এড়িয়ে চলাই করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়

শফিকুর রহমান

করোনাভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই একজন থেকে অন্য জনে ছড়ায়। এটি সাধারণত একে অপরের সঙ্গে সরাসরি স্পর্শ দ্বারা বা খুব কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এবং সংক্রামিত (কন্টামিনেটেড) বস্তুর স্পর্শ দ্বারা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে আসলেও এখন মৃত্যুর মিছিল দিনে দিনে বড় হয়েই চলেছে এবং এক অজানা আতঙ্কে আমরা প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছি।

যতদিন পর্যন্ত বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে টিকার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না, ততদিন হয়তো আমরা করোনা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরে আসতে পারব না। বর্তমান টিকাগুলো হয়তো আমাদের এক বছরের বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে না। আবার, করোনার স্পাইক প্রোটিনে বার বার পরিবর্তন আসার ফলে সৃষ্ট নতুন ধরনগুলোর স্পাইক প্রোটিনের এমাইনো এসিড সিকুয়েন্সের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি বছরই হয়তো টিকা তৈরিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা পাওয়া সম্ভব হবে না এবং টিকা উৎপাদনকারী দেশ ছাড়া আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশের জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে বা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণের একটি সাময়িক হাতিয়ার হলেও লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার পর করোনা সংক্রমণ যে আবার বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার কথা চিন্তা করে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনও সম্ভব নয়। কাজেই, করোনার সঙ্গেই আমাদের দীর্ঘকাল বসবাস করতে হবে এবং করোনাকে এড়িয়ে চলেই আমাদের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিতে হবে।

করোনার ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ধরনগুলো ৫০-৭০ শতাশং বেশি সংক্রমণাত্মক এবং করোনা আক্রান্ত একজন ব্যক্তি ৫০-৮১ জন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে করোনা ছড়াতে পারে বলে গবেষকরা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, করোনা একজন থেকে আরেক জনে কীভাবে ছড়াচ্ছে এবং আমরা করোনা থেকে কীভাবে সুরক্ষা পেয়ে বেঁচে থাকব? বর্তমানে এটি প্রমাণিত যে, একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকা লোকদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার প্রধান উপায়। তবে, বাতাসের মাধ্যমেও করোনাভাইরাস ছড়ানোর একটি অন্যতম উপায় এবং সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধের পর্যালোচনায়ও তা বলা হয়েছে।

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি, গান, চিৎকার, বা কথা বলার সময় ভাইরাসটি শ্বাসতন্ত্রের ড্রপলেট (জলীয় কণার ফোঁটা) এবং অ্যারোসোলের (বাতাসে ছড়িয়ে থাকতে পাড়ে এমন ক্ষুদ্র জলীয় কণা) মাধ্যমে আশপাশের সুস্থ লোকদের মুখ বা নাক দিয়ে প্রবেশ করে তাদের আক্রান্ত করতে পারে। সাধারণত, ৫ মাইক্রোমিটার থেকে বড় আকারের (ব্যাস) ড্রপলেটগুলো মহাকর্ষের অধীনে দ্রুতই মাটিতে পড়ে যায় এবং কেবলমাত্র ১ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়াতে পারে। একটি হাঁচির মাধ্যমে ৫-১২ মাইক্রোমিটার আকারের প্রায় ৪০ হাজার ড্রপলেট ১০০ মিটার/সেকেন্ড গতিতে নির্গত হতে পারে। আবার, একটি কাশির মাধ্যমে বা পাঁচ মিনিট কথা বলার মাধ্যমে ০.৫ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার আকারের প্রায় ৩০০০ মাইক্রোড্রপলেট বা অ্যারোসোল নির্গত হতে পারে এবং করোনাভাইরাস সংক্রামিত কোন ব্যক্তি প্রশ্বাস ফেলার মাধ্যমেও অ্যারোসোল নির্গত হয়। এসব অ্যারোসোল প্রায় ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত ১ মিটারের বেশি দূরত্ব জুড়ে বাতাসে ছড়িয়ে থাকতে পারে। এমনকি, মাটিতে পড়ে থাকা ড্রপলেট কণাগুলো থেকে সৃষ্ট হালকা ও ছোট আকারের ড্রপলেট নিউক্লি (বাতাসে আংশিক শুকনো ড্রপলেটের অবশিষ্টাংশ) আমাদের হাঁটাচলা, খেলাধুলা ও ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে বায়ুকে আঘাত বা নাড়াচাড়া করার কারণে সহজেই স্থানীয় বায়ুতে আবার ছড়িয়ে পড়তে পারে। যখন অন্য একজন ব্যক্তি এ অ্যারোসোল বা ড্রপলেট নিউক্লি ছড়ানো জায়গায় শ্বাস নেন তখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া করোনাবাহী এসব অ্যারোসোল ও ড্রপলেট নিউক্লি স্থানীয় বায়ুপ্রবাহের দ্বারা ২ মিটারের বেশি বা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পাড়ে। এ কারণেই সবাইকে জনসমাগমন এড়িয়ে চলা, বাইরে বেরোনোর সময় মাস্ক পরে নেয়া এবং ১-২ মিটার শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা উচিৎ।

