আহত কুরমা, বনবিভাগের বাহাদুরি এবং পৃথিবী পুনরুদ্ধার প্রশ্ন

পাভেল পার্থ

দেশে বনভূমি সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বনবিভাগ। সরকারি হিসাবে দেশে ১১ ভাগ বন আছে, যদিও থাকা দরকার ২৫ ভাগ। বনবিভাগের অনেক উল্লেখযোগ্য এবং অবিস্মরণীয় কাজ আছে। এখনো ঢাল-তলোয়ার ছাড়া ‘নিধিরাম সর্দার’ বনপ্রহরীরা সুন্দরবন থেকে শুরু করে পাহাড়ি বনগুলোর দেখভাল করেন অনেকটা নিজের জীবন দিয়েই। বনবিভাগের অনেক কর্মচারী-কর্মকর্তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি- বন্যপ্রাণীর প্রতি কত বিস্ময়কর ভালোবাসা তাদের, বনের প্রতি তারা কতোটা নিবেদিত। কক্সবাজারের শিলখালী গর্জনবৃক্ষ কেটে একটা রাস্তা তৈরি করতে চেয়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিলখালী বনবিট কর্মকর্তা বন কেটে সেই রাস্তা বানাতে দেননি। বন বাঁচাতে লড়েছিলেন। কিন্তু এ ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা আর দায়বোধ বনবিভাগের সবার মাঝে নেই। তাই সর্বোচ্চ বনকর্মকর্তা হয়েও কেউ কেউ ওসমান গণির মতো বনের পর বন কেটে অবৈধ টাকা মজুত করেছিলেন।

বনবিভাগের অনেক কর্মকর্তার গাছপাচার, বন্যপ্রাণী বাণিজ্য, বনবিনাশের খবর প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এমনকি বনবিভাগ স্থানীয় ফরেস্ট ভিলেজার, বনবাসী, আদিবাসীদের নামে হরহামেশাই মিথ্যা বনমামলা দেয়, অত্যাচার-নিপীড়ন করেন। খুন-ধর্ষণ আর লুটতরাজের সাথেও জড়িয়ে আছে অনেক বনকর্মকর্তার নাম। টাঙ্গাইলে মধুপুর শালবনে বিনে নকরেককে বনবিভাগ পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শিশিলিয়া স্নালকে গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। শিশিলিয়ার অপরাধ ছিল শালবনের ঝরাপাতা কুড়ানো। মধুপুরে পীরনে স্লাল হত্যা থেকে শুরু করে নেত্রকোনার মেনকীফান্দায় অজিত রিছিলের ওপর অত্যাচার সবই করেছিল বনবিভাগ। কাপ্তাইয়ে জন্ম থেকে দুই হাত না থাকা ব্যক্তির নামে যেমন গাছ কাটার বনমামলা করেছে বনবিভাগ, একইভাবে কারো বিরুদ্ধে একশ’র বেশিও বনমামলা করেছে। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তার জন্যই বারবার দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির সব সাফল্য বারবার ম্লান হয়ে যায়। বনবিভাগের কিছু দায়িত্বহীন, কর্তব্যবিমুখ, বনবিনাশী কর্মকর্তার জন্যই বারবার বনবিভাগ জনমানুষের কাছে এক ‘অবিশ্বাসী’, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং ‘নির্যাতক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষত জনমনস্তত্বে বনবিভাগ সম্পর্কে মানুষের কী ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি এটি কখনই আমরা আন্দাজ করতে চাইনি। অথচ কিছু মানুষের কান্ডজ্ঞানহীন দুর্নীতি আর দায়িত্বহীনতার জন্য একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই ‘কলঙ্কিত’ হতে পারে না। কিন্তু বনবিভাগ কোনোভাবেই এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে পারে না, এসব গ্লানি ঢেকে ফেলতে পারে না। নিরপেক্ষ তদন্ত, বিচার এবং সর্বোপরি বনবান্ধব অনুশীলন ও চর্চাকে বাড়িয়ে আরো বেশি মানুষকে বন সুরক্ষায় যুক্ত করার ভেতর দিয়ে বনবিভাগ সত্যিকারের বনমুখী ও জনমুখী প্রতিষ্ঠান হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। এসব লুটতরাজ, দুর্নীতি কী আহাজারির ভেতর এখনো বনবিভাগের কোনো না কোনো বনপ্রহরী কী কর্মকর্তা রাতবিরেতে গাছকাটার শব্দে জেগে ওঠেন, প্রাণ হাতে ছুটে যান। একটা বুটজুতা, টর্চলাইট, রেইনকোট কী ছাতাও নেই; সুন্দরবনে কত বনপ্রহরীকে দেখেছি ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতরও একটা ছোট নৌকায় টহল দিতে। বনবিভাগের এ ভালোবাসার প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে। এ শক্তি নিয়েই নতুন করে দাঁড়াক দরদি ও দায়িত্বশীল এক বনবিভাগ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ঘটনায় আবারো ম্লান হয়েছে বনবিভাগের মুখ। মৌলভীবাজারের রাজকান্দি রেঞ্জ স্থানীয় ফরেস্ট ভিলেজারকে বিনাঅপরাধে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। পাশাপাশি উক্ত রেঞ্জের কুরমা বনবিটের কর্মকর্তা করোনা মহামারিকালের সরকারি এবং স্থানীয়দের স্বাস্থ্যবিধি চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘন করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে ২০ এপ্রিল ২০২১ তারিখে। যখন ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব। এবারের ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘আসুন পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করি’। প্রশ্ন হলো কাদের নিয়ে এই পুনরুদ্ধার কাজ শুরু হবে? বনবিভাগের পেটোয়া কর্মকর্তাদের দিয়ে কী কোনো পুনরুদ্ধার কাজ করা সম্ভব? নাকি যাকে পিটিয়ে জখম করা হলো সেই পরিবেশবন্ধু তরুণ? করোনা মহামারিকালেই আমাদের এসব প্রশ্নের ফায়সালা করতে হবে। পৃথিবী পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কাদের নিয়ে দাঁড়াবে আগামীর বাংলাদেশ এই মহামারিকালই তা নির্ধারণের বিশেষ সময়।

