‘মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি’

পুরান ঢাকার আরমেনিয়ান স্ট্রিটের হাজী মুসা ম্যানসনের আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া তৃতীয় তলার বাসিন্দা আবুল বাশার তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন চারদিকে শুধু ধোঁয়া।

‘একটু শ্বাস নেয়ার জন্য কী ভীষণ যন্ত্রণা সইতে হয় এটা কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারবে না। তওবা ও কালেমা পড়ে সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, আর এটা আমার পক্ষে ভোলাও সম্ভব নয়। কারণ মৃত্যুর অনেক কাছ থেকে ফিরে এসেছি,’ বলছিলেন তিনি।

‘আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। চোখ খুললেই দেখি ধোঁয়া আর ধোঁয়া। পরে দরজা খুলে দেখি নিচে আগুনের লেলিহান শিখা। কিছুই আর ভাবতে পারছিলাম না।’

আরেক বাসিন্দা মো. রেজা আলী জানান, ‘আমার শ্যালক ইমন মোবাইলে গেমস খেলছিল, সে হঠাৎ দেখে আগুনের ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে। তারপর সে পরিবারের সবাইকে ডেকে তুলে। আমরা জানালার কাচ ভেঙে পেছনের দিক দিয়ে নেমে পাশের বিল্ডিংয়ের সহায়তার কোনমতে প্রাণ রক্ষা করি।’

হাজী মুসা ম্যানসনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে গভীর রাতে আগুন লাগার পর তলায় তলায় গিয়ে বেল চেপে আর ডাকাডাকি করে সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ভবনের নিরাপত্তাকর্মী রাসেল, কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি।

গতকাল হাজী মুসা ম্যানসনে লাগা আগুনের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২১ জন আহত হলেও বাকিদের জীবিত উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুনের সূত্রপাত নিচতলার কেমিক্যাল গোডাউন থেকেই।

ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট ৩ ঘণ্টার চেষ্টার পর গতকাল সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। ৯/১ আরমানিয়ান স্ট্রিট হোল্ডিংয়ে ছয়তলা হাজী মুসা ম্যানসনের নিচতলায় ছিল রাসায়নিকের গুদাম। উপরের ফ্লোরগুলোতে ভাড়াটিয়ারা থাকতেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতে সেহেরির আগে আগে নিচতলায় যখন আগুন লাগল, অনেক পরিবারই তখন ঘুমে। কেউ আবার সেহেরির জন্য উঠে ধোঁয়ার গন্ধ টের পান। ওই ভবনের দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত লোকজন বসবাস করে। আগুন লাগার পর ভবনের ছাদে কিছু লোক আটকা পড়ে যায়, পরে তাদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

আগুনে মৃত চারজনের মধ্যে শহীদুল ইসলামও ওই ভবনের নিরাপত্তাককর্মী ছিলেন। রাসেলের মামা অলিউল্লাহ দিনমুজুরের কাজ করতেন, রাতে মুসা ম্যানসনের ছাদের চিলেকোঠায় রাসেলের সঙ্গেই থাকতেন।

মৃত সুমাইয়া আক্তার চতুর্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তিনি ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। আর পরিবারের অন্য ৫ সদস্যও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লড়াই করছেন মৃত্যুর সঙ্গে। নিহত সুমাইয়ার বোন মুনা ও দুলাভাই আশিক শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে রয়েছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ মেজো জামাই নিয়ে মুসা ম্যানশনের চতুর্থতলায় থাকতেন ইব্রাহিম ও সুফিয়া দম্পতি।

সেখানে আগুনের খুব কাছে থেকেও বেঁচে ফিরেছেন জেসমিন আক্তার, স্বামী আবদুস সালাম, তাদের দুই সন্তান। ভবনটির দ্বিতীয়তলার বাসিন্দা তারা।

জেসমিন আক্তার বলেন, ‘বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব শেষ! কিছুই আর ভাবতে পারছিলাম না। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি। নতুন জীবন পেয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে পড়ব, এভাবেই আগুনের কাছে থেকেও বেঁচে ফিরব ভাবিনি। নতুন করে সব কিছু পেলাম, আমার সন্তানরা এতিম হয়নি।’

