আব্বাস সিদ্দিকী এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এইবারের ভোটে (২০২১) সবার-ই নজর আব্বাস সিদ্দিকী এবং তার দল ইন্ডিয়ান সেকুলির ফ্রন্টকে ঘিরে। মাত্র চার মাস আগে তৈরি একটা রাজনৈতিক দলকে ঘিরে এই ধরনের উৎসাহ পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনো তৈরি হয়নি। সিপিআই (এম) সহ বামফ্রন্ট ভুক্ত বামদলগুলো, যাদের রাজনৈতিক ব্যাপ্তি ব্রিটিশ আমল থেকে, যাদের দলের প্রতিষ্ঠাতাদের বেশিরভাগই ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেসব দলগুলো যেভাবে এই আব্বাস এবং তার দলকে ঘিরে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, সেটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রেক্ষিতেই নয়, ভারতের রাজনীতির পরিমণ্ডলেও একটা ঘটনাবহুল ব্যাপার। কংগ্রেসের মতো প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো একটি দল, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, পারছে না আই এসএফকে অস্বীকার করতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় রাজনীতিককে ও আব্বাসকে অস্বীকার করতে অসত্য বলতে হচ্ছে। পবিত্র ফুরফুরা শরীফের সঙ্গে আব্বাসের সম্পর্ককে অস্বীকার করে মানুষের কাছে ফুরফুরা শরীফের ঐতিহ্য, ত্যাগ, তিতিক্ষা, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম-সব কিছুকেই গুলিয়ে দিতে হচ্ছে মমতার। কারণ, সিপিআই (এম) নেতা গৌতম দেব, তার দল চাক বা না চাক একদা ফুরফুরার ত্বহা সিদ্দিকীকে যেভাবে রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই ত্বহাকে মমতা মুকুল রায়ের মাধ্যমে নিজের পক্ষে টেনে এনেছেন। আব্বাসের জনপ্রিয়তা বাড়লে ত্বহার জনপ্রিয়তা কমবে। আর ত্বহার জনপ্রিয়তা কমলে মমতার ভোট বাক্সে টান পড়বে। এটা হলো মমতার হিসাব। আর বিজেপি চাইছে আব্বাস উঠে আসুক ভোট কাটুয়া হিসেবে। মমতার সংখ্যালঘু ভোটে ধস নামান আব্বাস- এটাই চায় বিজেপি। আর বামপন্থিরা চাইছেন, যে সংখ্যালঘুরা তাদের প্রতি বিমুখ হয়েছেন, তারা আবার ফিরে আসুন আব্বাসের হাত ধরে।

বামপন্থিরা বিশেষ করে সিপিআই (এম) মমতার শাসনকালের ১০ বছরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারের ক্ষেত্রে ক্রমশ: কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। এভাবে বামপন্থিদের কোণঠাসা হওয়ার সব থেকে বড় কারণ, মমতার প্রথম দফার শাসনকালে রাজনীতিকে বিরোধী শূন্য করবার তাগিদ। এই পর্যায়ে এসে দেখা যায়, মমতার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক আক্রমণের মোকাবিলা করবার ক্ষমতা বামপন্থিরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। ভূমিস্তরে বামপন্থিদের সংগঠন প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে, নতুবা নীচুতলার নেতৃত্বের একটা অংশ নিজেদের পিঠ বাঁচাতে শাসকের সঙ্গে আপোষ করে চলেছে। এই অবস্থাতে স্থানীয় স্তরের বেশকিছু ভোটে অলিখিতভাবে নীচুতলার বামপন্থিরা বিজেপির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া পর্যন্ত করেছিল একটা সময়ে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনকালের ১০ বছর সিপিআই (এম) এর একটা অংশ, আড়াল থেকে যাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল সুভাষ চক্রবর্তী, লক্ষণ শেঠ, অনিল বসুর মতো লোকেরা, তাদের লক্ষ্য ছিল দল এবং বিধানসভায় বুদ্ধবাবুর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা। বুদ্ধবাবুকে যেন সুভাষ চক্রবর্তী বা তার কাছের মানুষদের তোষামদ করে চলতে হয়- এটাই ছিল এই অংশের সিপিআই (এম) নেতাদের টার্গেট। এই লক্ষ্যেই সুভাষ চক্রবর্তী নয়ের দশকেই দমদম লোকসভা কেন্দ্রে মমতা এবং বিজেপির যৌথ প্রার্থীকে জিতিয়ে নিজেদের প্রার্থী অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়েছিলেন। বস্তুত শহুরে মধ্যবিত্তের ভেতরে বিজেপিকে জায়গা করে দেয়ার ক্ষেত্রে মমতা আর সুভাষের সেটা ছিল যৌথ উদ্যোগ। উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনো উপায়ে বুদ্ধবাবুকে কমজোরি করা। এই কাজে বামফ্রন্টের অন্য শরিকদলগুলো, যেমন, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, এদের যথেষ্ট মদত ছিল। রাজনীতিক হিসেবে শিশির - শুভেন্দু অধিকারীদের যে উত্থান, সিপিআইকে (এম) জব্দ করতে সেই উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিলেন বামফ্রন্টের শরিক, ডিএসপি নেতা প্রবোধ সিংহ। গোটা দীঘা অঞ্চলজুড়ে যে ব্যবসায়িক প্রতিপত্তির জোরে ক্রমে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন করেন অধিকারী পরিবার, প্রাথমিকভাবে তার পেছনে ছিলেন এই প্রবোধ সিংহ।