যেখানে জনসমাগম বেশি সেখানে এবং বদ্ধ পরিবেশে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি সবচেয় বেশি। বদ্ধ ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকা করোনা রোগীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুপ্রবাহ তৈরি করতে পারেন, যা পাশের বিছানায় বা অন্য রুমে থাকা সুস্থ ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এমনকি, বদ্ধ কক্ষে এসি বা ফ্যানের বাতাসের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই, ঘরের ভেতর বায়ু চলাচলের জন্য জানালা খুলে রাখা দরকার।

সাধারণত অ্যারোসোল সংক্রমণ কোন জনাকীর্ণ এবং অপর্যাপ্ত পরিমাণে বায়ুচলাচলকারী স্থান- যেমন ঘর বা কক্ষ, হোটেল- রেঁস্তোরা, মিটিং বা অনুষ্ঠানস্থল, ফিটনেস ক্লাব, নাইটক্লাব, অফিস ও উপাসনালয়সহ অন্যান্য বদ্ধ স্থানগুলোতে ঘটে থাকে যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। এসব বদ্ধ কক্ষে বা স্থানগুলোতে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে করোনাভাইরাস বাতাশে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। কাজেই, এসব জনাকীর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলাসহ বদ্ধ জনসমাগম পরিবেশে বেশিক্ষণ অবস্থান না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি বিভিন্ন বস্তুর উপরিভাগে পতিত হতে পারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে টেবিল, চেয়ার, রেলিং, দরজার হ্যান্ড্রেলসহ অন্যান্য সব বস্তুগুলোতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুস্থ ব্যক্তিরা ভাইরাস ছড়ানো এসব পৃষ্ঠগুলোকে স্পর্শ করার পর নাকে বা মুখে হাত দ্বারা স্পর্শ করলে ভাইরাস আক্রান্ত হবেন। এ জন্যই মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে এবং হাত সাবান দ্বারা না ধুয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা যাবে না। এছাড়া, বাহির থেকে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এবং কোন কিছু স্পর্শ করার পূর্বেই হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া জরুরি। যেখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে না সেখানে সেনিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।

সুতরাং, আমরা যতদিন না টিকার মাধ্যমে করোনাকে জয় করার সামর্থ্য অর্জন করি ততদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাসকে এড়িয়ে চলার জন্য বাইরে বের হলে বা কর্মস্থলে সর্বদা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মুখে মাস্ক ব্যবহার ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার আভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সবার সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। একই সঙ্গে সামাজিক অনুষ্ঠান বাদ দিতে হবে বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুবই ছোট পরিসরে করতে হবে। এসব না মানলে ভয়ঙ্কর পরিণতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

[লেখক, অধ্যাপক, মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।]

mrahman7@lakeheadu.ca

শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল ২০২১ , ১০ বৈশাখ ১৪২৮ ১০ রমজান ১৪৪২

