করোনাকালে নিরাপদে হাওরের বোরো সংগ্রহ

হুমায়ুন কবীর

বোরো মৌসুমের মোট উৎপাদিত ধানের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় হাওরাঞ্চল থেকে। সারা বছর সারাদেশে মোট ধান উৎপাদিত হয় প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। তার মধ্যে শুধু বোরো মৌসুমেই উৎপাদিত হয় এক কোটি ৯০ লাখ থেকে প্রায় দুই কোটি মেট্রিক টন। আর শুধু হাওরাঞ্চলেই উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টন। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৭টি জেলার ৪৭টি উপজেলায় এ বোরো ধানের আবাদ হয়ে থাকে। এ অঞ্চলটিকে বোরো ধানের জন্য শস্যভা-ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সেজন্য দেশের মোট বোরো ফসলের এক পঞ্চমাংশ ফসল নিরাপদে ঘরে উত্তোলন করার ওপর সারাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কযুক্ত।

হাওরাঞ্চলের বোরো ধান নিরাপদে সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে, কারণ সেখানকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টিকে মাথায় রেখে। প্রতি বছর অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হানা দিয়ে এসব বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে প্রকৃতি। এ বছরও এপ্রিল মাসের শুরুর দিকেই বড় একটি ঝড়ো হাওয়ায় হাওরসহ সারাদেশের অনেক স্থানে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিগত কয়েকবছর আগেও এ মৌসুমে পাহাড়ি ঢল আর আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ফসলেই শুধু নয়, সেখানকার মাছ-গাছ থেকে শুরু করে পশু পাখি পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সমতল ভূমির তুলনায় হাওরে একটু আগে এবং আগাম জাতের উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জাত রোপণ করা হয়। সেজন্য সারাদেশের তুলনায় সেখানকার বোরা ধান একটু আগেভাগেই কর্তন ও মাড়াই করা যায়। তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও সেখানকার ধান কাটার জন্য এখন উপযুক্ত মৌসুম চলছে। কোন কোন জমির ধান এখনই কাটার উপযুক্ত, আবার কোন কোন জমির ধান আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে কর্তন উপযোগী হয়ে উঠবে। তাছাড়া আগাম পাহাড়ি ঢলের বন্যার আশঙ্কায় ক্ষেতের পুরো ধান পাকার আশায় বসে না থেকে ৮০% ভাগ ধান পাকলেই তা কেটে ঘরে তোলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন কৃষি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু এ করোনা আক্রান্ত সময়ে পূর্বের ন্যায় ধান কাটার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে যা নিয়ে শুধু ওই এলাকার কৃষকই নয় সরকারও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান দুটি সমস্যা হলো- (১) হাওরাঞ্চলের ধান যেহেতু অন্য সমতল ভূমির তুলনায় একটু আগেই কর্তন করা হয় সেজন্য স্বাভাবিক সময়ে অন্যান্য এলাকা থেকে এখানে ধান কাটার জন্য কৃষি শ্রমিক প্রয়োজন। কিন্তু করোনায় কারণে সেসব কৃষি শ্রমিকের অনেকেই আসার সাহস পাচ্ছে না। অপরদিকে গণপরিবহন চলাচল সীমিত থাকায় দূর-দূরান্তের কৃষি শ্রমিকের যাতায়াত অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছে। (২) অন্য সময় অন্য সমতল এলাকা থেকে ধানকাটার যন্ত্র যাতায়াত করার সুযোগ পেতো যা এবার সেসব এলাকা থেকে ধান ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য কৃষি যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করা সম্ভবপর হচ্ছে না। কিন্তু সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষকদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে।

বর্তমানে করোনার কারণে শহরে কাজ করা অনেক মানুষ গ্রামে গ্রামে অবস্থান করছেন। তাদের এখন তেমন কোন কাজ নেই। এমন সময়ে তাদের জাতির প্রয়োজনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে গ্রামের কৃষি জমিতে কাজ করা অতটা ভয়ের কিছু নেই। কারণ সেখানে মুক্ত বাতাস ও রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ। এমন পরিবেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেকটাই কম। সেজন্য যেসব কৃষকের জমির ধান আগে পাকবে সে জমিতে সেসব মানুষদের নিয়ে দলীয়ভাবে ধান কেটে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। পরে সেই দলটি আরেকজন কৃষকের জমির ধান কেটে দিতে পারে। এলাকাভিত্তিক এমন একটি টিম গঠন করে পুরো দুই সপ্তাহ সময়ের মধ্যে সারা হাওর এলাকার ধান কেটে ফেলা সম্ভব। এভাবে গত বছর সফলতা পাওয়া গিয়েছিল। তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যারা এ কাজে সম্পৃক্ত হবেন, তারা অবশ্যই করোনা প্রতিরোধের সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তা করতে হবে।

[লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

kbdhumayun08@gmail.com

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১ , ১১ বৈশাখ ১৪২৮ ১১ রমজান ১৪৪২