কী ঘটেছে কুরমায়?

দেশে যে ক্ষয়িষ্ণু মিশ্র বর্ষারণ্যগুলো টিকে আছে তার ভেতর রাজকান্দি গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম, পর্যটন, ভ্রমণ কিংবা যোগাযোগ নানা কারণে লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা, খাদিম, রাতারগুল যতটা পরিচিত রাজকান্দি ততটা নয়। চা বাগান এবং সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোর কারণে এখানে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অনন্য। সিলেট বিভাগের জনবসতির ভেতর খাসি জনগোষ্ঠী সচরাচর বনবিভাগ, চাবাগান, সরকারি খাসজমি ইজারা নিয়ে বসবাস করেন। খাসি ভাষায় এসব পাহাড়ি টিলার গ্রামকে পুঞ্জি বলে। শতবর্ষী প্রাচীন এসব গ্রামের বৈশিষ্ট্য হলো এসব গ্রাম গড়ে ওঠে প্রাচীন বৃক্ষসমৃদ্ধ টিলা বনভূমিতে। কারণ খাসিরা গাছপান, গোলমরিচ, পিপুল, মিশ্র ফলবাগান, আদা-হলুদ, ঔষধি গাছের জুম-বাগান করেন যা কোনো চিরচেনা সমতল অঞ্চলে সম্ভব নয়।

খাসি জীবনধারা এবং পরিবেশগত মূল্যবোধের কারণেই তাদের চারপাশের বনভূমি রক্ষা করতে হয়। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সব বনভূমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলে খাসি গ্রামগুলো বনবিভাগ বা চা বাগানের অধীন হয়ে যায়। বনবিভাগ বনের জায়গায় বসবাসকারীদের নাম দেয় ‘ফরেস্ট ভিলেজার’। বনজসম্পদ পাহারা ও বনরক্ষার নিমিত্তে এরা বিনাবেতনে কাজ করেন। মৌলভীবাজারের রাজকান্দি রেঞ্জের কুরমা বনবিটের জায়গায় গড়ে ওঠা কুরমা খাসিপুঞ্জি এমনি এক ফরেস্ট ভিলেজার বসতি। প্রায় ৫০টি খাসি পরিবারের বসবাস এখানে। সোনি সুচিয়াং এবং পি রিয়াং খংলার ছেলে ফরমি সুচিয়াংয়ের জন্ম এই পুঞ্জিতেই। এখন বয়স প্রায় আটাশ। ঘটনার দিন রাজকান্দি রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, কুরমা বনবিটের নবনিযুক্ত বিটকর্মকর্তা মো. রাজ্জাক আহমেদসহ, বনকর্মী জহির মিয়া এবং মো. ফোরকান মিয়া কুরমা পুঞ্জির ফরমিদের পানজুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করেন। ফরমিরা জানান, করোনাকালে বিশেষ লকডাউন বিধি থাকায় এ সময় তারা বহিরাগত কাউকেই পানজুমে প্রবেশ করতে দেন না। বনবিভাগের লোকজন করোনাকালীন এ স্বাস্থ্যবিধিকে কোনো তোয়াক্কা না করে ফরমিকে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটান। তারা কুরমা বনবিটের একটি কক্ষে আটকে রেখে তাকে নির্যাতন করেন।

