আবদুল মতিন খসরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোহাম্মদ শাহজাহান

প্রিয়জনের ভালোবাসা, শোক ও ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে ১৫ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর অন্যতম সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি। সর্বমহলে ভদ্র, বিনয়ী, ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত মতিন খসরু করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ এপ্রিল মারা যান।

বহু ইতিহাস সৃষ্টিকারী একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিন খসরুর সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো- আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে হত্যাকান্ডের দুই যুগ পর তিনি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থায় তড়িঘড়ি করে ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। অভিযুক্তদের সব প্রকার আইনি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে দেশের প্রচলিত আইনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে।

দুই যুগ পরে মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করা ছিল খুবই একটি কঠিন কাজ। সেই কঠিন দুরূহ কাজটি ধৈর্য, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সুসম্পন্ন করে অভিযুক্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সমগ্র জাতিকে ঋণী করে গেছেন তিনি। হত্যার দুই দশক পর বিচার শুরু করে সাড়ে তিন দশক পর কয়েকজন ঘাতকের ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সাবেক এ আইনমন্ত্রীর নাম। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার শোকবার্তায় যথার্থই বলেছেন, ‘কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা বিচারে আবদুল মতিন খসরুর ভূমিকা জাতি সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’

১৯৯৬-এর ১২ জুনের নির্বাচনে ২৩ জুন সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লার বুড়িচং থেকে পরপর দু’বার নির্বাচিত তরুণ সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরুকে আইন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস ছিল, জাতির পিতা হত্যার বিচারটি দেশের প্রচলিত আইনে সুনিপুণভাবে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন এই তরুণ আইনজীবী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ও বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা ও বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করাটাকে ব্রত হিসেবে নেন আইন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু।

জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (কালো আইন) বাতিল বিল উত্থাপন করে এক আবেগময় ও ঐতিহাসিক ভাষণ দেন আইন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। যুক্তিতর্ক তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ সেই ভাষণে মতিন খসরু বলেন, আমাদের সংবিধানে ইনডেমনিটি বিষয়ে একটি মাত্র আর্টিকেল আছে। সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে যে, ‘দুটি মাত্র কারণে কেবলমাত্র সংসদ কোনো কার্যকে দায়মুক্ত করতে পারে।’ অর্থাৎ মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে অথবা দেশের অভ্যন্তরে কোথাও আইনশৃঙ্খলা সংরক্ষণ বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কেবলমাত্র সংসদ কোন কার্য ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি দিতে পারে। এই ২টি বিষয় ছাড়া আর কোনো ঘটনা বা বিষয়ে দায়মুক্তি দেয়ার বিধান আমাদের পবিত্র সংবিধানে নেই।

আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা খুনের বদলে খুন, দাঁতের বদলে দাঁত, রক্তের বদলে রক্ত চাই না। আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। তিনি বলেন, বিচারের স্বার্থে আমি এই পর্যন্ত কোনো খুনির নাম উচ্চারণ করিনি। তারা স্ব-ঘোষিত খুনি। মাননীয় স্পিকার, তারা স্ব-ঘোষিত খুনি। আপনি যদি ক্যাসেট চান, আমি সেই ক্যাসেট উপস্থাপন করতে পারব। বিবিসির সঙ্গে, গ্রানাডা টেলিভিশনের সঙ্গে এবং ব্যাংককে বসে তারা বলেছে, yes, we have killed him. আমরা খুন করেছি। শিশু, নারীসহ জাতির পিতাকে যারা হত্যা করেছে, সেই খুনিকে দুনিয়ার কোনো আইন, অধ্যাদেশ বা সংসদ দায়মুক্তি দিতে পারে না। সবশেষে মতিন খসরু বলেন, আমরা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে চাই। এই পাপ থেকে নিষ্কৃতি দিতে চাই।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। বাংলার মানুষ মতিন খসরুর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে।

[ লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা ]

bandhu.ch77@yahoo.com

শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল ২০২১ , ১০ বৈশাখ ১৪২৮ ১০ রমজান ১৪৪২

