মুক্তির সুবর্ণজয়ন্তীতে নদীপ্রশ্ন

পাভেল পার্থ

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর। মুক্তির এই প্রাণোচ্ছ্বল সুবর্ণলগ্নে কেমন আছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ? মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া দেশের নদী-জলাভূমি? এই দেশ জন্ম নিয়েছে নদীপ্রবাহকে শপথ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিকামী জনতার সাহসী উচ্চারণ ছিল ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। কিন্তু আমরা কী আমাদের নদীর ঠিকানা অবিরল ছলছল রাখতে পেরেছি? যে নদীময়তা মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি তৈরি করল আমরা সেই নদী-ভূগোল বিকশিত করতে পেরেছি। স্বাধীনতার গত ৫০ বছরে? আমাদের নদীবিমুখ উন্নয়ন নদীর সেই ঠিকানা নিরুদ্দেশ করে দিয়েছে, বিস্মৃত করেছে, জোর করে মুছে দিয়েছে। প্রতিদিন দেশের নানাপ্রান্ত থেকে নদীমৃত্যুর খবর আসে। নিহত নদীর লাশের ভারে গণমাধ্যম করুণ হয়ে ওঠে। প্রশ্নহীনভাবে দিনের পর দিন লাশ পড়ে থাকে। কেউ সরায় না। এমনকি রুগ্ণ আহত ক্ষতবিক্ষত জখম নিয়ে কত নদীর আহাজারি। রাষ্ট্র নির্বিকার। নদীর লাশের ওপর দিয়ে নেতার গাড়ি বহর যায়। মরা নদীর রক্তস্রোত ডিঙিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রবৃদ্ধির মাতম ওঠে। চোখের সামনে কত নদী দিনে-দুপুরে খুন হয়ে যায়, ছিনতাই হয়ে যায়, ধর্ষিত হয়, লুট হয়ে যায়, গুম হয়ে যায়। তার হদিশ কেউ রাখে না। নদীর জন্য কোন সাহসী আদালত নেই। নদীর সেবা-শশ্রুষার জন্য কোন হাসপাতালও নেই। আমরা কী এমনই নদীবিমুখ ছিলাম? ইতিহাস কী জনভাষ্য তো তা বলে না। আমরা তো নদীর আওয়াজে বাড়বাড়ন্ত হওয়া নদীপাগল মানুষ। কিন্তু এই আমাদের চোখের সামনেই এক এক করে দিনেদুপুরে, রাতবিরেতে নিরুদ্দেশ নিখোঁজ হয়ে গেলে কত তরতাজা নদী। কী করে হলো? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অবশ্যই আমাদের এই নদীপ্রশ্নকে সামনে আনা দরকার। গত ৫০ বছরে তাহলে ঘটেছে কী? কেন নদীর দেশে নদীরা হারিয়ে গেল একের পর এক? কারণ নদীকে নিরন্তর খুন জখম করেই যে মেদবহুল হলো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দেনদরবার। এই নদীবনাশী উন্নয়নের পুস্তকি নাম ‘নয়াউদারবাদী উন্নয়ন’। দেশের নদ-নদীর প্রাণভিক্ষা রাষ্ট্রের কাছে এখনও কোন আবদার হিসেবে স্বীকৃত নয়। অথচ এই নদীর কঙ্কালের ওপর দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো আমরা বুলি আওড়াই ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক’।

২.