এই সময়কাল থেকেই সমস্ত বিরোধী শক্তি মুসলমান সমাজকে বামফ্রন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। আজ মমতার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, যে নিজেকে দেওবন্দ তরিকাভুক্ত করে অসত্য প্রচার করে, সে নন্দীগ্রাম পর্বে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বামফ্রন্ট সরকার, বিশেষ করে বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে প্রচার করেছে। এই লোকটিকে ব্যবহার করে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম সমস্যার সমাধানের নাম করে বুদ্ধবাবুকে প্রতারিত করতে চেয়েছিলেন সুভাষ ঘনিষ্ঠ এক প্রকাশক।

এই যে ঘরে বাইরের ষড়যন্ত্র তাকে মোকাবিলা করে বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের মেলে ধরবার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে সিপিআইকে (এম) অনেক লড়াই করতে হয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার দরুণ যে অংশটি নানা দরুনের সুযোগ সুবিধার ভাগীদার হয়েছিল, ঠুনকো আদর্শের দোহাই দিয়ে সার্বিক আদর্শবোধকে উপরে ফেলতেই তারা বেশি যতœশীল ছিলেন। গত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এবং আরএসএস-বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতে দাঙ্গা হয়েছে। এই দাঙ্গার বিরুদ্ধে বামফ্রন্টের প্রথম সারির নেতারা যেমন যতœশীল থেকেছেন, তেমনই প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তখনও পর্যন্ত সিপিআইয়ের (এম) অন্যতম শীর্ষনেতা ভিডিও ক্যামেরার সামনে বলেছেন; বসিরহাটে মুসলমানরা দাঙ্গা করেছে। সারারাত ধরে লুঠপাট করেছে। এ কথা বলার দায়ে আজ পর্যন্ত গৌতম দেবকে কোনো শাস্তি দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি সিপিআই (এম)।