দুটি শিশু এটি দেখে পুঞ্জিতে খবর দেয় এবং নির্যাতিতের মামা ডালিম সুচিয়াং এবং পুঞ্জির সহকারী হেডম্যান বনবিভাগের অফিসে এসে মুচলেকা দিয়ে আহতকে ছাড়িয়ে নিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। গণমাধ্যমের কাছে স্থানীয় ৯নং ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, এভাবে কাউকে মারধর করা ঠিক হয়নি। রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমে জানান, নির্যাতিত যুবকটি বনের গাছগাছালি ছাঁটাই করছিল এজন্য তাকে শাসন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কেবল ভীষণভাবে আহত ফরমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মোবাইলে কথা বলার সময় ফরমি আমাকে বলেছে, আমি আর কথা বলতে পারতেছি না, আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

ফরমির ওপর বনবিভাগের এমন নিদারুণ অবিচার এই মহামারিকালে আমাদের কী জানান দিলো? বিশেষ করে এই ধরিত্রী দিবসের আয়োজনের দিনে? কেন বনবিভাগ জোর করে করোনার সময় একটি খাসিপুঞ্জিতে ঢুকতে গেলেন? কেন বনবিভাগ জানবেন না খাসিদের মহামারিকালীন লোকায়ত লকডাউন পদ্ধতিগুলো? এছাড়া খাসিদের পানজুমগুলো তো সবসময়ের জন্যই খুব যতেœ রাখা হয়। অধিকাংশ খাসিপুঞ্জিতে তাই সামনে সাইনবোর্ড থাকে ‘বহিরাগতের প্রবেশ নিষেধ’। যে কর্মকর্তারা এই কান্ড কুরমায় ঘটালেন অবশ্যই তারা বাংলাদেশের মানুষ। এসব স্বাস্থ্যগত ও প্রতিবেশগত বিধিবিধান তাদের জানার কথা। একজন বনকর্মকর্তা বন, বন্যপ্রাণী, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংশ্লিষ্ট আইন, নীতি, প্রজ্ঞাপন ও ঘোষণাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন এবং তা পালন করছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু কুরমার এই সাম্প্রতিক ঘটনায় তারা প্রমাণ করলেন তারা দেশের বন সংক্রান্ত বিধিগুলো বিষয়ে জানেন না। তারা রাষ্ট্রীয় বিধি লঙ্ঘন করে দেশের একজন নিরপরাধ নাগরিককে অন্যায়ভাবে পিটিয়ে জখম করেছেন। দেশের আইন অনুযায়ী বনকর্মকর্তারা অপরাধ করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইনে এ অপরাধের বিচার ও দন্ডের বিধানও আছে।

খাসিপুঞ্জির করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি ও ‘উৎরাম’

