কবে সরবে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম?

চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুন লেগে ৭৩ জনের প্রাণহানির পর ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, ১ মাসের মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কারখানা সরিয়ে নেয়া হবে। চালানো হবে অভিযান। তারপর পার হয়ে গেছে ২ বছর কিন্তু রাসায়নিকের গুদামও সরেনি আর অভিযানেরও কোন দেখা নেই।

এর আগে ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে ১২৪ জনের প্রাণহানির পর পরই পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গোডাউন ও কারখানা সরিয়ে নেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ২০১৯ সালে ফের চকবাজারে একই ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনার পর সেই দাবি আবার সামনে আসে। গতকাল আরমানিটোলা কেমিক্যাল মার্কেটে আগুনে ৪ জনের প্রাণহানীর পর সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, একের পর এক ঘটনা ঘটে। কিছুদিন হৈচৈ। কমিটি গঠন হয়। সুপারিশ করা হয়। কিন্তু আলোর মুখ দেখে না। এরপর সবকিছু পুরোনো রূপেই চলে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনের আগুনের ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস প্রশ্ন তুলেছেন এতো নজরদারির মধ্যে কীভাবে অবৈধ রাসায়নিক দ্রব্যাদি মজুদ ও অবৈধ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে আমরা কিন্তু সম্পূর্ণরূপে কার্যক্রম পরিচালনার ট্রেড লাইসেন্স বন্ধ করে দিই। এ কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ব্যাপক রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা আটুট থাকি।’

মেয়র বলেন, ‘আমি অবাক হই, সিটি করপোরেশন থেকে কোন ধরনের বাণিজ্যিক অনুমতি ছাড়াই কীভাবে তারা এই রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি করে, কীভাবে গুদামজাত করে এবং কীভাবে ব্যবসা করে। খুবই অবাক কাণ্ড। কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সমস্যা রয়ে যাবে। মেয়র আরও বলেন, ‘শিল্প মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প নিয়েছে কেরানীগঞ্জে এসব গুদামগুলো স্থানান্তর করা হবে। সেটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এ নিয়ে আমাদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভা হয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সভা করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের ওপর যেসব দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তা পালন করেছি। অবৈধ রাসায়নিক গুদামে তালিকা করার কথা বলা হয়েছিল, আমরা তা করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করিনি।’

সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাসায়নিকের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেয়া। কিন্তু সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টার আগুনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ৩১টি সুপারিশ করে। সুপারিশের প্রথমটিই ছিল পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বংশাল থানা এলাকার আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, লালবাগ থানা এলাকার শহীদনগর ও ইসলামবাগ এবং চকবাজার থানা এলাকায় রয়েছে ৪০০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এ ভবনগুলোতে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল, টলুইনের মতো দাহ্য পদার্থ। ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হওয়ার পর কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও পুরান ঢাকা থেকে এসব কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ হয়নি। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলে এখানে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, দিন দিন কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়ির মালিকরা অগ্রিম টাকা এবং বেশি ভাড়ার লোভে বাসা বাড়িতে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিচ্ছে।

২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনে ৭৩ জনের প্রাণহানির পর অভিযান শুরু করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। পরে তা রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। ভবন মালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধের মুখে কেমিক্যাল গোডাউন, দোকান এবং কারখানা অপসারণের অভিযান থেকে সরে আসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পুরান ঢাকায় অধিকাংশ বাড়ির বেইজমেন্টে কেমিক্যাল গোডাউন অথবা কারখানা। এসব কেমিক্যাল গোডাউন বা কারখানার ৯৮ শতাংশই অনুমোদনহীন। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ, ডিএসসিসির কর্মকর্তা, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে মাসোহারার ভিত্তিতে ম্যানেজ করে আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন বানিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন বলে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক পরিচালক মো. জাহিদ হাসান টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, ‘পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা অপসারনের সিদ্ধান্ত বহু আগের। সম্প্রতি কেমিক্যাল পল্লী গঠনের প্রকল্প নেয়ার পর সমিতিতে গোডাউন পাওয়ার আশায় কাজগপত্র জমা দিয়েছি। আমার মতো বহু ব্যবসায়ী কাগজপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু সেই পল্লীর বাস্তবায়ন আর চোখে পড়েনি। এরপর ২ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে।’ এই ব্যবসায়ী বলেন, কে দোকানের অন্তরালে কেমিক্যাল মজুদ করে রেখেছে সেটি তো ঘুরে ঘুরে দেখে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একটি সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

