিম আইডেন্টিটির জায়গা থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম আইডেন্টিটিকে সম্বোধন করার চেষ্টা করেছেন। সবটা মিলে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচয় স্বত্বার’ রাজনীতি এই নির্বাচনে জাকিয়ে বসেছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। সেই কারণেই এই নির্বাচনকে অনেকেই বলছে ঐতিহাসিক নির্বাচন। পাশাপাশি নির্বাচনী সভায় ‘খেলা হবে’ সেøাগান কোনদিন মানুষ ভাবতে পারেনি নির্বাচনকে খেলার পর্যায় নিয়ে যাওয়া হবে। তার বিপরীতে নানা রকম সেøাগান যেমন উঠে আসছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সবাই কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। গেরুয়া শিবির (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গকে রাজনৈতিকভাবে দখল করার চেষ্টা করছেন উল্টোদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা বাঙালির সেন্টিমেন্ট সামনে এনে তিনি বিজেপির অগ্রযাত্রাকে আটকানোর চেষ্টা করছেন।

কয়েক দিন ধরে ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে সফরের কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল। তার এ সফরকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতির অংশ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে খবরগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। কলকাতার আনন্দবাজার কিংবা দিল্লির হিন্দুস্তান টাইমস স্পষ্ট করে লিখেছে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সব ধরনের কৌশলই গ্রহণ করছে। আর সেই কৌশলেরই অংশ হচ্ছে মতুয়া সম্প্রদায়ের সমর্থন-সহানুভূতি আদায় করা। সফরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে হলেও তার সফরের অংশ হয়েছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় ওড়াকান্দির হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মন্দির এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালীমন্দির।

তৃণমূলের মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনের দিন বাংলাদেশে সফরের নামে ভোট প্রচারণায় তিনি খুবই ক্ষুব্ধ এবং ভোট প্রচারণার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তিনি নির্বাচন বিধি ভঙ্গ করেছেন বলে জানান। এমনকি তিনি এটাকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থি বলেও

আখ্যায়িত করেন। অন্য দেশের রাজনীতিতে, বিশেষত নির্বাচনে ভারতের প্রভাব খাটানোর চেষ্টার বিষয়ে অবশ্য নতুন করে বলার কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পকে জেতাতে ‘আব কা বার ট্রাম্প সরকার’স্লোগানটি মোদিই দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলগুলোর বর্জন ভাঙতে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের উদ্যোগের স্মৃতিও কারও বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ যে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি ইস্যু হয়ে আছে, তা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু মতুয়া ভোটব্যাংক প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের অংশ হয়ে যাওয়ায় এখন নিশ্চিত করে বলা চলে যে ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশের ভূমিকা কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর্তমান বাস্তবতায় বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমে পড়ায় এবং বাংলা দখলের অভিপ্রায়ের কারণে এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের আসন সংখ্যা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ২ মে চূড়ান্ত ফলাফলের দিনই নির্ধারিত হবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পরিচালনা ও নেতৃত্বে থাকবে কে আসছে- তৃণমূল, বিজেপি নাকি বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। ফলাফল যেটাই ঘটুক প্রতিবেশী পশ্চিবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির সম্পর্ক আরও গভীর ও হৃদ্যতার হবে এটাই উভয় বাংলার জনগণের প্রত্যাশা।

[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]