অজস্র নদীপ্রবাহের শিরা-ধমনীতে টেনে আনা উজানের হিমালয়ের পলিতেই জন্ম নিয়েছে ভাটির বাংলাদেশ। নদীর বিন্যাসেই গড়ে উঠেছে এখানকার প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র, স্বভাব, জীবনবোধ, অর্থনীতি ও রাজনীতি। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সুরমা, তিস্তা, মেঘনা, কর্ণফুলী, নাফ, শীতলক্ষ্যা, মগড়া, ফেনী, ডাকাতিয়া, মনু, রক্তি, কপোতাক্ষ, লংলা, ধলেশ্বরী, করতোয়া, ইছামতী, রায়মঙ্গল, শংখ, হালদা, কংশ, তিতাস, পিয়াইন, উবদাখালী, জাদুকাটা, সিমসাং, বড়াল, বলেশ্বর, গড়াই, তুরাগ সব নদ-নদীই আজ মুমূর্ষু ও মরণকামড় দিয়ে মানচিত্র আগলে আছে। এ অঞ্চল নদীসংস্কৃতির আতুরঘর। জীবিকা, খাদ্য, গীতবাদ্য কি জীবনের আওয়াজ সব নদী ঘিরে। এখানে নদী মানে নারী ও পুরুষের গতিময়তা। নদী অববাহিকা যেমন জন্ম দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন ও সম্পর্কের ধরন। নদী ঘিরেই বিকশিত ও বিস্তার ঘটেছে পুঁজির। গড়ে উঠেছে নদীনির্ভর যোগাযোগ ও বাণিজ্য। দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দিরটি নির্মাণ শুরু হয় প্রায় ৩০০ বছর আগে, ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে। এ মন্দিরের পোড়ামাটির ফলকে নৌকাযাত্রার চিত্র আছে। কাছেই টেপা নদী, এখন ক্ষতবিক্ষত। গঙ্গা যেমন জলের দেবী, খোয়াজ খিজির ও বদর গাজী তেমনি পানির পীর। নিম্নœবর্গের বিশ্বাস ও কৃত্য এমনি নদীকেন্দ্রিক। মসলিন ও জামদানির মতো মিহিবুননের বস্ত্র কারিগরির জন্ম দিয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীর অনেক রঙ বলেই আমাদের বস্ত্রবিন্যাসেও এমনি রঙের ভিন্নতা। পাবনার তাঁত, টাঙ্গাইল তাঁত, হাজংদের বানা তাঁত আর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী তাঁতের ভেতর তাই এত বৈভব। নানান নদীর প্রবাহেই বিকশিত হয়েছে দেশের হাজারো ধানের পাঁচালি। মাছে-ভাতের বাংলাদেশ তো আর এমনি হয়নি, এটিও নদীসংস্কৃতির এক অনন্য নির্দেশনা।

২.

নয়াউদারবাদী উন্নয়নপ্রক্রিয়া নদীময় নির্দেশনা অমান্য করেছে, লঙ্ঘন করে চলেছে। নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতির ধারাপ্রবাহ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ষাটের দশকে নরম্যান বোরলগকে খর্বাকৃতির তথাকথিত উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। তার সেই উদ্ভাবনকে কব্জা করে সারা দুনিয়ায় চাপিয়ে দেয়া হয় ফসল উৎপাদনের এক নয়া তড়িকা। নাম দেয়া হয় সবুজ বিপ্লব। যন্ত্র দিয়ে মাটির তলার জল টেনে তুলে, রাসায়নিক সার ও বিষের ফেনায় জমিকে বিষাক্ত করে চালু হয় কৃষি অর্থনীতির বিনাশী উৎপাদন বাহাদুরি। এর আগ পর্যন্ত, মানুষ মেঘের জল কি নদ-নদী-খাল-বিল-হাওর-ছড়া-বাঁওড়ের জলই কৃষি উৎপাদনে কাজে লাগিয়েছে। মানুষ নদীর ব্যাকরণ বোঝার চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্র মানুষের জান ও জবানকে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। খাদ্য উৎপাদনের নামে জমিতে ঢালতে হয়েছে অবিরাম বিষ আর বিষ। বিষের সব তলানি জমে নদীর কলিজা কি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছে। নদীর গর্ভধারণ হয় যে বনপাহাড়ে রাষ্ট্র তা খুন করেছে। একটার পর একটা কারখানা বসিয়েছে। এডিডাস, হিলফাইজার, ফিলিপ মরিস, নাইকির মতো করপোরেট বস্ত্র কোম্পানির বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতেই মূলত: দশাসই হয়েছে এক নদীমাতৃক দেশের গার্মেন্ট শিল্প। গার্মেন্টসহ শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদীর শরীর আজ বিকল। ঢাকার হাজারিবাগ ট্যানারি একাই মেরে ফেলেছে বুড়িগঙ্গাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের উল্টেপাল্টে দিয়েছে সেখানকার নদীবিন্যাস। এমনকি চাবাগান, তামাক চাষ, আগ্রাসি একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাসের বাণিজ্যিক বাগান বা হাইব্রিড ভুট্টা চাষ সবই নদীকে জখম করে চলছে। রাষ্ট্র সবই করেছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতিরে। কিন্তু একটিবারও দেশের নদীময় জীবনকথিকাকে গুরুত্ব দেয়নি। কৃষি, মৎস্য, গার্মেন্ট কি শিল্পকারখানা দেশের সব অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতই নদীমৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু কোন জবাবদিহিতা নেই, কোন বিচার নেই, কোন রেখাপাত নেই। যেন সব নদী এভাবেই মরবে আর চাঙ্গা হতে থাকবে দেশের তথাকথিত প্রবৃদ্ধির হার। যদিও এই প্রবৃদ্ধির গণিতে আগাপাছতলা জড়িয়ে আছে নয়াউদারবাদী করপোরেট সহিংসতা। বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজির লাগাতার অন্যায় বিকাশকে বৈধতা দিয়ে রাষ্ট্র এখনও নদীবিরোধী এমন উন্নয়ন মনস্তত্ব ধারণ করে আছে।