করোনাকালে নিরাপদে হাওরের বোরো সংগ্রহ

হুমায়ুন কবীর

image

বোরো মৌসুমের মোট উৎপাদিত ধানের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় হাওরাঞ্চল থেকে। সারা বছর সারাদেশে মোট ধান উৎপাদিত হয় প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। তার মধ্যে শুধু বোরো মৌসুমেই উৎপাদিত হয় এক কোটি ৯০ লাখ থেকে প্রায় দুই কোটি মেট্রিক টন। আর শুধু হাওরাঞ্চলেই উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টন। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৭টি জেলার ৪৭টি উপজেলায় এ বোরো ধানের আবাদ হয়ে থাকে। এ অঞ্চলটিকে বোরো ধানের জন্য শস্যভা-ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সেজন্য দেশের মোট বোরো ফসলের এক পঞ্চমাংশ ফসল নিরাপদে ঘরে উত্তোলন করার ওপর সারাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কযুক্ত।

হাওরাঞ্চলের বোরো ধান নিরাপদে সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে, কারণ সেখানকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টিকে মাথায় রেখে। প্রতি বছর অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হানা দিয়ে এসব বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে প্রকৃতি। এ বছরও এপ্রিল মাসের শুরুর দিকেই বড় একটি ঝড়ো হাওয়ায় হাওরসহ সারাদেশের অনেক স্থানে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিগত কয়েকবছর আগেও এ মৌসুমে পাহাড়ি ঢল আর আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ফসলেই শুধু নয়, সেখানকার মাছ-গাছ থেকে শুরু করে পশু পাখি পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সমতল ভূমির তুলনায় হাওরে একটু আগে এবং আগাম জাতের উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জাত রোপণ করা হয়। সেজন্য সারাদেশের তুলনায় সেখানকার বোরা ধান একটু আগেভাগেই কর্তন ও মাড়াই করা যায়। তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও সেখানকার ধান কাটার জন্য এখন উপযুক্ত মৌসুম চলছে। কোন কোন জমির ধান এখনই কাটার উপযুক্ত, আবার কোন কোন জমির ধান আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে কর্তন উপযোগী হয়ে উঠবে। তাছাড়া আগাম পাহাড়ি ঢলের বন্যার আশঙ্কায় ক্ষেতের পুরো ধান পাকার আশায় বসে না থেকে ৮০% ভাগ ধান পাকলেই তা কেটে ঘরে তোলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন কৃষি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু এ করোনা আক্রান্ত সময়ে পূর্বের ন্যায় ধান কাটার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে যা নিয়ে শুধু ওই এলাকার কৃষকই নয় সরকারও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান দুটি সমস্যা হলো- (১) হাওরাঞ্চলের ধান যেহেতু অন্য সমতল ভূমির তুলনায় একটু আগেই কর্তন করা হয় সেজন্য স্বাভাবিক সময়ে অন্যান্য এলাকা থেকে এখানে ধান কাটার জন্য কৃষি শ্রমিক প্রয়োজন। কিন্তু করোনায় কারণে সেসব কৃষি শ্রমিকের অনেকেই আসার সাহস পাচ্ছে না। অপরদিকে গণপরিবহন চলাচল সীমিত থাকায় দূর-দূরান্তের কৃষি শ্রমিকের যাতায়াত অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছে। (২) অন্য সময় অন্য সমতল এলাকা থেকে ধানকাটার যন্ত্র যাতায়াত করার সুযোগ পেতো যা এবার সেসব এলাকা থেকে ধান ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য কৃষি যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করা সম্ভবপর হচ্ছে না। কিন্তু সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষকদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে।

বর্তমানে করোনার কারণে শহরে কাজ করা অনেক মানুষ গ্রামে গ্রামে অবস্থান করছেন। তাদের এখন তেমন কোন কাজ নেই। এমন সময়ে তাদের জাতির প্রয়োজনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে গ্রামের কৃষি জমিতে কাজ করা অতটা ভয়ের কিছু নেই। কারণ সেখানে মুক্ত বাতাস ও রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ। এমন পরিবেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেকটাই কম। সেজন্য যেসব কৃষকের জমির ধান আগে পাকবে সে জমিতে সেসব মানুষদের নিয়ে দলীয়ভাবে ধান কেটে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। পরে সেই দলটি আরেকজন কৃষকের জমির ধান কেটে দিতে পারে। এলাকাভিত্তিক এমন একটি টিম গঠন করে পুরো দুই সপ্তাহ সময়ের মধ্যে সারা হাওর এলাকার ধান কেটে ফেলা সম্ভব। এভাবে গত বছর সফলতা পাওয়া গিয়েছিল। তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যারা এ কাজে সম্পৃক্ত হবেন, তারা অবশ্যই করোনা প্রতিরোধের সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তা করতে হবে।

[লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

kbdhumayun08@gmail.com