পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন

কলেজছাত্রীসহ নিহত ৪ আহত ২১

পুরান ঢাকার আরমেনিয়ান স্ট্রিটের একটি আবাসিক ভবন। ভবনটির নিচতলায় ১৮টি কেমিক্যালের দোকান। সেই ভবনেই গতকাল ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডে চারজন মারা গেছেন। আগুনে ও ধোঁয়ায় আহত হয়ে পড়েছেন আরও ২১ জন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনে অবস্থা খুবই গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

মৃত চারজনের মধ্যে ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার নিলুফা (২২) ৪র্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। ভবনের নিচতলার মার্কেটের দারোয়ান মো. রাসেল (২৭), রাসেলের মামা ওয়ালিউল্লাহ (৭০) এবং অকিল এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী কবির (২৮)।

গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলায় প্রতিটি দোকান কেমিক্যালে ঠাসা। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বস্তায় বস্তায় পড়ে আছে। মূলত ওখানে দোকানিরা স্যাম্পল হিসেবে কেমিক্যাল মুজদ করে রাখতেন।

গতকাল ভোররাতে বংশাল থানার বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ৯/১১ আরমেনিয়ান স্ট্রিটে হাজী মুসা ম্যানসনে অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটি প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ৬টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ওই ভবনের আহত একাধিক বাসিন্দা জানায়, ভোররাত সোয়া ৩টার দিকে ভবনটির নিচতলায় থাকা কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত। কেমিক্যাল থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নিচতলা থেকে উপরের দিকে আগুন উঠতে না পারলেও ধোঁয়ায় পুরো ভবন ছেয়ে যায়। প্রত্যেক বাসিন্দার রুমে ধোঁয়া ঢুকে যায়। তখন কেউ ঘুমে, কেউ সেহরির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এতে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে যে যার মতো করে ছুটতে থাকেন।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুন লাগার পর মানুষজন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও ধোঁয়া ও আগুনের কারণে বের হতে পারেননি।

বিভিন্ন ফ্লোরে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করতে থাকেন। আটকেপড়া বাসিন্দারা বারান্দা ও জানালা থেকে মোবাইলের আলো জ্বেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে বিভিন্ন তলা থেকে অন্তত ১৩/১৪ জনকে ক্রেন ব্যবহার করে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা বারান্দার গ্রিল কেটে বাসিন্দাদের উদ্ধার করেন। পরে একে একে আটকেপড়া সবাইকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

ফায়ার সার্ভিসের দেয়া পানিতে বস্তায় থাকা কেমিক্যাল গলে বিভিন্ন রং ধারণ করে ড্রেনে ভেসে যাচ্ছে। দেখা যায়, দোকান ও গুদামের ভেতরে বড় বড় ড্রামগুলো পুড়ে গেছে। এছাড়া রাসায়নিক পণ্য কেনাবেচায় ব্যবহৃত কিছু ছোট ছোট কনটেইনারও দেখা গেছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে জানালার গ্রিল কাটা। কাঁচগুলো ভাঙা। বাসিন্দারা গ্রিল কেটে কয়েকটি শাড়ি জোড়া লাগিয়ে তা বেয়ে নিচে নেমে আসেন। আগুনের তাপে ছাদের গেট খোলা সম্ভব হয়নি। তাই বাসিন্দারা ছাদে উঠতে পারেননি। চিলেকোঠায় থাকা ওয়ালিউল্লাহ ও কবির সেখানেই মারা যান। ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবু সায়েম অগ্নিনির্বাপণ থেকে শুরু করে কেমিক্যাল সরানো পর্যন্ত ওই ভবনে কাজ করেন। তিনি জানান, তারা এসে বাড়ির মূল গেটে তালা দেয়া অবস্থায় পান। আগুনের তাপে গেট, গ্রিল সবই গরম হয়ে যায়। হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছিল না। হাইড্রোলিক কাটার দিয়ে গেটের তালা কেটে ভেতরে ঢুকেন। দারোয়ান রাসেলের লাশ যেই রুম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই রুমের বৈদ্যুতিক বোর্ড পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ঘটনার পর থেকে ওই ভবনের মালিক ও নিচের দোকানিদের কাউকে খুঁজে পায়নি পুলিশ। ভবনটিতে কেমিক্যাল রাখার জন্য সিটি করপোরেশনের ট্রেডলাইসেন্স ছিল কিনা এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন।

ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগুনের সূত্রপাত নিয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলেনি।

ঘটনার পর গতকাল দুপুরে নিচতলার কয়েক হাজার বস্তা কেমিক্যাল সেখান থেকে ট্রাকযোগে মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যায় ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল হাসান জানান, ওই ভবনের নিচতলায় কসটিক সোডা, ব্লিচিং পাউডার, জিলেটিং, হাউড্রোলিক পার অক্সাইড ও এসিডিক এসিড নামক কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। এগুলোর পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘ভবনটির নিচতলায় থাকা কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুন লাগতে পারে। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করবে। এরপরই আগুন লাগার কারণ জানা সম্ভব হবে। ফায়ার সার্ভিস তার আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।’

ভবনটির পাশের ভবনের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ওই ভবনের নিচে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। আশপাশের প্রায় সব ভবনেই এ ধরনের গুদাম রয়েছে।

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ বলেছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা পরীক্ষা করে দেখে জানাবে রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে কিনা এবং ভবনের দোকানগুলোতে দাহ্য পদার্থ আছে কিনা।

বংশাল থানার ওসি মো. শাহীন ফকির জানান, ছাত্রী সুমাইয়া ওই ভবনের চতুর্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর পাশের এটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে মই দিয়ে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বের করে আনা হয়। কিন্তু সুমাইয়া অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সুমাইয়া ও রাসেলের মরদেহ ভোরেই উদ্ধার করা হয়।

ওয়ালিউল্লাহ ও কবিরের মরদেহ গতকাল বেলা ১১টার দিকে ভবনটির ছাদে পাওয়া যায়। ঢামেক সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চারজন ভর্তি রয়েছেন। তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর ১৭ জন ওয়ার্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন জানান, সেখানে চিকিৎসাধীন চারজনের শরীরের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।

পুরান ঢাকায় ২০১০ সালের জুনে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে ১২৪ জন নিহত হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন নিহত হন। আহত হন অনেকেই। এছাড়া প্রায়ই কেমিক্যালের গোডাউনগুলোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে।

এদিকে, শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তন্ময় প্রকাশ ঘোষ বলেন, এই ঘটনায় ২১ জন রোগী হাসপাতালে আসে। এদের মধ্যে একজনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি ২০ জনকে ভর্তি রাখা হয়েছে। তারা হলেন একই পরিবারের আশিকুজ্জামান (২৮), স্ত্রী ইশরাত জাহান মুনা (২৭), মুনার বাবা ইব্রাহিম সরকার (৬০), মা সুফিয়া বেগম (৫০), মুনার ভাই জুনায়েদ (১৮), আরেক পরিবারের দেলোয়ার হোসেন (৫৫), স্ত্রী লায়লা বেগম (৪৫) দুই ছেলে শাফায়াত হোসেন (৩২) শাকির হোসেন (৩০), শাফায়াতের স্ত্রী মিলি আক্তার (২৩) ও তাদের দুই বছরের মেয়ে ইয়াশফা। খোরশেদ আলম (৫০), স্ত্রী চেশমেয়ারা বেগম (৪৫) ও ছেলে সাখাওয়াত হোসেন (২৭)। আকাশ (২২), আসমা সিদ্দিক (৪৫), মেহেরুন্নেছা মেঘনা (৫০), পাবিহা (২৬), ইউনুস মোল্লা (৪০), মো. ফারুক হোসেন (৫৫)। তিনি জানান, এদের মধ্যে আশিকুজ্জামান, ইশরাত জাহান মুনা, খোরশেদ আলম ও শাফায়েত হোসেনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। খোরশেদ আলমের ২২ শতাংশ ও শাফায়েতের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। বাকিদের সবাই ধোঁয়ায় আক্রন্ত হয়েছে। সবার শ্বাসনালি ক্ষতি হয়েছে।