মমতা গত দল বছরে যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ভিতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে শক্তিশালী করেছেন, তার বিপরীতে সংখ্যালঘুর স্বাধিকারের প্রশ্নে নিজেদের লড়াইকে আরও দৃঢ় করে, সংখ্যালঘুর আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সিপিআই (এম) সেভাবে জোরদার কিছু করতে পারেনি। বস্তুত মহ. সেলিমের মতো সর্বগ্রাহ্য নেতাকে দলের মুখ হিসেবে তুলে ধরে সর্বসাধারণের কাছে আস্থা ফিরিয়ে আনার যে বুদ্ধিমত্তা সেটা গত ১০ বছরে সিপিআই (এম) দেখাতে পারেনি। শ্যামল চক্রবর্তীদের মতো শুধু গোষ্ঠী প্রাধান্য বজায় রাখতে তৎপর নেতারা ক্ষমতা হারানোর পর ৮-৯ বছরেও ক্ষমতার খোঁয়ারি কাটাতে পারেননি। তাদের কাছে সেলিমের মতো পরিচ্ছন্ন মাষ দলের মুখ হলে নিজেদের বহু সমস্যা হয়ে যাবে- এই মানসিকতায় রাজনীতিটাকে তারা পরিচালনা করেছেন। সেলিমকে দমিয়ে দিতে মইনুল হাসানের মতো পকেটের লোককে মাথায় তুলেছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী, গৌতম দেবেরা। এখন অবশ্য এই মইনুল তৃণমূল কংগ্রেসে আছেন। মমতাও তাকে তেমন গুরুত্ব দেন, সে রকম কোন ইঙ্গিত মইনুল তৃণমূলে যোগ দেয়ার বছর তিনেক পরেও পাওয়া যায়নি।

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে আব্বাস সিদ্দিকীর উল্কার মতো আবির্ভাব। গৌতম দেব একটা সময়ে আব্বাসের আত্মীয় ত্বহা সিদ্দিকীকে নিয়ে বেশ শোরগোল তুলেছিলেন। গৌতম দেব ত্বহাকে কব্জা করছেন দেখেই তাকে হাইজ্যাক করে নেয় তখনকার তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতি করা ত্বহাকে নিয়ে যখন শোরগোল তুলেছিলেন গৌতম দেব, তখন সুভাষ চক্রবর্তীর শিষ্য প্রশিষ্যেরা একটাও কথা বলেনি। গৌতম দেবের প্রমোট করা ত্বহা যখন মমতার কাছের লোক হয়ে বুমেরাং হয়ে যায় বামপন্থিদের কাছে, তখন ও তেমন তাপ উত্তাপ দেখা যায়নি।

ডিমিট্রভের যুক্তফ্রন্টের তত্ত্বের সময়োপযোগী প্রয়োগ ঘটিয়ে আদ্যন্ত আধুনিক মনষ্ক আব্বাস, তার ভাই নওশাদদের যখন রাজনীতির গ্রুমিং করলেন মহ. সেলিম, সেই গ্রুমিং এ উৎসাহিত হয়ে এরা যখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষদের জন্যে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুসরণ করে আব্বাসের দল আইএসএফ যে বাম- কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় এলো, তার ও মূল কৃতিত্ব সেলিমেরই। এই সমঝোতায় আসার ক্ষেত্রে সেলিম বামপন্থিদের যতটা অগ্রসর করতে পেরেছেন, সেভাবে হয়তো কংগ্রেস এগিয়ে আসেনি। দক্ষিণবঙ্গে আইএসএফের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়াটি সেলিমের উদ্যোগে যতটা আগে হয়েছে তার ফলে ভোট রাজনীতিতে সংযুক্ত মোর্চা অনেকটাই সুবিধা পাবে বলে মনে হয়। আর উত্তরবঙ্গে এই সমঝোতার প্রশ্নে কংগ্রেস যতটা শৈথিল্য দেখিয়েছে, তার দায়টাও গোটা সংযুক্ত মোর্চাকেই ভোটে বইতে হবে।

আব্বাসকে ঘিরে মানুষের একটা বড় অংশের ভেতরে প্রবল আগ্রহ। আবার বামপন্থিদের ভেতরে ছদ্মবেশী সঙ্গী মানসিকতার লোকেদের বিরক্তি। তারা যত নষ্টের গোড়া মনে করছেন সেলিমকে। এই সিপিআইয়ের (এম) গৌতম দেব যখন ত্বহা সিদ্দিকীকে মাথায় তুলেছিলেন, তখন সেভাবে এই সঙ্গী মানসিকতার বামপন্থিদের ভেতরে হেলদোল দেখা যায় নি। কারণ, গৌতম রেখেছিলেন স্টালিনীয় গোপনীয়তা। আর সেলিম যেটা করেছেন, সেটা করেছেন জলের মতো স্বচ্ছতা নিয়ে।