সিলেট বিভাগের আদিবাসী খাসি ভাষায় মহামারি মানে হলো ‘ইয়াপখাম’। আগে থেকেই খাসিদের ভেতর মহামারি বা বড় অসুখের আগে নিজেদের পুঞ্জি (গ্রাম) বন্ধের রীতি আছে। এ সময় পুঞ্জির সব প্রবেশপথ বহিরাগতদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। পুঞ্জিতে যারা থাকেন তারা নিয়ম মেনে স্নান সেরে পানজুমে যান এবং ফেরার পর স্নান করে ঘরে ঢোকেন। নারীরা পুঞ্জির সীমানার ভেতরে পাহাড়ি জঙ্গল থেকে শাকলতা কুড়িয়ে আনেন। মহামারী সামালের এই গ্রামবন্ধ প্রক্রিয়াকে খাসি ভাষায় বলে- ‘খাং খারদেপ ছোনং বাহ ইয়াপখাম’। সহজে আমরা একে খাসি লকডাউন হিসেবে বুঝতে পারি। বনবিভাগ যখন পানজুমে ঢুকতে চেয়েছিলেন, তখন কিন্তু ফরমি তাদের এই লকডাউন বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। এছাড়া এভাবে লকডাউনের বিধিতো সরকারও ঘোষণা করেছে। বরং খাসিরা প্রথম থেকে সরকারের সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে কঠোরতম লকডাউন পালন করে আসছেন। আর বনবিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে সেই স্বাস্থ্যবিধি গায়ের জোরে ভেঙে দিলেন? বনবিভাগ কী আশা করেছিলেন? খাসিরা ভেতরে কোনো বন্যপ্রাণী লুকিয়ে রেখেছেন নাকি বিশাল বিশাল সব গাছ কেটে মজুত করেছেন? বনবিভাগের জানা দরকার বন বাঁচাতে মুরইছড়া পুঞ্জির অনিল ইয়ং ইয়ং আমরণ অনশনে বসেছিলেন, নাহার পুঞ্জির খাসিরা চার হাজার গাছ বাঁচাতে নিজের জীবন আগলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জোর করে ঢুকে যখন বনবিভাগ কোনো বন-অপরাধ দেখতে পেল না, তখন হয়তো তাদের ‘ব্যাটাগিরি’ উসকে ওঠলো। যাবতীয় আইন অমান্য করে তারা নির্মমভাবে ফরমিকে পেটালেন। মহামারি ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি পালন করতে যেয়ে বনবিভাগের হাতে গুরুতর জখম হতে হলো এই নিরীহ যুবককে।

খাসিদের কাছে এমনিতেও পানজুম এক পবিত্রস্থল। এখানে নিজেরাই স্নান করে পরিচ্ছন্ন হয়ে প্রবেশ করেন। কারণ বহিরাগতদের মাধ্যমে পানজুমে উৎরাম নামক এক সংক্রামক ব্যধি ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে কত পানজুম নষ্ট হয়ে বসত বদলাতে হয়েছে। এসব না জেনে কিভাবে কেউ রাজকান্দি বা কুরমাতে কাজ করতে যান? কেবল বনবিজ্ঞান নয়, বন এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণ ও বিধিগুলোর প্রতি বনবিভাগকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

ঘটনার তদন্ত ও বিচার হোক

৯নং ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান ঘটনার স্বীকার করে বলেছেন, এভাবে পেটানো বনবিভাগের ঠিক হয়নি। বন এলাকায় বনবিভাগের গুটিকয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংগঠিত এমনতর অন্যায়, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ হাতেগোনা দুয়েকজন মো. নজরুল ইসলাম, মো. রাজ্জাক আহমেদ, মো. জহির মিয়া কী মো. ফোরকান মিয়ার অপরাধ ও অপকর্মের জন্য কোনোভাবেই বনবিভাগের মহিমা ও গৌরব ম্লান হতে পারে না।

এরকম বিচারহীন অপরাধই বনবিভাগের কাউকে না কাউকে এক সময় ‘ওসমান গণি’ বানিয়ে দেয়। তাই এখন থেকেই সাবধান ও সতর্ক হওয়া জরুরি। কোনোভাবেই এ ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া যাবে না। সম্মানিত পরিবেশ-বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রীর এলাকার একজন নাগরিক বিনা অপরাধে বনবিভাগের হাতে এভাবে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে পারে কি? দ্রুত এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে পাবলিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি। অবশ্যই দোষীদের বিচার ও দন্ড প্রদান করা জরুরি। যদি নির্যাতিত ফরমি দোষী হয় তবে বনআইনের মাধ্যমে তার বিচার ও দন্ড প্রদানের ব্যবস্থা আছে। কাউকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে জখম করার কোনো এখতিয়ার নির্যাতক বনকর্মকর্তাদের রাষ্ট্র দেয়নি। এর জন্য রাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিভাগ আছে। এ ঘটনার বিচার না হলে ফরমির মনে বনবিভাগ ও সরকার সম্পর্কে জমা হয়ে রইবে এক প্রশ্নহীন ক্ষোভ আর দূরত্ব। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার ভেতর দিয়েই পৃথিবী পুনরুদ্ধারের সত্যিকারের যাত্রা সম্ভব।

[লেখক: গবেষক]

animistbangla@gmail.com

শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল ২০২১ , ১০ বৈশাখ ১৪২৮ ১০ রমজান ১৪৪২

