রানা প্লাজা ধস, ৮ বছরেও দুটি মামলা শেষ হয়নি

৮ বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে ঘটে এক মানবিক বিপর্যয়। ৮তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন রানা প্লাজা ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৪ জন পোশাককর্মী। আহত হন আরও প্রায় দুই হাজার। এ ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দুটি মামলা দায়ের হয়। যদিও মামলার এখনও কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। প্রায় পাঁচ বছর আগে এই দুই মামলার অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন বিচারিক আদালত কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, দুই মামলায় এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য দিতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে আলোচিত মামলা দুটির বিচারিক কার্যক্রম শুরুর ‘গেঁরো’ কবে খুলবে, তা নিয়েই প্রশ্ন সচেতন মহলের।

আদালত সূত্র জানায়, হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান ৮ আসামি। এদের মধ্যে ৬ জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়। দুই আসামি সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজী মোহাম্মদ আলী ও সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহর পক্ষে করা আবেদনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তাদের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখনও হত্যা মামলার সাক্ষ্য নিতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিদের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য চারবার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে চিঠি দিয়েও কোন কাজ হয়নি। অপরদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কয়েকজন আসামি রিভিশন আবেদন করেন। এদের মধ্যে আসামি ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মামলাটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত। বাকিদের রিভিশন আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় এ মামলায়ও সাক্ষ্য শুরু করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।

হত্যা মামলার বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মিজানুর রহমান বলেন, অভিযোগ গঠনের পর ৮ আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে ৬ জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। দুই আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহ এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজী মোহাম্মদ আলীর পক্ষের আবেদন এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তাদের আবেদনের ফলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে চার বার চিঠি দেয়া হয়েছে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অফিস থেকে। চিঠি দেয়ার পরও কোন কাজ হয়নি। তাই মামলার বিচার প্রক্রিয়ার কোন অগ্রগতি হচ্ছে না।

ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন আবেদন করেন। তাদের মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর করেছে আদালত। অপরদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। রিভিশনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যাবে। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় পাঁচ বছর আগে অভিযোগ গঠন হয়েছে। কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। তাদের পক্ষে আবেদনের ফলে স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়া সবাই জামিনে আছেন। মামলায় কোন সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না, আর আসামি রানাকে জামিনও দিচ্ছে না আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত দ্রুত স্থগিতাদেশ নিষ্পত্তি করে মামলার কার্যক্রম চালু করা।

হত্যা মামলা

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। এর নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা মামলা করেন।

ভবন মালিক সোহেল রানা কারাবন্দী আছেন

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

ইমারত নির্মাণ আইনে মামলা

একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় অপর মামলাটি করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ওই আদালতে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

দুই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলো- রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজী মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।

তিন বছরের কারাদণ্ড রানার

এদিকে ভবন ধসের পর পালিয়ে যাওয়া রানাকে কয়েকদিন পর যশোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন থেকে বন্দী তিনি। গ্রেপ্তারের পর রানার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ওই মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

আজও অরক্ষিত রানা প্লাজার স্মৃতিস্তম্ভ

অবৈধ দখলদার ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ড সরানোর দাবি শ্রমিকদের

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান

এক হাজার একশ’ ছত্রিশজনের তাজাপ্রাণ আর কয়েক শতাধিক শ্রমিকের পঙ্গুত্ববরণের কূপ ছিল রানা প্লাজা। এক সময় ৯ তলা ভবনজুড়েই থাকতো কোলাহল ও কর্মচঞ্চল্যতা। তবে এখন অনেকটাই ডুবায় ভাসছে কস্তুরী পানা ও আগাছায়। আর সামনের পাশে অবৈধ দোকানিদের দখলে প্রতিযোগিতা। সে সঙ্গে অবৈধ ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ও ড্রাইভাররা গল্প গুজবের স্থান বেছেছে রানা প্লাজার স্মৃতিস্তম্ভে। তবে শ্রমিকদের দাবি অবৈধভাবে দখলদার উচ্ছেদ ও স্মৃতিস্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণের।

সরেজমিনে দেখা যায়, রানা প্লাজার সামনের জমিগুলোতে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ড কাজে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে খেপের অভাবে অলস সময় পার করা ট্যাক্সি ড্রাইভাররা স্মৃতিস্তম্ভে বসে আবার কেউবা পা তুলে দাঁড়িয়ে গল্প গুজবে মেতেছে।