৩.

দেশের ২৩০টি নদ-নদীর ভেতর ৫৪ কি তারও বেশি জলপ্রবাহ নেমেছে ভারতীয় অঞ্চল থেকে, বাকি তিনটির উৎস মায়ানমার। নদীখুনের এই উন্নয়ন-জখম শুধু দেশের ভেতরে নয়, উজানেও এই বাহাদুরির লাগামহীন। রাষ্ট্র এসবের তালাশ ও হিস্যা আদায়ে একেবারেই অথর্ব। ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ, টিপাইমুখ কি উজানে একটার পর একটা বাঁধ আর জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প দেশের নদীপ্রবাহকে গলা টিপে হত্যা করছে প্রতিদিন প্রতিরাত। পাশাপাশি আছে সীমান্ত পাহাড়ে করপোরেট কয়লা ও পাথর খনন। উত্তর-পূর্ব ভারতে এলোপাথারি খননের ফলে পাহাড় ভেঙেচুরে উজানের ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালিতে দম হারিয়ে জীবন দিচ্ছে বাংলাদেশের হাওর-ভাটি অঞ্চল। অভিন্ন নদী বিষয়ে বাংলাদেশের নদী কূটনীতি নদীবান্ধব নয়। জাতিসংঘের নদী সনদ স্বাক্ষর না করাকে রাষ্ট্র এখনও এক জবরদস্তি ‘পৌরুষ’ হিসেবেই জাহির করে যাচ্ছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কোনভাবেই বাঁধবিরোধী নয়। ১৯৬২ সনে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে কর্ণফুলী অববাহিকাকে হত্যা করেছে রাষ্ট্র। দুম করে নদীপ্রবাহে তৈরি করে যাচ্ছে সেতু, বাঁধ, ব্যারেজ, কালভার্ট ও উন্নয়ন অবকাঠামো। পাথর আর বালি বাণিজ্যের নামে খুন করা হয়েছে পিয়াইন, সিমসাং, সারি, ধলাই, মহাদেও, জাদুকাটা, গোয়াইন, তুরাগ, বালু নদী।

৪.