আব্বাসের পাশে এত বেশি গরিবগুর্বো সাধারণ মানুষের ভিড় দেখে এই প্রশ্নটাই জাগছে যে, বামপন্থি আন্দোলনকে কি আর সমাজের একদম নীচুতলার মানুষ, অর্থনৈতিক- সামাজিকভাবে অসহায় মানুষ নিজেদের আন্দোলন বলে মনে করছে না? গত ১০ বছরে গোটা পশ্চিমবঙ্গে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা সারদা-নারদার মতো আর্থিক কেলেঙ্কারিই হোক, কামদুনি- পার্ক স্ট্রিট, মধ্যমগ্রামে গণধর্ষণ- মৃত্যু, সুদীপ্ত- মইদুল হত্যা, যাই হোক না কেন, মমতা আজ বিরোধী নেত্রী থাকলে আন্দোলনকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিতেন, বামপন্থিরা তা পারেননি। এটি মধ্যবিত্ত চরিত্রের প্রবল্যের জন্যে তারা পারেননি, নাকি দলের জনবিচ্ছিন্নতা তার জন্যে দায়ী, নাকি সেলিমের মতো ডায়নেমিক নেতা সার্বিক নেতৃত্বে নেই বলে তারা পারেন- এ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতেই থাকবে।

এই বিচার-বিশ্লেষণের ভেতর দিয়েই একটা চরম সত্য প্রকাশ পাচ্ছে যে, গরিবদের ওপর নিয়ন্ত্রণের রাশ এখন কমিউনিস্ট পার্টির থেকে অনেক বেশি আব্বাস সিদ্দিকীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। মাত্র চার মাসের ভেতরে রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরের একজন সদ্য যুবক যা করেছেন, তেমনটা কিন্তু ’৪৭-এর আগে-পরে এপার বাংলাতে আর কেউ করতে পারেননি। ধর্মসভাতে মানুষকে মাতানো একজন এত অল্প সময়ে কি করে এত পরিণত রাজনীতিক হয়ে উঠলেনÑ এটাই আগামী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির নিরিখে একটি বহুমূল্যবান প্রশ্ন হয়ে উঠবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ১১ রমজান ১৪৪২

আব্বাস সিদ্দিকী এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এইবারের ভোটে (২০২১) সবার-ই নজর আব্বাস সিদ্দিকী এবং তার দল ইন্ডিয়ান সেকুলির ফ্রন্টকে ঘিরে। মাত্র চার মাস আগে তৈরি একটা রাজনৈতিক দলকে ঘিরে এই ধরনের উৎসাহ পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনো তৈরি হয়নি। সিপিআই (এম) সহ বামফ্রন্ট ভুক্ত বামদলগুলো, যাদের রাজনৈতিক ব্যাপ্তি ব্রিটিশ আমল থেকে, যাদের দলের প্রতিষ্ঠাতাদের বেশিরভাগই ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেসব দলগুলো যেভাবে এই আব্বাস এবং তার দলকে ঘিরে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, সেটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রেক্ষিতেই নয়, ভারতের রাজনীতির পরিমণ্ডলেও একটা ঘটনাবহুল ব্যাপার। কংগ্রেসের মতো প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো একটি দল, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, পারছে না আই এসএফকে অস্বীকার করতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় রাজনীতিককে ও আব্বাসকে অস্বীকার করতে অসত্য বলতে হচ্ছে। পবিত্র ফুরফুরা শরীফের সঙ্গে আব্বাসের সম্পর্ককে অস্বীকার করে মানুষের কাছে ফুরফুরা শরীফের ঐতিহ্য, ত্যাগ, তিতিক্ষা, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম-সব কিছুকেই গুলিয়ে দিতে হচ্ছে মমতার। কারণ, সিপিআই (এম) নেতা গৌতম দেব, তার দল চাক বা না চাক একদা ফুরফুরার ত্বহা সিদ্দিকীকে যেভাবে রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই ত্বহাকে মমতা মুকুল রায়ের মাধ্যমে নিজের পক্ষে টেনে এনেছেন। আব্বাসের জনপ্রিয়তা বাড়লে ত্বহার জনপ্রিয়তা কমবে। আর ত্বহার জনপ্রিয়তা কমলে মমতার ভোট বাক্সে টান পড়বে। এটা হলো মমতার হিসাব। আর বিজেপি চাইছে আব্বাস উঠে আসুক ভোট কাটুয়া হিসেবে। মমতার সংখ্যালঘু ভোটে ধস নামান আব্বাস- এটাই চায় বিজেপি। আর বামপন্থিরা চাইছেন, যে সংখ্যালঘুরা তাদের প্রতি বিমুখ হয়েছেন, তারা আবার ফিরে আসুন আব্বাসের হাত ধরে।