আহত কুরমা, বনবিভাগের বাহাদুরি এবং পৃথিবী পুনরুদ্ধার প্রশ্ন

পাভেল পার্থ

দেশে বনভূমি সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বনবিভাগ। সরকারি হিসাবে দেশে ১১ ভাগ বন আছে, যদিও থাকা দরকার ২৫ ভাগ। বনবিভাগের অনেক উল্লেখযোগ্য এবং অবিস্মরণীয় কাজ আছে। এখনো ঢাল-তলোয়ার ছাড়া ‘নিধিরাম সর্দার’ বনপ্রহরীরা সুন্দরবন থেকে শুরু করে পাহাড়ি বনগুলোর দেখভাল করেন অনেকটা নিজের জীবন দিয়েই। বনবিভাগের অনেক কর্মচারী-কর্মকর্তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি- বন্যপ্রাণীর প্রতি কত বিস্ময়কর ভালোবাসা তাদের, বনের প্রতি তারা কতোটা নিবেদিত। কক্সবাজারের শিলখালী গর্জনবৃক্ষ কেটে একটা রাস্তা তৈরি করতে চেয়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিলখালী বনবিট কর্মকর্তা বন কেটে সেই রাস্তা বানাতে দেননি। বন বাঁচাতে লড়েছিলেন। কিন্তু এ ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা আর দায়বোধ বনবিভাগের সবার মাঝে নেই। তাই সর্বোচ্চ বনকর্মকর্তা হয়েও কেউ কেউ ওসমান গণির মতো বনের পর বন কেটে অবৈধ টাকা মজুত করেছিলেন।

বনবিভাগের অনেক কর্মকর্তার গাছপাচার, বন্যপ্রাণী বাণিজ্য, বনবিনাশের খবর প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এমনকি বনবিভাগ স্থানীয় ফরেস্ট ভিলেজার, বনবাসী, আদিবাসীদের নামে হরহামেশাই মিথ্যা বনমামলা দেয়, অত্যাচার-নিপীড়ন করেন। খুন-ধর্ষণ আর লুটতরাজের সাথেও জড়িয়ে আছে অনেক বনকর্মকর্তার নাম। টাঙ্গাইলে মধুপুর শালবনে বিনে নকরেককে বনবিভাগ পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শিশিলিয়া স্নালকে গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। শিশিলিয়ার অপরাধ ছিল শালবনের ঝরাপাতা কুড়ানো। মধুপুরে পীরনে স্লাল হত্যা থেকে শুরু করে নেত্রকোনার মেনকীফান্দায় অজিত রিছিলের ওপর অত্যাচার সবই করেছিল বনবিভাগ। কাপ্তাইয়ে জন্ম থেকে দুই হাত না থাকা ব্যক্তির নামে যেমন গাছ কাটার বনমামলা করেছে বনবিভাগ, একইভাবে কারো বিরুদ্ধে একশ’র বেশিও বনমামলা করেছে। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তার জন্যই বারবার দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির সব সাফল্য বারবার ম্লান হয়ে যায়। বনবিভাগের কিছু দায়িত্বহীন, কর্তব্যবিমুখ, বনবিনাশী কর্মকর্তার জন্যই বারবার বনবিভাগ জনমানুষের কাছে এক ‘অবিশ্বাসী’, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং ‘নির্যাতক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষত জনমনস্তত্বে বনবিভাগ সম্পর্কে মানুষের কী ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি এটি কখনই আমরা আন্দাজ করতে চাইনি। অথচ কিছু মানুষের কান্ডজ্ঞানহীন দুর্নীতি আর দায়িত্বহীনতার জন্য একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই ‘কলঙ্কিত’ হতে পারে না। কিন্তু বনবিভাগ কোনোভাবেই এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে পারে না, এসব গ্লানি ঢেকে ফেলতে পারে না। নিরপেক্ষ তদন্ত, বিচার এবং সর্বোপরি বনবান্ধব অনুশীলন ও চর্চাকে বাড়িয়ে আরো বেশি মানুষকে বন সুরক্ষায় যুক্ত করার ভেতর দিয়ে বনবিভাগ সত্যিকারের বনমুখী ও জনমুখী প্রতিষ্ঠান হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। এসব লুটতরাজ, দুর্নীতি কী আহাজারির ভেতর এখনো বনবিভাগের কোনো না কোনো বনপ্রহরী কী কর্মকর্তা রাতবিরেতে গাছকাটার শব্দে জেগে ওঠেন, প্রাণ হাতে ছুটে যান। একটা বুটজুতা, টর্চলাইট, রেইনকোট কী ছাতাও নেই; সুন্দরবনে কত বনপ্রহরীকে দেখেছি ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতরও একটা ছোট নৌকায় টহল দিতে। বনবিভাগের এ ভালোবাসার প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে। এ শক্তি নিয়েই নতুন করে দাঁড়াক দরদি ও দায়িত্বশীল এক বনবিভাগ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ঘটনায় আবারো ম্লান হয়েছে বনবিভাগের মুখ। মৌলভীবাজারের রাজকান্দি রেঞ্জ স্থানীয় ফরেস্ট ভিলেজারকে বিনাঅপরাধে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। পাশাপাশি উক্ত রেঞ্জের কুরমা বনবিটের কর্মকর্তা করোনা মহামারিকালের সরকারি এবং স্থানীয়দের স্বাস্থ্যবিধি চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘন করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে ২০ এপ্রিল ২০২১ তারিখে। যখন ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব। এবারের ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘আসুন পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করি’। প্রশ্ন হলো কাদের নিয়ে এই পুনরুদ্ধার কাজ শুরু হবে? বনবিভাগের পেটোয়া কর্মকর্তাদের দিয়ে কী কোনো পুনরুদ্ধার কাজ করা সম্ভব? নাকি যাকে পিটিয়ে জখম করা হলো সেই পরিবেশবন্ধু তরুণ? করোনা মহামারিকালেই আমাদের এসব প্রশ্নের ফায়সালা করতে হবে। পৃথিবী পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কাদের নিয়ে দাঁড়াবে আগামীর বাংলাদেশ এই মহামারিকালই তা নির্ধারণের বিশেষ সময়।