কত নদী, কত নাম, কত সম্পর্ক, কত পরিচয়। এসবের আর কোন হদিশই আজ নেই। নদীর তীরে গড়ে ওঠা বট-পাকুড়-হিজল-তমালের ছায়ায় গ্রামীণ হাট-গঞ্জ-বাজার আজ উধাও। বরং নদীর তীর, এমনকি নদীর বুক পর্যন্ত দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মারদাঙ্গা নগর আর বাণিজ্যকেন্দ্র। যেখানে নদীনির্ভর অর্থনীতির কোন রেখাপাত নেই, কেবলি বহুজাতিক সর্বগ্রাসী বাজার। পদ্মার ইলিশ, তিস্তার পুটিতর, জাদুকাটা-রক্তির নানিদ বা কংশের মহাশোল মাছেরা যেমন নিরুদ্দেশ হয়েছে। বদলে গেছে নদীনির্ভর জীবন ও জীবিকাও। নদী হারিয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে, অচেনা নগরের ভিড়ে স্বীকৃতিহীন দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। নদী নিয়ে সচরাচর নদী-ভাঙন, নদী দখল ও দূষণ, নদী ভরাট, নাব্যতা হ্রাস, পানির ভাগাভাগি এমন সব খবরই বেশি উসকে ওঠে। কিন্তু একদা বিকশিত নদীনির্ভর অর্থনীতির আওয়াজ খুব একটা নাগালে মেলে না। অস্বীকারের কোন উপায় নেই, এই জনপদের গ্রামীণ নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ব্যাকরণ পুরোটাই আদল দিয়েছে নদীর গতিপ্রবাহ। সেই প্রবাহ যেমন রুদ্ধ, তেমনি রুদ্ধ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর বিকাশমানতাও। কারণ রাষ্ট্র দেশের অর্থনৈতিক বিস্তারকে নদীর উজান-ভাটির শর্ত হিসেবে মান্য করেনি। টেনে এনেছে বহুজাতিক পুঁজির অন্যায় বাজার। আর মাথা ন্যুয়ে রেখেছে নদীবিমুখ এক নয়াউদারবাদী উন্নয়ন রাজনীতির চোখরাঙানির তলায়।

৫.

নদীবিরোধী নয়াউদারবাদী উন্নয়ন মনস্তত্ব থেকে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে হবে। উজান-ভাটিতে নদীর আপন গতিপ্রবাহের ন্যায়বিচার সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে দাঁড়াতে হবে। নদীই সচল করে তুলবে দেশের অর্থনীতির ভিত, জীবনের গতি। নদীর তীরেই বিকশিত হয়ে চলেছে গ্রাম-জীবিকা-উৎপাদন ও জীবন। নদীর কাছ থেকে জবরদস্তি করে নদীর তীর লুট করা হচ্ছে। নদীর তীরের ওপর একক মালিকানা, কর্তৃত্ব আর দখলের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্র প্রমাণ করে চলছে নদী বিষয়ে রাষ্ট্রের অন্যায় উদাসীনতা। এভাবে চলতে পারে না। নদীমাতৃক এই দেশে এমন সহস্র নদী-অবিচার আর কত? নদী শুধু স্মৃতিকথা না হয়ে থাকুক, নদী হয়ে ওঠুক জীবন চলার পথ ও পাথেয়। পাটের জিন-মানচিত্র তৈরি করে লোক দেখানো উন্নয়নের ফিরিস্তি নিম্নবর্গ খুব বেশি আমল দেবে না। পাটনির্ভর অর্থনীতি থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো নদীহীনতা। নদীর জান কলিজা থ্যাঁতলে দিয়ে পাট-অর্থনীতি সম্ভব নয়। এতে শুধু পলিথিনের বাজারই চাঙ্গা হবে। আবার হয়তো পলিথিনের কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী থেকে পলিথিন অপসারণের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বরাদ্দ হবে। শুধু প্রকল্প, বাজেট, বরাদ্দ দিয়ে নদীচিন্তা হয় না। দরকার নদীর সত্যিকারের মুক্তি। আর এই মুক্তি সংগ্রামে গর্জে ওঠুক নদীময় তরুণ বাংলাদেশ। শিরায় শিরায় বইয়ে দিক প্রবীণজনের লাখো নদী স্মৃতিকথা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আসুন নদীপ্রশ্নকে জাতীয় জিজ্ঞাসা হিসেবে সামিল করি। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনাকেই’ আমাদের সত্যিকারের ঠিকানা করে তুলি।

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১ , ৯ বৈশাখ ১৪২৮ ৯ রমজান ১৪৪২