বামপন্থিরা বিশেষ করে সিপিআই (এম) মমতার শাসনকালের ১০ বছরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারের ক্ষেত্রে ক্রমশ: কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। এভাবে বামপন্থিদের কোণঠাসা হওয়ার সব থেকে বড় কারণ, মমতার প্রথম দফার শাসনকালে রাজনীতিকে বিরোধী শূন্য করবার তাগিদ। এই পর্যায়ে এসে দেখা যায়, মমতার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক আক্রমণের মোকাবিলা করবার ক্ষমতা বামপন্থিরা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। ভূমিস্তরে বামপন্থিদের সংগঠন প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে, নতুবা নীচুতলার নেতৃত্বের একটা অংশ নিজেদের পিঠ বাঁচাতে শাসকের সঙ্গে আপোষ করে চলেছে। এই অবস্থাতে স্থানীয় স্তরের বেশকিছু ভোটে অলিখিতভাবে নীচুতলার বামপন্থিরা বিজেপির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া পর্যন্ত করেছিল একটা সময়ে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনকালের ১০ বছর সিপিআই (এম) এর একটা অংশ, আড়াল থেকে যাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল সুভাষ চক্রবর্তী, লক্ষণ শেঠ, অনিল বসুর মতো লোকেরা, তাদের লক্ষ্য ছিল দল এবং বিধানসভায় বুদ্ধবাবুর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা। বুদ্ধবাবুকে যেন সুভাষ চক্রবর্তী বা তার কাছের মানুষদের তোষামদ করে চলতে হয়- এটাই ছিল এই অংশের সিপিআই (এম) নেতাদের টার্গেট। এই লক্ষ্যেই সুভাষ চক্রবর্তী নয়ের দশকেই দমদম লোকসভা কেন্দ্রে মমতা এবং বিজেপির যৌথ প্রার্থীকে জিতিয়ে নিজেদের প্রার্থী অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়েছিলেন। বস্তুত শহুরে মধ্যবিত্তের ভেতরে বিজেপিকে জায়গা করে দেয়ার ক্ষেত্রে মমতা আর সুভাষের সেটা ছিল যৌথ উদ্যোগ। উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনো উপায়ে বুদ্ধবাবুকে কমজোরি করা। এই কাজে বামফ্রন্টের অন্য শরিকদলগুলো, যেমন, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, এদের যথেষ্ট মদত ছিল। রাজনীতিক হিসেবে শিশির - শুভেন্দু অধিকারীদের যে উত্থান, সিপিআইকে (এম) জব্দ করতে সেই উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিলেন বামফ্রন্টের শরিক, ডিএসপি নেতা প্রবোধ সিংহ। গোটা দীঘা অঞ্চলজুড়ে যে ব্যবসায়িক প্রতিপত্তির জোরে ক্রমে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন করেন অধিকারী পরিবার, প্রাথমিকভাবে তার পেছনে ছিলেন এই প্রবোধ সিংহ।

এই সময়কাল থেকেই সমস্ত বিরোধী শক্তি মুসলমান সমাজকে বামফ্রন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। আজ মমতার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, যে নিজেকে দেওবন্দ তরিকাভুক্ত করে অসত্য প্রচার করে, সে নন্দীগ্রাম পর্বে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বামফ্রন্ট সরকার, বিশেষ করে বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে প্রচার করেছে। এই লোকটিকে ব্যবহার করে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম সমস্যার সমাধানের নাম করে বুদ্ধবাবুকে প্রতারিত করতে চেয়েছিলেন সুভাষ ঘনিষ্ঠ এক প্রকাশক।