কী ঘটেছে কুরমায়?

দেশে যে ক্ষয়িষ্ণু মিশ্র বর্ষারণ্যগুলো টিকে আছে তার ভেতর রাজকান্দি গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম, পর্যটন, ভ্রমণ কিংবা যোগাযোগ নানা কারণে লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা, খাদিম, রাতারগুল যতটা পরিচিত রাজকান্দি ততটা নয়। চা বাগান এবং সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোর কারণে এখানে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অনন্য। সিলেট বিভাগের জনবসতির ভেতর খাসি জনগোষ্ঠী সচরাচর বনবিভাগ, চাবাগান, সরকারি খাসজমি ইজারা নিয়ে বসবাস করেন। খাসি ভাষায় এসব পাহাড়ি টিলার গ্রামকে পুঞ্জি বলে। শতবর্ষী প্রাচীন এসব গ্রামের বৈশিষ্ট্য হলো এসব গ্রাম গড়ে ওঠে প্রাচীন বৃক্ষসমৃদ্ধ টিলা বনভূমিতে। কারণ খাসিরা গাছপান, গোলমরিচ, পিপুল, মিশ্র ফলবাগান, আদা-হলুদ, ঔষধি গাছের জুম-বাগান করেন যা কোনো চিরচেনা সমতল অঞ্চলে সম্ভব নয়।

খাসি জীবনধারা এবং পরিবেশগত মূল্যবোধের কারণেই তাদের চারপাশের বনভূমি রক্ষা করতে হয়। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সব বনভূমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলে খাসি গ্রামগুলো বনবিভাগ বা চা বাগানের অধীন হয়ে যায়। বনবিভাগ বনের জায়গায় বসবাসকারীদের নাম দেয় ‘ফরেস্ট ভিলেজার’। বনজসম্পদ পাহারা ও বনরক্ষার নিমিত্তে এরা বিনাবেতনে কাজ করেন। মৌলভীবাজারের রাজকান্দি রেঞ্জের কুরমা বনবিটের জায়গায় গড়ে ওঠা কুরমা খাসিপুঞ্জি এমনি এক ফরেস্ট ভিলেজার বসতি। প্রায় ৫০টি খাসি পরিবারের বসবাস এখানে। সোনি সুচিয়াং এবং পি রিয়াং খংলার ছেলে ফরমি সুচিয়াংয়ের জন্ম এই পুঞ্জিতেই। এখন বয়স প্রায় আটাশ। ঘটনার দিন রাজকান্দি রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, কুরমা বনবিটের নবনিযুক্ত বিটকর্মকর্তা মো. রাজ্জাক আহমেদসহ, বনকর্মী জহির মিয়া এবং মো. ফোরকান মিয়া কুরমা পুঞ্জির ফরমিদের পানজুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করেন। ফরমিরা জানান, করোনাকালে বিশেষ লকডাউন বিধি থাকায় এ সময় তারা বহিরাগত কাউকেই পানজুমে প্রবেশ করতে দেন না। বনবিভাগের লোকজন করোনাকালীন এ স্বাস্থ্যবিধিকে কোনো তোয়াক্কা না করে ফরমিকে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটান। তারা কুরমা বনবিটের একটি কক্ষে আটকে রেখে তাকে নির্যাতন করেন।