মুক্তির সুবর্ণজয়ন্তীতে নদীপ্রশ্ন

পাভেল পার্থ

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর। মুক্তির এই প্রাণোচ্ছ্বল সুবর্ণলগ্নে কেমন আছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ? মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া দেশের নদী-জলাভূমি? এই দেশ জন্ম নিয়েছে নদীপ্রবাহকে শপথ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিকামী জনতার সাহসী উচ্চারণ ছিল ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। কিন্তু আমরা কী আমাদের নদীর ঠিকানা অবিরল ছলছল রাখতে পেরেছি? যে নদীময়তা মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি তৈরি করল আমরা সেই নদী-ভূগোল বিকশিত করতে পেরেছি। স্বাধীনতার গত ৫০ বছরে? আমাদের নদীবিমুখ উন্নয়ন নদীর সেই ঠিকানা নিরুদ্দেশ করে দিয়েছে, বিস্মৃত করেছে, জোর করে মুছে দিয়েছে। প্রতিদিন দেশের নানাপ্রান্ত থেকে নদীমৃত্যুর খবর আসে। নিহত নদীর লাশের ভারে গণমাধ্যম করুণ হয়ে ওঠে। প্রশ্নহীনভাবে দিনের পর দিন লাশ পড়ে থাকে। কেউ সরায় না। এমনকি রুগ্ণ আহত ক্ষতবিক্ষত জখম নিয়ে কত নদীর আহাজারি। রাষ্ট্র নির্বিকার। নদীর লাশের ওপর দিয়ে নেতার গাড়ি বহর যায়। মরা নদীর রক্তস্রোত ডিঙিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রবৃদ্ধির মাতম ওঠে। চোখের সামনে কত নদী দিনে-দুপুরে খুন হয়ে যায়, ছিনতাই হয়ে যায়, ধর্ষিত হয়, লুট হয়ে যায়, গুম হয়ে যায়। তার হদিশ কেউ রাখে না। নদীর জন্য কোন সাহসী আদালত নেই। নদীর সেবা-শশ্রুষার জন্য কোন হাসপাতালও নেই। আমরা কী এমনই নদীবিমুখ ছিলাম? ইতিহাস কী জনভাষ্য তো তা বলে না। আমরা তো নদীর আওয়াজে বাড়বাড়ন্ত হওয়া নদীপাগল মানুষ। কিন্তু এই আমাদের চোখের সামনেই এক এক করে দিনেদুপুরে, রাতবিরেতে নিরুদ্দেশ নিখোঁজ হয়ে গেলে কত তরতাজা নদী। কী করে হলো? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অবশ্যই আমাদের এই নদীপ্রশ্নকে সামনে আনা দরকার। গত ৫০ বছরে তাহলে ঘটেছে কী? কেন নদীর দেশে নদীরা হারিয়ে গেল একের পর এক? কারণ নদীকে নিরন্তর খুন জখম করেই যে মেদবহুল হলো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দেনদরবার। এই নদীবনাশী উন্নয়নের পুস্তকি নাম ‘নয়াউদারবাদী উন্নয়ন’। দেশের নদ-নদীর প্রাণভিক্ষা রাষ্ট্রের কাছে এখনও কোন আবদার হিসেবে স্বীকৃত নয়। অথচ এই নদীর কঙ্কালের ওপর দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো আমরা বুলি আওড়াই ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক’।

২.