এই যে ঘরে বাইরের ষড়যন্ত্র তাকে মোকাবিলা করে বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের মেলে ধরবার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে সিপিআইকে (এম) অনেক লড়াই করতে হয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার দরুণ যে অংশটি নানা দরুনের সুযোগ সুবিধার ভাগীদার হয়েছিল, ঠুনকো আদর্শের দোহাই দিয়ে সার্বিক আদর্শবোধকে উপরে ফেলতেই তারা বেশি যতœশীল ছিলেন। গত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এবং আরএসএস-বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতে দাঙ্গা হয়েছে। এই দাঙ্গার বিরুদ্ধে বামফ্রন্টের প্রথম সারির নেতারা যেমন যতœশীল থেকেছেন, তেমনই প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তখনও পর্যন্ত সিপিআইয়ের (এম) অন্যতম শীর্ষনেতা ভিডিও ক্যামেরার সামনে বলেছেন; বসিরহাটে মুসলমানরা দাঙ্গা করেছে। সারারাত ধরে লুঠপাট করেছে। এ কথা বলার দায়ে আজ পর্যন্ত গৌতম দেবকে কোনো শাস্তি দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি সিপিআই (এম)।

মমতা গত দল বছরে যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ভিতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে শক্তিশালী করেছেন, তার বিপরীতে সংখ্যালঘুর স্বাধিকারের প্রশ্নে নিজেদের লড়াইকে আরও দৃঢ় করে, সংখ্যালঘুর আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সিপিআই (এম) সেভাবে জোরদার কিছু করতে পারেনি। বস্তুত মহ. সেলিমের মতো সর্বগ্রাহ্য নেতাকে দলের মুখ হিসেবে তুলে ধরে সর্বসাধারণের কাছে আস্থা ফিরিয়ে আনার যে বুদ্ধিমত্তা সেটা গত ১০ বছরে সিপিআই (এম) দেখাতে পারেনি। শ্যামল চক্রবর্তীদের মতো শুধু গোষ্ঠী প্রাধান্য বজায় রাখতে তৎপর নেতারা ক্ষমতা হারানোর পর ৮-৯ বছরেও ক্ষমতার খোঁয়ারি কাটাতে পারেননি। তাদের কাছে সেলিমের মতো পরিচ্ছন্ন মাষ দলের মুখ হলে নিজেদের বহু সমস্যা হয়ে যাবে- এই মানসিকতায় রাজনীতিটাকে তারা পরিচালনা করেছেন। সেলিমকে দমিয়ে দিতে মইনুল হাসানের মতো পকেটের লোককে মাথায় তুলেছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী, গৌতম দেবেরা। এখন অবশ্য এই মইনুল তৃণমূল কংগ্রেসে আছেন। মমতাও তাকে তেমন গুরুত্ব দেন, সে রকম কোন ইঙ্গিত মইনুল তৃণমূলে যোগ দেয়ার বছর তিনেক পরেও পাওয়া যায়নি।

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে আব্বাস সিদ্দিকীর উল্কার মতো আবির্ভাব। গৌতম দেব একটা সময়ে আব্বাসের আত্মীয় ত্বহা সিদ্দিকীকে নিয়ে বেশ শোরগোল তুলেছিলেন। গৌতম দেব ত্বহাকে কব্জা করছেন দেখেই তাকে হাইজ্যাক করে নেয় তখনকার তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতি করা ত্বহাকে নিয়ে যখন শোরগোল তুলেছিলেন গৌতম দেব, তখন সুভাষ চক্রবর্তীর শিষ্য প্রশিষ্যেরা একটাও কথা বলেনি। গৌতম দেবের প্রমোট করা ত্বহা যখন মমতার কাছের লোক হয়ে বুমেরাং হয়ে যায় বামপন্থিদের কাছে, তখন ও তেমন তাপ উত্তাপ দেখা যায়নি।