দুটি শিশু এটি দেখে পুঞ্জিতে খবর দেয় এবং নির্যাতিতের মামা ডালিম সুচিয়াং এবং পুঞ্জির সহকারী হেডম্যান বনবিভাগের অফিসে এসে মুচলেকা দিয়ে আহতকে ছাড়িয়ে নিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। গণমাধ্যমের কাছে স্থানীয় ৯নং ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, এভাবে কাউকে মারধর করা ঠিক হয়নি। রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমে জানান, নির্যাতিত যুবকটি বনের গাছগাছালি ছাঁটাই করছিল এজন্য তাকে শাসন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কেবল ভীষণভাবে আহত ফরমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মোবাইলে কথা বলার সময় ফরমি আমাকে বলেছে, আমি আর কথা বলতে পারতেছি না, আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

ফরমির ওপর বনবিভাগের এমন নিদারুণ অবিচার এই মহামারিকালে আমাদের কী জানান দিলো? বিশেষ করে এই ধরিত্রী দিবসের আয়োজনের দিনে? কেন বনবিভাগ জোর করে করোনার সময় একটি খাসিপুঞ্জিতে ঢুকতে গেলেন? কেন বনবিভাগ জানবেন না খাসিদের মহামারিকালীন লোকায়ত লকডাউন পদ্ধতিগুলো? এছাড়া খাসিদের পানজুমগুলো তো সবসময়ের জন্যই খুব যতেœ রাখা হয়। অধিকাংশ খাসিপুঞ্জিতে তাই সামনে সাইনবোর্ড থাকে ‘বহিরাগতের প্রবেশ নিষেধ’। যে কর্মকর্তারা এই কান্ড কুরমায় ঘটালেন অবশ্যই তারা বাংলাদেশের মানুষ। এসব স্বাস্থ্যগত ও প্রতিবেশগত বিধিবিধান তাদের জানার কথা। একজন বনকর্মকর্তা বন, বন্যপ্রাণী, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংশ্লিষ্ট আইন, নীতি, প্রজ্ঞাপন ও ঘোষণাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন এবং তা পালন করছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু কুরমার এই সাম্প্রতিক ঘটনায় তারা প্রমাণ করলেন তারা দেশের বন সংক্রান্ত বিধিগুলো বিষয়ে জানেন না। তারা রাষ্ট্রীয় বিধি লঙ্ঘন করে দেশের একজন নিরপরাধ নাগরিককে অন্যায়ভাবে পিটিয়ে জখম করেছেন। দেশের আইন অনুযায়ী বনকর্মকর্তারা অপরাধ করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইনে এ অপরাধের বিচার ও দন্ডের বিধানও আছে।

খাসিপুঞ্জির করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি ও ‘উৎরাম’