অজস্র নদীপ্রবাহের শিরা-ধমনীতে টেনে আনা উজানের হিমালয়ের পলিতেই জন্ম নিয়েছে ভাটির বাংলাদেশ। নদীর বিন্যাসেই গড়ে উঠেছে এখানকার প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র, স্বভাব, জীবনবোধ, অর্থনীতি ও রাজনীতি। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সুরমা, তিস্তা, মেঘনা, কর্ণফুলী, নাফ, শীতলক্ষ্যা, মগড়া, ফেনী, ডাকাতিয়া, মনু, রক্তি, কপোতাক্ষ, লংলা, ধলেশ্বরী, করতোয়া, ইছামতী, রায়মঙ্গল, শংখ, হালদা, কংশ, তিতাস, পিয়াইন, উবদাখালী, জাদুকাটা, সিমসাং, বড়াল, বলেশ্বর, গড়াই, তুরাগ সব নদ-নদীই আজ মুমূর্ষু ও মরণকামড় দিয়ে মানচিত্র আগলে আছে। এ অঞ্চল নদীসংস্কৃতির আতুরঘর। জীবিকা, খাদ্য, গীতবাদ্য কি জীবনের আওয়াজ সব নদী ঘিরে। এখানে নদী মানে নারী ও পুরুষের গতিময়তা। নদী অববাহিকা যেমন জন্ম দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন ও সম্পর্কের ধরন। নদী ঘিরেই বিকশিত ও বিস্তার ঘটেছে পুঁজির। গড়ে উঠেছে নদীনির্ভর যোগাযোগ ও বাণিজ্য। দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দিরটি নির্মাণ শুরু হয় প্রায় ৩০০ বছর আগে, ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে। এ মন্দিরের পোড়ামাটির ফলকে নৌকাযাত্রার চিত্র আছে। কাছেই টেপা নদী, এখন ক্ষতবিক্ষত। গঙ্গা যেমন জলের দেবী, খোয়াজ খিজির ও বদর গাজী তেমনি পানির পীর। নিম্নœবর্গের বিশ্বাস ও কৃত্য এমনি নদীকেন্দ্রিক। মসলিন ও জামদানির মতো মিহিবুননের বস্ত্র কারিগরির জন্ম দিয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীর অনেক রঙ বলেই আমাদের বস্ত্রবিন্যাসেও এমনি রঙের ভিন্নতা। পাবনার তাঁত, টাঙ্গাইল তাঁত, হাজংদের বানা তাঁত আর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী তাঁতের ভেতর তাই এত বৈভব। নানান নদীর প্রবাহেই বিকশিত হয়েছে দেশের হাজারো ধানের পাঁচালি। মাছে-ভাতের বাংলাদেশ তো আর এমনি হয়নি, এটিও নদীসংস্কৃতির এক অনন্য নির্দেশনা।

২.

নয়াউদারবাদী উন্নয়নপ্রক্রিয়া নদীময় নির্দেশনা অমান্য করেছে, লঙ্ঘন করে চলেছে। নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতির ধারাপ্রবাহ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ষাটের দশকে নরম্যান বোরলগকে খর্বাকৃতির তথাকথিত উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। তার সেই উদ্ভাবনকে কব্জা করে সারা দুনিয়ায় চাপিয়ে দেয়া হয় ফসল উৎপাদনের এক নয়া তড়িকা। নাম দেয়া হয় সবুজ বিপ্লব। যন্ত্র দিয়ে মাটির তলার জল টেনে তুলে, রাসায়নিক সার ও বিষের ফেনায় জমিকে বিষাক্ত করে চালু হয় কৃষি অর্থনীতির বিনাশী উৎপাদন বাহাদুরি। এর আগ পর্যন্ত, মানুষ মেঘের জল কি নদ-নদী-খাল-বিল-হাওর-ছড়া-বাঁওড়ের জলই কৃষি উৎপাদনে কাজে লাগিয়েছে। মানুষ নদীর ব্যাকরণ বোঝার চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্র মানুষের জান ও জবানকে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। খাদ্য উৎপাদনের নামে জমিতে ঢালতে হয়েছে অবিরাম বিষ আর বিষ। বিষের সব তলানি জমে নদীর কলিজা কি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছে। নদীর গর্ভধারণ হয় যে বনপাহাড়ে রাষ্ট্র তা খুন করেছে। একটার পর একটা কারখানা বসিয়েছে। এডিডাস, হিলফাইজার, ফিলিপ মরিস, নাইকির মতো করপোরেট বস্ত্র কোম্পানির বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতেই মূলত: দশাসই হয়েছে এক নদীমাতৃক দেশের গার্মেন্ট শিল্প। গার্মেন্টসহ শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদীর শরীর আজ বিকল। ঢাকার হাজারিবাগ ট্যানারি একাই মেরে ফেলেছে বুড়িগঙ্গাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের উল্টেপাল্টে দিয়েছে সেখানকার নদীবিন্যাস। এমনকি চাবাগান, তামাক চাষ, আগ্রাসি একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাসের বাণিজ্যিক বাগান বা হাইব্রিড ভুট্টা চাষ সবই নদীকে জখম করে চলছে। রাষ্ট্র সবই করেছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতিরে। কিন্তু একটিবারও দেশের নদীময় জীবনকথিকাকে গুরুত্ব দেয়নি। কৃষি, মৎস্য, গার্মেন্ট কি শিল্পকারখানা দেশের সব অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতই নদীমৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু কোন জবাবদিহিতা নেই, কোন বিচার নেই, কোন রেখাপাত নেই। যেন সব নদী এভাবেই মরবে আর চাঙ্গা হতে থাকবে দেশের তথাকথিত প্রবৃদ্ধির হার। যদিও এই প্রবৃদ্ধির গণিতে আগাপাছতলা জড়িয়ে আছে নয়াউদারবাদী করপোরেট সহিংসতা। বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজির লাগাতার অন্যায় বিকাশকে বৈধতা দিয়ে রাষ্ট্র এখনও নদীবিরোধী এমন উন্নয়ন মনস্তত্ব ধারণ করে আছে।