জানা গেছে, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর। এরমধ্যে দুবার প্রকল্পের জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ১০ বছরেও নতুন প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়নি। আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ২০১১ সালে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জমি চিহ্নিত করে সেখানে ১৭ তলার কয়েকটি ভবন তৈরি করে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামের জন্য বরাদ্দ দিতে ডিপিপিও করেছিল। সে সময় রাসায়নিক কারখানা মালিকদের তিনটি সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য একাধিকবার বসলেও তারা কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। আট বছর পর ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা’ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়। ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় বিসিকের ওই প্রকল্পের আওতায় কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ ব্রাহ্মণকীর্ত্তা মৌজায় ৫০ একর জমি চিহ্নিত করে ৯৩৬টি প্লট করার কথা বলা হয়। প্রকল্পটিও সংশোধন হয় চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর। গত বছরের ১৮ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর জমি নিয়ে ‘বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিসিক। সিরাজদিখানের কামারখান্দা, চিত্রকোট ও গোয়ালখালী মৌজায় বাস্তবায়িত এ প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ১৫৪টি প্লট তৈরির কথা ছিল। এরমধ্যে ১ হাজার ২০৮টি এ-টাইপ, ৯০৪টি বি-টাইপ এবং ৪২টি এস-টাইপ প্লট করে রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউনের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা।

সংশোধিত ডিপিপি গত বছর ৩০ এপ্রিল অনুমোদন দেয় একনেক। সে বছরের ১২ জুন শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। এ প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ টাকা। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত ১৪৩ কোটি ৩৮ লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য প্রকল্পের জমিতে মাটি ভরাটের কাজ এখনও শুরু হয়নি। মাটি ভরাট শেষ হলে অবকাঠামো ও কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অধিগ্রহণ করা জমি নিয়েছে বিসিক। মাটি ভরাটের দরপত্র হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে মাটি ভরাট হয়ে যাবে। আগামী বছরের জুনে ব্যবসায়ীদের প্লট বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে বিসিক বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ১১ রমজান ১৪৪২

কবে সরবে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম?

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুন লেগে ৭৩ জনের প্রাণহানির পর ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, ১ মাসের মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কারখানা সরিয়ে নেয়া হবে। চালানো হবে অভিযান। তারপর পার হয়ে গেছে ২ বছর কিন্তু রাসায়নিকের গুদামও সরেনি আর অভিযানেরও কোন দেখা নেই।

এর আগে ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে ১২৪ জনের প্রাণহানির পর পরই পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গোডাউন ও কারখানা সরিয়ে নেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ২০১৯ সালে ফের চকবাজারে একই ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনার পর সেই দাবি আবার সামনে আসে। গতকাল আরমানিটোলা কেমিক্যাল মার্কেটে আগুনে ৪ জনের প্রাণহানীর পর সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, একের পর এক ঘটনা ঘটে। কিছুদিন হৈচৈ। কমিটি গঠন হয়। সুপারিশ করা হয়। কিন্তু আলোর মুখ দেখে না। এরপর সবকিছু পুরোনো রূপেই চলে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনের আগুনের ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস প্রশ্ন তুলেছেন এতো নজরদারির মধ্যে কীভাবে অবৈধ রাসায়নিক দ্রব্যাদি মজুদ ও অবৈধ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে আমরা কিন্তু সম্পূর্ণরূপে কার্যক্রম পরিচালনার ট্রেড লাইসেন্স বন্ধ করে দিই। এ কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ব্যাপক রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা আটুট থাকি।’

মেয়র বলেন, ‘আমি অবাক হই, সিটি করপোরেশন থেকে কোন ধরনের বাণিজ্যিক অনুমতি ছাড়াই কীভাবে তারা এই রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি করে, কীভাবে গুদামজাত করে এবং কীভাবে ব্যবসা করে। খুবই অবাক কাণ্ড। কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সমস্যা রয়ে যাবে। মেয়র আরও বলেন, ‘শিল্প মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প নিয়েছে কেরানীগঞ্জে এসব গুদামগুলো স্থানান্তর করা হবে। সেটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এ নিয়ে আমাদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভা হয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সভা করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের ওপর যেসব দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তা পালন করেছি। অবৈধ রাসায়নিক গুদামে তালিকা করার কথা বলা হয়েছিল, আমরা তা করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করিনি।’

সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাসায়নিকের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেয়া। কিন্তু সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টার আগুনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ৩১টি সুপারিশ করে। সুপারিশের প্রথমটিই ছিল পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বংশাল থানা এলাকার আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, লালবাগ থানা এলাকার শহীদনগর ও ইসলামবাগ এবং চকবাজার থানা এলাকায় রয়েছে ৪০০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এ ভবনগুলোতে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল, টলুইনের মতো দাহ্য পদার্থ। ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হওয়ার পর কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও পুরান ঢাকা থেকে এসব কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ হয়নি। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলে এখানে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, দিন দিন কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়ির মালিকরা অগ্রিম টাকা এবং বেশি ভাড়ার লোভে বাসা বাড়িতে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিচ্ছে।

২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনে ৭৩ জনের প্রাণহানির পর অভিযান শুরু করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। পরে তা রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। ভবন মালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধের মুখে কেমিক্যাল গোডাউন, দোকান এবং কারখানা অপসারণের অভিযান থেকে সরে আসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পুরান ঢাকায় অধিকাংশ বাড়ির বেইজমেন্টে কেমিক্যাল গোডাউন অথবা কারখানা। এসব কেমিক্যাল গোডাউন বা কারখানার ৯৮ শতাংশই অনুমোদনহীন। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ, ডিএসসিসির কর্মকর্তা, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে মাসোহারার ভিত্তিতে ম্যানেজ করে আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন বানিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন বলে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক পরিচালক মো. জাহিদ হাসান টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, ‘পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা অপসারনের সিদ্ধান্ত বহু আগের। সম্প্রতি কেমিক্যাল পল্লী গঠনের প্রকল্প নেয়ার পর সমিতিতে গোডাউন পাওয়ার আশায় কাজগপত্র জমা দিয়েছি। আমার মতো বহু ব্যবসায়ী কাগজপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু সেই পল্লীর বাস্তবায়ন আর চোখে পড়েনি। এরপর ২ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে।’ এই ব্যবসায়ী বলেন, কে দোকানের অন্তরালে কেমিক্যাল মজুদ করে রেখেছে সেটি তো ঘুরে ঘুরে দেখে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একটি সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

জানা গেছে, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর। এরমধ্যে দুবার প্রকল্পের জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ১০ বছরেও নতুন প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়নি। আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ২০১১ সালে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জমি চিহ্নিত করে সেখানে ১৭ তলার কয়েকটি ভবন তৈরি করে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামের জন্য বরাদ্দ দিতে ডিপিপিও করেছিল। সে সময় রাসায়নিক কারখানা মালিকদের তিনটি সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য একাধিকবার বসলেও তারা কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। আট বছর পর ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা’ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়। ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় বিসিকের ওই প্রকল্পের আওতায় কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ ব্রাহ্মণকীর্ত্তা মৌজায় ৫০ একর জমি চিহ্নিত করে ৯৩৬টি প্লট করার কথা বলা হয়। প্রকল্পটিও সংশোধন হয় চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর। গত বছরের ১৮ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর জমি নিয়ে ‘বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিসিক। সিরাজদিখানের কামারখান্দা, চিত্রকোট ও গোয়ালখালী মৌজায় বাস্তবায়িত এ প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ১৫৪টি প্লট তৈরির কথা ছিল। এরমধ্যে ১ হাজার ২০৮টি এ-টাইপ, ৯০৪টি বি-টাইপ এবং ৪২টি এস-টাইপ প্লট করে রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউনের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা।

সংশোধিত ডিপিপি গত বছর ৩০ এপ্রিল অনুমোদন দেয় একনেক। সে বছরের ১২ জুন শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। এ প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ টাকা। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত ১৪৩ কোটি ৩৮ লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য প্রকল্পের জমিতে মাটি ভরাটের কাজ এখনও শুরু হয়নি। মাটি ভরাট শেষ হলে অবকাঠামো ও কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অধিগ্রহণ করা জমি নিয়েছে বিসিক। মাটি ভরাটের দরপত্র হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে মাটি ভরাট হয়ে যাবে। আগামী বছরের জুনে ব্যবসায়ীদের প্লট বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে বিসিক বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।