আগুন থেকে বেঁচে ফিরে আসা জেসমিন বলেন, ‘সেহরির জন্য উঠেছি, খাওয়া-দাওয়ার পর তখনও কেউ ঘুমাইনি। বাচ্চারা খেলছিল। হঠাৎ মেয়ে বলে ওঠে ‘আম্মু তোমরা কিছু করছো, ধোঁয়া আসতেছে কেন?’ বাইরে দরজা খুলতেই দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমার স্বামী ঘরের প্রধান দরজা লাগিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ চলে যায়, ধোঁয়া বেড়ে গেলে গন্ধ আর ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নেয়া কষ্ট হচ্ছিল, চোখ জ্বালাপোড়া করছিল। বেডরুমে দুই ছেলে মেয়ে কান্না করছিল। ওরা ভয়ে চিৎকার করছিল, এক পর্যায়ে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা প্রধান দরজা ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।’

জেসমিন বলেন, তার স্বামী আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছিলেন না। ‘আমি বার বার বলছিলাম ঘরে থাকলে ধোঁয়ায় মারা যাব। পরে আগুন যখন কমল, সূর্য ওঠায় আশপাশে যখন আলো আসল তখন আমরা বের হওয়ার চেষ্টা করি। ওড়না পেঁচিয়ে আমি কোনমতে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসি। আর পাশের ফ্ল্যাটে ছিলেন সাতজন। তারা জানালা ভেঙে কাঠের টুকরা দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে নিচে নেমে যায়।’

জেসমিন আক্তারের স্বামী আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা এ ভবনে উঠেছি বেশি দিন হয়নি। স্ত্রী ছেলে মেয়েকে নিয়ে এ ধরনের ভবনে উঠা ছিল জীবনের বড় ভুল। আল্লাহর শুকরিয়া বেঁচে ফিরেছি।’

সন্তান নাতিসহ ৬ জনকে নিয়ে ভবনটির পাঁচতলা সি ব্লকে থাকতেন হেনা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে জেগেই ছিলাম। ধোঁয়া দেখে প্রথমে মনে করেছিলাম রান্নার ধোঁয়া। কেউ একজন কলিং বেল চাপে। শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখি পুরো ভবনে ধোঁয়া। পরে পশ্চিম পাশের গ্রিল কেটে মই দিয়ে বাইরে বের হই।’

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ১১ রমজান ১৪৪২

‘মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি’

গোলাম মোস্তফা

পুরান ঢাকার আরমেনিয়ান স্ট্রিটের হাজী মুসা ম্যানসনের আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া তৃতীয় তলার বাসিন্দা আবুল বাশার তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন চারদিকে শুধু ধোঁয়া।

‘একটু শ্বাস নেয়ার জন্য কী ভীষণ যন্ত্রণা সইতে হয় এটা কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারবে না। তওবা ও কালেমা পড়ে সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, আর এটা আমার পক্ষে ভোলাও সম্ভব নয়। কারণ মৃত্যুর অনেক কাছ থেকে ফিরে এসেছি,’ বলছিলেন তিনি।

‘আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। চোখ খুললেই দেখি ধোঁয়া আর ধোঁয়া। পরে দরজা খুলে দেখি নিচে আগুনের লেলিহান শিখা। কিছুই আর ভাবতে পারছিলাম না।’

আরেক বাসিন্দা মো. রেজা আলী জানান, ‘আমার শ্যালক ইমন মোবাইলে গেমস খেলছিল, সে হঠাৎ দেখে আগুনের ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে। তারপর সে পরিবারের সবাইকে ডেকে তুলে। আমরা জানালার কাচ ভেঙে পেছনের দিক দিয়ে নেমে পাশের বিল্ডিংয়ের সহায়তার কোনমতে প্রাণ রক্ষা করি।’

হাজী মুসা ম্যানসনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে গভীর রাতে আগুন লাগার পর তলায় তলায় গিয়ে বেল চেপে আর ডাকাডাকি করে সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ভবনের নিরাপত্তাকর্মী রাসেল, কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি।

গতকাল হাজী মুসা ম্যানসনে লাগা আগুনের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২১ জন আহত হলেও বাকিদের জীবিত উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুনের সূত্রপাত নিচতলার কেমিক্যাল গোডাউন থেকেই।

ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট ৩ ঘণ্টার চেষ্টার পর গতকাল সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। ৯/১ আরমানিয়ান স্ট্রিট হোল্ডিংয়ে ছয়তলা হাজী মুসা ম্যানসনের নিচতলায় ছিল রাসায়নিকের গুদাম। উপরের ফ্লোরগুলোতে ভাড়াটিয়ারা থাকতেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতে সেহেরির আগে আগে নিচতলায় যখন আগুন লাগল, অনেক পরিবারই তখন ঘুমে। কেউ আবার সেহেরির জন্য উঠে ধোঁয়ার গন্ধ টের পান। ওই ভবনের দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত লোকজন বসবাস করে। আগুন লাগার পর ভবনের ছাদে কিছু লোক আটকা পড়ে যায়, পরে তাদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

আগুনে মৃত চারজনের মধ্যে শহীদুল ইসলামও ওই ভবনের নিরাপত্তাককর্মী ছিলেন। রাসেলের মামা অলিউল্লাহ দিনমুজুরের কাজ করতেন, রাতে মুসা ম্যানসনের ছাদের চিলেকোঠায় রাসেলের সঙ্গেই থাকতেন।

মৃত সুমাইয়া আক্তার চতুর্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তিনি ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। আর পরিবারের অন্য ৫ সদস্যও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লড়াই করছেন মৃত্যুর সঙ্গে। নিহত সুমাইয়ার বোন মুনা ও দুলাভাই আশিক শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে রয়েছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ মেজো জামাই নিয়ে মুসা ম্যানশনের চতুর্থতলায় থাকতেন ইব্রাহিম ও সুফিয়া দম্পতি।

সেখানে আগুনের খুব কাছে থেকেও বেঁচে ফিরেছেন জেসমিন আক্তার, স্বামী আবদুস সালাম, তাদের দুই সন্তান। ভবনটির দ্বিতীয়তলার বাসিন্দা তারা।

জেসমিন আক্তার বলেন, ‘বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব শেষ! কিছুই আর ভাবতে পারছিলাম না। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি। নতুন জীবন পেয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে পড়ব, এভাবেই আগুনের কাছে থেকেও বেঁচে ফিরব ভাবিনি। নতুন করে সব কিছু পেলাম, আমার সন্তানরা এতিম হয়নি।’

আগুন থেকে বেঁচে ফিরে আসা জেসমিন বলেন, ‘সেহরির জন্য উঠেছি, খাওয়া-দাওয়ার পর তখনও কেউ ঘুমাইনি। বাচ্চারা খেলছিল। হঠাৎ মেয়ে বলে ওঠে ‘আম্মু তোমরা কিছু করছো, ধোঁয়া আসতেছে কেন?’ বাইরে দরজা খুলতেই দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমার স্বামী ঘরের প্রধান দরজা লাগিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ চলে যায়, ধোঁয়া বেড়ে গেলে গন্ধ আর ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নেয়া কষ্ট হচ্ছিল, চোখ জ্বালাপোড়া করছিল। বেডরুমে দুই ছেলে মেয়ে কান্না করছিল। ওরা ভয়ে চিৎকার করছিল, এক পর্যায়ে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা প্রধান দরজা ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।’

জেসমিন বলেন, তার স্বামী আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছিলেন না। ‘আমি বার বার বলছিলাম ঘরে থাকলে ধোঁয়ায় মারা যাব। পরে আগুন যখন কমল, সূর্য ওঠায় আশপাশে যখন আলো আসল তখন আমরা বের হওয়ার চেষ্টা করি। ওড়না পেঁচিয়ে আমি কোনমতে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসি। আর পাশের ফ্ল্যাটে ছিলেন সাতজন। তারা জানালা ভেঙে কাঠের টুকরা দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে নিচে নেমে যায়।’

জেসমিন আক্তারের স্বামী আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা এ ভবনে উঠেছি বেশি দিন হয়নি। স্ত্রী ছেলে মেয়েকে নিয়ে এ ধরনের ভবনে উঠা ছিল জীবনের বড় ভুল। আল্লাহর শুকরিয়া বেঁচে ফিরেছি।’

সন্তান নাতিসহ ৬ জনকে নিয়ে ভবনটির পাঁচতলা সি ব্লকে থাকতেন হেনা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে জেগেই ছিলাম। ধোঁয়া দেখে প্রথমে মনে করেছিলাম রান্নার ধোঁয়া। কেউ একজন কলিং বেল চাপে। শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখি পুরো ভবনে ধোঁয়া। পরে পশ্চিম পাশের গ্রিল কেটে মই দিয়ে বাইরে বের হই।’