৩.

দেশের ২৩০টি নদ-নদীর ভেতর ৫৪ কি তারও বেশি জলপ্রবাহ নেমেছে ভারতীয় অঞ্চল থেকে, বাকি তিনটির উৎস মায়ানমার। নদীখুনের এই উন্নয়ন-জখম শুধু দেশের ভেতরে নয়, উজানেও এই বাহাদুরির লাগামহীন। রাষ্ট্র এসবের তালাশ ও হিস্যা আদায়ে একেবারেই অথর্ব। ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ, টিপাইমুখ কি উজানে একটার পর একটা বাঁধ আর জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প দেশের নদীপ্রবাহকে গলা টিপে হত্যা করছে প্রতিদিন প্রতিরাত। পাশাপাশি আছে সীমান্ত পাহাড়ে করপোরেট কয়লা ও পাথর খনন। উত্তর-পূর্ব ভারতে এলোপাথারি খননের ফলে পাহাড় ভেঙেচুরে উজানের ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালিতে দম হারিয়ে জীবন দিচ্ছে বাংলাদেশের হাওর-ভাটি অঞ্চল। অভিন্ন নদী বিষয়ে বাংলাদেশের নদী কূটনীতি নদীবান্ধব নয়। জাতিসংঘের নদী সনদ স্বাক্ষর না করাকে রাষ্ট্র এখনও এক জবরদস্তি ‘পৌরুষ’ হিসেবেই জাহির করে যাচ্ছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কোনভাবেই বাঁধবিরোধী নয়। ১৯৬২ সনে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে কর্ণফুলী অববাহিকাকে হত্যা করেছে রাষ্ট্র। দুম করে নদীপ্রবাহে তৈরি করে যাচ্ছে সেতু, বাঁধ, ব্যারেজ, কালভার্ট ও উন্নয়ন অবকাঠামো। পাথর আর বালি বাণিজ্যের নামে খুন করা হয়েছে পিয়াইন, সিমসাং, সারি, ধলাই, মহাদেও, জাদুকাটা, গোয়াইন, তুরাগ, বালু নদী।

৪.