আবদুল মতিন খসরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোহাম্মদ শাহজাহান

image

প্রিয়জনের ভালোবাসা, শোক ও ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে ১৫ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর অন্যতম সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি। সর্বমহলে ভদ্র, বিনয়ী, ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত মতিন খসরু করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ এপ্রিল মারা যান।

বহু ইতিহাস সৃষ্টিকারী একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিন খসরুর সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো- আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে হত্যাকান্ডের দুই যুগ পর তিনি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থায় তড়িঘড়ি করে ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। অভিযুক্তদের সব প্রকার আইনি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে দেশের প্রচলিত আইনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে।

দুই যুগ পরে মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করা ছিল খুবই একটি কঠিন কাজ। সেই কঠিন দুরূহ কাজটি ধৈর্য, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সুসম্পন্ন করে অভিযুক্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সমগ্র জাতিকে ঋণী করে গেছেন তিনি। হত্যার দুই দশক পর বিচার শুরু করে সাড়ে তিন দশক পর কয়েকজন ঘাতকের ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সাবেক এ আইনমন্ত্রীর নাম। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার শোকবার্তায় যথার্থই বলেছেন, ‘কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা বিচারে আবদুল মতিন খসরুর ভূমিকা জাতি সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’

১৯৯৬-এর ১২ জুনের নির্বাচনে ২৩ জুন সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লার বুড়িচং থেকে পরপর দু’বার নির্বাচিত তরুণ সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরুকে আইন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস ছিল, জাতির পিতা হত্যার বিচারটি দেশের প্রচলিত আইনে সুনিপুণভাবে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন এই তরুণ আইনজীবী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ও বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা ও বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করাটাকে ব্রত হিসেবে নেন আইন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু।

জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (কালো আইন) বাতিল বিল উত্থাপন করে এক আবেগময় ও ঐতিহাসিক ভাষণ দেন আইন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। যুক্তিতর্ক তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ সেই ভাষণে মতিন খসরু বলেন, আমাদের সংবিধানে ইনডেমনিটি বিষয়ে একটি মাত্র আর্টিকেল আছে। সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে যে, ‘দুটি মাত্র কারণে কেবলমাত্র সংসদ কোনো কার্যকে দায়মুক্ত করতে পারে।’ অর্থাৎ মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে অথবা দেশের অভ্যন্তরে কোথাও আইনশৃঙ্খলা সংরক্ষণ বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কেবলমাত্র সংসদ কোন কার্য ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি দিতে পারে। এই ২টি বিষয় ছাড়া আর কোনো ঘটনা বা বিষয়ে দায়মুক্তি দেয়ার বিধান আমাদের পবিত্র সংবিধানে নেই।

আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা খুনের বদলে খুন, দাঁতের বদলে দাঁত, রক্তের বদলে রক্ত চাই না। আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। তিনি বলেন, বিচারের স্বার্থে আমি এই পর্যন্ত কোনো খুনির নাম উচ্চারণ করিনি। তারা স্ব-ঘোষিত খুনি। মাননীয় স্পিকার, তারা স্ব-ঘোষিত খুনি। আপনি যদি ক্যাসেট চান, আমি সেই ক্যাসেট উপস্থাপন করতে পারব। বিবিসির সঙ্গে, গ্রানাডা টেলিভিশনের সঙ্গে এবং ব্যাংককে বসে তারা বলেছে, yes, we have killed him. আমরা খুন করেছি। শিশু, নারীসহ জাতির পিতাকে যারা হত্যা করেছে, সেই খুনিকে দুনিয়ার কোনো আইন, অধ্যাদেশ বা সংসদ দায়মুক্তি দিতে পারে না। সবশেষে মতিন খসরু বলেন, আমরা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে চাই। এই পাপ থেকে নিষ্কৃতি দিতে চাই।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। বাংলার মানুষ মতিন খসরুর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে।

[ লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা ]

bandhu.ch77@yahoo.com