ডিমিট্রভের যুক্তফ্রন্টের তত্ত্বের সময়োপযোগী প্রয়োগ ঘটিয়ে আদ্যন্ত আধুনিক মনষ্ক আব্বাস, তার ভাই নওশাদদের যখন রাজনীতির গ্রুমিং করলেন মহ. সেলিম, সেই গ্রুমিং এ উৎসাহিত হয়ে এরা যখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষদের জন্যে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুসরণ করে আব্বাসের দল আইএসএফ যে বাম- কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় এলো, তার ও মূল কৃতিত্ব সেলিমেরই। এই সমঝোতায় আসার ক্ষেত্রে সেলিম বামপন্থিদের যতটা অগ্রসর করতে পেরেছেন, সেভাবে হয়তো কংগ্রেস এগিয়ে আসেনি। দক্ষিণবঙ্গে আইএসএফের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়াটি সেলিমের উদ্যোগে যতটা আগে হয়েছে তার ফলে ভোট রাজনীতিতে সংযুক্ত মোর্চা অনেকটাই সুবিধা পাবে বলে মনে হয়। আর উত্তরবঙ্গে এই সমঝোতার প্রশ্নে কংগ্রেস যতটা শৈথিল্য দেখিয়েছে, তার দায়টাও গোটা সংযুক্ত মোর্চাকেই ভোটে বইতে হবে।

আব্বাসকে ঘিরে মানুষের একটা বড় অংশের ভেতরে প্রবল আগ্রহ। আবার বামপন্থিদের ভেতরে ছদ্মবেশী সঙ্গী মানসিকতার লোকেদের বিরক্তি। তারা যত নষ্টের গোড়া মনে করছেন সেলিমকে। এই সিপিআইয়ের (এম) গৌতম দেব যখন ত্বহা সিদ্দিকীকে মাথায় তুলেছিলেন, তখন সেভাবে এই সঙ্গী মানসিকতার বামপন্থিদের ভেতরে হেলদোল দেখা যায় নি। কারণ, গৌতম রেখেছিলেন স্টালিনীয় গোপনীয়তা। আর সেলিম যেটা করেছেন, সেটা করেছেন জলের মতো স্বচ্ছতা নিয়ে।

আব্বাসের পাশে এত বেশি গরিবগুর্বো সাধারণ মানুষের ভিড় দেখে এই প্রশ্নটাই জাগছে যে, বামপন্থি আন্দোলনকে কি আর সমাজের একদম নীচুতলার মানুষ, অর্থনৈতিক- সামাজিকভাবে অসহায় মানুষ নিজেদের আন্দোলন বলে মনে করছে না? গত ১০ বছরে গোটা পশ্চিমবঙ্গে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা সারদা-নারদার মতো আর্থিক কেলেঙ্কারিই হোক, কামদুনি- পার্ক স্ট্রিট, মধ্যমগ্রামে গণধর্ষণ- মৃত্যু, সুদীপ্ত- মইদুল হত্যা, যাই হোক না কেন, মমতা আজ বিরোধী নেত্রী থাকলে আন্দোলনকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিতেন, বামপন্থিরা তা পারেননি। এটি মধ্যবিত্ত চরিত্রের প্রবল্যের জন্যে তারা পারেননি, নাকি দলের জনবিচ্ছিন্নতা তার জন্যে দায়ী, নাকি সেলিমের মতো ডায়নেমিক নেতা সার্বিক নেতৃত্বে নেই বলে তারা পারেন- এ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতেই থাকবে।

এই বিচার-বিশ্লেষণের ভেতর দিয়েই একটা চরম সত্য প্রকাশ পাচ্ছে যে, গরিবদের ওপর নিয়ন্ত্রণের রাশ এখন কমিউনিস্ট পার্টির থেকে অনেক বেশি আব্বাস সিদ্দিকীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। মাত্র চার মাসের ভেতরে রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরের একজন সদ্য যুবক যা করেছেন, তেমনটা কিন্তু ’৪৭-এর আগে-পরে এপার বাংলাতে আর কেউ করতে পারেননি। ধর্মসভাতে মানুষকে মাতানো একজন এত অল্প সময়ে কি করে এত পরিণত রাজনীতিক হয়ে উঠলেনÑ এটাই আগামী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির নিরিখে একটি বহুমূল্যবান প্রশ্ন হয়ে উঠবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]