রানা প্লাজার শ্রমিক নাসির জানান, ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজার নয় তলা ভবন ধসে পড়ে। এতে প্রাণ হারায় ১ হাজার ১শ’ ৩৬ জন এবং কয়েক হাজার শ্রমিক আহত হয়ে মানবেতন জীবনযাপন করছে। তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ হলেও দেখভালের দায়িত্বে নেই কেউ আবার অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে দখল করে নিচ্ছে রানা প্লাজার জমি।

তবে এ ব্যাপারে অবৈধভাবে দখলকারী দোকানিদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়নি।

অন্যদিকে মহাসড়কের জমি ও রানা প্লাজা স্মৃতিস্তম্ভের খালি জায়গায় গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। সেখানে জামাল নামের এক ড্রাইভারের সভাপতিতে গড়ে উঠেছে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডটি। সেই সঙ্গে ড্রাইভারদের অবসর সময় কাটে স্মৃতিস্তম্ভে বসে গল্প-গুজব করে।

এ বিষয়ে ওই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের সভাপতি জামাল জানান, ‘ড্রাইভাররা আসলে বুঝে নাই তাদের আমি ওয়ার্নিং দিয়ে দিবো। যাতে তারা এতটুকু জায়গা ছেড়ে যা ইচ্ছা তাই করে।’

এদিকে সাভার হাইওয়ে থানার ওসি সাজ্জাদ করিম খান জানান, এর আগে একাধিকবার ওই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের রেকার বিলও করেছি কিন্তু কিছু দিন বন্ধ করে ঘুরেফিরে আবার তারা শুরু করে। তবে তিনি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান।

তবে এ নিয়ে ক্ষোভের কথা জানান রানা প্লাজার গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইমাদুল ইসলাম (এমদাদ)। তিনি বলেন, রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিলো। তবে কোন মর্যাদা নেই সেই স্মৃতিস্তম্ভের। সম্মান না করে অবহেলায় অরক্ষিতভাবে রয়েছে স্তম্ভটি। স্তম্ভটি রক্ষায় মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি রানা প্লাজার সামনে দোকানগুলোতে প্রভাবশালীদের অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধ করে উচ্ছেদের আহ্বান জানান।

এ বিষয়ে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাজহারুল ইসলাম জানান, এখনও আমার কাছে এধরনের কোন অভিযোগ আসেনি। তবে আগামীকাল রানা প্লাজার সামনে পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস জানিয়েছেন এই নির্বাহী কর্মকর্তা।

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ১১ রমজান ১৪৪২

রানা প্লাজা ধস, ৮ বছরেও দুটি মামলা শেষ হয়নি

আদালত বার্তা পরিবেশক

image

৮ বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে ঘটে এক মানবিক বিপর্যয়। ৮তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন রানা প্লাজা ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৪ জন পোশাককর্মী। আহত হন আরও প্রায় দুই হাজার। এ ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দুটি মামলা দায়ের হয়। যদিও মামলার এখনও কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। প্রায় পাঁচ বছর আগে এই দুই মামলার অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন বিচারিক আদালত কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, দুই মামলায় এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য দিতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে আলোচিত মামলা দুটির বিচারিক কার্যক্রম শুরুর ‘গেঁরো’ কবে খুলবে, তা নিয়েই প্রশ্ন সচেতন মহলের।

আদালত সূত্র জানায়, হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান ৮ আসামি। এদের মধ্যে ৬ জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়। দুই আসামি সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজী মোহাম্মদ আলী ও সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহর পক্ষে করা আবেদনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তাদের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখনও হত্যা মামলার সাক্ষ্য নিতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিদের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য চারবার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে চিঠি দিয়েও কোন কাজ হয়নি। অপরদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কয়েকজন আসামি রিভিশন আবেদন করেন। এদের মধ্যে আসামি ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মামলাটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত। বাকিদের রিভিশন আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় এ মামলায়ও সাক্ষ্য শুরু করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।

হত্যা মামলার বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মিজানুর রহমান বলেন, অভিযোগ গঠনের পর ৮ আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে ৬ জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। দুই আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহ এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজী মোহাম্মদ আলীর পক্ষের আবেদন এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তাদের আবেদনের ফলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে চার বার চিঠি দেয়া হয়েছে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অফিস থেকে। চিঠি দেয়ার পরও কোন কাজ হয়নি। তাই মামলার বিচার প্রক্রিয়ার কোন অগ্রগতি হচ্ছে না।

ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন আবেদন করেন। তাদের মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর করেছে আদালত। অপরদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। রিভিশনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যাবে। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় পাঁচ বছর আগে অভিযোগ গঠন হয়েছে। কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। তাদের পক্ষে আবেদনের ফলে স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়া সবাই জামিনে আছেন। মামলায় কোন সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না, আর আসামি রানাকে জামিনও দিচ্ছে না আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত দ্রুত স্থগিতাদেশ নিষ্পত্তি করে মামলার কার্যক্রম চালু করা।