এড়িয়ে চলাই করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়

শফিকুর রহমান

image

করোনাভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই একজন থেকে অন্য জনে ছড়ায়। এটি সাধারণত একে অপরের সঙ্গে সরাসরি স্পর্শ দ্বারা বা খুব কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এবং সংক্রামিত (কন্টামিনেটেড) বস্তুর স্পর্শ দ্বারা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে আসলেও এখন মৃত্যুর মিছিল দিনে দিনে বড় হয়েই চলেছে এবং এক অজানা আতঙ্কে আমরা প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছি।

যতদিন পর্যন্ত বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে টিকার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না, ততদিন হয়তো আমরা করোনা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরে আসতে পারব না। বর্তমান টিকাগুলো হয়তো আমাদের এক বছরের বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে না। আবার, করোনার স্পাইক প্রোটিনে বার বার পরিবর্তন আসার ফলে সৃষ্ট নতুন ধরনগুলোর স্পাইক প্রোটিনের এমাইনো এসিড সিকুয়েন্সের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি বছরই হয়তো টিকা তৈরিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা পাওয়া সম্ভব হবে না এবং টিকা উৎপাদনকারী দেশ ছাড়া আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশের জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে বা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণের একটি সাময়িক হাতিয়ার হলেও লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার পর করোনা সংক্রমণ যে আবার বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার কথা চিন্তা করে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনও সম্ভব নয়। কাজেই, করোনার সঙ্গেই আমাদের দীর্ঘকাল বসবাস করতে হবে এবং করোনাকে এড়িয়ে চলেই আমাদের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিতে হবে।

করোনার ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ধরনগুলো ৫০-৭০ শতাশং বেশি সংক্রমণাত্মক এবং করোনা আক্রান্ত একজন ব্যক্তি ৫০-৮১ জন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে করোনা ছড়াতে পারে বলে গবেষকরা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, করোনা একজন থেকে আরেক জনে কীভাবে ছড়াচ্ছে এবং আমরা করোনা থেকে কীভাবে সুরক্ষা পেয়ে বেঁচে থাকব? বর্তমানে এটি প্রমাণিত যে, একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকা লোকদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার প্রধান উপায়। তবে, বাতাসের মাধ্যমেও করোনাভাইরাস ছড়ানোর একটি অন্যতম উপায় এবং সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধের পর্যালোচনায়ও তা বলা হয়েছে।

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি, গান, চিৎকার, বা কথা বলার সময় ভাইরাসটি শ্বাসতন্ত্রের ড্রপলেট (জলীয় কণার ফোঁটা) এবং অ্যারোসোলের (বাতাসে ছড়িয়ে থাকতে পাড়ে এমন ক্ষুদ্র জলীয় কণা) মাধ্যমে আশপাশের সুস্থ লোকদের মুখ বা নাক দিয়ে প্রবেশ করে তাদের আক্রান্ত করতে পারে। সাধারণত, ৫ মাইক্রোমিটার থেকে বড় আকারের (ব্যাস) ড্রপলেটগুলো মহাকর্ষের অধীনে দ্রুতই মাটিতে পড়ে যায় এবং কেবলমাত্র ১ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়াতে পারে। একটি হাঁচির মাধ্যমে ৫-১২ মাইক্রোমিটার আকারের প্রায় ৪০ হাজার ড্রপলেট ১০০ মিটার/সেকেন্ড গতিতে নির্গত হতে পারে। আবার, একটি কাশির মাধ্যমে বা পাঁচ মিনিট কথা বলার মাধ্যমে ০.৫ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার আকারের প্রায় ৩০০০ মাইক্রোড্রপলেট বা অ্যারোসোল নির্গত হতে পারে এবং করোনাভাইরাস সংক্রামিত কোন ব্যক্তি প্রশ্বাস ফেলার মাধ্যমেও অ্যারোসোল নির্গত হয়। এসব অ্যারোসোল প্রায় ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত ১ মিটারের বেশি দূরত্ব জুড়ে বাতাসে ছড়িয়ে থাকতে পারে। এমনকি, মাটিতে পড়ে থাকা ড্রপলেট কণাগুলো থেকে সৃষ্ট হালকা ও ছোট আকারের ড্রপলেট নিউক্লি (বাতাসে আংশিক শুকনো ড্রপলেটের অবশিষ্টাংশ) আমাদের হাঁটাচলা, খেলাধুলা ও ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে বায়ুকে আঘাত বা নাড়াচাড়া করার কারণে সহজেই স্থানীয় বায়ুতে আবার ছড়িয়ে পড়তে পারে। যখন অন্য একজন ব্যক্তি এ অ্যারোসোল বা ড্রপলেট নিউক্লি ছড়ানো জায়গায় শ্বাস নেন তখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া করোনাবাহী এসব অ্যারোসোল ও ড্রপলেট নিউক্লি স্থানীয় বায়ুপ্রবাহের দ্বারা ২ মিটারের বেশি বা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পাড়ে। এ কারণেই সবাইকে জনসমাগমন এড়িয়ে চলা, বাইরে বেরোনোর সময় মাস্ক পরে নেয়া এবং ১-২ মিটার শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা উচিৎ।