সিলেট বিভাগের আদিবাসী খাসি ভাষায় মহামারি মানে হলো ‘ইয়াপখাম’। আগে থেকেই খাসিদের ভেতর মহামারি বা বড় অসুখের আগে নিজেদের পুঞ্জি (গ্রাম) বন্ধের রীতি আছে। এ সময় পুঞ্জির সব প্রবেশপথ বহিরাগতদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। পুঞ্জিতে যারা থাকেন তারা নিয়ম মেনে স্নান সেরে পানজুমে যান এবং ফেরার পর স্নান করে ঘরে ঢোকেন। নারীরা পুঞ্জির সীমানার ভেতরে পাহাড়ি জঙ্গল থেকে শাকলতা কুড়িয়ে আনেন। মহামারী সামালের এই গ্রামবন্ধ প্রক্রিয়াকে খাসি ভাষায় বলে- ‘খাং খারদেপ ছোনং বাহ ইয়াপখাম’। সহজে আমরা একে খাসি লকডাউন হিসেবে বুঝতে পারি। বনবিভাগ যখন পানজুমে ঢুকতে চেয়েছিলেন, তখন কিন্তু ফরমি তাদের এই লকডাউন বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। এছাড়া এভাবে লকডাউনের বিধিতো সরকারও ঘোষণা করেছে। বরং খাসিরা প্রথম থেকে সরকারের সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে কঠোরতম লকডাউন পালন করে আসছেন। আর বনবিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে সেই স্বাস্থ্যবিধি গায়ের জোরে ভেঙে দিলেন? বনবিভাগ কী আশা করেছিলেন? খাসিরা ভেতরে কোনো বন্যপ্রাণী লুকিয়ে রেখেছেন নাকি বিশাল বিশাল সব গাছ কেটে মজুত করেছেন? বনবিভাগের জানা দরকার বন বাঁচাতে মুরইছড়া পুঞ্জির অনিল ইয়ং ইয়ং আমরণ অনশনে বসেছিলেন, নাহার পুঞ্জির খাসিরা চার হাজার গাছ বাঁচাতে নিজের জীবন আগলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জোর করে ঢুকে যখন বনবিভাগ কোনো বন-অপরাধ দেখতে পেল না, তখন হয়তো তাদের ‘ব্যাটাগিরি’ উসকে ওঠলো। যাবতীয় আইন অমান্য করে তারা নির্মমভাবে ফরমিকে পেটালেন। মহামারি ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি পালন করতে যেয়ে বনবিভাগের হাতে গুরুতর জখম হতে হলো এই নিরীহ যুবককে।

খাসিদের কাছে এমনিতেও পানজুম এক পবিত্রস্থল। এখানে নিজেরাই স্নান করে পরিচ্ছন্ন হয়ে প্রবেশ করেন। কারণ বহিরাগতদের মাধ্যমে পানজুমে উৎরাম নামক এক সংক্রামক ব্যধি ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে কত পানজুম নষ্ট হয়ে বসত বদলাতে হয়েছে। এসব না জেনে কিভাবে কেউ রাজকান্দি বা কুরমাতে কাজ করতে যান? কেবল বনবিজ্ঞান নয়, বন এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণ ও বিধিগুলোর প্রতি বনবিভাগকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

ঘটনার তদন্ত ও বিচার হোক

৯নং ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান ঘটনার স্বীকার করে বলেছেন, এভাবে পেটানো বনবিভাগের ঠিক হয়নি। বন এলাকায় বনবিভাগের গুটিকয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংগঠিত এমনতর অন্যায়, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ হাতেগোনা দুয়েকজন মো. নজরুল ইসলাম, মো. রাজ্জাক আহমেদ, মো. জহির মিয়া কী মো. ফোরকান মিয়ার অপরাধ ও অপকর্মের জন্য কোনোভাবেই বনবিভাগের মহিমা ও গৌরব ম্লান হতে পারে না।

এরকম বিচারহীন অপরাধই বনবিভাগের কাউকে না কাউকে এক সময় ‘ওসমান গণি’ বানিয়ে দেয়। তাই এখন থেকেই সাবধান ও সতর্ক হওয়া জরুরি। কোনোভাবেই এ ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া যাবে না। সম্মানিত পরিবেশ-বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রীর এলাকার একজন নাগরিক বিনা অপরাধে বনবিভাগের হাতে এভাবে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে পারে কি? দ্রুত এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে পাবলিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি। অবশ্যই দোষীদের বিচার ও দন্ড প্রদান করা জরুরি। যদি নির্যাতিত ফরমি দোষী হয় তবে বনআইনের মাধ্যমে তার বিচার ও দন্ড প্রদানের ব্যবস্থা আছে। কাউকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে জখম করার কোনো এখতিয়ার নির্যাতক বনকর্মকর্তাদের রাষ্ট্র দেয়নি। এর জন্য রাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিভাগ আছে। এ ঘটনার বিচার না হলে ফরমির মনে বনবিভাগ ও সরকার সম্পর্কে জমা হয়ে রইবে এক প্রশ্নহীন ক্ষোভ আর দূরত্ব। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার ভেতর দিয়েই পৃথিবী পুনরুদ্ধারের সত্যিকারের যাত্রা সম্ভব।

[লেখক: গবেষক]

animistbangla@gmail.com