হত্যা মামলা

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। এর নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা মামলা করেন।

ভবন মালিক সোহেল রানা কারাবন্দী আছেন

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

ইমারত নির্মাণ আইনে মামলা

একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় অপর মামলাটি করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ওই আদালতে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

দুই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলো- রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজী মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।

তিন বছরের কারাদণ্ড রানার

এদিকে ভবন ধসের পর পালিয়ে যাওয়া রানাকে কয়েকদিন পর যশোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন থেকে বন্দী তিনি। গ্রেপ্তারের পর রানার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ওই মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

আজও অরক্ষিত রানা প্লাজার স্মৃতিস্তম্ভ

অবৈধ দখলদার ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ড সরানোর দাবি শ্রমিকদের

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান

এক হাজার একশ’ ছত্রিশজনের তাজাপ্রাণ আর কয়েক শতাধিক শ্রমিকের পঙ্গুত্ববরণের কূপ ছিল রানা প্লাজা। এক সময় ৯ তলা ভবনজুড়েই থাকতো কোলাহল ও কর্মচঞ্চল্যতা। তবে এখন অনেকটাই ডুবায় ভাসছে কস্তুরী পানা ও আগাছায়। আর সামনের পাশে অবৈধ দোকানিদের দখলে প্রতিযোগিতা। সে সঙ্গে অবৈধ ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ও ড্রাইভাররা গল্প গুজবের স্থান বেছেছে রানা প্লাজার স্মৃতিস্তম্ভে। তবে শ্রমিকদের দাবি অবৈধভাবে দখলদার উচ্ছেদ ও স্মৃতিস্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণের।

সরেজমিনে দেখা যায়, রানা প্লাজার সামনের জমিগুলোতে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ড কাজে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে খেপের অভাবে অলস সময় পার করা ট্যাক্সি ড্রাইভাররা স্মৃতিস্তম্ভে বসে আবার কেউবা পা তুলে দাঁড়িয়ে গল্প গুজবে মেতেছে।

রানা প্লাজার শ্রমিক নাসির জানান, ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজার নয় তলা ভবন ধসে পড়ে। এতে প্রাণ হারায় ১ হাজার ১শ’ ৩৬ জন এবং কয়েক হাজার শ্রমিক আহত হয়ে মানবেতন জীবনযাপন করছে। তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ হলেও দেখভালের দায়িত্বে নেই কেউ আবার অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে দখল করে নিচ্ছে রানা প্লাজার জমি।

তবে এ ব্যাপারে অবৈধভাবে দখলকারী দোকানিদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়নি।

অন্যদিকে মহাসড়কের জমি ও রানা প্লাজা স্মৃতিস্তম্ভের খালি জায়গায় গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। সেখানে জামাল নামের এক ড্রাইভারের সভাপতিতে গড়ে উঠেছে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডটি। সেই সঙ্গে ড্রাইভারদের অবসর সময় কাটে স্মৃতিস্তম্ভে বসে গল্প-গুজব করে।

এ বিষয়ে ওই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের সভাপতি জামাল জানান, ‘ড্রাইভাররা আসলে বুঝে নাই তাদের আমি ওয়ার্নিং দিয়ে দিবো। যাতে তারা এতটুকু জায়গা ছেড়ে যা ইচ্ছা তাই করে।’

এদিকে সাভার হাইওয়ে থানার ওসি সাজ্জাদ করিম খান জানান, এর আগে একাধিকবার ওই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের রেকার বিলও করেছি কিন্তু কিছু দিন বন্ধ করে ঘুরেফিরে আবার তারা শুরু করে। তবে তিনি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান।

তবে এ নিয়ে ক্ষোভের কথা জানান রানা প্লাজার গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইমাদুল ইসলাম (এমদাদ)। তিনি বলেন, রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিলো। তবে কোন মর্যাদা নেই সেই স্মৃতিস্তম্ভের। সম্মান না করে অবহেলায় অরক্ষিতভাবে রয়েছে স্তম্ভটি। স্তম্ভটি রক্ষায় মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি রানা প্লাজার সামনে দোকানগুলোতে প্রভাবশালীদের অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধ করে উচ্ছেদের আহ্বান জানান।

এ বিষয়ে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাজহারুল ইসলাম জানান, এখনও আমার কাছে এধরনের কোন অভিযোগ আসেনি। তবে আগামীকাল রানা প্লাজার সামনে পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস জানিয়েছেন এই নির্বাহী কর্মকর্তা।