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ১১ রমজান ১৪৪২

পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন

কলেজছাত্রীসহ নিহত ৪ আহত ২১

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামে আগুনে বারবার কেড়ে নেয় অনেক প্রাণ। গতকাল ভোর রাতেও ঘটে একই ঘটনা আপনজন হারানোর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকা -সংবাদ

পুরান ঢাকার আরমেনিয়ান স্ট্রিটের একটি আবাসিক ভবন। ভবনটির নিচতলায় ১৮টি কেমিক্যালের দোকান। সেই ভবনেই গতকাল ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডে চারজন মারা গেছেন। আগুনে ও ধোঁয়ায় আহত হয়ে পড়েছেন আরও ২১ জন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনে অবস্থা খুবই গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

মৃত চারজনের মধ্যে ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার নিলুফা (২২) ৪র্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। ভবনের নিচতলার মার্কেটের দারোয়ান মো. রাসেল (২৭), রাসেলের মামা ওয়ালিউল্লাহ (৭০) এবং অকিল এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী কবির (২৮)।

গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলায় প্রতিটি দোকান কেমিক্যালে ঠাসা। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বস্তায় বস্তায় পড়ে আছে। মূলত ওখানে দোকানিরা স্যাম্পল হিসেবে কেমিক্যাল মুজদ করে রাখতেন।

গতকাল ভোররাতে বংশাল থানার বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ৯/১১ আরমেনিয়ান স্ট্রিটে হাজী মুসা ম্যানসনে অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটি প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ৬টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ওই ভবনের আহত একাধিক বাসিন্দা জানায়, ভোররাত সোয়া ৩টার দিকে ভবনটির নিচতলায় থাকা কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত। কেমিক্যাল থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নিচতলা থেকে উপরের দিকে আগুন উঠতে না পারলেও ধোঁয়ায় পুরো ভবন ছেয়ে যায়। প্রত্যেক বাসিন্দার রুমে ধোঁয়া ঢুকে যায়। তখন কেউ ঘুমে, কেউ সেহরির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এতে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে যে যার মতো করে ছুটতে থাকেন।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুন লাগার পর মানুষজন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও ধোঁয়া ও আগুনের কারণে বের হতে পারেননি।

বিভিন্ন ফ্লোরে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করতে থাকেন। আটকেপড়া বাসিন্দারা বারান্দা ও জানালা থেকে মোবাইলের আলো জ্বেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে বিভিন্ন তলা থেকে অন্তত ১৩/১৪ জনকে ক্রেন ব্যবহার করে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা বারান্দার গ্রিল কেটে বাসিন্দাদের উদ্ধার করেন। পরে একে একে আটকেপড়া সবাইকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

ফায়ার সার্ভিসের দেয়া পানিতে বস্তায় থাকা কেমিক্যাল গলে বিভিন্ন রং ধারণ করে ড্রেনে ভেসে যাচ্ছে। দেখা যায়, দোকান ও গুদামের ভেতরে বড় বড় ড্রামগুলো পুড়ে গেছে। এছাড়া রাসায়নিক পণ্য কেনাবেচায় ব্যবহৃত কিছু ছোট ছোট কনটেইনারও দেখা গেছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে জানালার গ্রিল কাটা। কাঁচগুলো ভাঙা। বাসিন্দারা গ্রিল কেটে কয়েকটি শাড়ি জোড়া লাগিয়ে তা বেয়ে নিচে নেমে আসেন। আগুনের তাপে ছাদের গেট খোলা সম্ভব হয়নি। তাই বাসিন্দারা ছাদে উঠতে পারেননি। চিলেকোঠায় থাকা ওয়ালিউল্লাহ ও কবির সেখানেই মারা যান। ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবু সায়েম অগ্নিনির্বাপণ থেকে শুরু করে কেমিক্যাল সরানো পর্যন্ত ওই ভবনে কাজ করেন। তিনি জানান, তারা এসে বাড়ির মূল গেটে তালা দেয়া অবস্থায় পান। আগুনের তাপে গেট, গ্রিল সবই গরম হয়ে যায়। হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছিল না। হাইড্রোলিক কাটার দিয়ে গেটের তালা কেটে ভেতরে ঢুকেন। দারোয়ান রাসেলের লাশ যেই রুম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই রুমের বৈদ্যুতিক বোর্ড পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ঘটনার পর থেকে ওই ভবনের মালিক ও নিচের দোকানিদের কাউকে খুঁজে পায়নি পুলিশ। ভবনটিতে কেমিক্যাল রাখার জন্য সিটি করপোরেশনের ট্রেডলাইসেন্স ছিল কিনা এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন।

ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগুনের সূত্রপাত নিয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলেনি।

ঘটনার পর গতকাল দুপুরে নিচতলার কয়েক হাজার বস্তা কেমিক্যাল সেখান থেকে ট্রাকযোগে মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যায় ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল হাসান জানান, ওই ভবনের নিচতলায় কসটিক সোডা, ব্লিচিং পাউডার, জিলেটিং, হাউড্রোলিক পার অক্সাইড ও এসিডিক এসিড নামক কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। এগুলোর পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘ভবনটির নিচতলায় থাকা কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুন লাগতে পারে। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করবে। এরপরই আগুন লাগার কারণ জানা সম্ভব হবে। ফায়ার সার্ভিস তার আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।’

ভবনটির পাশের ভবনের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ওই ভবনের নিচে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। আশপাশের প্রায় সব ভবনেই এ ধরনের গুদাম রয়েছে।

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ বলেছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা পরীক্ষা করে দেখে জানাবে রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে কিনা এবং ভবনের দোকানগুলোতে দাহ্য পদার্থ আছে কিনা।

বংশাল থানার ওসি মো. শাহীন ফকির জানান, ছাত্রী সুমাইয়া ওই ভবনের চতুর্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর পাশের এটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে মই দিয়ে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বের করে আনা হয়। কিন্তু সুমাইয়া অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সুমাইয়া ও রাসেলের মরদেহ ভোরেই উদ্ধার করা হয়।

ওয়ালিউল্লাহ ও কবিরের মরদেহ গতকাল বেলা ১১টার দিকে ভবনটির ছাদে পাওয়া যায়। ঢামেক সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চারজন ভর্তি রয়েছেন। তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর ১৭ জন ওয়ার্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন জানান, সেখানে চিকিৎসাধীন চারজনের শরীরের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।

পুরান ঢাকায় ২০১০ সালের জুনে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে ১২৪ জন নিহত হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন নিহত হন। আহত হন অনেকেই। এছাড়া প্রায়ই কেমিক্যালের গোডাউনগুলোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে।

এদিকে, শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তন্ময় প্রকাশ ঘোষ বলেন, এই ঘটনায় ২১ জন রোগী হাসপাতালে আসে। এদের মধ্যে একজনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি ২০ জনকে ভর্তি রাখা হয়েছে। তারা হলেন একই পরিবারের আশিকুজ্জামান (২৮), স্ত্রী ইশরাত জাহান মুনা (২৭), মুনার বাবা ইব্রাহিম সরকার (৬০), মা সুফিয়া বেগম (৫০), মুনার ভাই জুনায়েদ (১৮), আরেক পরিবারের দেলোয়ার হোসেন (৫৫), স্ত্রী লায়লা বেগম (৪৫) দুই ছেলে শাফায়াত হোসেন (৩২) শাকির হোসেন (৩০), শাফায়াতের স্ত্রী মিলি আক্তার (২৩) ও তাদের দুই বছরের মেয়ে ইয়াশফা। খোরশেদ আলম (৫০), স্ত্রী চেশমেয়ারা বেগম (৪৫) ও ছেলে সাখাওয়াত হোসেন (২৭)। আকাশ (২২), আসমা সিদ্দিক (৪৫), মেহেরুন্নেছা মেঘনা (৫০), পাবিহা (২৬), ইউনুস মোল্লা (৪০), মো. ফারুক হোসেন (৫৫)। তিনি জানান, এদের মধ্যে আশিকুজ্জামান, ইশরাত জাহান মুনা, খোরশেদ আলম ও শাফায়েত হোসেনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। খোরশেদ আলমের ২২ শতাংশ ও শাফায়েতের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। বাকিদের সবাই ধোঁয়ায় আক্রন্ত হয়েছে। সবার শ্বাসনালি ক্ষতি হয়েছে।