কত নদী, কত নাম, কত সম্পর্ক, কত পরিচয়। এসবের আর কোন হদিশই আজ নেই। নদীর তীরে গড়ে ওঠা বট-পাকুড়-হিজল-তমালের ছায়ায় গ্রামীণ হাট-গঞ্জ-বাজার আজ উধাও। বরং নদীর তীর, এমনকি নদীর বুক পর্যন্ত দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মারদাঙ্গা নগর আর বাণিজ্যকেন্দ্র। যেখানে নদীনির্ভর অর্থনীতির কোন রেখাপাত নেই, কেবলি বহুজাতিক সর্বগ্রাসী বাজার। পদ্মার ইলিশ, তিস্তার পুটিতর, জাদুকাটা-রক্তির নানিদ বা কংশের মহাশোল মাছেরা যেমন নিরুদ্দেশ হয়েছে। বদলে গেছে নদীনির্ভর জীবন ও জীবিকাও। নদী হারিয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে, অচেনা নগরের ভিড়ে স্বীকৃতিহীন দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। নদী নিয়ে সচরাচর নদী-ভাঙন, নদী দখল ও দূষণ, নদী ভরাট, নাব্যতা হ্রাস, পানির ভাগাভাগি এমন সব খবরই বেশি উসকে ওঠে। কিন্তু একদা বিকশিত নদীনির্ভর অর্থনীতির আওয়াজ খুব একটা নাগালে মেলে না। অস্বীকারের কোন উপায় নেই, এই জনপদের গ্রামীণ নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ব্যাকরণ পুরোটাই আদল দিয়েছে নদীর গতিপ্রবাহ। সেই প্রবাহ যেমন রুদ্ধ, তেমনি রুদ্ধ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর বিকাশমানতাও। কারণ রাষ্ট্র দেশের অর্থনৈতিক বিস্তারকে নদীর উজান-ভাটির শর্ত হিসেবে মান্য করেনি। টেনে এনেছে বহুজাতিক পুঁজির অন্যায় বাজার। আর মাথা ন্যুয়ে রেখেছে নদীবিমুখ এক নয়াউদারবাদী উন্নয়ন রাজনীতির চোখরাঙানির তলায়।

৫.

নদীবিরোধী নয়াউদারবাদী উন্নয়ন মনস্তত্ব থেকে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে হবে। উজান-ভাটিতে নদীর আপন গতিপ্রবাহের ন্যায়বিচার সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে দাঁড়াতে হবে। নদীই সচল করে তুলবে দেশের অর্থনীতির ভিত, জীবনের গতি। নদীর তীরেই বিকশিত হয়ে চলেছে গ্রাম-জীবিকা-উৎপাদন ও জীবন। নদীর কাছ থেকে জবরদস্তি করে নদীর তীর লুট করা হচ্ছে। নদীর তীরের ওপর একক মালিকানা, কর্তৃত্ব আর দখলের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্র প্রমাণ করে চলছে নদী বিষয়ে রাষ্ট্রের অন্যায় উদাসীনতা। এভাবে চলতে পারে না। নদীমাতৃক এই দেশে এমন সহস্র নদী-অবিচার আর কত? নদী শুধু স্মৃতিকথা না হয়ে থাকুক, নদী হয়ে ওঠুক জীবন চলার পথ ও পাথেয়। পাটের জিন-মানচিত্র তৈরি করে লোক দেখানো উন্নয়নের ফিরিস্তি নিম্নবর্গ খুব বেশি আমল দেবে না। পাটনির্ভর অর্থনীতি থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো নদীহীনতা। নদীর জান কলিজা থ্যাঁতলে দিয়ে পাট-অর্থনীতি সম্ভব নয়। এতে শুধু পলিথিনের বাজারই চাঙ্গা হবে। আবার হয়তো পলিথিনের কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী থেকে পলিথিন অপসারণের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বরাদ্দ হবে। শুধু প্রকল্প, বাজেট, বরাদ্দ দিয়ে নদীচিন্তা হয় না। দরকার নদীর সত্যিকারের মুক্তি। আর এই মুক্তি সংগ্রামে গর্জে ওঠুক নদীময় তরুণ বাংলাদেশ। শিরায় শিরায় বইয়ে দিক প্রবীণজনের লাখো নদী স্মৃতিকথা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আসুন নদীপ্রশ্নকে জাতীয় জিজ্ঞাসা হিসেবে সামিল করি। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনাকেই’ আমাদের সত্যিকারের ঠিকানা করে তুলি।

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@gmail.com