যেখানে জনসমাগম বেশি সেখানে এবং বদ্ধ পরিবেশে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি সবচেয় বেশি। বদ্ধ ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকা করোনা রোগীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুপ্রবাহ তৈরি করতে পারেন, যা পাশের বিছানায় বা অন্য রুমে থাকা সুস্থ ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এমনকি, বদ্ধ কক্ষে এসি বা ফ্যানের বাতাসের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই, ঘরের ভেতর বায়ু চলাচলের জন্য জানালা খুলে রাখা দরকার।

সাধারণত অ্যারোসোল সংক্রমণ কোন জনাকীর্ণ এবং অপর্যাপ্ত পরিমাণে বায়ুচলাচলকারী স্থান- যেমন ঘর বা কক্ষ, হোটেল- রেঁস্তোরা, মিটিং বা অনুষ্ঠানস্থল, ফিটনেস ক্লাব, নাইটক্লাব, অফিস ও উপাসনালয়সহ অন্যান্য বদ্ধ স্থানগুলোতে ঘটে থাকে যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। এসব বদ্ধ কক্ষে বা স্থানগুলোতে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে করোনাভাইরাস বাতাশে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। কাজেই, এসব জনাকীর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলাসহ বদ্ধ জনসমাগম পরিবেশে বেশিক্ষণ অবস্থান না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি বিভিন্ন বস্তুর উপরিভাগে পতিত হতে পারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে টেবিল, চেয়ার, রেলিং, দরজার হ্যান্ড্রেলসহ অন্যান্য সব বস্তুগুলোতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুস্থ ব্যক্তিরা ভাইরাস ছড়ানো এসব পৃষ্ঠগুলোকে স্পর্শ করার পর নাকে বা মুখে হাত দ্বারা স্পর্শ করলে ভাইরাস আক্রান্ত হবেন। এ জন্যই মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে এবং হাত সাবান দ্বারা না ধুয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা যাবে না। এছাড়া, বাহির থেকে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এবং কোন কিছু স্পর্শ করার পূর্বেই হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া জরুরি। যেখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে না সেখানে সেনিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।

সুতরাং, আমরা যতদিন না টিকার মাধ্যমে করোনাকে জয় করার সামর্থ্য অর্জন করি ততদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাসকে এড়িয়ে চলার জন্য বাইরে বের হলে বা কর্মস্থলে সর্বদা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মুখে মাস্ক ব্যবহার ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার আভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সবার সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। একই সঙ্গে সামাজিক অনুষ্ঠান বাদ দিতে হবে বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুবই ছোট পরিসরে করতে হবে। এসব না মানলে ভয়ঙ্কর পরিণতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

[লেখক, অধ্যাপক, মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।]

mrahman7@lakeheadu.ca